কল্পনা চাকমা– এই নামটি মনে করার সঙ্গে সঙ্গে বেদনায় মন ভাড়ি হয়ে আসে। বুকের মধ্যে দেড় দশক আগে বিঁধে যাওয়া কাঁটার রক্তক্ষরণ হতে থাকে, হতে থাকে।… মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ি মেয়েটির কথা। মনে পড়ে আজও এই অপহরণের সুবিচার হয়নি। বাংলাদেশ নামক কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এতো বড় একটি মানববাধিকার লংঘনের দায় দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বহন করছে। আর একই সঙ্গে ওই কন্টক-ক্ষত বয়ে চলেছি আমরা, কল্পনার সতীর্থ পাহাড়ি-বাঙালিরা, ওই ১৫ বছর ধরেই।…

তথ্য সাংবাদিকতার যোগসূত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানাই, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র বছর খানেক আগে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ির নিউ ল্যাইল্যাঘোনা গ্রাম থেকে সেনা কর্মকর্তা লেফটেনেন্ট ফেরদৌস অস্ত্রের মুখে অপহরণ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমাকে। থানা সে সময় কল্পনা চাকমার অপহরণের মামলা গ্রহণ করলেও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে কৌশলে বাদ দেওয়া হয় সেনা কর্মকর্তা ও তার সহযোগিদের নাম।

কল্পনাকে উদ্ধারের দাবিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল ইউমেন্স ফেডারেশন রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান — এই তিন পার্বত্য জেলায় হরতাল আহ্বান করে। ওই হরতালের পিকেটিং-এ হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালিয়ে খুন করে চারজন ছাত্রকর্মীকে। উত্তাল পাহাড়ের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সমতলেও।

১৯৯৬ সালের জুন-জুলাইয়ে আমরা অল্প কয়েকজন সাংবাদিক সে সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কল্পনা চাকমা অপহরণের খবরটি সংবাদপত্রে ফাঁস করি। তৈরি করি একেবার পর এক সরেজমিন প্রতিবেদন। এর পর কল্পনা চাকমা অপহরণকে কেন্দ্র করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, দেশী-বিদেশী নারী সংগঠন তথা মানবাধিকার সংস্থা কাম এনজিও, দেশ জুড়ে শুরু হয় হইচই। কল্পনা চাকমা পরিনত হন পাহাড়ের মানবাধিকার লংঘনের জ্বলন্ত প্রতীক হিসেবে।…

সে আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয়ে বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে লোক দেখানো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি রাঙামাটি শহর ও ঢাকায় দপ্তর খুলে তদন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করে। এর তদন্ত রিপোর্টও এখন হিমাগারের কৃষ্ণবিবরে। সে সেনা বাহিনীর ২৪ ডিভিশন (পদাতিক) এক বিবৃতিতে এই অপহরণের সঙ্গে সেনা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে। ইনিয়ে-বিনিয়ে তার এর দায় চাপায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধিন গেরিলা দল শান্তিবাহিনীর ওপর! আবার সে সময় সেনাবাহিনীর ২৪ ডিভিশন কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পাহাড়ে লিফলেটও বিলি করে। …

আগুনে ঘি ঢেলে দিতে সেনা সমর্থনে অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ (আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দিগন্ত টিভির টক-শো’র নিয়মিত বক্তা) এবং সেটেলার বাঙালি নেতা সাইফুল ইসলাম দিলদার সে সময় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক হাওয়াই মানবাধিকার সংস্তার ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, তারা অনুসন্ধানে জেনেছেন, কল্পনা চাকমাকে নাকি আদৌ অপহরণ করা হয়নি! তার মা বাঁধুনি চাকমাসহ গ্রামবাসীরা নাকি তাদের জানিয়েছেন, শান্তিবাহিনীর সমঝোতায় কল্পনা চাকমাকে নাকি ভারতের ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দিয়ে শান্তিবাহিনীই নাকি এই অপহরণ নাটক সৃষ্টি করেছে!

