দুই দুইটা সন্তান হবার পর তাদের সম্পর্কের নদীতে তিরতির করে জেগে ওঠে চর। চরে আটকা পড়ে আর ভাল লাগে না রফিকের। চলনে-বলনে, সবকিছুতে রাহেলা হয়ে ওঠে চোখের-কাঁটা। তো চোখে কাঁটা নিয়ে কি আর ঘর করা য়ায়? ভাঙন তো ধরবেই। কিন্তু রফিক অতটা নির্দয় নয় যে রাহেলাকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে নিজে সুখী হবে। সময়টা তো আর কম নয়। দশ দশটা বছর ঘর করে কাটিয়ে দিল একজনের সাথে। অথচ তার নানা এবং দাদা, তিনজন এবং তার এক কাকা দুইজন বউ নিয়ে সুখে সংসার করে জীবন কাটিয়েছে। যদিও তার কাকার দ্বিতীয় বিয়ের সময় সে যৌবন দোষে অথবা কাকীর প্ররোচনায় রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, নিজের জীবনে এই অপকর্মটি করবে না। কিন্তু সে কি তখন জানতো, রাহেলা শরীরের বাঁধন ঢিলেঢালা হয়ে যাবে আর সে কোন আকর্ষণ অনুভব করবে না। কেমন বুড়িয়ে গেছে যেন। ব্যবসার অজুহাত দেখিয়ে আজকাল প্রায়ই সে বাড়ি ফেরে না। রাহেলা কিছু বললে সে খলবলিয়ে ওঠে, “কোথায় থাকি না থাকি তার হিসাব তোমারে দিতে অইবো?”
রাহেলাও ছেড়ে কথা বলতো না, “যদি আমিও রাইতে বাড়ি না ফিরি?”
“তোমারে নিষেধ করলো কে?”
“তোমার মতো কামাই রোজগার করলে কথাটা অত সহজে বলতে পারতা না”
“তোমারে কামাই রোজগার করতেই বা নিষেধ করলো কে?”
“নাও বাচ্চা দুইটা তুমি পাল, দেখ, পারি কি-না?” তারপর হাতটা শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে বললো, “যতটা মুর্খ ভাবছো অতটা মুর্খ আমি না। অহন মেয়েরা গার্মেন্টসে কাজ কইরাও বাঁচতাছে।“
“মেয়ে মানুষ শয়তান আর নাস্তিকের সাথে তর্ক করা একই কথা।“ খুব একটা মূল্যবান কথা বলতে পেরে রফিক স্বস্তি বোধ করে ।
রাহেলা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, “অহন আমি শয়তান, আর বিয়ার পরে কি কইতা মনে আছে?” তারপর কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে সে-ই স্মরণ করিয়ে দেয়, “তুমি আমার হুর-পরী, তুমি আমার আসমানের চান, আমার আন্ধার ঘরের আলো আরো কত কি, সব ভুইলা গেছ?”
রফিক ঘরে থাকাটা নিরাপদ বোধ করলো না, তাতে তার মহা আবিষ্কারের স্বস্তি ভাবটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সময়, সময়ই সব বলে দেয়, আমিই কি জানতাম, একদিন ক্লান্তি আসবে, জোর করেও মন বসাতে পারবো না। আমি আর কি করবো? সব আমার কপালের লেখা। আমার কপালে যদি দুইটা বিয়ে থাকে তো আমি খন্ডাবো কেমন করে? কপাল, কপালের কথা বললে কারো আর কিছু বলার থাকবে না। জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে সে-সব তো আল্লার হাতে। তার নিজের কি করার আছে? ভাবতে ভাবতে রফিক বেশ হালকা বোধ করে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে, তাহলে আর দ্বিতীয় বিয়ের পথে আর কোন কাঁটা নেই। একথাটা আগে মনে হলে অনেক আগেই দ্বিতীয় পত্নী ঘরে তূলে ফেলতে পারতো।
মনে মনে এক রকম স্থির করে ফেললো, দ্বিতীয় বিয়ে সে করেবই। বাঁধা এলে বাঁধবে লড়াই, ছাত্রজীবনের এ শ্লোগানটি এখন আরো অর্থবহ হয়ে ওঠে। তবে রাহেলাকে চটিয়ে কিছু করা যাবে না।
বিগড়ে গেলে ঝামেলা বাড়বে। ঝামেলায় পড়ে সময় নষ্ট করার মত মানুষ সে নয়। মুসলিম আইন না থাকলে রাহেলার মতামতের পরোয়া করতো না সে। কবে যে দেশে সরাসরি ইসলাম কায়েম হবে, কে জানে? তখন আর নারীর মতামত নিতে হবে না। এ মাসে চাঁদার পরিমানটা বাড়িয়ে দিতে হবে। আপাতত রাহেলার সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। ভালোয় ভালোয় তাকে রাজি করাতে হবে। না হলে পরে অন্য পথ তো খোলা আছেই।
একজন চতুর ঘটকের সন্ধান পেয়ে যায় রফিক। ঢাকা শহরে নিরিবিলি জায়গার খুব অভাব। কোন একটা গোপন কথা বলার গোপন জায়গা নেই। খামাকা সরকারকে ট্যাক্স দেয়া। একটা হোটেলের এক কোণায় বসে ফিসফিস করে রফিক বললো, “বিয়ে করবো, দ্বিতীয় বিয়ে, পারবেন?”
