সভ্যতা বিকাশের একটা পর্‍যায়ে উপজাত হিসেবে কোন গোষ্ঠীর অব্যাখ্যাত ও অবদমিত কামনা বাসনার স্ফূরণ ঘটেছিল মিথ গুলোতে।ফলে মিথগুলো কাজ করতো এক ধরণের উদ্দীপক রূপে।মিথ গুলোর বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা আছে;এগুলো নির্দেশিত হয় নি কোন আসমানি পরাশক্তির কাছ থেকে।মিথের রূপ অনেক।গবেষকরা এদেরকে নানা ভাগে ভাগ করেছেন।আস্তিক্যবাদী বহু ও এক ঈশ্বরবাদী মিথগুলো নিয়েই আমি বলব। জামার্ন ভাষাবিজ্ঞানী ও প্রাচ্যতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলার বলেন যে মিথ হচ্ছে ‘ভাষার রোগ’ অর্থ্যাৎ ভাষার কোন বিশেষ ধরণের অপরিপূণর্তা জন্ম দেয় মিথের।কী সেই অপরিপূণর্তা যার ফলে উদ্ভব হয় মিথের?ম্যাক্সমুলারের মতে গুণবাচক বিশেষ্য বা এবস্ট্রাক্ট নাউনের অভাবে কোন ভাষায় জন্ম নিতে পারে মিথের। ম্যাক্সমুলার বলছেন গুণবাচক বিশেষ্যের এই অভাব মেটানোর জন্য প্রাচীন মানবগোষ্ঠী কোন মূর্ত সত্ত্বার আশ্রয় নিত অর্থ্যাৎ গুণ সমূহকে আরোপিত করতো কোন দৈহিক আঁধারে।ফলে তৈরী হত মিথ। যেমন গ্রীক দেবী আগ্লিয়া (Aglaea)মানে হচ্ছে মহিমা;কিংবা সোফিয়া(Sophia) দেবীর আক্ষরিক মানে হল জ্ঞান।আবার ঈজিপশিয়ান ধর্মে দেখা যায় ‘মাত’-এর মতো দেবী যার মানে হল ন্যায় বা সত্য।(দ্রঃমোজেস ও একেশ্বরবাদ;লেখক-সিগমুন্ড ফ্রয়েড)।মজার ব্যাপার হল বিভিন্ন মিথে ভাষা নিয়েও বেশ কথা-বার্তা আছে। মুসলিম মিথে বলা আছে আল্লাহপাক আদমকে সমস্ত বস্তুর নাম শিখিয়েছেন।(সূরা বাকারাহঃ৩১)।আবার তৈত্তরীয় উপনিষদ বলছে যে প্রজাপতির ধ্যানরত অবস্থায় প্রাপ্ত তিনটি শব্দের মধ্য দিয়ে ভাষার যাত্রা শুরু।তবে ভাষা নিয়ে সবচেয়ে অসাধারণ কথা আছে পূব আফ্রিকান মিথে।ওয়াসানিয়া নামক জনগোষ্ঠীর মাঝে এ কথা চালু আছে যে ভাষার বৈচিত্র্য হয়েছে মানব গোষ্ঠীর একে অপরের কাছ থেকে,কোন এক বন্যার ফলে,দূরে সরে যাবার কারণে।(উইকিপিডিয়া)।আফ্রিকার এই মিথটি সত্যের বেশ কাছাকাছি অবস্থান করছে।
ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক জেমস ফ্রেজার তাঁর ‘দ্যা গোল্ডেন বাউ’ গ্রন্থে বলছেন যে যাদুপ্রক্রিয়ার ভুল ব্যাখ্যা থেকে উৎপত্তি হয় মিথের।কেননা প্রাচীন যাদুবিদ্যার উদ্ভব হয়েছিল প্রকৃতির আইনকে ভালভাবে না বুঝার ফলে।যাদুপ্রক্রিয়া প্রাকৃতিক অবস্থাকে পরিবর্তন করতে চরমভাবে ব্যার্থ হতে থাকলে প্রাচীন মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মকেও আর সঠিক মনে করল না;বরং তারা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকল অপ্রাকৃত বিষয়াদিতে-মিথ তৈরী করে।এরকমটি হওয়ার সম্ভাবনাও খুব প্রচুর।