লিখেছেন-রাহনুমা রাখী

“নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী”- কথাটি ভার্জিনিয়া উলফের।হাজারো শতক ধরে তর্কে বিতর্কে নারী যতটা স্থান জুড়ে রয়েছে অন্য কোনো প্রাণী ততোটা নয়।কেনোনা নারী একটি পরাজিত সত্তা।যে ফিরে পায়নি তার যোগ্যতম অবস্থান।ফিরে পায়নি এখনও তার ঘর।

নারী কি?বাংলা অভিধান ঘাঁটলে নারীর যে সমার্থক খুঁজে পাওয়া যায়-স্ত্রী, রমণী, ললনা, অঙ্গনা, কামিনী, বনিতা, মহিলা, বামা, নিতম্বিনী, সুন্দরী প্রভৃতি।নারী সুন্দর তাই সে রমণী, সুন্দরী।নারী কামনা জাগায় তাই সে কামিনী,নিতম্বিনী।গরু থাকে গোয়ালে,মুরগি থাকে খামারে ঠিক তেমনি নারী থাকে মহলে তাই সে মহিলা।নারী মাতা,ভগিনী,স্ত্রী,সেবাদাসী।নারী নম্র ভদ্র, শরৎএর উপন্যাসের নায়িকার মতো বুক ফোটে তো মুখ ফোটে না।নারী স্ত্রী হয়ে একজন পুরুষের অধীনে বসবাস করে,ঘর গৃহ-স্থলী নিয়ে সময় কাটায়, প্রসব করবে মনুষ্য সন্তান।

সমাজে এই নারীর সংজ্ঞা!

মনুষ্য প্রজাতির দুটি সত্তা- নারী ও পুরুষ।একইরকম ২২ জোড়া অটোসোম নিয়ে ও এক জোড়া ভিন্ন সেক্স ক্রোমোসোম নিয়ে জন্ম নেয় মানুষ নামক প্রাণী।সেক্স ক্রোমোসোম আবার দুই প্রকার X ক্রোমোসোম ও Y ক্রোমোসোম।নারীর ক্ষেত্রে এই ক্রোমোসোমের বিন্যাস থাকে XX ও পুরুষের ক্ষেত্রে XY।শুধুমাত্র একটি লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোসোমX অথবা Y এর পার্থক্যের দরুনই কি একটি পুরুষ হয়ে উঠে প্রভু ও নারী হয়ে উঠে দাসী?না।আমাদের সমাজে নারী পুরুষের যে পার্থক্য স-দৃশ্যমান তা যতটুকু না প্রাকৃতিক কিংবা বৈজ্ঞানিক তার চেয়ে অনেক বেশি ঐতিহাসিক ও সামাজিক।

নারী সম্পর্কে ঠিক এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন সিমোন দ্য বোভোয়ার-“কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে উঠে নারী”।

আর নারী তৈরি করার এই প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই ছোটকাল থেকে।

একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন সে এই পৃথিবীকে চিনতে শিখে তার চোখ দিয়ে অনুভব করতে শিখে তার হাত দিয়ে বুঝতে শিখে তার মন দিয়ে।আর আমাদের কিছু সামাজিক অবকাঠামো যা নির্ধারণ করে নীতি,নিয়ম, প্রথা,তা ধীরে ধীরে বদলে দিতে থাকে শিশুর মন ও করে তুলে তাদেরই মতো করে।খেলার উপকরণ হিসেবে সবার প্রথম আমরা একটা শিশুর হাতে কি তুলে দেই?ছেলে শিশুর হাতে বন্দুক, পিস্তল, স্পোর্টস কার, বল, ব্যাট।এই খেলনাগুলো তার ভিতর বোধ জন্মায় ক্ষমতার, দাপটের, প্রতিযোগিতার।সে সিনেমার নায়কের মতো অভিনয় করে খেলনা বন্দুক দিয়ে উড়িয়ে দেয় ভিলেনদের।সে কল্পনা করে ক্রিকেটারের মতো ঝাপ দিয়ে লুফে নিচ্ছে ক্যাচ। আর একটি মেয়ের হাতে তুলে দেয়া হয় পুতুল, পুতুলের ঘর, বিছানা, হাড়ি পাতিল।মেয়েটি পুতুলকে সাজায়,সন্তানের মতো আদর করে, তার বিয়ে দেয়, হাড়ি পাতিল দিয়ে সে রান্না করে।এভাবেই একটি ছেলে তৈরি হয় ভবিষ্যতের পৃথিবীতে সংঘর্ষ করে বেঁচে থাকতে আর মেয়েটি সংসারের একঘেয়ে চার দেয়ালের ভিতর প্রতিদিন একই কাজের পুনরাবৃত্তি ও সন্তান লালন পালন করে জীবন কাটিয়ে দিতে।