ঘটক অপ্রয়োজনে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তার ভাবখানা এমন যেন সে রাষ্ট্রের কোন গোপন তথ্য অন্য কোন রাষ্ট্রের গোয়েন্দার হাতে তুলে দিচ্ছে। খুব ধীর-স্থিরভাবে চায়ের কাপে একটা চুমুক দেয়। এই অবসরে সে একটু ভেবে নেয়, ভাবনাটাই আসল। ঠিকঠাক মত গুছিয়ে বলতে না পারলে মক্কেল হাত ছাড়া হয়ে যায়। তাও আবার দ্বিতীয় বিয়ে। একটু এগিয়ে অনেক পাত্র পারিবারিক চাপে সটকে পড়ে।
রফিক অহেতুক কালক্ষেপণে অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু এ মুহুর্তে নীরব থাকাই হয়ে ওঠে তার রণ-কৌশল।
সেও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্থির হয়ে চেয়ে থাকে ঘটকের দিকে।
গলা কেঁশে আবারো একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে ঘটক প্রায় ফিসফিস করে বললো, “চাইর-পাঁচটা বিয়া তো আজকাল ফকিন্নির পুতেরাও করে, আর আপনি অইলেন..।“ একটু থেমে সে আবার ভাবে। বিয়ের সংখ্যা চার-পাঁচের মধ্যে রাখলে দুই খুব সহজ হয়ে যায়। এসবই তার অভিজ্ঞতা। তারপর সে যোগ করে, “আপনি তো আর চাইর-পাঁচটা করতাছেন না, মাত্র দুইটা।“
রফিক গম্ভীর কন্ঠে বললো, “একসঙ্গে চার-পাঁচটা বউ রাখবার ক্ষমতা ওদের নেই। ওরা একটা ছেড়ে, আরেকটা ঘরে আনে। আমাদের বংশে এমন নজীর নেই। আমার দাদা তিন তিনটা বিয়ে করেছিলেন কিন্তু একজনকেও তালাক দেন নাই। আবার কোন স্ত্রীকে অত্যাচার করেছে এমন কথা তার শত্রুরাও বলতে পারবে না।“
তার মানে শত্রু ছিল, হয়তো ভয়ে বলেনি। এসব ক্ষেত্রে তাই হয়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ঘটকের এসব জানা। আস্তো একটা মিষ্টি মুখে ভেতর নাড়াচাড়া করতে করতে সে ভাবছিলো। রফিকের কথা শেষ হবার সাথে সাথে সে বলে, “তওবা, তওবা আমি কি আর আপনার কুলীন বংশ নিয়ে কিছু বলেছি? আপনি রাগ করবেন না।“
মুখের ভেতরে রসগোল্লার উপস্থিতির কারণে কি-না রফিক বুঝতে পারলো না, তবে তার কথা বেশ মিষ্টি লাগলো। রফিক হাঁফ ছেড়ে বললো, “কতদিন লাগবে পাত্রী খুঁজে পেতে?”