যতদূর জানা যায় মনা বা টোটেম সংস্কৃতির বিকাশের মধ্য দিয়ে বহু-ঈশ্বরবাদী মিথের উদ্ভব হয়েছে।যদি ঈজিপ্টকে ধরে আগাই তবে দেখতে পাবো যে কৃষি সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের সময় একেশ্বরবাদী মিথের উদ্ভব।কেননা সমাজে তখন স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে ফারাওরা।সম্রাট একজন মানে হল ঈশ্বরও একজন থাকবেন।ফারাওরাও তাই করলেন;কেননা,তা না হলে শোষিত অত্যাচারিত জনগন বেঁকে বসতে পারে।তার জন্য চাই মগজ ধোলাই।তো আনুমানিক ১৩৫৭ খ্রিঃপূবে রাজা আমেন হোটেপ ইতিহাসের প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে সমগ্র মিশরে চালু করলেন একেশ্বরবাদী প্রচারণা(ফ্রয়েডঃমোজেস ও একেশ্বরবাদ)।যদিও আমেন হোটেপের মৃত্যুর পর ঠেংগিয়ে বিদায় করা হয় একেশ্বরবাদকে কিন্তু কিছু বছর বাদেই তা আবার সম্মান পেতে থাকে বিভিন্ন গোত্রের কাছে।মূসার সময়ে দেখা দেয় এক অদ্ভূত প্রচেষ্টা। একেশ্বরবাদী চেতনা কাজ করতে থাকে সমাজের একদম নিচুস্তরে-খেটে খাওয়া শোষিত,বঞ্চিত শ্রমিকদের মাঝে এবং তা বিকশিত হতে থাকে চরম বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মধ্যে।মূসার পলায়নের মধ্য দিয়ে দেখা যায় ধীরে ধীরে বিমূর্ত একেশ্বরবাদ জায়গা করে নিচ্ছে মূর্ত একেশ্বরবাদের স্থানে।

এই বিমূর্ত একেশ্বরবাদ আর্থ-সামাজিক পটভূমির কারণেই বেড়ে উঠার জায়গা পেল পৃথিবীর যেকোন স্থানে।যেখানেই সামন্ততন্রের উদ্ভব ঘটেছে,সামন্তীয় রাজারা শুরু করেছে সাম্রাজ্য বিস্তার, সেখানেই দেখা দিয়েছে বিমূর্ত একেশ্বরবাদ।কেননা রাজ্যের বিস্তারের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের ক্ষমতাও বেড়ে গেছে ততদিনে।ফলে ঈশ্বরকেও নিতে হয়েছে অসীমতার ধারণা;ফলে ঈশ্বর হয়ে গেছেন বিমূর্ত।এবং ততদিনে গৃহে বন্দী হয়ে গেছে নারী।কৃষি জমির বিকাশের ফলে খাবারের প্রাচুর্‍য ঘটতে থাকে এবং কৃষি জমির কাজ থেকে সরে যেতে হয় নারীকেই,যদিও নারীই প্রথম এর গোড়াপত্তন করেছিল।নারীর সরে যেতে হয় কারণ শিকারী পুরুষ ততদিনে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে।তার কাজের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় কৃষি জমি।নারী,প্রাকৃতিক কারণে সন্তান ধারণ করতে গিয়ে,হেরে যায় বন্ধ্যা পুরুষের কাছে।নারীকে হারানো হয়।দ্বিতীয় যে কারণ বলা হয় তা হচ্ছে যুদ্ধ্ব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে বাঁধা সৃষ্টি করা হয় প্রথমে।কেননা নারী যদি যুদ্ধে মারা যায় তবে ঐ গোষ্ঠীর এমন কেউ মারা গেল যে কিনা আরেকজন যোদ্ধার জন্ম দিতে পারত।ফলে ক্রমাগত নারী স্থান করে নেয় গৃহে এবং গৃহই হয়ে দাঁড়ায় তার আরাধ্য স্থল।