সোনার কাঠি রুপোর কাঠি,সিন্ড্রেলা, ঘুমন্ত সুন্দরী রাজকুমারীদের কাহিনী কে না শুনেছেন!ছোটকালে এইসব রূপকথাই তো শুনে আমরা বড় হই।ডাইনীর অভিশাপে রাজকুমারী ঘুমিয়ে থাকে রাজার সাম্রাজ্যে বন্দী হয়ে।রাজকুমার ঘোড়া ছুটিয়ে আসে, সকল বাধা বিঘ্ন পেড়িয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যায় রাজকুমারীকে।

কিংবা দয়ালু রাজার কাহিনী-রাজ্য ভ্রমণ করতে বেরিয়ে এসে এক সৎ মেয়ের সন্ধান পেয়ে তিনি পুরস্কার স্বরূপ তাকে তার ছেলের পুত্রবধূ করে বরন করেন।এইসব রূপকথা, শিশুতোষ গল্পের পুরো পাতা ধরে থাকে প্রায় একই কাহিনী।রাজকুমারী অপেক্ষায় থাকে রাজকুমারের, কবে এসে তাকে জয় করে নিয়ে যাবে তার সাথে।একটি ছেলের সাহসিকতায় যেখানে তাকে পুরস্কার দেয়া হয় রাজার অর্ধেক রাজ্য ও সবচেয়ে আদরের কন্যাটি সেখানে একটি মেয়ের সাহসিকতায় কিংবা সততায় থাকে তাকে পুত্রবধূ করে নেয়ার পুরষ্কার।শৈশবের এইসব কথা-গল্পই একটি মেয়ে শিশুর মনে স্বপ্ন জাগায় নিজেকে সাজাত, সুন্দর করে তুলতে।নিজেকে সে বারবার আয়নায় দেখে।মাকে দেখে তার অনুকরণ করার চেষ্টা চালায়।কপালে টিপ পড়তে ভালোবাসে।শাড়ি গয়না নিয়ে নাড়াচাড়া করে।দাদির কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমোয় ও স্বপ্ন দেখে একদিন তার জীবনেও আসবে এক রাজকুমার।সে তার নিয়তি সেই অজানা পুরুষের কাছে সপে দিয়ে জাল বুনতে থাকে একটি একটি করে।

শিশু থেকে যখন বালিকা হয়ে উঠে মেয়ে।আস্তে আস্তে তার বাইরের জগত ছোট হতে থাকে।খেলাধুলোর মাঠ, দৌড় ঝাপ, পার্ক, উদ্যান তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে।ঘরের ভিতর সে শিখতে থাকে সেলাই, রান্না বান্না, অতিথি আসলে আপ্যায়ন, ঘর গৃহ-স্থলীর কাজ।যা তার নিয়তি।সেই নিয়তি সমাজ যা নির্ধারণ করে রাখে একটি মেয়ের জন্য।

