ইন্টারভিউ

আকাশ মালিক

আজ থেকে প্রায় আটত্রিশ বৎসর পূর্বে প্রথম ইংল্যান্ড এসেছিলাম। তখনকার ইংল্যান্ড আর আজকের ইংল্যান্ডের মধ্যে অনেক তফাৎ। তখন দিনের সুর্য্য সারা বছরই ঘন কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে থাকতো। সকাল-সন্ধ্যা, রাত-দিন টাহর করা মুশকিল হতো। রমজান ছিলনা সুতরাং ঈদের বা কোরবানীর চাঁদও উঠতোনা। মক্তব মাদ্রাসা নেই, কোন মসজিদও নেই। পরিবার পরিজন ছিলনা বললেই চলে। জীবিকার জন্যে প্রবীণরা চাকরি করতেন কার্পেট ফ্যাক্টোরি, গ্লাস ফ্যাক্টোরি এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টোরিতে, আর যুবকেরা রেষ্টুরেন্টে। মিডল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরে একটি সুতা ফ্যাক্টোরিতে আমার জীবনের প্রথম কাজ। ফ্যাক্টোরির কাজে সকাল আটটার বাস ধরে নয়টার আগে কর্মস্থলে হাজির হতে হয়। ঘড়ির এল্যার্ম শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠার অভ্যেস নেই। ঘুম পূর্ণ হওয়ার আগেই রুমের সহকর্মীর ঘড়িতে যখন এল্যার্ম বাজতো, মনে হতো যেন কেয়ামত আসন্ন। তখনকার দিনে এ দেশে অসহ্য ঠান্ডা পড়তো। কাজের লোক যারা ভোর রাতে বাস-স্টপে দাঁড়িয়েছে তারা জানে বিলেতের ঠান্ডা কী জিনিস। আমি যুবক মানুষ, ফ্যাক্টোরির কাজ ভাল লাগলোনা। চলে এলাম ডরসেট এরিয়ার বর্নমাউথ শহরে। তাজমহল নামক একটি রেষ্টুরেন্টে কিচেন পৌ্র্টারের কাজ হলো। থাকা খাওয়া রেষ্টুরেন্টের উপরে, মোট এগারোজন কর্মচারী, প্রধান শেফ ছাড়া সকলেই ব্যাচলার অবিবাহিত। শেফ মুরুব্বি মানুষ, মাথার চুল, মুখের দাড়ি পাটের মত সাদা। এক কালে এক ইংরেজ বণিকদলের জাহাজের বাবুর্চি ছিলেন। তিনি এই রেষ্টুরেন্টের সকলের নানা। ম্যানেজার ফরিদ ভাই আর প্রধান শেফ নানার কথায় আমাদের বস (রেষ্টুরেন্টের মালিক) উঠেন আর বসেন। পুরো পনেরো বছর যাবত এরা দুজন এই রেষ্টুরেন্টে আছেন, কাষ্টমাররা তাদেরকেই রেষ্টুরেন্টের মালিক মনে করে।

সকাল এগারোটা থেকে বেলা তিনটা, আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত কাজ। সাঙ্ঘাতিক বিজি রেষ্টুরেন্ট। সপ্তাহে দশ হাজার পাউন্ডের টেইকিং। তখনকার সময়ের দশ হাজার পাউন্ড অনেক টাকা। আহহারে বিলেতের কাজ, হায়রে কষ্ট। রেষ্টুরেন্ট খোলার পর থেকে বন্ধ হওয়ার পরেও আমার মাথার উপর দিয়ে শেফের বড় বড় হাড়ি বাসন, ওয়েটারের চা-কফির কাপ, মদের গ্লাস, ছেড়া তাসবিহর গুটার মত সিংকে এসে পড়তো। ওগুলো সব ধুয়া মুছা করা, ফ্লোর ঝাড়ু দেওয়া, মপ মারা, ডাস্টবিন সাফ করা আমার কাজ। গামলা-বাথের মতো বড় সিংকের ওয়াশিংপাউডারযুক্ত ময়লা পানিতে সকাল বিকেল হাত দুটো কনুই পর্যন্ত ডুবে থাকতো। কাজ শেষে হাতের দিকে তাকালে ভয় হতো, যেন মরা মানুষের দুটো হাত। সপ্তাহে আমার বেতন একুশ পাউন্ড পঞ্চাশ পেনি। শহরের পাবলিক বাথে পয়সা দিয়ে গোসল, নিজের পয়সা দিয়ে লন্ড্রি, নিজের পয়সা দিয়ে রুমের হিটার জ্বালাতে হতো। বাংলাদেশী গ্রোসারি দোকান ছিলনা, কেউ হালাল মাছ মাংসের চিন্তাও করতোনা। রেষ্টুরেন্টের যুবকদের জীবন, ফ্যাক্টোরির প্রবীণদের জীবনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। এখানে সবাই এক একজন এলভিস, জন ট্রাভাল্টা। চুলের ফ্যাশন ঠিক রাখার জন্যে নিজ নিজ ছুটির দিনে সেলুন বুক করা থাকতো। প্রত্যেকেরই হাই হিল জুতা, বাগি ট্রাউজার, টাইট শার্ট। প্রায় সকলেরই গার্লফ্রেন্ড আছে, এমন কি নানারও। নানার গার্লফ্রেন্ড সুজানা, তার পঞ্চাশোর্ধ বয়স প্রসাধনির কুদরতে ত্রিশে নামিয়ে রাখতেন।