ঘটক বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললো, “আপনার জন্য তো আর যেনতেন পাত্রী দেখতে পারি না। তবে আমার হাতে মেলা পাত্রী আছে, একটু ভাইব্যা দেখতে অইবো কোনটা আপনার লগে মানাইবো। এই আর কি দুইচারদিন।“
রফিক একটু উদাসীনভাবে বললো, “দেখেন যত তাড়াতাড়ি পারেন, করেন। আমার আর ভাললাগে না।“
“বুঝি, সবই বুঝি। এক তরকাঅরি দিয়া কি আর প্রত্যেকদিন ভালা লাগে?”
কথাটা সে নিজে মানলেও ঘটকের মুখ থেকে শুনতে তার ভাল লাতলো না। তার মনে হলো, ঘটক ব্যাটা তার বউকে তরকারি ভেবে বসে আছে। এর একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার। রফিক একটু গম্ভীর কন্ঠ বললো, ” মেয়ে মানুষ আর তরকারী এক জিনিষ না, সম্মান দিয়া কথা বইলেন।” কথাটা বলে নিজেকে বেশ প্রগতিশীল মনে হলো।
“ওই আএর কী, একটু মস্কারা করি।” বলে ঘটক মুচকি হাসলো।
“তো একটু তাড়াতাড়ি খুঁইজেন, এসব কাজে সময় বেশি নেয়া ভাল না।”
“মাশাল্লা, যত তাড়াতাড়ি পারি, আপনেরে জানামু।”
একশত টাকার একটা নোট ঘটকের হাতে গুঁজে দিয়ে রফিক বললো, “আমার বাসায় না এসে অ্ফিসেই আসবেন।”
” আপনে কোন চিন্তা কইরেন না। আমি দুই একদিনের মধ্যে খবর নিয়া আবার হাজির হমু।”
“বংশ মর্যাদা দেখার দরকার নাই, গরীব ঘরের হলোও চলবে। তবে সুন্দরী হতে হবে| আর বয়সটাও একটু লক্ষ্য রাখবেন, যত কম বয়সের

কৌশলগত কারণে রফিক রাহেলার সাথে বেশ আন্তরিক হয়ে ওঠে। তার কন্ঠে ফুটে ওঠে অন্য এক সুর। সন্তানের কাছে মা-ই সব, বাপ আর কি, দুইটা টাকা পয়সা এনে দেয়। এটা ওটা কিনে দেয়। আর সন্তানরাও তো মা মা করে পাগল। আমাকে আর খুঁজে?
“তোমারে পাইলে তো খুঁজবো।“
“তা ঠিক, সারাক্ষণ ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, আমিই বা কি করি?”
রাহেলা ভাবলো, হয়তো রফিকের সুমতি হচ্ছে। তার দাদীর কথাটি মনে পড়ে. পুরুষ মানুষ মাঝে মধ্যে একটু আধটু পাগলামি করবো আবার ঠিক অইয়া যাইবো, তবে চোখে চোখে রাখবি, একটু এদিক ওদিক অইলে সব শেষ। কথাটা সে এখনো মেনে চলে।
রাহেলার মুখের দিকে তাকিয়ে রফিক ভাবলো, কাজ হচ্ছে মনে হয়। সে আর এক ধাপ এগিয়ে বললো, “তুমি টাকা পয়সা নিয়ে কোন চিন্তা করো না। আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমাদের কোনদিন কষ্টে রাখবো না।“
রাহেলা মুচকি হেসে বললো, “শুধু কি টাকা পয়সায় মন ভরে, আর কিছু লাগে না?”
রফিক বিপদের গন্ধ পেয়ে বললো, “এখন আমি কাজে যাই, কোন চিন্তা করো না।“

চারদিনের মাথায় ঘটক রফিকের কপালে কড়া নাড়লো। বেশ হাসি খুশি। বিশ্ব বিজয় করে যেন এইমাত্র ফিরে এসেছে বীরের বেশে। এখন রফিক তাকে টাকার মালা দিয়ে বরণ করে নিলেই হয়। ঘটকের চোখে উদ্ভাসিত আলো দেখে রফিকের বুকের টিপটিপানি বেড়ে যায়।
উভয়ে অস্থির। একজন বলার জন্য, অন্যজন শোনার জন্য। অফিস থেকে বেরিয়ে বাইরে পা রাখতে না রাখতে রফিক তার দিকে ঘন ঘন তাকাতে লাগলো। আর ঘটক এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে খুব সতর্কতার সাথে বললো, “কাম বানায়া ফালাইছি। খুব সুন্দরী, এক্কেবারে ফকফকা পরী। আপনার ঘরে আর কেরাসিনের বাতি লাগব না।“
রফিক মুচকি হেসে বললো, “আগে কি গ্রামে ঘটকালি করতেন?”