বয়ঃসন্ধিকালে ঋতুস্রাবের পর থেকে একটি মেয়ের জীবন আরো বেশি জটিল হয়ে পড়ে।সেই প্রথম শারীরিকভাবে সে নারী হয়ে উঠতে থাকে।ঋতুস্রাবের সময় তলপেটে ব্যথা, ভারী ভারী লাগা, উঠতি বুকে সামান্য ঝাকনিতে ব্যথা করা যা শরীর সম্পর্কে তাকে বিরক্ত করে তুলে।নিজের শারীরিক গঠন নিজের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে পরে।এই অবস্থাটি প্রশমিত হতে পারত যদি তাকে খেলতে দেয়া হত, সাতার কাটতে দেয়া হত, শারীরবৃত্তিক চর্চা করতে দেয়া হত।তাহলে সে কাটিয়ে উঠতে পারত এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারত চলাফেরায়, নিয়ন্ত্রণ করা শিখে নিত নিজের শরীরকে।তা না করে আমরা করি তার উল্টো।সবার আগে আমরা তার পৃথিবীটাকে করে তুলি ছোট।তার চলাফেরার পথে আরোপ করি নানা বিধিনিষেধ।ঋতুস্রাব যেনো এক শারীরিক ব্যাধি।মা সঙ্গোপনে জানিয়ে দেয় এ নিষিদ্ধ কিছু।লুকিয়ে লুকিয়ে প্যাড বদলানো হয়।অন্য কারো সামনে এই ব্যাপারে কোনো কথা উঠানো যায় না।কথা উঠলে নিজেকে লজ্জিত হতে হয় যারা শুনে তারাও লজ্জিত হয়।দোকান থেকে ন্যাপকিন কিনে আনতে গেলে ব্রাউন পেপারে মুড়িয়ে নেয়া হয়।যেনো অবৈধ, লজ্জাকর, নিষিদ্ধ কোনো ষড়যন্ত্র চলছে নিজের দেহ নিয়ে।অথচ তার ভাইয়ের মুসলমানিতে পাড়া-সুদ্ধ লোকদের ডেকে খাওয়ানো হয়।ভাইয়ের জননাঙ্গ তখন নিষিদ্ধ হয় না।বরং তার শিশ্ন হয়ে উঠে আদরের বস্তু।আদর করে তার নাম দেয়া হয় সোনা, ধন।অপরদিকে তার জননাঙ্গ সবসময়ই নিষিদ্ধ।তাকে জানতে দেয়া হয় না,নাড়াচাড়া করতে দেয়া হয় না জননাঙ্গ নিয়ে।বিয়ের পরে অনেকবার সঙ্গমে যাওয়ার পরও নারী জানতে পারে না তার যোনী, ভগাঙ্কুরের সঠিক কাজ।যে দেহটি সে বয়ে বেড়ায় আজীবন, তা নিয়ে সে অজ্ঞই থাকে,জানতে পারে না কখনই তার ভিতর কি খনি লুকিয়ে আছে।তার বুকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় ওড়না।বুক থেকে ওড়না সামান্য খসলেই যেনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়।বাসে, ট্রেনে, ফুটপাতে এমনকি নিজের ঘরে বাবা ভাইদের সামনে খুব সাবধানে নিজেকে কাপড় দিয়ে মুড়ে চলতে হয়।শরীরের কোনো উঁচু অংশ যেনো ভুলেও না দেখা যায়।এতো কিছুর পরেও সে পারে না যৌন হয়রানি থামাতে, পারে না ধর্ষণ থামাতে।এমনকি ঘরের মানুষ যাদের সে আপন ভেবে বেড়ে উঠেছে তাদের চোখেও সে দেখে কামুক দৃষ্টি।তার মানে পুরুষের কাছে সে নিতান্তই যৌন বস্তু!তার শরীরই তার শত্রু হয়ে উঠে।সে দৌড়তে পারে না, বাসে উঠে ছেলেদের মত ঝুলতে পারে না, দৌড়ে এসে ট্রেন ধরতে পারে না।রাত বারোটার দিকেও তার ভাই ঘরে ফিরে কিন্তু সে নিজে ফিরতে পারে না।রাত হওয়ার সাথে সাথেই মুরগির খামারের মুরগির মতো তাকে ঘরে ঢুকে বসে থাকতে হয়।সিগারেট ফুকা,বন্ধুদের সাথে যেখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়া একটি ছেলের জন্য যা নিতান্তই স্বাভাবিক তার জন্য তা অস্বাভাবিক এই ভাবনাই তাকে হতাশ করে তুলে নিজের ব্যাপারে।মেয়েটি যদি উড়তে চায় তবে লোকে তাকে বেহায়া বলে গালি দেয়।সে যদি সিগারেট ফুকতে চায় কিংবা ছেলেদের মতো স্বতঃস্ফূর্ত পোশাক পরতে চায় তবে লোকেরা তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।এই সবই নারীকে বুঝতে শিখায় সমাজের কাছে সে নিতান্তই একটি জড়বস্তু।একটি অক্রিয় বস্তু।ছোট ছোট এইসব আনন্দ তার জন্য নয়।তার নিজস্ব কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই।তার আছে শুধু একটি শরীর যা দিয়ে সে তুষ্ট করবে পুরুষদের, সন্তান জন্ম দিয়ে রক্ষা করবে বংশধর।