রাতের বেলা সময় সুযোগে কর্মচারীদের কেউ নাইট ক্লাবে, কেউ ক্যাসিনো, কেউ গার্লফ্রেন্ডের ঘরে চলে যান। আবার যাদের কেউ নেই তারা একরুমে বসে তাস খেলা জুড়ে দেন। ব্রে, টুয়েন্টি নাইন, কল ব্রিজ, রাশিয়ান ব্রিজ, ইন্টারন্যাশনেল ব্রিজ সকল প্রকার খেলাই চলে। মাঝে মাঝে বসে তিন তাসের জুয়া, মিনিমাম বেট পাঁচ পেনি। এদের এই খেলায় আমার খুব একটা ইন্টারেষ্ট ছিলনা। আমাকে যে কোন অবস্থায়ই হউক সিংক থেকে উঠতে হবে। কিচেন পৌর্টার থেকে কুক, কুক থেকে তান্দুরি শেফ, তারপর মেইন শেফ, এই হলো আমার টার্গেট। ম্যানেজার ফরিদ ভাই শিক্ষিত এবং খুব ভাল মানুষ। তার কাছে আমার টার্গেটটা গোপনে ব্যক্ত করলাম। তিনি একটা তদবির বাতলে দিলেন, বললেন- নানার গার্লফ্রেন্ডকে দেখলে ইয়ং লেডি বলে সন্মোধন করতে হবে। কয়েক মাসের মধ্যেই নানার বিশ্বস্ত মানুষ হয়ে গেলাম। সিংক থেকে মুক্তি পেলাম হাতে উঠলো হাতির কান মার্কা বড় চামচ আর কুকিং-প্যান। বেতনও কিছুটা বাড়লো, এবার তান্দুরি শেফ হবার পালা। কিন্তু মরার আগে দোজখের আগুনে হাত ঢুকাই কী ভাবে? নানার ধমক আর পয়সার লোভে বিসমিল্লাহ বলে ওভেনে হাত ঢুকালাম। ছ্যাত ছ্যাত করে হাতের বেশ কিছু লোম ও কিছু জায়গার চামড়া পুড়ে গেল। মনকে সান্তনা দিলাম যাক, মরার পরেও তো কত চামড়া জ্বলবে আবার নতুন চামড়া উঠবে। এই দশা তো সকলেরই হয়।

