রুমানা মঞ্জুর এখন এক পরিচিত নাম। তাকে নিয়ে ফেসবুক, ব্লগ ছাড়াও মুখে মুখে ফিরছে আলোচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষিকা আজ দেখিয়ে দিয়েছেন আমরা আসলেই এখনো কোথায় আছি। রুমানা আজ বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছেন, তার বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, ডান চোখও প্রায় গেছে, নাকে এবং সারা শরীরে কামড়ের ভয়ানক দাগ। আর এসবই করেছে তার স্বামী হাসান সাঈদ। কিজন্য জানেন? তার সন্দেহ ছিল রুমানা কানাডায় উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে এক ইরানী ছেলের প্রেমে পড়েছিলেন এবং তার সাথে প্রেম চালিয়ে আসছিলেন। আমি এখানে অন্য অনেকের মত এটা কখনোই বলবনা রুমানার ব্যাপারে এ অভিযোগ(!) সম্পূর্ণ মিথ্যে। এ ব্যাপারে আমি কোন মন্তব্য করতে চাইছিনা কারণ মানুষের মন বড় বিচিত্র আর তাছাড়া আসলে রুমানা বা তার স্বামীর মধ্যকার পরিস্থিতি কি ছিল আমি জানিনা। আমি শুধু এই পুরো ঘটনার মাঝে দিয়ে আমাদের সমাজের মানসিকতা দেখার চেষ্টা করব।

একদল এ ঘটনায় মনে করেছেন-

১। মেয়েটারই তো সমস্যা ছিল, তার নিজের দোষেই তো তার এই দুর্দশা। স্বামী সন্তান ফেলে প্রেম করবা আর শাস্তি পাবানা? এই ধরণের মেয়েদের জন্যই সুস্থ সামাজিক ও পারিবারিক জীবন নষ্ট(!)হয়।

(অথচ এ ধরণের একপেশে এবং অসুস্থ মানসিকতার মানুষগুলো কিন্তু এ সম্ভাবনা মাথায় রাখেননি মেয়েটি পারিবারিক জীবনে অসুখী থাকতে পারে। তাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে এমন সমস্যা থাকতে পারে যা আমরা জানিনা অথচ তা হয়ত তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এগুলো ছাড়াও আরেকটি সম্ভাবনা থেকেই যায়, তা হল মানুষের মন খুব বিচিত্র আচরণ করতে পারে বন্ধুত্ব, ভালবাসা এ ধরণের মানবীয় অনুভূতির ক্ষেত্রে। যেমন ধরুন একজন পুরুষ বা নারী তার বিবাহিত থাকা অবস্থায় আরেকজন মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন, আমরা ওই পুরুষ বা নারীর পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এ ঘটনাটার প্রভাব নিয়ে কথা বলতে পারি হয়তো, কিন্তু সমগ্র পরিস্থিতি না জেনে বিচারকের আসন গ্রহন করে তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করতে পারিনা।)

২। একদল মনে করেছেন মেয়েটা কেন আগে বের হয়ে আসেনি? এটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। কেন এরকম মোটামুটি মূল্যহীন স্বামীর ঘর করে আসছিলেন তিনি এতদিন, যে কিনা সংসারের ভরণপোষনের যোগ্যতা বা সামর্থ্যও রাখতনা?