জিহোভার ভাষায়-‘Anatomy is her destiny’। শরীরই তার নিয়তি।

মেয়েদের আড্ডায় তাই ঘুরেফিরে এই বিষয়গুলোই চলে আসে।কার কবে বিয়ে হল,কে কোন গহনা কিনল,নতুন ফ্যাশনের পোশাক পড়ল,কার স্বামী কেমন।কোন খেলোয়াড় কত সুন্দর,কোন নায়ক কত আকর্ষণীয়।সে খেলোয়াড়দের পছন্দ করে তার খেলা দেখে নয়,তরুণ রাজনীতিবিদদের পছন্দ করে তার রাজনীতি দেখে নয়।খেলোয়াড়, গায়ক, নায়ক,রাজনীতিবিদ সর্বত্র সে খুঁজে তার স্বপ্নের রাজকুমার।সে স্বপ্ন দেখে তাদের সাথে রোমান্স করার,ঘুরে বেড়ানোর,বিয়ে করার,তাদের সন্তানের মা হওয়ার।যদিও সে জানে তা সে কখনই পারবে না তবুও সে দেখে কারণ এছাড়া সে আর কিছুই শিখেনি।বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমার সহপাঠিনীদের মাঝেও দেখেছি  জীবন সম্পর্কে এক অদ্ভুত অবসাদ।ছেলেরা চিন্তা করে কতদিনে পাশ করে চাকরি নিবে।আর মেয়েরা ভাবলেশহীন।ছেলেদেরকে আমি প্রায়ই বলতে শুনি -‘তোমাদের কি!তোমরা তো ছেলে দেখে কারো গলায় ঝুলে যাবে’।আর মেয়েরাও সেই কথায় তাল দিয়ে সমর্থন যুগিয়ে যায়।ভারী ভারী যেই কোনো কাজ তারা ছেলেদের উপর সপে দিয়ে বলে-‘আমরা তো মেয়ে!আমরা তো এ করতে পারি না!’কিছু কিছু মেয়ে যদি ভাঙ্গতে চায় এই প্রথা, কাজ করতে চায় গঠনমূলক তবে তাকে কাজ করতে হয় ছেলেদের সাথেই।আর তখনই তাদের নামে শুরু হয় মুখরোচক কাহিনী।একা একটি মেয়ে দশ বারোটা ছেলের সাথে বসে চা পান করছে,সিগারেট ফুঁকছে পায়ের উপর পা তুলে,আড্ডা মারছে।নিশ্চয়ই মেয়েটার কিছু সমস্যা আছে।মেয়েটা আসলে বেশ্যা!অর্থাৎ তুমি অবলা, রমণী তাই হয়েই থাকো।সুন্দর করে সাজো, নিতম্ব কোমর দুলিয়ে হাঁটো।ছেলেদের আকৃষ্ট কর।একসময় বিয়ে করে কোনো এক ছেলের গলায় ঝুলে পড়।বিপ্লবী, প্রতিবাদী হয়ো না।ভাঙ্গতে যেও না তোমার সামনের দেয়ালটি।