দিনের বেলা ষ্টাফের সকল ঘুম থেকে জেগে উঠার আগেই নানাকে দেখতাম একটা ইংরেজি পত্রিকা নিয়ে নিচে বসে আছেন। ডেইলি সান অথবা ডেইলি মিরর। কী যে পড়তেন আমি বুঝতাম না। শেষে আবিষ্কার করলাম, নানার দৌড় পত্রিকার পেইজ ত্রি আর স্পোর্স সেকশন পর্যন্ত। আফটারনুন দুই ঘন্টার ব্রেইক টাইমেও নানা নিচে বসে থাকেন, বাকিরা কেউ টেলিভিশন দেখেন আর কেউ ঘুমিয়ে পড়েন। নানা মাঝে মাঝে কোথায় যেন উধাও হয়ে যান। একদিন তাকে ফলো করলাম। তিনি লাডব্রুক নামের জুয়ার ঘরে ঢুকলেন। আমি বললাম-
– নানা, আমি এসেছি।
– শুস, কথা বলবিনা। দেখ, ফাইন্যাল ফারলং, কাম অন সন, কাম অন। হেহ, হে, উইনিং বাই ক্লিয়ার টু লেন্ত।
– কি হচ্ছে নানা?
– আমার ঘোড়া উইন করলো। পুরো টু লেন্ত ক্লিয়ার।
– আপনার ঘোড়া?
– দূর বে আক্কেল তুই বুঝবিনা। শোন, কাউকে বলিস না আমাকে এখানে দেখেছিস।
– কিন্তু হলোটা কী তা তো বুঝলাম না।
– আমার সাথে কাউন্টারে চল।
– এ কী নানা, পুরো পঞ্চাশ পাউন্ড! আমার এক সপ্তাহের বেতন এক মিনিটে উপার্জন?
– শুস, কাউকে বলবিনা।
– নানা, আমি জুয়া খেলবো।
– তুমি ঘোড়া কুত্তার কী বুঝবে?
– কুত্তারও দৌড় আছে নাকি?
– আছে।
– নানা, আমি কুত্তা খেলবো।
– তো চয়েস করো একটা কুত্তা, এই দেখো এখানে ছয়টা কুত্তার নাম আছে।
– কুত্তি নাই?
– আছে।
– একটা সুন্দর নাম পেয়েছি নানা।
– কি?
– এঞ্জ্যাল অফ দ্যা সাউথ। নানা, এটা কুত্তা না কুত্তি?
– কথা কম বলো। কতো ধরবি?
– দুই পাউন্ড।
– প্রাইস কত?
– তা তো বুঝিনা।
– ধুর শালা, এটা উইন করবে না।
– কেন?
– টেন টু ওয়ান কুত্তি, দৌড়ের সময় পেশাব করতে বসে যাবে।
– আমি এটাই ধরবো, কী করতে হবে বলুন।
– ট্রাপ নাম্বার লেখো, রেইসের টাইম লেখো, দুই পাউন্ড উইন লিখে কাউন্টারে নিয়ে যাও।

দুই মিনিট যেতে না যেতে নানা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কাম বানাইছো নাতি। প্রথম বেটেই টুয়েন্টি পাউন্ড উইন’। জীবনের প্রথম উইনিং ম্যানি নিয়ে বার্টন শপে গিয়ে একটা লেদার জ্যাকেট কিনলাম। পরের কয়েক সপ্তাহে নানার কাছ থেকে ঘোড়া কুত্তার পূর্ণ সবক নিলাম। পত্রিকা পড়তে নানার চশমা লাগে। এক নীরব আফটারনুন ব্রেইক টাইমে নানা আমাকে ডাক দিলেন- ‘নাতি এই দেখো, এই কলামে ঘোড়ার নাম, এখানে ঘোড়ার মালিক, এখানে ট্রেইনার আর এখানে জকির (সোয়ার) নাম থাকে। এই হলো ঘোড়ার বয়স আর এখানে জকির ওজন। এবার বলো-
– এই ঘোড়াটার নাম কি?
– সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তারবারি)
– ট্রেইনার?
– হেনরি সেসিল।
– মালিক?
– সায়্যিদ বিন আল মাখতুম।
– জকি?
– লেষ্টার পিগট।
– আর এই ঘোড়াটার মালিক?
– খালিদ আব্দুল্লাহ।
– নাতি, এই দুই ঘোড়া দিয়ে আর এই কুত্তা দিয়ে দুই পাউন্ডের একটা ডাবল-ট্রাবল লাগা। তুই এক পাউন্ড, আমি এক পাউন্ড। তুই লাকি মানুষ, কাম হতেও পারে।
– উইন করলে কত পাবো নানা?
– পাঁচ শো পাউন্ড।
হর্স দুটো উইন করলো, কিন্তু হট ফেভারেট ডগ সেকেন্ড হলো, আমাদের বেট মারা গেল। এর পর থেকে গাম্বলিং এর যাবতীয় বিদ্যার্জনে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলাম। পত্রিকার লটারি থেকে এমিউজমেন্টের ফ্রুট মেশিন, সাপ্তাহিক ফুটবল, ডেইলি ফুটবল, ক্যাসিনো, প্রাইভেট তাসের জুয়া সব জায়গায় আমার বিচরণ। যে চক্রবর্তি মাল্টিপোল বেটের হিসেব করতে লাডব্রুকের কাউন্টারের কর্মচারির সময় লাগে পাঁচ মিনিট, আমার লাগে দুই মিনিট। ‘সিঙ্গল ‘ডাবল’ ‘ট্রাবল’ ‘ইয়াঙ্কি’ ‘ফোরকাষ্ট’ ‘ট্রাইকাষ্ট’ ‘রাউন্ড-রবিন’ ‘হিঞ্জ’ সব আমার নখদর্পণে। টাইবেরিয়াস ক্যাসিনোর রাশিয়ান রোলেট, ফাইভকার্ড পোকার, সেভেন কার্ড স্টাড, ত্রি কার্ড ব্রাগ, ব্লাকজ্যাক সব মুখস্ত হয়ে গেছে। এখন মোটামুটি আমি একজন দক্ষ জুয়াড়ি। কিন্তু রাত দিন কাগজ কলম, ক্যালকুলেটার দিয়ে হিসেব করেও ক্যাসিনোর ডিলারকে ১০০% বিট করার সমাধান পেলাম না। যত রকমের বেট করিনা কেন, তার একটা এক্সট্রা উইনিং চান্স থেকেই যায়।

