:: হাইপেশিয়া :: রুকসানা/আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট :: অ্যাডা :: তসলিমা নাসরিন :: হুমায়ুন আজাদ :: দালাইলামা :: সুরের রাণী মমতাজ ::

বাঙালি, না-কি বাংলাদেশি? বিচার চাই, না-কি চাই না? শহীদ প্রেসিডেন্ট, না-কি জনক প্রেসিডেন্ট? বিশাল হৃদয়, না-কি বাকশাল হৃদয়? বুদ্ধিজীবীর পর বুদ্ধিজীবী তাদের জীবন পার করে ফেলেছেন; সেমিনারের পর সেমিনার আয়োজন হয়ে গেছে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গেছে, তবু এই সব বিতর্কের সমাধান হয় নি। কারণ সমাধান করার জন্য যে ধানের চাল খেয়ে বড় হতে হয়, সে ধান বাংলার মাটিতে জন্মায় না। তবে, একটা স্বত্ত্ব নিয়ে বাঙালি কখনো বিতর্ক করে নি; সমাধান করাতো দূরে থাক, সমস্যাই সৃষ্টি হয়নি। দল-মত, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত অবিসংবাদিতভাবে সবাই মেনে নিয়েছে সেই স্বত্ত্ব, পুরুষত্ব; সহজ বাংলায় বলতে গেলে পুরুষ স্বত্ত্ব। তাই, পুরুষত্ব এখানে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে পুরুস্বত্ত্ব দিয়ে।

কিন্তু আউশ-আমন ধান প্রধান এই অনুন্নত, অর্থহীণ বিতর্কের দেশেও মাঝে মাঝে এমন কিছু সাহসী সন্তানের জন্ম হয়, যাদের উপস্থিতি তিনবেলা পেট পুরে খেতে পারা উন্নত বিশ্বও শুধু স্বপ্নেই কল্পনা করতে পারে। সহস্র মানুষের শিরশ্ছেদ করে বীরের সন্মান পাওয়ার যে-যুগ, সে-যুগ পার হয়ে, ভূখন্ড আর খাজনা আদায়ের যে-যুগ, সে-যুগ পার হয়ে আজকের পৃথিবী অবতীর্ণ হয়েছে অধিকার আদায়ের যুদ্ধে। ডানে-বামে, উপরে-নীচে, দুই হাতে সমানে তীর, ধনুক আর তরবারি চালাতে পারলেই এ-যুদ্ধের যোদ্ধা হওয়া যায় না। তীব্র মনোবল আর অসংকোচ প্রকাশের দুর্বার সাহস দিয়েই শুধু এ-যুদ্ধে নাম লেখানো যায়। নাম লেখানোর পর পিছু না হটে, তীব্র দাপটের সাথে যারা এগিয়ে যেতে পেরেছে তাদের সংখ্যা নগণ্য, এক-দুই শতকে একজন-আধজন। কুবিতর্কের চারণভূমি, যেখানে বিতার্কিকরা সুবিশাল তৃণভুমিতে চারণ করে যায়, সেই তৃণভোজীদের দেশে কপালগুণে অথবা কপালদোষে জন্মেছিলো একজন দুরন্ত যোদ্ধা, তসলিমা নাসরিন

১৯৬২ সালের ২৫ শে অগাস্ট ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করা ‘তসলিমা নাসরিন’ কে পরিচয় করানোর প্রচেষ্টাই প্রহসণ। কিন্তু, কিসের বিরুদ্ধে তাঁর এই সংগ্রাম, তার এই অভিযান? কোন সে সংঘাতে লিপ্ত আজ গোটা মানবজাতি? উত্তরটা তসলিমা নিজেই দিয়ে রেখেছেন- মানব জাতির এই সংঘাত ধর্মে-ধর্মে নয়, পুর্ব আর পশ্চিমের মধ্যেও নয়; এই সংঘাত যৌক্তিক-মুক্তচিন্তার সাথে অযৌক্তিক-অন্ধবিশ্বাসের, এই সংঘাত প্রথাগতদের সাথে প্রগতিশীলদের; মুক্তির মন্ত্রে যারা দীক্ষিত তাদের সাথে স্থবিরদের এই সংঘাত।

এক ডাণ্ডা বেশিওয়ালা বাংলার পুরুষ হাঁটে ঘাটে মাঠে ময়দানে, যখন যেখানে পারছে, অন্ধকার কি-বা আলোতে ডাণ্ডা ব্যবহার করে চলছে। প্রতিবন্ধী বালিকা, আট বছরের শিশুকন্যা, হাসপাতালের রোগী, প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রী, অবুঝ কাজের মেয়ে, এমনকি মাঠের লাল গরুটাও নিস্তার পায়নি ‘ডাণ্ডা’র হাত থেকে। তাতে কারো কোনো সমস্যা হয়নি,হচ্ছেও না। সমস্যা হচ্ছে তখন, যখন কেউ জোর গলায় বলতে আসছে সেই অন্যায় অনাচারের কথা। আর সে যদি জোরগলার কোনো মেয়ে হয়, তাহলেতো কথাই নেই; পুরুস্বত্বের স্বত্বাধিকারী গোটা রয়েল বেঙ্গল পুরুষ জাতি জেগে উঠে, তাদের ডান্ডাগুলো জিহাদী চেতনা নিয়ে শামিল হয় জঙ্গী মিছিলে। একে একে জড়ো হতে থাকে ডাণ্ডা গুলো; জড়ো হতে থাকে বাড়ীর সামনে, চৌরাস্তার মোড়ে, রাজপথে, বায়তুল মোকাররমে।