“তা করতাম কিন্তু শহরে আমার ডিমান্ড ভাইরা গেল, তাই আটকায়া গেলাম। আরে গ্রামে মানুষ বেশি পয়সা দিতে চায় না। বড় কিপ্টা।“
“পয়সার অসুবিধা আপনার হবে না, তো বলেন কি খবর নিয়ে এলেন।“
“মাইয়্যাডার একটাই দোষ। গরীর। বাপ থাইক্যাও নাই। ভাইও বিয়া কইরা আলাদা। খুব কষ্টে আছে।“
“রফিক সদম্ভে ঘোষণা করলো, ” এ বিয়েতে আমি এক টাকাও যৌতুক নেবো না ।“
“আলহামদুলিল্লা। আপনে অইলেন খাঁটি মুমিন, তাই এই কথা কইতে পারলেন।“
“শুধু তাই নয় ওর মা-র ভরণ-পোষণ যা লাগে আমিই চালাব, বলবেন কোন অসুবিধা হবে না।“

একটা পরিবারকে বাঁচাবার জন্যই রফিককে এ বিয়ে করতে হচ্ছে, কথাটা রাহেলার কানে তুলতেই সে ক্ষেপে গিয়ে বললো, “অত যুদি উপকারের ইচ্ছা, তো বিয়া না কইরাও করন যায়।“
একটি পরিবারকে সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করা কতটা পূণ্যের কাজ, কথাটা নানাভাবে বুঝিয়ে যখন কাজ হলো না তখন সে একটি মোক্ষম অস্ত্র ছুঁড়ে দিল, “তুমি কোরান মানো?”
নরফিকের এ কথায় রাহেলা ভড়কে গেলো, বললো, “তোমার বিয়ার লগে কোরানের কি সম্পর্ক?”
বিজ্ঞের মত হেসে রফিক বললো, “আছে, আছে। কোরান তো পড়েছো আরবীতে বাংলায় তো আর পড়নি, তাই জান না। তবে বলি, শোন, তিন-চারটা বিয়ে করার জন্য কোন অনুমতি লাগে না। যদি আমি মনে করি এতিমদের প্রতি সুবিচার করতে পারব তা হলেই হবে। তবুও চাচ্ছি, দেশের আইনটা মানুষের তৈরী, তাই।“
উপায় না দেখে রাহেলা রফিকের ঘনিষ্ট বন্ধু সাবেরের বাসায় গিয়ে সব খুলে বললো। রাহেলা মনে হলো হয়তো সাবেরই পারে এ বিয়ে ঠেকাতে। রাহেলা তার বিশ্বাসের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিদায় নেবার আগে বললো, “আমি যে এসেছিলাম আপনার বন্ধু যেন না জানে।“

আগের মত ঘনিষ্ট যোগাযোগ না থাকলেও রফিক তার বন্ধুদের মধ্যে সাবেরকে একটু বেশি খাতির করতো। সাবেরের যশ-খ্যাতির জন্য একটু ভয়ও করতো। তো অনেকদিন পর সাবেরকে দেখে রফিক একটু বিব্রতবোধ করলো। কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসির দড়ি টেনে, সে ভাবটা আড়াল করে বললো, “অনেকদিন পর যে, কি মনে করে?”
“বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র নিতে এলাম আর কি।“
“তুই কোত্থেকে শুনলি?”
“তা শোনে কাজ নেই। তুই কি আসলেই বিয়ে করতে যাচ্ছিস?”
রফিক ম্লান হেসে বললো, “অনেক চেষ্টা করলাম আর পারলাম না।“
“কি পারলি না?”
“তোর ভাবী আর পারে না। কি বলবো লজ্জার কথা, আর পারি না।“ বলে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে রফিক।
“তো ভাবীকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, কি ব্যাপার?”