বিজ্ঞাপন সংস্থায় বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন থাকে শুধু নারীর সাজ উপকরণ দিয়ে।সাবান, পাউডার, রূপচর্চার ভেষজ উপকরণ, নেইলপালিশ, লিপস্টিক, বিভিন্ন আকৃতির ব্রা যা নারীর বুকের মাপকে করবে আকর্ষণীয় প্রভৃতি।বিজ্ঞাপনের কাহিনীগুলোও প্রতিফলিত করে সমাজে নারীর সঠিক অবস্থানটি।

টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করবে মেয়ে।সব প্রস্তুতি নেয়া শেষ।আর মাত্র কয়দিন বাকি।তখনই সে খেয়াল করল তার চেহারার রঙের চেয়ে গায়ের রঙ অনুজ্জ্বল।এলো সমাধান নতুন এক ক্রিম।সেই ক্রিমের দরুন মেয়েটি হয়ে উঠল সুন্দর  আর জিতে নিয়ে এলো ট্রফি!

সাইকেলের রেসে অংশগ্রহণ করে মাকে একটি বাড়ি উপহার দিতে পারবে না ঠিকই জানে মেয়ে।তাই শুরু হয় লোশন মাখামাখি।সাইকেল রেস জিতার দিন এক ফটোগ্রাফার তাকে দেয় কাঙ্ক্ষিত সুযোগ ব্যান্ড অ্যাম্বাস্যডার হওয়ার।এভাবেই পূরণ করে সে তার স্বপ্ন।

সাংবাদিকতার কাজে প্রতিদিন ঘুরতে হয় অলিগলি।পুড়তে হয় রোদে।তাই গায়ের চামড়া হয়ে পড়ে কালো।চিন্তা নেই আপনার জন্য আছে সানস্ক্রিন লোশন।পরের দিনই প্রেস কনফারেন্সে সাক্ষাৎ দিতে আসা ব্যক্তিটি সাংবাদিকদের ভিড় থেকে সেই মেয়েটিকেই সামনে এগিয়ে আসার অনুরোধ করে আর শুধু তার প্রশ্নেরই উত্তর দেয়।

বয়স ৩০ পেরুনো স্ত্রী চোখের পাশে ভাজ, অমসৃণ চামড়া নিয়ে বড়ই বিব্রত।স্বামী তাকে আর আগের মতো ভালোবাসে না।এইজ মিরাকল ক্রিম ব্যবহার করে সে ফিরে পেয়েছে তার আগের যৌবন, ধরে রেখেছে তার তারুণ্য।স্বামীর প্রেম তাই আবারও জেগে উঠে।স্ত্রীকে ভালবাসতে এখন আর স্বামী কার্পণ্য করে না!

