আমরা ছিলাম একটি দ্বীপের বাসিন্দা
আমাদের ছিল একটি সমৃদ্ধ পরিবার।
গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান
পুকুরভরা মাছ, গৃহভরা শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য।
আমাদের ছবির মত বাড়ির পাশ ঘেঁষে-
কুলকুল সুরে বয়ে যেত,আমাদের চির পরিচিত
চির আপন বঙ্গোপসাগর।
সেই চির চেনা সাগর; একদিন খেলার ছলে,এক নিমেষে
কেড়ে নিয়ে গেল আমাদের যথাসর্বস্ব।

তারপর একদিন কপর্দকহীন অবস্থায়,
ছিন্ন-মলিন বস্ত্রে, স্বপ্নহীন উদাস চোখে,
ভগ্নহৃদয়ে, আমরা পাড়ি জমালাম শহরে;
বেঁচে থাকার তরে।

শহরের নাম না জানা কোণায় ছোট্ট একটি বাসা,
কোন রকমে গাদাগাদি ক’রে বেঁচে থাকা।
কোন উঠোন নেই,বাগিচা নেই
ফসলের ক্ষেত নেই
নেই সবুজের পরে সবুজ
নেই কোন সাগরের প্রবাহমান সুর,
নেই কোন প্রাণের ছোঁয়া।
আমাদের চোখে জীবন ভাঙা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি।
আমাদের মনে ভাঙনের ব্যথা,
সর্বস্ব হারানোর তীব্র বেদনা,
তার উপরে জীবন জীবিকার ভীষণ তাড়না।

এখানে আমাদের সকলের প্রাণ হাঁপিয়ে উঠে।
দিদিমা বলেন বাবাকে,
বাড়ি ফিরে চল খোকা
এখানে আর কতদিন বন্দী হ’য়ে বেঁচে থাকা?
বাবা বলেন, কোথায় যাব মা সবই তো গেছে।

দিদিমা প্রশ্ন করেন বাবাকে,
আমরা এখানে কেন ,
কেন এ চার দেয়ালের বন্দীশালায়?
আমাদের তো ছিল একটি প্রকাণ্ড আটচালা টিনের ঘর।
ছিল একটি বিশাল বাগান,ধানের গোলা,
বিশাল দিঘি শানবাঁধানো ঘাট।
বাবা বলেন, সবই গেছে মা; সবই গেছে সাগর জলে।

প্রশ্ন করেন দিদিমা,
সেই শিউলি ফুলের গাছটা, সেই ডালিম গাছটা,
পুকুর পারের লেবু গাছটা,
সেই নারকেল-সুপারির বাগান,
আম-কাঁঠালের বাগান,
বাবা বলেন সবই গেছে মা সবই গেছে।

প্রশ্ন করেন দিদিমা,
সেই হালের লাঙল-জোয়াল
সেই হালের গরুটা, সেই গাভীটা?
ফসলভরা ক্ষেত, চৌরাস্তার হাটটি,
বটতলার বৈশাখী মেলা,নবান্নের উৎসব
সবই কি গেছে ভেঙে?
সেই ফসল ছড়ানো আঙিনাটি,
সেই আনন্দে ভরা গৃহটি,
তোর বাবার কবরটিও কি গেছে ভেঙে
সবই কি গেছে সাগর জলে ভেসে?
বাবা বলেন, সবই এখন সাগর জলে।

দিদিমা তাঁর দক্ষিণ হস্তটি শূন্যে তুলে,
কেবল প্রশ্ন করেন আর
করাঘাত করেন কপালে।
আর্তনাদে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলেন,
“কোথায় গেল সব হারিয়ে
কোথায় গেল সব বিলীন হয়ে?”

দিদিমা প্রশ্ন করেন বাবাকে
প্রশ্ন করেন মাকে
প্রশ্ন করেন আমাকে।
“আর কি কখনো আসবেনা সেইসব দিন ফিরে,
আর কোনদিন কি তোরা খেলবিনা
সেই উঠোন ঘিরে?”
আমরা বলি “আর কোন দিন আসবেনা কিছু ফিরে,
সবই গেছে জলে, সবই গেছে জলে।“