যেন সে শুনতে পায়নি, “ওরা খুব বিপদের মধ্যে আছে। আমার সাথে বিয়ে হলে পরিবারটা বেঁচে যায়।“
“সেটা তো তুই বিয়ে না করেও করতে পারিস?”
রফিক ক্রমশঃ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বুঝলো, সোজা কথায় কাজ হবে না। সাবেরকে তার ভয় পাবার কি আছে। সেকি তাকে খাওয়াচ্ছে পড়াচ্ছে যে ভয় পেতে হবে? ভাবতে ভাবতে বলেই ফললো, “বিয়ে আমি করব, তাতে কে কি ভাবলো আমার কিছু যায় আসে না।“
সাবের ভাবলো, কোন কাজ হবে না। তবুও বললো, “এ যুগে কি একজন শিক্ষিত লোক দুই তিনজন স্ত্রী নিয়ে সংসার করে?”
রফিক মরিয়া হয়ে বললো, “আমাদের নবী কি অশিক্ষিত ছিলেন, তিনি পারলে, তার উম্মত হয়ে আমি কেন পারবো না?”
“তিনি তো আরো অনেককিছু করেছেন, সেগুলো কর, তারপর না হয় বিয়ের পর্ব শুরু করিস।“

রাহেলা স্নানাহার প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। সারাক্ষণ ঘরের এক কোণে বসে বসে কাঁদে। কারো সাথে কথা বলে না। এমনকি সন্তান ২টার প্রতিও তার আগের মত লক্ষ্য নেই। রফিকের কানে যে এসব খবর যায়নি তা নয়। সে নিজের বিয়ে ছাড়া আর সব ব্যাপারে উদাসীন। তবে ছেলেমেয়ের প্রতি লক্ষ্য না রাখার জন্য রাহেলাকে বে-হায়া, বে-শরম বলে গালমন্দ করতে ছাড়লো না।

বিয়ের পূব রাত্রি। কেনা কাটা শেষ। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। প্রথম প্রেমে পড়া যুবকের মত রফিক গুনগুনিয়ে গান গায় আর মনে মনে হিসাব করে, কোনকিছু বাদ পড়ে গেলো কি-না? এজন্য অবশ্য রাহেলাকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলো। রাহেলার কাছে এ প্রস্তাব ছিল কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত। অগত্যা রফিক একা একাই সব কেনা কাটা সম্পন্ন করে। রাত বাড়ে রফিকের চোখে ঘুম আসে না। বার বার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নতুন বধুর মুখ। তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। এ রাত যেন আর শেষ হবে না।


বাড়িতে বেশ ধুমধাম। লোকজনের হৈ চৈ হাঁক-ডাক সব ছাপিয়ে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর। রাহেলাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। তার মনে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার। নিজের বাসর ঘর নানান রকম ফুল দিয়ে সে নিজেই চমৎকার সাজিয়েছে। নব-বধুর মতো সেজে-গুঁজে বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখে নিচ্ছে কোথাও কোন খুঁত রয়ে গেছে কি-না। নিজেকে দেখতে দেখতে সহসা সে কুমারী হয়ে গেলো। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব তার সাজ-গুজ আর উচ্ছ্বাস দেখে টিকা-টিপ্পনি কাটতে লাগলো। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। রাহেলা আপন মনে গুন গুন করে গান গাইছে। যেমনটি গেয়েছিল প্রথম বিয়ের সময়। রফিককে নিয়ে সংসার করতে করতে তার বড় একঘেয়ে লাগছিলো। রফিকের দিকে তাকিয়ে সে আর কোন আগ্রহ অনুভব করে না। শুধু তাই নয়, রফিককে দেখলে মাঝে মধ্যে মন বিষিয়ে উঠতো। রফিক অবশ্য অনেক চেষ্টা করেছিলো এ বিয়ে থামাতে, রাহেলা পাত্তা দেয়নি। পুরুষ মানুষের কথায় চললে কি আর জীবন চলে?