চরম উত্তেজনায় জেগে উঠা ডাণ্ডাগুলি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, তাতে ভীত হয়ে উঠে সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল, আমলা-মন্ত্রী-প্রশাসন। তাই, এতগুলো ডাণ্ডার ঘুম পাড়ানোর জন্য বলি দিতে হয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত কোনো এক বীরযোদ্ধা-কে। রয়েল বেঙ্গল পুরুষজাতির ডাণ্ডাময় আক্রোশের কাছে অসহায় হয়ে বছরের পর বছরজুড়ে নির্বাসনে তসলিমা নাসরিন। বিদেশের মাটিতে বসে দিনের পর দিন হাহাকার করছেন, আকুতি জানাচ্ছেন দেশে ফিরবার জন্য, একটা একটা করে অসহ্য দিন পার করছেন। কিন্তু কারো যেন সে-দিকে তাকানোরও সময় নেই। সকল দেশের রানী সোনার বাংলা, এদেশের না-কি একটা সংবিধানও আছে! সেখানে না-কি মানুষের অধিকারের কথাও আছে! একদল বানর না-কি সে-সংবিধান নিয়ে আবার লাফালাফিও করে! কি জানি, হয়তো ডাণ্ডার ভারে চাপা পড়ে গেছে তাদের সেই সংবিধান।

তসলিমা বিদেশি কোম্পানীর কাছে দেশের সম্পদ বিক্রি করে দেয়নি, লুট করে নেয়নি দরিদ্র মানুষের সমস্ত কিছু, খুন করেনি, চুরি-ডাকাতি করেনি, পল্টন ময়দানে মাথা ফাটিয়ে দেয়নি; তসলিমা শুধু বলেছিলো, ঘুষ না খেলেই একজন পুরুষ সৎ, সে-যদি হাজারটা নারীর সাথে সম্পর্ক রাখে তাহলেও সৎ। কিন্তু, হাজারটা ভালো কাজ করলেও, শুধু মাথায় ওড়না না দিয়ে, বোরখা না-পরে চললেই একজন নারী অসতী হয়ে যায়, কেন? কেন সততার সংজ্ঞা নারীর জন্য আলাদা? এই বঙ্গীয় বদ্বীপে কেন বলার, প্রশ্ন করার অধিকার যে একমাত্র পুরুষের, সে-নিয়ম ভেঙ্গে ফেলেছিলেন তসলিমা। আর যেন কোনো নারী এ দুঃসাহস করতে না পারে, মাথা উঁচু করে কথা বলতে না পারে, অন্য আর সব নারীদের সামনে সে-উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য বিতাড়িত করা হয় তসলিমাকে।

ধরে নিলাম, তসলিমা বাংলাদেশের সবচেয়ে নিম্নযোগ্যতা সম্পন্ন নিচু মানের লেখক; ধরে নিলাম, তসলিমা বঙ্গদেশিয় তথাকথিত সতী-সাবিত্রী মেয়ে নয়। তাতে কি তার দেশে থাকার অধিকার শেষ হয়ে যায়? তথাকথিত সামাজিক প্রথা ভেঙ্গে ফেলা, ধর্মের নামে দমিয়ে রাখাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া, জীবনকে নিজের মত করে চালিয়ে নেয়া, এরকম মেয়েতো বাংলায় এখন আর কম নেই। তাদেরতো দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হচ্ছে না। তাহলে, কেন তসলিমাকে নির্বাসনে থাকতে হবে? উত্তর হয়তো এরকম, যা খুশি করুক, কিন্তু সেটা মুখে বলবে কেন? কাগজে লিখবে কেন? হায়রে ভণ্ডের দল! তসলিমার দোষ তাহলে তসলিমা ভণ্ড নয়; মুখে এক, কাজে-কর্মে আরেক, তসলিমা সেই মেয়ে নয়। তাই তসলিমার মত সাহসী, স্পষ্টভাষী যোদ্ধাকে নিজেদের পাশে স্থান দেয়ার সাহস কিংবা যোগ্যতা ভণ্ডদের হয়ে উঠেনি।

তথাকথিত, যুদ্ধাপরাধীরা বাংলায় মন্ত্রী হয়। তাদেরকে নির্বাসনে যেতে হয়-না। কারণ, তাদের ডাণ্ডা আছে। তাদের ক্ষেত্রে, রয়েল বেঙ্গল ডাণ্ডাধারী পুরুষজাতির ডাণ্ডাগুলি ঘুমিয়ে থাকে। চোর-বাটপার, গুণ্ডা-বদমাশ, পীর-দরবেশ, স্মাগলার, ছিনতাইকারী, রাজাকার, খুনী, ধর্ষক, মাস্তান সবার জায়গা আছে বাংলায়; জায়গা নেই শুধু তসলিমা নাসরিনের।

তসলিমা নাসরিনের ওয়েবসাইট

পরবর্তী পর্ব

জুন ১৮, ২০১১
[email protected]