নানা আমার সকল সুখ দুঃখের সাথী। একদিন তাকে বললাম- ‘নানা, আপনাদের সকলের গার্লফ্রেন্ড আছে, আমার তো কেউ নেই’। নানা একটা এড্রেস দিলেন, সাথে বাস নাম্বার। বললেন- ‘রেষ্টুরেন্টের পেছনের বাস ষ্টপে সাউথাম্পটন-গামী ৩৪ নং বাস থামে। সাউথাম্পটন বাস ষ্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরবে। ট্যাক্সিওয়ালাকে এই ঠিকানা দেখালে তোমাকে সোজা রেড-লাইট এলাকায় নিয়ে যাবে। লাল-বাতি জ্বালানো যে কোন ঘরে নক করবে’। বেশ কয়েক সপ্তাহ ছুটির দিনে সাউথাম্পটন আপ এন্ড ডাউন করার পর মনে হলো, পয়সা দিয়ে এভাবে দুধের স্বাদ জল দিয়ে আর কতদিন মেটাবো? এবার ফরিদ ভাইকে ধরতে হবে। ফরিদ ভাইয়ের ওয়াইফ, মানুষ নয় এক জীবন্ত দেবী। দিলীপ কুমার তাকে দেখলে সায়েরা ভানু বলে ভুল করতেন। সাদা চেহারা কৃষ্ণ-কালো চুল। কথা বলেন স্প্যানিশ ভাষায়, আমি তার আগা-মাথা কিছু বুঝিনা। সে ই আমাকে একদিন শিখিয়েছিল- gracias (গ্রাসিয়াস) ধন্যবাদ, Te quiero (টি কুয়াইরো) আমি তোমাকে ভালবাসি, ¿Cuál es tu nombre? (কুয়ালিস তু নমরে) তুমার নাম কি? ইত্যাদি। সব শুনে ফরিদ ভাই দিন তারিখ ঠিক করে একদিন আমাকে একটি নাইট ক্লাবে নিয়ে গেলেন। ক্লাবের নাম ইনকগনিটো। ফরিদ ভাইয়ের শেখানো তদবির কাজে লাগলো। একদিন এক শ্বেতাঙ্গিনী যুবতিকে ড্রিংক ওফার করলাম- ‘ক্যান আই বাই ইউ এ ড্রিংক’? সে রাজি হলো। মেয়েটির নাম চেলসি। রাতের শেষ স্লো-মোশনের গানের সময়, ডান্সফ্লোরে সে আমাকে আহবান করলো- ‘উড ইউ লাইক টু ডান্স উইথ মি’? গানের প্রথম কলিটা এখনও ভুলি নাই- ‘লাভ মি টেন্ডার লাভ মি ট্রু, ও মাই ডার্লিং—–। জীবনে প্রথম বারের মত এক নারীকে জড়িয়ে ধরে ডান্স করলাম। সে কানে কানে বললো- ‘আই লাইক ইউর আফটার শেইভ’। এর পর আর কোনদিন সাউথাম্পটন যেতে হয়নি। ডায়মন্ড রিং দেইনি, সোনার অলংকারও নয়, এক বছরের মাথায় চেলসি সে নিজেই প্রস্তাব করলো- ‘উড ইউ ম্যারি মি’?