নিজের শয়ন ঘরে সেই যে সকাল বেলায় দরজা জানালা বন্ধ করে রফিক উপুড় হয়ে পড়ে আছে আর ওঠেনি। অবশ্য কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতেও আসেনি। সবাই রাহেলাকে নিয়ে ব্যস্ত। দশ দশটি বছর সংসার করার পর রাহেলা কি-না এখন অন্য পুরুষ ঘরে এনে তুলবে। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। এ দুঃখের কথা শোনার মানুষও তার নেই। চোখের জলে কখন বালিশ ভিজে যায়, সে নিজেও টের পায় না। রাহেলাকে হাতে পায়ে ধরে কত বুঝিয়েছে কোন কাজ হয়নি। রাহেলা যে এমন নিষ্ঠুর, বিয়ের কি সে বুঝতে পেরেছিল? তখন তো উঠতে বসতে তুমি আমার রাজকুমার, উত্তমকুমার, আন্ধার ঘরের আলো, আর আজ? ভাবতে ভাবতে তার বুকের ভেতর হাঁফানি ওঠে। মনে হয়, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। আবার তার রাগ ওঠে ঐ লোকটার কথা ভেবে, রাহেলা স্বামী আছে জেনেও যে তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। আজ রফিক যদি নিজে উপার্জনক্ষম হতো, তাহলে কি আর রাহেলা তাকে এতো সহজে ত্যাগ করতে পারতো? পরক্ষণে তার মনে হয়, সম্পর্ক কি শুধু টাকা পয়সায় হয়? নিজেই উত্তর দেয়, হয়, হয়। কিন্তু সে নিজে উপার্জন করতে পারলে সে টাকা-পয়সার সম্পর্কের ধার ধারতো না।
বাড়িতে হৈ চৈ সপ্তমে ওঠে। প্রথম যেদিন সে এ বাড়িতে আসে তখন তাকে নিয়েও ঠিক এই রকম হৈ চৈ হয়েছিলো। রফিক আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয় কেমন করে? একবার তার ইচ্ছে হলো, গিয়ে দেখে আসে, রাহেলার নতুন বর কি তার চেয়ে সুন্দর?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে। হৈ চৈ হাঁক ডাক স্তিমিত হয়ে আসে। রফিকের পাশের ঘরেই রাহেলার বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। ও ঘরে যাবার দরজাটা সকাল থেকে বন্ধ করে রেখেছে । হঠাৎ পাশের ঘর হাসির খিলখিল ধ্বনি ভেসে এলে, রফিকের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। একবার ইচ্ছে হলো, উঁকি দিয়ে দেখে আসে। কিন্তু পর মুহুর্তে তার গা ঘৃণায় রি রি করে ওঠলো। ছিঃ ছিঃ, এই কয়দিন আগেও যে মানুষটা তার শরীর জড়িয়ে ধরে কত কবিতা গান শুনিয়েছে, আর আজ অন্য একজন পুরুষের গায়ে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে। মানুষ এত নির্ল্জ্জ হয় কি করে?
চুড়ির রিনরিন এবং সেই সাথে মৃদু ধস্তাধস্তির মতো পরিচিত একটা শব্দ ভেসে এলে রফিকের লোপকূপ খাঁড়া হযে যায়। ব্যাপারটা আন্দাজ করতে তার কষ্ট হয় না। রফিকের জীবনেও এমনি এক রাতে রাহেলা চাপা হাসির গুঞ্জরণ তুলে লুটিয়ে পড়েছিলো তার বুকের ওপর। সে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতেই রফিকের চোখ বেয়ে দরদরিয়ে জল পড়তে লাগলো। বালিশ ভিজে যায়। তার নীরব কান্না যেন আর থামতে চায় না। বালিশটা বুকে চেপে সে দলিত-মথিত করতে থাকে। হঠাৎ জেগে ওঠা মধ্যরাতের ক্ষুধা তীব্র হয়ে ওঠে। ইচ্ছে হলো দরজা খুলে এক্ষুনি বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? পরবর্তী মুহুর্তে সে নিজেকে ধিক্কার দিলো। ছিঃ ছিঃ এমন ভাবনা তো আগে কখনো মনে উদয় হয়নি। আজ এমন হচ্ছে কেন?
ওপাশে হঠাৎ আলো নিবে গেলো। রফিকের বুকটা ধড়াস্ করে উঠলো। তার হৃদ-কম্পন দ্রুত ওঠা-নামা করতে থাকে। সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। এক লাফে বিছানা থেকে ওঠে উম্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো দরজার ওপর।