একটি লিংক সংযুক্ত করে দিলামঃ http://www.csulb.edu/~rodrigue/aag87.html এবং মিথ তৈরী হতে থাকে যে নারী ধ্বংস করেছে পুরুষকে।ক্ষমতা চলে যায় পুরুষের কাছে।সন্তান উৎপাদনকে আর সামাজিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হল না।নারীর এই অবদমনের চিত্র পাওয়া যায় বহু ও একেশ্বরবাদী মিথগুলোতে।বহুশ্বরবাদী মিথগুলো নারীকে দেখায় প্রচন্ড লোভী ও সুবিধাবাদী প্রবঞ্চক হিসেবে;অন্যদিকে একেশ্বরবাদী মিথগুলো নারীকে দেখায় শয়তানের প্রবেশদ্বার হিসেবে।নারীর এই বন্দীদশা আর কাটে নি।অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্য দিয়ে মিথের অবদমন ও পরাজয় ঘটলেই কেবলমাত্র নারীর স্বাধীনতা সম্ভব।

আধুনিক মিথে দুটো ব্যাপার জড়িয়ে আছে।নিখাদ আনন্দের জন্য সৃষ্ট মিথ গুলো নিয়ে কিছু বলার নেই।হলিউডি মুভির অধিকাংশই তো আধুনিক মিথের উপর দাঁড়িয়ে আছে।একটা উদাহরণ দেয়া যায়-আমেরিকান লেখক এডগার রাইস বারো ১৯১২ সালে টারজান নামক যে মিথ সৃষ্টি করেছিলেন তা আধুনিক মিথের একটি দারুণ উদাহরণ।তারপর সুপারম্যান,ব্যাটম্যান নামক অতি মানবীয় সৃষ্টি গুলো আধুনিক যুগের আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক একটা চরিত্র।এগুলো আমাদের কোন কিছুতে বিশ্বাস করতে জোরাজুরি করে না;বলে না যে ওদেরকে বিশ্বাস না করলে আমরা অ-প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল হয়ে যাবো।কিন্তু আমাদের ক্ষতি করে সে সমস্ত মিথ যেগুলো জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।আমরা এখনো মিথের জগতে বাস করি।মিথের মধ্যে থেকেও আমরা নিজেদের ভাবি প্রগতিশীল,আধুনিক।আসলে আমরা যে কত অনাধুনিক তা আমাদের তথাকথিত স্ব-ঘোষিত ও স্ব-উচ্চারিত প্রগতিশীলদের কর্মকান্ড দেখলে বুঝা যায়।আমাদের সন্রাসবাদী সংগঠনগুলো ভাবে তারা প্রগতিশীল;আবেগে ভারাক্রান্ত কিন্তু ততটাই অযোগ্য নারীবাদি সংগঠনগুলো ভাবে তারা প্রগতিশীল;বিজ্ঞানে অগাধ জ্ঞান কিন্তু সমস্ত বিজ্ঞানের বিকাশ বুঝতে নারাজ ব্যাক্তিটিও নিজেকে ভাবে প্রগতিশীল।এরা সবাইকে বকা ঝকা করে;প্রচুর জ্ঞান দেয় এবং তৈরী করে কিছু চেলা এবং সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করে সমাজের ও দেশের।এরা নিজেদের চারপাশে ছড়িয়ে রাখে অসাধারণ কিছু মিথের আবরণ।এই আবরণ ছিড়তে গেলে চিৎকার করে উঠে চারপাশ;সে চিৎকার মৌলবাদিদের মতোই ভয়ানক।

আগেই বলেছি মিথ হল সমাজের বাস্তবিক ব্যবস্থারই উপজাত কাল্পনিক জগৎ।সুতরাং বাস্তবিক অবস্থা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র আমরা মুক্ত হতে পারি মিথের রাজ্য থেকে।নিখাদ সুন্দরের কল্পনা আমাদের কাম্য;বিকৃত কল্পনা নয়।