বেশ কয়েক মাস আগে মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম – “মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছে।” লেখাটা সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সী আবিষ্কারের ওপর ছিল, গ্যালাক্সীটি বিগ ব্যাংগের মাত্র ৬০০ মিলিয়ন বছরের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল। ঐ লেখাটার সূত্র ধরে ও কিছু প্রশ্নের আলোকে কিছু বক্তব্যকে পুনরায় উপস্থাপনা করছি।

সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সীগুলো পার হলে আমরা পাই নিউট্রাল হাইড্রোজেনের একটা স্তর, তার পরে একটা অস্বচ্ছ দেয়াল যার পেছনে বিগ ব্যংএ সৃষ্ট ফোটন আলোক কণাসমূহ ইলেকট্রনের মেঘের মাঝে আটকা পড়ে আছে। সেই দেয়াল হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণের শেষ সীমা, যে দেয়ালের বিকিরণ আমরা পৃথিবী থেকে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রউন্ড হিসেবে দেখছি। সেই দেয়ালের পেছনে হচ্ছে বিগ ব্যাং। আমার বক্তব্য ছিল আমরা যদি “এই মূহুর্তে” সেই অস্বচ্ছ দেয়ালের কাছে পৌঁছতে পারতাম তাহলে সেখানে কোন দেয়াল থাকত না, বরং আমরা দেখতাম আমাদের মতই একটা মহাবিশ্ব – গ্যালাক্সিতে ভরা। কিন্তু সেই জায়গা থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে পৃথিবী দেখা যেত নয়া, দেখা যেত একটি অস্বচ্ছ দেয়াল। এর মানে হচ্ছে বিগ ব্যাংএর পরবর্তী মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের তরঙ্গ পৃথিবী যেখানে আজ অবস্থিত সেখান থেকে সবে মাত্র ঐ জায়গায় পৌঁছাচ্ছে।

অর্থাৎ মহাবিশ্বের যে কোন বিন্দুতেই যাওয়া যাক না কেন সেখান থেকে একটা গোলকের কল্পনা করা যেতে পারে যার সীমা রচিত হবে সেই অস্বচ্ছ দেয়াল দিয়ে। যত দিন যাবে সেই দেয়ালের দূরত্ব আমাদের থেকে বাড়বে কারণ দেয়ালের পেছন থেকে আলো আমাদের কাছে পৌঁছানোর সময় পাবে। বিগ ব্যাং যদি প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে সংঘটিত হয়, তবে সেখান থেকে আলো এসে পৌঁছাতে ১৪ বিলিয়ন বছর লেগেছে। এর মানে এই নয় সেই দেয়ালের দূরত্ব ১৪ বিলিয়ন আলোকবছর। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জীর মডেলের গণনা অনুযায়ী সেই দেয়াল “এই মূহুর্তে” আমাদের কাছ থেকে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে, অর্থাৎ মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ধরে নেয়া যায়। কি ভাবে ১৪ বিলিয়ন বছরের মধ্যে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ৪৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ হল সেটা নিয়ে আর এক দিন আলোচনা করা যাবে, এখানে শুধু বলে রাখি যখন কোন দূরবর্তী বিন্দু থেকে আমাদের কাছে আলো আসে তখন আলোকে একটা প্রসারণশীল দেশ বা স্থানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ আলো যে উৎস থেকে রওনা হয়েছিল তা পেছন দিকে আরো দূরে সরে যেতে থাকে এবং সামনে যেখানে আলোর পৌঁছনোর কথা সেই উদ্দেশ্য বিন্দুও দূরে সরে যেতে থাকে।

আমি এখানে গোলক, ব্যাস, ব্যাসার্ধ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করছি কারণ ইদানীং কালের পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে মহাবিশ্বের সামগ্রিক জ্যামিতি ইউক্লিডিও, অর্থাৎ দেশ-কালের “মেট্রিক” সমতল। তার মানে এই মহাবিশ্বে একটি বিশাল ত্রিভূজ আঁকলে তার তিনটি কোণের সমষ্টি হবে ১৮০ ডিগ্রী। কিন্তু ইউক্লিডিও মহাবিশ্ব মানে একটি অসীম মহাবিশ্বও বটে!

কিন্তু মহাবিশ্ব যদি “এই মূহুর্তে” অসীম হয়, তবে সে অতীতেও অসীম ছিল। কোন একটি “সীমিত” বিন্দু থেকে অসীম মহাবিশ্বের সূত্রপাত হতে পারে না। শুধুমাত্র একটি অসীম মহাবিশ্ব থেকেই আর একটি অসীম মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে।

তাহলে আমাদের বিগ ব্যাংএর মডেলটি কি রকম হওয়া উচিত?

ধরে নিন আজ থেকে ১৪ বিলিয়ন বছর আগে সেই অসীম মহাবিশ্বের ঘনত্ব সাংঘাতিক রকম বেশী ছিল। চিন্তা করুন একটা বিশাল কাদামাটির (বা রাবারের) দলা যা কিনা প্রতিটি মাত্রায় অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কোন একটা বিশেষ মূহুর্তে, যাকে আমরা বিগ ব্যাং বলছি, দলাটি বিস্তৃত হতে শুরু করল। এই মডেলটি আপনি একটা রাবারের দলাকে হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন। দেখবেন যে এই প্রসারণের ফলে রাবার বা কাদামাটির ঘনত্ব কমে যাচ্ছে এবং আপনি যদি নিজেকে একটি রাবারের কণা হিসেবে কল্পনা করেন দেখবেন যে অন্য সব কণাই আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এখন মনে করুন যে মুহূর্তে প্রসারণ শুরু হল সেই মুহূর্তে অনেক আলোরও (ফোটনের) সৃষ্টি হল (বিগ ব্যাং জনিত আলো, বস্তু-প্রতি বস্তু ধ্বংসের আলো, ইত্যাদি)। ধীরে ধীরে ঘনত্ব কমে গেলে সেই আলো মুক্তি পেয়ে মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দিকে রওনা দিল। আমাদের পৃথিবী যেখানে সৃষ্টি হবার কথা সেই জায়গার আলো অনেক আগেই চলে গেছে (১৪ বিলিয়ন বছর আগে), সেই আলোই এখন ৪৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সীরা কসমিক মাইক্রোওয়েভ হিসেবে দেখছে।

আমাদের যদি “ঈশ্বরের দৃষ্টি” থাকত তবে আমরা দেখতাম আমাদের মহাবিশ্বের গ্যালাক্সীপুঞ্জের মত গঠনই একটা অসীম স্থানে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু আলোর সীমিত গতির জন্য দূরবর্তী স্থানের সংবাদ শুধুমাত্র এখনই আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে।

১৪ বিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা হয়েছিল। কিন্তু সেটা একটি বিন্দু থেকে বিস্ফোরণের মত নয়। [এমনও সম্ভব দুটি অসীম ত্রি-মাত্রিক মহাবিশ্ব চতুর্থ মাত্রায় ভাসতে ভাসতে ধাক্কা খেয়েছিল যা কিনা স্থান-কালের প্রসারণের সৃষ্টি করেছিল। সেটাও এক ধরণের বিগ ব্যাং।] সাধারণতঃ পাঠ্যবইএ বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রবন্ধে এই ছবিটা ঠিকমত দেয়া হয় না, তার একটা কারণ অবশ্য এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই একটু দ্বিধান্বিত আছেন, অসীম স্থানে বিস্তৃত আদি মহাবিশ্বের ধারণাটা বোধগম্য নয়।