এই হল বর্তমানের বহুল প্রচলিত বিজ্ঞাপনের কাহিনী।যেগুলো বারেবারে নির্দেশ করে নারী তুমি যেই ক্ষেত্রেই বিচরণ কর, তুমি খেলোয়াড় হও কিংবা সাংবাদিক নয়ত গায়িকা তোমাকে হতে হবে সুন্দর।একটি ছেলের যোগ্যতার মাপকাঠি যেখানে তার প্রতিভা, তোমার প্রতিভার প্রধান মাপকাঠি তোমার রূপ।কারণ তুমি একটা দেখার বস্তু!দুচোখ দিয়ে গেলার বস্তু!তাই তো গাড়ির শোরুমে নতুন গাড়ির উদ্বোধনে দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকে দুইজন সুন্দরী।এমনকি বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা শুরুর আগেও কাপ প্রদর্শনের সময় বিশ্বকাপের দুইপাশে দুইজন নারী শোভা পায়।বাণিজ্যিক ক্রিকেট টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে চিয়ার্স লিডারদের রমরমা ব্যবসা।মাঠে পুরুষেরা ব্যাট বল নিয়ে যুদ্ধ করে আর পিছনে চিয়ার্স লিডারেরা নেচে গেয়ে খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা ও দর্শকদের মনোরঞ্জনে থাকে ব্যস্ত।প্রবাদে আছে-‘প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে থাকে একজন নারীর হাত’।এখানেও নারীর কাজ সেবামুলক।পুরুষ প্রতিযোগিতায় নামবে, পরিশ্রম করে ঘর ভর্তি করবে সাফল্যের জয়গানে।আর নারী তুমি পিছন থেকে যুগিয়ে যাবে তার অনুপ্রেরণা।মঞ্চের পর্দার পিছনেই তোমার অবস্থান।মঞ্চে তোমার আবির্ভাব কখনই হবে না।তুমি নিজে সফল কখনই হবে না।তুমি শুধু পুরুষকে করে তুলবে সফল, কর্মোদ্যম।সমাজ নারীর কাছে তাই প্রত্যাশা করে।

নারীর শিক্ষা-পদ্ধতিও থাকে ভিন্ন।মাধ্যমিক লেভেলে তাকে দেয়া হয় গার্হস্থ্য অর্থনীতি নামক একটি বিষয় যেখানে সুচারু রূপে বর্ণনা করা থাকে আদর্শ গৃহিণীর করণীয়।বিদ্যালয় পর্যায়ের, পরিবার পর্যায়ের, সমাজ পর্যায়ের তার সকল শিক্ষা দীক্ষার একটিই উদ্দেশ্য কিভাবে তাকে বিয়ের উপযুক্ত করে তোলা যায়।একটি মেয়ের বাবা মায়ের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা থাকে তার বিয়ের!কতদিনে মেয়ে ১৮ পেরুবে, একটি উপযুক্ত পাত্র দেখে বিয়ে দেয়া হবে এই চিন্তাতেই তাদের কপালের ভাজ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।উচ্চ মাধ্যমিক লেভেল পাশ করার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় পাত্র খোঁজা।পাত্র হতে হবে শিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বাবলম্বী।অপরদিকে একটি মেয়ের কাছে কিন্তু কখনই এ আশা করা হয় না।ধরেই নেয়া হয় নারী এক বিকলাঙ্গ প্রাণী যে কখনই স্বংসম্পুর্ন নয়।যাকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কোনো একটি পুরুষের ছায়ায় প্রতিপালিত হতে হবে।হতে পারে সে বাবা, তার স্বামী কিংবা ছেলে।বিয়ের বাজারে সুন্দরী মেয়ে তাই কড়া মূল্যে বিক্রি হয়।এদের পেতে সব ছেলের মা বাবারাই মুখিয়ে থাকে।পাত্রীর ক্ষেত্রে সুন্দর হওয়া থাকে প্রথম শর্ত।এছাড়া মেয়েকে হতে হবে নম্র, মুরব্বীদের সামনে যে চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে কথা বলে।তার গায়ের রঙ দেখা হয়,চুলের গোছা মাপা হয়,বুকের মাপ নেয়া হয়।সুস্বাদু করে পরিবেশন করা হয় পুরুষের সামনে।যেনো বিছানায় তাকে উপভোগ করতে পারে সুখানুভূতি নিয়ে।মেয়েকে বিয়ে করে পার করিয়ে দিতে পারলেই বাবা হাফ ছেড়ে বাঁচে।আমাদের মতো সমাজে যেখানে মেয়ে শুধুই একটি বোঝা সেখানে অনেকেই বিশেষ করে গ্রামে মেয়ের পরিবার বিয়ের বয়স ১৮ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও নারাজ!তাই আজো বাল্যবিবাহ সগৌরবে তার বিজয় পতাকা উড়িয়ে চলছে বাংলাদেশে।