একদিন নানা দেশে চলে গেলেন, এখন আমার উপর শেফের দায়ীত্ব। দিনের কাজ শেষে ঘোড়ার ঘর (লাডব্রুক) রাতের কাজ শেষে টাইবেরিয়াস (ক্যাসিনো) ছুটির দিন গার্লফ্রেন্ড। কাজ, জুয়া, মদ, নাইট-ক্লাব এই হলো সাপ্তাহিক রুটিন। পুরো দশটি বৎসর এভাবেই কাটলো। জুয়ায় শুধু যে হেরেছি তা নয়, মাঝে মাঝে বড় বড় এমাউন্টের টাকা জিতেছি কিন্তু ধরে রাখতে পারি নাই। ক্যাসিনোতে আমার ফেভারেইট নাম্বার ছিল দশ আর উনত্রিশ। এই নাম্বার দুটো আমার ডেইট অফ বার্থের দুটো সংখ্যা। এই দুই নাম্বারের উপর বেট করে এক রাতে এগারো হাজার পাউন্ড উইন করেও শুন্য হাতে ঘরে ফিরেছি। একবার ছয়টা ঘোড়া দিয়ে সুপার ইয়াংকি খেলেছিলাম। শেষ রেইসের ফেভারেইট ঘোড়াটা ফটো ফিনিশে সেকেন্ড হলো আর আট হাজার পাউন্ড হাতের ফাঁক দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। আরেকবার বিশটা ফুটবল টিম দিয়ে একিউমিলেটার লাগিয়েছিলাম। দুইটা টিম ড্রো করার কারণে তিরিশ হাজার পাউন্ডের চান্স মারা গেল।

দশ বছর পর মনে পড়লো, সর্পও গর্তে ঢুকার সময় সোজা হয়ে ঢুকে। এভাবে জীবন নষ্ট করা ঠিক নয়। জুয়া খেলা ছেড়ে দিলাম। এক বছর রুজী করে পাঁচ হাজার পাউন্ড সেইভ করলাম। হঠাৎ একদিন মনে চিন্তা জাগলো, জুয়া খেলে জীবনটা তো প্রায় শেষ করে দিলাম। গাম্বলিং করে লক্ষ লক্ষ পাউন্ড খোয়ালাম, লাস্ট একটা চান্স নিয়ে দেখলে কেমন হয়, কিছুটা টাকা উদ্ধার করা যায় কি না। জুয়ার ঘরে যাই নাই সত্য, কিন্তু একটা ঘোড়াকে ফলো করছি বিগত এক বছর যাবৎ। ঘোড়াটির নাম- শেরগার (Shergar), কপালে তার লম্বা চন্দ্রটিকা। মুসলমান মালিক, দুনিয়া বিখ্যাত বিলিওনেয়ার প্রিন্স করিম আগা খান। নিজাম উদ্দীন আউলিয়া ১০০টা খুন করার পর একটা খুনের কারণে আউলিয়া হয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি জীবনের শেষ জুয়া খেলবো।