এর উত্তর হচ্ছে সমাজ। আমাদের সমাজে পুরুষের ছায়া ছাড়া কোন একাকী মেয়ের জীবন যে কতটা দুর্বিষহ হতে পারে সেকথা বলাই বাহুল্য। আমাদের সমাজে একজন লোক একজন মহিলাকে তার স্ত্রী বানিয়ে ব্রোথেল চালালেও সমাজ ততটা বাঁধা দেয়না যতটা দেয় কোন যুবতী বা ডিভোর্সি বা বিধবা মহিলা এমনকি তার সন্তানকে নিয়ে কোন বাসা ভাড়া নিতে চাইলে। কারণ পুরুষ যত অথর্ব বা অকর্মণ্যই হোক সে একজন নারীর মাথার উপরের ছায়া! মনে করুন আমাদের সমাজের একজন পঙ্গু, মদ্যপ ও বেকার লোক, যাকে তার স্ত্রী আয় করে খাওয়ান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই পরিবারের কর্তা কে হন বলুন তো? অবশ্যই ওই পুরুষ! একজন ডিভোর্সি বা বিধবা মহিলা আমাদের সমাজে বাসা ভাড়া পাবেননা সহজে, চাকরি পাবেননা সহজে, বাবার বাড়িতে থাকলেও দুদিন পরেই শুরু হবে গঞ্জনা, প্রতিবেশীরা তার দিকে প্রথমে করুণা আর তার পরে ঘৃণার চোখে তাকাবে, উনি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে সমস্যায় পড়বেন, উনার ও উনার বাবার পরিবারের সম্মানহানি হবে কারণ সেই মেয়েটি হয়ত তার জন্য অযোগ্য একজন মানুষকে ত্যাগ করে এসেছে বা কোন কারণে তার স্বামীকে হারিয়েছে! এ পরিস্থিতিতে রুমানার ওই সংসারে থেকে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি কি আমরা তাকে দোষ দিতে পারি, বলতে পারি যে এটা সম্পূর্ণই তার সিদ্ধান্ত ছিল যেখানে সমাজ আমাদেরকে বিশেষ করে মেয়েদেরকে বেঁধে দেয় কি ধরণের আচরণ সে করতে পারবে?

মোটামুটি অধকাংশ মানুষের কাছেই রুমানার ব্যাপারটা খুব অবাক করার মত কিছুনা, যেন এটাই স্বাভাবিক। এমনকি আমার সামনে এক নারীকে বলতে শুনেছি

“আহারে ওই শয়তানটা মেয়েটার কি অবস্থা করেছে! থাক স্বামী স্ত্রীর যেই জায়গাটাতে আঘাত দেয় ওই জায়গাটুকু বেহেস্তে যায়!”

আর একথা খোদ হাদিসেই আছে (দুঃখিত সূত্র দিতে পারছিনা এই মুহূর্তে)। ওই পশুটি এখনো স্বামী! ভৃত্যের প্রতি যত অন্যায়ই করুকনা কেন সে প্রভু। সাঈদ রুমানার মুক্তির উপায়! রুমানার তো তাহলে উচিত সারা শরীরের প্রতিটি জায়গায় সাঈদের আঘাত নেয়া যাতে তার শরীরের কোন টুকরোই বাদ না যায় বেহেস্তের ছোয়া পাওয়া থেকে!

রুমানার এ ঘটনা ঘটেছিল নাকি গত ৫ই জুন, আর এ ঘটনা মানুষে সামনে এসেছে ১৩ই জুন। এর কারণ কি এটা হতে পারেনা যে এই সমাজে “স্বামী” হবার কারণে সে এ কদিন সেলিব্রেটি হওয়ার আর লাল দালানের আতিথেয়তা পাবার পথ থেকে দূরে ছিল?

আমি অনেকের মত মনে করছিনা সাঈদ নেহাতই কুৎসা ছড়াচ্ছে রুমানার ব্যাপারে। ইরানী ছেলের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারটা পুরোটাই ভুয়া। তারা এই কথাগুলো ভাবছে কারণ অপরিষ্কার চরিত্রের কোন মেয়ের পক্ষ নিলে যে এই সমাজে আমাদের মান থাকেনা!

রুমানার প্রেমের ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়ও তবু আমি তার পক্ষ নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছিনা, কারণ কাবিননামায় স্বাক্ষর করে কারো ইচ্ছা, বাসনা বা স্বাধীনতাকে কিনে নেয়া যায়না, কেউ আমাকে পছন্দ না করলে তার গায়ে হাত তোলাও যায়না, তাকে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা যায়না (যদি আমি নিজেকে আর আমার সাথীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে চাই, আর যদি তা না ভাবি সভ্যতা তো আমার জন্য নয়)। কেউ আজ আমাকে ভালবাসছে বলে আমি তাকে বাধ্য করতে পারিনা সারাজীবন আমাকে ভালবাসতে, বা আমি কাউকে নিজের করে রাখতে চাই বলে কাউকে বাধ্য করতে পারিনা আমার নিজের হয়ে থাকতে।