আমাদের দেশের তথাকথিত ‘নারীবাদী’গন যারা নারী অধিকার নিয়ে মিছিল মিটিল করেন তাদের একটাই উদ্দেশ্য থাকে ধর্ষিতা মেয়ে, পতিতা মেয়ে, নির্যাতিত মেয়ে, প্রতিবন্ধী মেয়ে যেই কোনো মেয়ে তাদের একটি গতি করা, তাদের একটি বিয়ে দেয়া।হুমায়ুন আযাদ এদের নিয়ে বলেছিলেন-“বাঙ্গলাদশে যারা নারীদের কল্যাণ চান,তারা মনে করেন নারীর কল্যাণ শুভবিবাহে,সুখী গৃহে,স্বামীর  একটি মাংসল পুতুল হওয়াকেই তারা মনে করেন নারী-জীবনের সার্থকতা।স্বামী যদি ভাত-কাপড় দেয়,তার উপর দেয় লিপস্টিক নখ-পালিশ ইত্যাদি,এবং আর বিয়ে না করে করলেও অনুমতি নিয়ে করে,বা তালাক না দিয়ে চার স্ত্রীকেই দেখে ‘সমান চোখে’।তাহলেই নারীকল্যান পিপাসুরা পরিতৃপ্ত,ও তাদের আন্দোলন সফল ভেবে ধন্য বোধ করেন”।

গ্রাম্য সালিশে ধর্ষিতা মেয়ের ধর্ষণের একটাই সমাধান- আজীবন তাকে ধর্ষণ করার সুযোগ করে দেয়া ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে।অর্থাৎ নারীর পরিণতি একটাই-বিয়ে।

এগুলো সমাজের অতি সাধারণ কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু প্রতিবন্ধকতা যা নারীর পথে স্বাভাবিক ভাবেই বয়ে চলছে।পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেই বৃত্ত তৈরি করে দিয়েছে, আবদ্ধ করে রাখতে নারীকে।নারী তা আজও পারেনি ভাঙ্গতে।কেনোনা নারী পারেনি এখনও পূর্ণ শক্তিতে জ্বলে উঠতে।নারীরা যতটুকু পেয়েছে তার প্রায় সবই পুরুষের দেয়া।নারী নিজে কিছুই অর্জন করেনি।

মার্কিন কালো শাদাদের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে জর্জ বার্নার্ড শ-এর একটি উক্তি ছিল-“মার্কিন শাদারা কালোদের ঠেলে নামিয়ে দেয় জুতোপালিশকারী বালকদের স্তরে,এবং এ থেকে তারা সিদ্ধান্ত পৌঁছে যে কালোরা জুতো পালিশ করা ছাড়া আর কিছুর উপযুক্ত নয়”।

নারী ও পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ঠিক একই স্তরের।পুরুষদের প্রায়ই যে অপবাদ দিতে শোনা যায় তা হল নারী অক্রিয়, অবলা, অপরিপক্ব।আসলে পুরুষেরা নিজেরাই নারীকে অবলা বানিয়ে রাখে।তাকে সক্রিয় করে তোলার সকল পথ বন্ধ করে বলে নারী অক্রিয়।

তাই নারীকে আজ বেঁচে উঠতে হবে।প্রতিষ্ঠিত হতে হবে একজন মানুষ হিসেবে।সমাজের পুরুষেরা ভুলে গিয়েছে নারীও মানুষ।তাদের সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।মেরি ওলষ্টোনক্র্যাফট, সিমোন দ্য বোভোয়ার, রোজা লুক্সেমবার্গ, তসলিমা নাসরিন যে পথে লড়ে চলেছেন নারীবাদীদের পক্ষে, মাদাম কুরি, আঙ সান সুচি যে পথে নারীত্বের শক্তি দেখিয়েছেন সেই পথে এখনও চলার অনেক বাকি আমাদের। “ওই গাঁয়েতে বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি ওই, তোমার বাড়ি কইগো নারী, তোমার বাড়ি কই”? নারী আজ সময় একটি ঘর খুঁজে নেয়ার।