ধোঁয়াশার ধুম্র জাল ছিন্ন করতে সে সময় আমার পাহাড়ি বন্ধুরা কল্পনা চাকমার বৃদ্ধ মা বাঁধুনি চাকমাকে ঢাকায় নিয়ে এসে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন। বৃদ্ধ মা কলিমুল্লাহ-দিলদারদের বয়ান অস্বীকার করে বার বার চোখ মুছে চাকমা ভাষায় একটি কথাই শুধু বার বার বলেছিলেন: মিছে খদা, সব মিছে খদা! …

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরে সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে রাঙামাটিতে আঞ্চলিক পরিষদের জমকালো অভিষেক অনুষ্ঠানের শুরুতেই বক্তব্যে প্রথমেই তিনি সরকারের কাছে জানতে চান, কোথায় এখন কল্পনা চাকমা?…

এরপর কাপ্তাই, কর্ণফূলি, কাচালং, মাইনি, চেঙ্গী, মাতামুহুরি, শঙ্খ নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে।…হয়েছে অনেক পাহাড় ধ্বস। হাসিনা, তত্ত্ববাধায়ক-খালেদা-সেনা সমর্থিত অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক হয়ে আবারো হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আর আস্তে আস্তে কল্পনা উদ্ধারের দাবিটিও হয়েছে স্তিমিত। …তার মামলাটিও চলে গেছে অতল গহব্বরে।

জাতি সংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী অংশ নিয়ে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় সুনাম কুড়িয়ে দেশের মুখ উজ্বল করেছে। ওদিকে প্রত্যক্ষ সেনা মদদে বাঘাইছড়ি, রামগড়, মহালছড়ি, মাইচ্ছড়ি, শুবলং, ন্যান্যাচরে একের পর এক ঘটেছে পাহাড়ি জনপদে সহিংস হামলার ঘটনা। জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে রক্ত ঝরেই চলেছে পাহাড়ে।…

সবশেষ খবরে প্রকাশ, গত বছর কল্পনা চাকমা অপহরণের ১৪ বছর পর পুলিশ এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দাখিল করে। বাঘাইছড়ি থানার পুলিশের প্রতিবেদনে কল্পনা চাকমা অপহরণের জন্য ‘একদল বন্দুকধারী’ সন্ত্রাসীকে দায়ী করা হলেও তারা কারা, সে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি।

পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে বাঘাইছড়ি থানার ওসি নাঈম উদ্দীন জানিয়েছিলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ২১ মে (২০১০) রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। ওই মামলায় সুনির্দিষ্ট আসামিদের বিরুদ্ধে কেন অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়নি, তা জানতে চাইলে ওসি নাঈম উদ্দীন বলেন, ‘১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমার অপহরণের পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়। তারা অপহৃতার কোনো সন্ধান পায়নি। এমনকি কে বা কারা তাঁকে অপহরণ করেছে, কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে তাও উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে আমরা এ মামলার চার্জশিট দিতে পারিনি। মামলাটির নিষ্পত্তি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি।’

এ ঘটনায় কল্পনা চাকমার বড় ভাই ও মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা অপহরণের জন্য একটি বিশেষ মহলকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ রয়েছে। এতে আসামিদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময় বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রেও একই কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ আসামিদের রক্ষা করার জন্য তাদের নাম বাদ দিয়েই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। [লিংক]

এরপর আদালত এই অপহরণ মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দেয়। তারা গত এক বছর ধরে কি দায়িত্ব পালন করে চলেছে, তা সহজেই অনুমেয়।

স্মৃতি-বিস্তৃতির দোলাচল এবং বিভ্রান্তির দীর্ঘতর নানান কূটকৌশল স্বত্ত্বেও কল্পনার সতীর্থরা আজও তাকে ভোলেননি। পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শ্লোগানে শ্লোগানে বরাবরই দাবি জানান কল্পনা চাকমা অপহরণের সুবিচারের। তার অপহরণ দিবসে প্রতিবছরই ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। তবু বাংলাদেশ নামক বাংলা ভাষাভাষির কর্তৃত্বপরায়ন রাষ্ট্র কল্পনা চাকমা অপহরণের দায় বহন করেই চলে।…

ছবি: কল্পনা চাকমা, আরিফ হক।

আরো পড়ুন: কল্পনা চাকমা এখন কোথায়? [লিংক]