সাঈদের এ ধরণের পাশবিক আচরণও কিন্তু সমাজ দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়। একজন পুরুষ আমাদের সমাজে “আমি নারীর চেয়ে উচ্চতর” এ ধরণের মনোভাব নিয়েই আসে, সে যখন দেখে সেই “নিম্নতর” জীবটির চেয়ে সে ব্যর্থ তখন তা তার পক্ষে সহ্য করা কষ্টকরই বটে। আর সেই নিম্নতর জীবটি যদি স্বাধীনভাবে যোগ্যতর কাউকে বেছে নিতে চেষ্টা করে তা তো আরো অসহ্য। এখন উপরোক্ত সব ঘটনাগুলো যদি হাসান সাঈদকে অসুস্থ করে ফেলে তাহলে তার পক্ষে এ ধরণের জঘন্য কাজ করা সম্ভব। সে স্বামী, আর এক নিম্নতর জীব নারীর তার চেয়ে যোগ্য হবার স্পর্ধা সে গুড়িয়ে দেবেনা? সাঈদের মত অসুস্থ কিন্তু সবাই না, কিন্তু সমাজ ও ধর্মীয় কিছু বিধান যে তাদেরকে অসুস্থ করে তুলতে পারে তা তো বলাই বাহুল্য।

ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু উদাহরণ নিচে দিলামঃ

সুরা বাকারার ২২৮ নং আয়াতে রয়েছে –

পুরুষের অবস্থান নারীদের চেয়ে উপরে।

সুরা নিসা’র ১১ নং আয়াতে রয়েছে –

একজন পুরুষ দুইজন স্ত্রীলোকের সমান।

এছাড়াও পুরুষকে তালাকের অধিকার দেয়া হয়েছে নারীকে দেয়া হয়নি। আর হাদিসে তো বলাই হয় স্বামীর হাতে স্ত্রীর শরীরের যে অংশ আঘাত পারে, সেই অংশ বেহেস্তে যাবে। এছাড়াও স্বামী যখনই স্ত্রীকে মিলনের জন্য ডাকবে স্ত্রী যে কেজই করুকনা কেন ছুটে আসতে হবে আর কোন স্ত্রী যদি স্বামীর চাহিদা পূরণ না করে তাহলে তাহলে নাকি ফেরেস্তারা সারারাত সেই স্ত্রীকে অভিশাপ দিতে থাকে। পুরুষের জন্য চার বিয়ের সুযোগ তো রয়েছেই।

আর স্ত্রীকে প্রহার করা কিন্তু ধর্মসম্মতই! সুরা নিসায় বলা হয়েছে-

“পুরুষ নারীর নিয়ন্ত্রণকর্তা এবং রক্ষাকর্তা, কেননা আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন (শারীরিক শক্তির বিচারে) এবং যেহেতু পুরুষ অর্থ দিয়ে তাদের ভরণপোষণ করে । তাই সতীসাধ্বী নারীরা হবে একান্ত অনুগতা-বাধ্যগতা, স্বামীর অবর্তমানে আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুযায়ী তাদের ইজ্জত আব্রু রক্ষা করবে । যে সকল স্ত্রী থেকে অবাধ্যতা এবং খারাপ আচরণের আশংকা করো, তাদের মৃদু তিরস্কার করো, অতঃপর তাদের সঙ্গে শয্যা বর্জন করো এবং অতঃপর তাদের প্রহার করো ।”

আরো শুনেছি

– ” স্ত্রী যদি বশ না মানে, তাহলে স্বামী তাকে উপহার দিয়ে কিনতে চেষ্টা করবে, আর তাতেও কাজ না হলে হাত বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে।”
-” স্বামী তাহার স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করিতে পারে, এর মধ্যে একটি, স্বামীর বিনা অনুমতিতে কাহারও বাড়িতে বেড়াইতে গেলে…”

হাসান সাঈদ ধর্মসম্মত কাজই করেছেন, যেজন্য রুমানা বেহেস্তবাসী হতে চলেছিলেন নরক যন্ত্রণার মাঝে দিয়ে।

এভাবে যদি সমাজের ও ধর্মের শিক্ষার মাধ্যমে নারী ও পুরুষ উভয়েই নারীকে নিম্নতর প্রাণী হিসেবে জানতে থাকে তাহলে তো নারীরা অর্ধমানুষ বা নিম্নতর জীব আর পুরুষেরা অমানুষ হয়েই থাকবে।