১৯৮১ সালের ঘটনা। সানডাউন পার্কে (Sandown Park) গার্ডিয়ান ক্লাসিক ট্রায়েল (Guardian Classic Trial) রেইসে শেরগার পুরো দশ লেন্তের ব্যবধানে জয়ী হলো। তখনও এপসম ডার্বিতে (Epsom Derby) শেরগারের উপর বেটিং প্রাইস ছিল এইট টু ওয়ান (এক পাউন্ডে আট পাউন্ড)। পাঁচ হাজার পাউন্ড ব্যাংক থেকে তুলে ঐ দিনই আল্লাহর নাম নিয়ে শেরগারের উপর রেখে দিলাম। এর পরপরই ডার্বি রেইসের জন্যে শেরগার হট ফেভারেইট হয়ে যায়। টপ ওউনার আগা খান, টপ ট্রেইনার স্যার মাইকেল স্টাউট, টপ জকি ওয়াল্টার সুইনবার্ণ, চাঁদ-কপালি ঘোড়া শেরগার। আমি ১০০% নিশ্চিত হয়ে গেলাম এই বেট মারা যেতে পারেনা। ঘোড়-দৌড়ের ২২৬ বৎসরের ফ্লাট রেইসের ইতিহাসের রেকর্ড ভঙ্গ করে শেরগার ১০ লেন্ত ডিস্টেন্সে উইন করলো। বুকির ঘর ক্যাশ টাকা দিতে পারলোনা, তারা ৪৫ হাজার পাউন্ডের একটা চেক দিল। সেদিন ছিল আমার জীবনের শেষ জুয়া খেলা। তারপর বেশীদিন আর মানুষের কাজ করতে হয়নি। একটা রেষ্টুরেন্ট করলাম, খুব ভাল ব্যবসা হলো। এর থেকে আল্লাহর মর্জি ইংল্যান্ডে তিনটা রেস্টুরেন্টের মালিক হলাম, দেশে হার্ট অফ সিটিতে একটি মার্কেট তৈ্রী করলাম। শহরে কোনদিন গেলে দেখবেন, বহু দূর থেকে বিশাল সাইন-বোর্ডে বড়বড় ইংরেজী হরফে লেখা আছে- ‘হাজী কুতুব মার্কেট’। সিটির পশ্চিম প্রান্থে চার কেদার জমিনের উপর আছে, আমার ওয়াইফের নামে আটতলা বিশিষ্ট ‘জুবেদা রেষ্ট হাউস’। গ্রামের বাড়িতে ঢুকার পথে পুকুরের পূর্বপারের তোরণে বাংলায় লেখা আছে ‘মদীনা মঞ্জীল’ প্রোপ্রাইটার, আলহাজ মুহাম্মদ কুতুবুদ্দীন।

এই পর্যায়ে এসে আমাদের গল্পের নায়ক কুতুবুদ্দীন থামলেন। একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় ক্যামেরা লেন্সের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ‘বিলেতের বাঙ্গালি’ নামক একটি টিভি প্রোগ্রামের জন্যে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন। ক্যামেরার পেছনে এবং ডানে বামে পাওয়ারফুল স্পটলাইটের আলোর তাপে ঘরের তাপমাত্রাই শুধু বাড়েনি, কুতুবুদ্দীনের ব্লাড-প্রেশারটাও বেড়ে যায়। ক্যামেরা তখনও রোলিং করছিল। কুতুবুদ্দীন ইঙ্গিত করলেন, তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। ডাইরেক্টর বললেন- কাট। ক্যামেরার পেছনের এবং রুমের দুই কর্ণারে রাখা সকল লাইট অফ করা হলো। রুমের ভিতর হঠাৎ করে আবছা একটা অন্ধকার নেমে এলো। কুতুবুদ্দীন চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন, ক্যামেরার পেছেনে কালো সিল্কের কাপড় পরিহিতা এক রমণী দাঁড়িয়ে। ভাবলেন, অপটিক ইল্যুশন। বাম দিকে তাকিয়ে দেখেন তার অতি নিকটে মাইক্রোফোন হাতে শুভ্রবস্ত্রাদিত ঘোমটা পরা আরেক নারী। কুতুবুদ্দীন ভয় পেলে গেলেন। দুই হাজার পাউন্ড দামে কেনা শান্ডালিয়ারের আলোটা বাড়িয়ে দিতে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। রুমের ভিতর অনেক্ষণ চুপচাপ নিস্তব্ধ, পিন পতন নীরবতা। প্রথম মুখ খুললেন ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণী-
– মিষ্টার কুতুবুদ্দীন, জীবনের পুরো একটা অধ্যায়ই তো গোপন করে গেলেন।
– কে তুমি?
– ইনকগনিটো ক্লাবে যাকে বলেছিলে- ‘তুমি আমার জীবনের প্রথম নারী’।
– হু আর ইউ?
– তোমার তিন সন্তানের জননী, চেলসি উদ্দীন। চিনতে পেরেছো?
– হু দ্যা হেল আর ইউ?
-খুলে দেখো, তোমার বৃটিশ সিটিজেনশিপ ডকুমেন্টে আমার নাম আজও আছে।

ইনটারভিউয়ার মহিলা সজোরে হাতের মাইক্রোফোনটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে, হু হু করে কেঁদে উঠলেন। বললেন- ‘সাউথাম্পটনের ভিকটোরিয়া রোডের কোন মহিলা নয়, ইনকগনিটো ক্লাবের তুমিও নও গো, আমি হতভাগিনী এই শয়তানের জীবনের প্রথম নারী’। কুতুবুদ্দীন কিছু বলতে চাইছিলেন, পারলেন না। জিহবায় লালা নেই, কণ্ঠ তার আড়ষ্ট। মহিলা বললেন- ‘একটিবার চোখ মেলে ভাল করে তাকিয়ে দেখো, আমি কে’? কুতুবুদ্দীন বাকরুদ্ধ। মহিলা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করেন-
– চিনেছো?
– না।
– কৃষ্ণ পুরের মোতিলাল দাসের মেয়ে বিপাশা দাস। তুমি আপাদমস্তক সাদা আল-খেল্লা পরেছো, মস্তকে দশ হাত লম্বা পাগড়ি লাগিয়েছো, মেহদি দিয়ে দাড়ি রাঙ্গিয়েছো, কিন্তু কোন কিছুতেই তোমার চোখ দুটোকে মুখোশ পরাতে পারোনি। আমি তোমাকে চিনতে মোটেই ভুল করিনি। তুমি মসজিদে আজান দাও, ছোট্ট ছোট্ট শিশু কিশোরদের ওয়াজ শুনাও, আরবি পড়াও, তোমার লজ্বা করেনা, তোমার অতীত মনে পড়েনা? মনে আছে গো ৭১ সালের সেই অন্ধকার তুমুল বৃষ্টিঝরা রাতের কথা? ১১ বছরের বালিকার দেহটা, করাতিয়া যেমন করাত দিয়ে সজীব বৃক্ষাদি কেটে পুলকিত হয়, তুমিও তেমনি আমার বুকটা চিড়ে টুকরো টুকরো করেছিলে। দুই হাতে দুমড়ে মোচড়ে, দলিত মথিত করেও তুমার তৃষ্ণা মেটেনি, তুমি আমার ছোট্ট দুটো স্তন দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ক্ষত বিক্ষত করেছিলে। আমার সর্ব অঙ্গে আজও তোমার বিষাক্ত দাঁতের দাগ রয়ে গেছে।

মহিলা তার গায়ের বস্ত্র খুলতে উদ্দ্যত হলেন। কুতুবুদ্দীন তার শরীরের সকল শক্তি দিয়ে, দু-পা একত্রিত করে সজোরে একটি লাথি মারেন। লাথিটা তার পাশে ঘুমন্ত স্ত্রী জুবেদা খাতুনের উরুতে ভীষণ আঘাত করলো। জুবেদা খাতুন চিৎকার দিয়ে ধরফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠেন। স্ত্রীর চিৎকারে কুতুবুদ্দীনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। জুবেদা স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে দেখেন, তার সমস্ত শরীর ঘামে শাওয়ার ভেজা হয়ে গেছে। তার সন্দেহ হলো স্বামীর হার্ট এট্যাক হয়েছে। জিজ্ঞেস করেন- ‘তোমার কী হয়েছে গো, এম্বুলেন্স ডাকবো’? কুতুবুদ্দীন বলেন- ‘কিছু না, তুমি ঘুমাও একটা দুঃসপ্ন দেখছিলাম’। কিছুক্ষণ পর জুবেদা খাতুন ঘুমিয়ে পড়লেন, কুতুবুদ্দীন ধীরে ধীরে নিচে এসে সোজা লিভিং রুমে চলে গেলেন। আস্তে করে শান্ডালিয়ারের সুইচ অন করলেন, দেখলেন পূর্ণ দ্বীপ্তিতে বাল্বগুলো সব ঠিকই জ্বলছে। কুতুবুদ্দীন খৃষ্টাল-পাথর বেষ্টিত বাতিগুলোর দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলেন।