ভারতীয় উপমহাদেশের যে কোন বিজ্ঞান-শিক্ষার্থীই স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন বা সি ভি রামনের নাম শুনেছেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘রামন ইফেক্ট (Raman Effect)’ বা ‘রামন-প্রভাব’ পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক আশ্চর্য মাইলফলক হয়ে আছে ১৯২৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে – যেদিন এই আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। রামন-প্রভাব আবিষ্কারের জন্য সি ভি রামন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩০ সালে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে তিনিই হলেন বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী। তাঁর নোবেল-বিজয়ী গবেষণার সবটুকুই সম্পন্ন হয়েছিল কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স’ এর ছোট্ট একটা গবেষণাগারে। এই গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি সংযোজন, সংরক্ষণ ও পরীক্ষণের কাজে তাঁকে যিনি সারাক্ষণ সহায়তা করেছিলেন তাঁর নাম আশুতোষ দে – আশুবাবু নামেই যিনি পরিচিত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই আশুবাবু জীবনে কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার সুযোগ পান নি। অবশ্য গবেষণার ক্ষেত্রে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না সি ভি রামনেরও। তাই তাঁর কোন গবেষণা-শিক্ষকও ছিলেন না। গবেষণার ক্ষেত্রে নিজেকেই নিজের পথ খুঁজে নিতে হয়েছিল রামনকে। আর তাঁর এই পথ-খোঁজা শুরু হয়েছিল একেবারে ছোটবেলা থেকেই।

স্যার সি ভি রামন

১৮৮৮ সালের ৭ই নভেম্বর তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীর কাছে তিরুভানাইকাভাল নামে ছোট্ট একটা গ্রামে মামার বাড়ীতে রামনের জন্ম। রামনের বাবা রামানাথন চন্দ্রশেখরন ছিলেন তাঞ্জোর জেলার এক বেশ স্বচ্ছল বনেদী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। প্রচুর চাষবাসের জমি ছিল তাঁদের। চন্দ্রশেখরন জমির দেখাশোনা করে প্রচুর অর্থ-উপার্জন করে আরামেই দিন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি জ্ঞানার্জনের পথ বেছে নিলেন। মাধ্যমিক পাশ করার পর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার আগেই বিয়ে করলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত সপ্তর্ষী শাস্ত্রীর মেয়ে পার্বতী আম্মালকে। তারপর ত্রিচিনোপলির এস-পি-জি (সোসাইটি ফর দি প্রমোশান অব দি গসপেল) কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে বিএ-তে ভর্তি হলেন। কিন্তু বিএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই গ্রামের কাছাকাছি একটা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। চন্দ্রশেখরন ও পার্বতী আম্মালের মোট আটটি সন্তান। পাঁচটি ছেলে ও তিনটি মেয়ের মধ্যে রামন দ্বিতীয়। রামনের জন্মের তিন বছর পর ১৮৯১ সালে চন্দ্রশেখরন এস-পি-জি কলেজ থেকে বি-এ পাশ করে ওই কলেজেই পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক নিযুক্ত হলেন।

দক্ষিণ ভারতে ছেলেমেয়েদের নামকরণের নিয়ম একটু অন্যরকম। এখানে সাধারণত এক শব্দের একটা নাম দেয়া হয়, কোন পদবী থাকে না। নামের আগে বাবার নামটাও জুড়ে দেয়া হয়। তিরুপতি মন্দিরের দেবতা ভেঙ্কটরামনের নামানুসারে রামনের নাম রাখা হয়েছিল ভেঙ্কটরামন। বাবা চন্দ্রশেখরনের নাম যুক্ত হয়ে পুরো নাম হলো চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন। পরবর্তীতে ভেঙ্কটরামন দুটো শব্দে বিভক্ত হয়ে ভেঙ্কট রামন হয়ে যায়। আরো পরে সি ভি রামন।

রামনের বয়স যখন চার বছর তখন তাঁর বাবা চন্দ্রশেখরন বিশাখাপত্তনমের এ ভি নরসীমা রাও কলেজে প্রভাষকের চাকরি নিয়ে চলে আসেন ত্রিচিনোপলি থেকে। সেখানে তিনি পড়াতেন পদার্থবিদ্যা, গণিত আর প্রাকৃতিক ভূগোল। ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল তাঁর। খুব ভালো বেহালা বাজাতেন। খেলাধূলাতেও খুব আগ্রহ ছিল চন্দ্রশেখরনের। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ছেলে ভেঙ্কট রামনের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ রোগা। তবে শরীর যতই খারাপ হোক, লেখাপড়ায় রামনের জুড়ি নেই। স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়িতে তার বাবার পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনের মোটা মোটা বই পড়তে শুরু করে দিয়েছে ছোট্ট রামন। স্কুলের পরীক্ষায় বিস্ময়কর ভালো ফলাফল করতে শুরু করেছে রোগা রামন।

মাত্র এগারো বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করে বাবার কলেজেই এফ-এ বা উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে ভর্তি হলেন। তেরো বছর বয়সে এফ-এ পাশ করে স্কলারশিপ পেয়ে ভর্তি হলেন মাদ্রাজের বিখ্যাত প্রসিডেন্সি কলেজে। চোঙার মত করে পরা ধুতি, মাথায় ছোট্ট একটা টুপি, খালি-পা রোগা-পটকা কুচকুচে কালো তেরো বছরের এ বালককে বি-এ ক্লাসে বসে থাকতে দেখে শুরুতে কিছুটা রেগেই গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপক। প্রশ্ন করলেন, “খোকা, তুমি কি ভুল করে স্কুলের বদলে কলেজের ক্লাসে চলে এসেছো?” ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল। ক্লাসের সব শিক্ষার্থীই চেনে এই তুখোড় ছাত্রটিকে। অধ্যাপকদেরও সময় লাগলো না রামনের মেধার পরিচয় পেতে। কিছুদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকরা বুঝতে পারলেন এমন মেধাবী ছাত্র তাঁরা তাঁদের শিক্ষকতা জীবনে আগে দেখেননি কখনো [1]। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক অধ্যাপক বুঝতে পারলেন রামনকে নতুন কিছু শেখানোর মত যথেষ্ট বিদ্যা তাঁদের ঘটে নেই।

পনের বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বিএ পাশ করলেন রামন। পদার্থবিজ্ঞান ও ইংরেজিতে কৃতিত্বের জন্য স্বর্ণপদক পেলেন। এমএ-তে ভর্তি হলেন পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে। ব্যবহারিক ক্লাসে স্পেক্ট্রোমিটারের সাহায্যে প্রিজমের কোণের পরিমাপ করতে গিয়ে রামন আলোকের কিছু ব্যতিক্রমী বর্ণালী লক্ষ্য করেন। এ বর্ণালীগুলো সম্পর্কে কোন রকম ধারণা তিনি কোন বইতে পেলেন না। নিজে নিজে আরো কিছু পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল একটা গবেষণাপত্র আকারে লিখে পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনের ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে। এম-এ পাশ করার আগেই ১৯০৬ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো সি ভি রামনের প্রথম গবেষণাপত্র “আনসিমেট্রিক্যাল ডিফ্রাক্‌শান-ব্যান্ডস ডিউ টু এ রেক্ট্যাঙ্গুলার এপার্চার” [2]। রামনের বয়স তখন মাত্র আঠারো। প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন সুযোগ তখন ছিল না। রামন নিজের চেষ্টাতেই কলেজের গবেষণাগারে গবেষণা করে তাঁর গবেষণা-পত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন।

স্বর্ণপদক নিয়ে বিএ পাশ করার পরপরই রামনের অধ্যাপকেরা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বিলেতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসতে। এত ভাল রেজাল্ট করেছেন তিনি, বিদেশে পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ পেতে কোন অসুবিধে হবার কথা নয়। রামনেরও ইচ্ছে ছিল বিলেত যাবার। কিন্তু বাধ সাধলো তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য। মাদ্রাজের সিভিল সার্জন তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সরাসরি বলে দিলেন বিলেতের প্রতিকূল আবহাওয়ায় গিয়ে পড়লে রামনকে আর বেঁচে থাকতে হবে না। ১৯০৬ সালে এম-এ পরীক্ষা হয়ে গেলো। ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেলো প্রত্যাশিত ভাবেই রামন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম-এ পাশ করেছেন।

এবার? রামনের মন-প্রাণ পড়ে আছে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়। কিন্তু তখনকার ব্রিটিশ ভারতে গবেষকের কোন চাকরি নেই। বিলেতে যেতে পারলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তা তো সম্ভব নয়। অধ্যাপকেরা পরামর্শ দিলেন সরকারি চাকরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিতে। রামনের যে মেধা তাতে অনায়াসেই তিনি আই-সি-এস অফিসার হতে পারতেন। কিন্তু আইসিএস পরীক্ষা দিতে হলে বিলেতে যেতে হবে যা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। আই-সি-এস অফিসারের পরেই যে সরকারী চাকরিটার মান ও বেতন – তা হলো ফাইন্যান্সিয়াল সিভিল সার্ভিস বা এফ-সি-এস। সরকারের অর্থবিভাগের অফিসার নিয়োগের এ পরীক্ষা ভারতেই হয়। পদার্থবিজ্ঞানের সাথে কোন রকম সম্পর্ক থাকবে না জেনেও রামন পরীক্ষা দিলেন। এফ-সি-এস পরীক্ষায় যে সব বিষয়ে পরীক্ষা হয় – যেমন ইতিহাস, অর্থনীতি ইত্যাদি – রামন আগে পড়েননি খুব একটা। পরীক্ষা দেয়ার পর রামন তাঁর ভাই রামস্বামীকে বলেছিলেন “যারা পরীক্ষা দিতে এসেছিল তাদের দিকে এক নজর তাকিয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমিই প্রথম হবো” [3]। কথাটাতে হয়তো রামনের তীব্র অহংবোধ প্রকাশ পেয়েছে – কিন্তু রামন ঠিকই প্রথম হয়েছিলেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই সি ভি রামন সহকারী একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের পদে নিযুক্ত হলেন। প্রথম কর্মস্থল কলকাতা।

ইতোমধ্যে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে রামনের সাথে দেখা হয় লোকসুন্দরীর। তেরো বছরের কিশোরী লোকসুন্দরী তখন বীণা বাজাচ্ছিলেন। রামনের পরিবারে সংগীতের আবহ ছিল, বাবা বেহালা বাজাতেন, নানারকম ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ আছে বাড়িতে। রামন মুগ্ধ হয়ে গেলেন লোকসুন্দরীর বীণাবাদন শুনে। ঠিক করলেন লোকসুন্দরীকে বিয়ে করবেন। তখনকার দিনে নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া ছিল রীতিমত সামাজিক বিপ্লবের সমতুল্য। লোকসুন্দরী অবশ্য পরবর্তীতে কিছুটা ঠাট্টাচ্ছলে বলেছেন যে রামন অনেক হিসেব করেই তাঁকে বিয়ে করেছিলেন [1]। কারণ তখন বিবাহিত এফ-সি-এস অফিসাররা বেতনের সাথে আরো দেড়শো রুপির একটা পারিবারিক বোনাস পেতেন। তখনকার দিনে দেড়শ’ রুপির মূল্য অনেক। চাকরিতে যোগ দেয়ার আগে ১৯০৭ সালের ৬ই মে বিয়ে হয়ে গেলো রামন আর লোকসুন্দরীর।

১৯০৭ সালের জুন মাসে রামন স্ত্রী লোকসুন্দরীকে নিয়ে কলকাতায় এলেন কাজে যোগ দিতে। বাসা নিলেন বউবাজারের কাছে স্কটস লেনে। ট্রামে চড়ে অফিসে যান। কলকাতায় নতুন এসেছেন – তাই ট্রাম থেকে যতদূর দেখা যায় রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে অফিসে পৌঁছে যান। কাজে যোগ দেয়ার ছয়-সাত দিন পরে একদিন এরকম অফিস যাওয়ার পথে চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড – যাতে লেখা আছে “ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স। ২১০ বউবাজার স্ট্রিট, কলকাতা”। রামনের কোন ধারণা নেই এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে। কিন্তু কৌতূহল সীমাহীন। ‘কাল্টিভেশান অব সায়েন্স’ – বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধনে ব্রতী হতেই তো চান তিনি। সেদিনই অফিস থেকে ফেরার পথে ট্রাম থেকে নেমে গেলেন সেখানে।

‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স’ বা আই-এ-সি-এস এর কিছুটা পরিচয় এখানে দেয়া যাক। ভারতের মাটিতে আধুনিক বিজ্ঞানের বীজ রোপিত হয় বিদেশিদের দ্বারা- তাঁদের নিজেদের স্বার্থে [4]। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানের সাবালকত্ব অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভারতে স্বদেশি বিজ্ঞান গবেষণার গোড়াপত্তন করতে চেয়েছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যার অনুপ্রেরণা হবে লন্ডনের রয়েল ইনস্টিটিউশন এবং ব্রিটিশ এসোসিয়েশান ফর দি এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স। বিদেশি শাসকদের অর্থানুকুল্যে নয়, শুধু দেশবাসীর দরাজ অনুদানেই তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে গবেষণা করার জন্য লাগবে না কোন ডিগ্রির তকমা, শুধু বিজ্ঞানে ভালবাসাই হবে যোগ্যতা। ১৮৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় আই-এ-সি-এস। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখা ছিল – “যাঁহারা এক্ষণে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়াছেন, অথচ বিজ্ঞানশাস্ত্র অধ্যয়নে একান্ত অভিলাষী আছেন, কিন্তু উপায়াভাবে সে অভিলাষ পূর্ণ করিতে পারিতেছেন না এইরূপ ব্যক্তিগণকে বিজ্ঞানচর্চা করিতে আহ্বান করা হইবে” [5]। আশা করা হয়েছিল স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিত্তবান ভারতীয়রা নিশ্চয়ই এ শুভ কাজে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু সে আশা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও এ প্রতিষ্ঠানের জন্য আশানুরূপ অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন নি। বিজ্ঞান গবেষণায় বাঙালির কৃপণতা লক্ষ্য করে ১৯০০ সালে লর্ড কার্জনও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন – “বাংলাদেশে তো ধনী পৃষ্ঠপোষকের অভাব নেই। তবে তাঁরা কেন এরকম মহৎ প্রয়াসে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন না?” [4]। ১৯০৪ সালে মহেন্দ্রলাল সরকার মারা যান। জীবনের শেষবেলায় মহেন্দ্রলাল ছিলেন আশাভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত। একটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট অর্থসাহায্য জোগাড় করা গেলো না। বড়ই দুঃখে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে বিজ্ঞান-সভা স্থাপনা করার চিন্তাই ছিল ভুল। সমস্ত জীবনে এক মরীচিকার পিছনে ছুটে বেড়ালেন। তার চেয়ে ডাক্তারিতে মন দিলে হয়তো গত তিরিশ বছরে যে অর্থ সংগৃহীত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি তিনিই উপার্জন করতে পারতেন। মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যুর পর আই-এ-সি-এস এর পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তাঁর ভাইপো অমৃতলাল সরকার।

রামন যখন আই-এ-সি-এস এর দরজায় এলেন তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কলিং বেল টেপার অনেকক্ষণ পর ধূতি-ফতুয়া পরা একজন লোক এসে দরজা খুলে দিলেন। ইনিই আশুতোষ দে – রামনের প্রিয় আশুবাবু যিনি পরবর্তী পঁচিশ বছর রামনের সাথে পরীক্ষাগারে কাজ করেছেন। আশুবাবু রামনকে নিয়ে গেলেন অমৃতলাল সরকারের কাছে। করিডোর দিয়ে যাবার সময় রামনের চোখে পড়ল মাঝারি আকারের একটা লেকচার হল – যার চেয়ার টেবিলে ধূলো জমে আছে। একটা ল্যাবোরেটরি আছে – সেটারও ছন্নছাড়া অবস্থা। সামান্য যে ক’টা যন্ত্রপাতি আছে তাতেও পুরো ধূলোর আস্তরণ। অমৃতলাল সরকারের কাছে এসোসিয়েশানের উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপের ব্যাপারে জানার পর রামনের মনে হলো – এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। রামনের উৎসাহ দেখে ভীষণ খুশি হলেন অমৃতলাল। এতদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠান তো রামনের মতো তরুণ বিজ্ঞানীর পথ চেয়েই ছিল। অমৃতলাল সরকার রামনের হাতে তুলে দিলেন এসোসিয়েশানের চাবি – যখন খুশি যতক্ষণ খুশি এসোসিয়েশানে গবেষণা করার অধিকার।

কাজ শুরু করলেন রামন। ঝড়ের মতো কাজের গতি তাঁর। তাঁর দৈনন্দিন রুটিন মোটামুটি এরকমঃ ভোর সাড়ে পাঁচটায় এসোসিয়েশানে এসে গবেষণা শুরু করেন, পৌনে দশটায় বাসায় এসে দ্রুত স্নান সেরে গপাগপ কিছু খেয়ে ট্যাক্সি চড়ে অফিসে চলে যান। ট্রামে যেতে অনেক সময় লাগে বলেই সময় বাঁচানোর জন্য এই ব্যবস্থা। পাঁচটায় অফিস ছুটির পর বাসায় না এসে সোজা চলে যান এসোসিয়েশানের ল্যাবে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ন’টা থেকে দশটা বেজে যায়। রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনের পুরোটাই কাটে এসোসিয়েশানের ল্যাবে। বিয়ে হয়েছে দু’মাসও হয়নি অথচ এর মধ্যেই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো ঘন্টা রামন ঘরের বাইরে থাকেন। স্ত্রী লোকসুন্দরী শুরুতে মান-অভিমান করলেও বুঝতে পারলেন রামনের কিছুই যায় আসে না তাতে। রামনের কাছে বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার তুলনায় লোকসুন্দরী বা ঘর-সংসার নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। পরবর্তী তেষট্টি বছরের বিবাহিত জীবনে লোকসুন্দরী প্রতিদিনই তাঁর স্বামীকে তুলনা করেছেন সাইক্লোনের সাথে – যাকে বেঁধে রাখা যায় না। রামন ও লোকসুন্দরী দম্পতির দুটো ছেলে – চন্দ্রশেখর ও রাধাকৃষ্ণন।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে বিজ্ঞানের প্রতি এত যার ভালবাসা – এসিস্ট্যান্ট একাউন্ট জেনারেল হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? অর্থবিভাগে বেশ সুনামের সাথে কাজ করছিলেন রামন। এ যেন তাঁর দুটো সম্পূর্ণ আলাদা স্বত্ত্বা। অর্থনীতিতে তাঁর দক্ষতার জন্য চাকরি জীবনের চার বছরের মাথায় তিনি প্রমোশন পেয়ে ডেপুটি একাউন্ট্যান্ট জেনারেল হয়েছিলেন। আরো দ্রুত উপরে উঠে যেতে পারতেন তিনি – কিন্তু কলকাতার বাইরে যেতে হবে – এসোসিয়েশানের ল্যাবোরেটরি থেকে দূরে থাকতে হবে – তাই রামন এড়িয়ে গেছেন চাকরিতে উন্নতির অনেক সোপান। এসোসিয়েশানে গবেষণা শুরু করার পর দু’বছর কলকাতার বাইরে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯০৯ সালে রেঙ্গুনে ও ১৯১০ সালে নাগপুরে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও সে দু’বছর তিনি নিজের বাসাকেই ল্যাবোরেটরি বানিয়ে ফেলেছিলেন – তবুও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন ১৯১১ সালে আবার কলকাতায় বদলি হয়ে ফিরে এসে।

১৯০৭ থেকে শুরু করে পরবর্তী দশ বছরে আলোক তরঙ্গ, শব্দ-তরঙ্গ, পদার্থের পৃষ্ঠতান, সুর-যন্ত্রের বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা করে পয়ত্রিশটি গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেন। এসোসিয়েশানে তাঁর একমাত্র সহকারী ছিলেন আশুবাবু। কয়েকটি গবেষণা-পত্রে সহ-লেখক হিসেবে আশুবাবুর নামও আছে। শুধু তাই নয়, রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ একটা গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয়েছে যার একমাত্র লেখক আশুতোষ দে অর্থাৎ আশুবাবু। আশুবাবুর পেপার পড়ে কেউ ধারণাও করতে পারবেন না যে তিনি কোনদিন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি।

দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা-পত্র প্রকাশের জন্য কোন জার্নাল নেই। দেশের বাইরে পাঠালে প্রকাশিত হতে অনেক সময় লেগে যায়। রামন উদ্যোগ নিয়ে এসোসিয়েশানের বুলেটিন প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন। এই বুলেটিনে তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন নিয়মিত ভাবে। ১৯১৭ সালে এই বুলেটিন প্রসিডিংস-এ পরিণত হয় এবং আরো পরে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’-এ রূপান্তরিত হয়।

রামনের গবেষণার বেশির ভাগ সমস্যাই দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ফসল। যেমন তাঁর বাবা যখন বেহালা বাজাতেন – তিনি তারের ওপর সুরের কাজ লক্ষ্য করেছেন। কলেজে পড়ার সময় কাজ করেছেন সনোমিটার নিয়ে, শব্দ সংক্রান্ত মেল্‌ডির পরীক্ষা। এ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রামন করেছেন টানা তারের কম্পন, শব্দের ব্যাতিচার, আলোক তরঙ্গের সাথে তাপের সম্পর্ক, উত্তপ্ত পদার্থ থেকে নির্গত শব্দের তরঙ্গ সহ আরো অনেক নতুন নতুন পরীক্ষা। তাঁর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত জার্নাল নেচার ও ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে।

ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সুর নিয়ে বিশেষ করে বীণা, তানপুরা, চেলো, মৃদঙ্গ ইত্যাদিতে সৃষ্ট সুর ও শব্দ সম্পর্কে অনেক গবেষণা করেছেন রামন। বীণার তারে যে প্রায় মানুষের গলার স্বরের মত সুর সৃষ্টি করা যায় – তার কি কোন ভৌত-বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে, নাকি তার পুরোটাই মনোবৈজ্ঞানিক? রামন পরীক্ষা করে দেখলেন যে বীণার তারের ব্রিজগুলো এমন কৌশলে স্থাপন করা হয় যাতে হেল্‌মহোল্টজের নীতি (Helmholtz law) অনুসৃত হয় না। হেল্‌মহোল্টজের নীতি অনুসারে বীণার তারের যে জায়গায় টোকা দেয়া হয় – সে জায়গায় কোন অপসুর (node) সৃষ্টি হতে পারে না। বীণার তারে যেহেতু এ নীতি চলে না – সেখানে কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিপুল সুর সৃষ্টি হয়। তাই বীণার তারে মানুষের গলার স্বরের কাছাকাছি সুর সৃষ্টি হতে পারে। বীণার পর মৃদঙ্গ আর তবলার তাল নিয়ে গবেষণা করলেন রামন। তাঁর গবেষণা-পত্রে তিনি দেখালেন যে তবলা বা মৃদঙ্গের মত বাদ্যযন্ত্রও বিশেষ অবস্থায় তারের যন্ত্রের মত সুর সৃষ্টি করতে পারে। বাদ্যযন্ত্রের ওপর রামন এত গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেছেন যে কালক্রমে তিনি এ বিষয়ের ‘ওয়ার্ল্ড অথরিটি’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন।

ইতোমধ্যে ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য টাকা দিয়েছেন তারকনাথ পালিত, রাসবিহারী ঘোষ প্রমুখ। উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির আহ্বানে রসায়ন বিভাগে যোগ দিয়েছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ‘রাসবিহারী ঘোষ প্রফেসর’ পদে যোগ দিয়েছেন দেবেন্দ্র মোহন বসু। প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন এক ঝাঁক তরুণমুখ – সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন ঘোষ, জ্ঞান ঘোষ, যোগেশ মুখার্জি প্রমুখ। ‘পালিত প্রফেসর’ পদের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজছিলেন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি। অনেক পি-এইচ-ডি, ডি-এস-সি সম্পন্ন প্রার্থী দরখাস্ত করছিলেন ওই পদের জন্য। কিন্তু কাউকেই উপযুক্ত মনে হচ্ছিল না স্যার আশুতোষের। তাঁর চোখ তখন সি ভি রামনের প্রতি। সেই ১৯০৭ সাল থেকেই স্যার আশুতোষ মুখার্জি রামনকে দেখছেন আই-এ-সি-এস এ নিরলস পরিশ্রম করতে। দেখছেন রামন কীভাবে একাই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে অনবরত গবেষণা-পত্র প্রকাশ করে চলেছেন। ১৯১৭ সালে স্যার আশুতোষ মুখার্জি সি ভি রামনকে আহ্বান করলেন বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের ‘পালিত প্রফেসর’ পদে যোগ দেয়ার জন্য।

রামন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অর্থবিভাগের চাকরিতে তাঁর উন্নতি হয়েছে অনেক। ডেপুটি একাউন্ট্যান্ট জেনারেল থেকে একাউন্ট্যান্ট জেনারেল হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভাইসরয় কাউন্সিলের ফিন্যান্স মেম্বারও হয়ে যেতে পারেন। যে উচ্চ-বেতন তিনি পাচ্ছেন তাতে নিজের খরচেই গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পদে যে বেতন তাঁকে দেয়া হবে তা তাঁর বর্তমান বেতনের অর্ধেকের চেয়েও কম। কিন্তু রামন বেতন নিয়ে ভাবছেন না, ভাবছেন তাঁর গবেষণার কথা, ভাবছেন এসোসিয়েশানে যে সময়টা তিনি দিচ্ছেন তা দিতে পারবেন কি না। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি কিছু শর্ত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানালেন। তাঁর শর্তের মধ্যে ছিল – তিনি কোন ক্লাস নেবেন না, কোন গবেষণা-ছাত্র নেবেন না, এসোসিয়েশানের সাথে তাঁর সম্পর্ক অপরিবর্তিত থাকবে ইত্যাদি। ‘পালিত প্রফেসর’ পদটা ছিল মূলত গবেষণা প্রফেসর পদ। কিন্তু সেই পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীর বিদেশি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকা অত্যাবশ্যক ছিল। রামনের বিদেশী কোন ডিগ্রি নেই। কিন্তু বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যাঁকে উপযুক্ত মনে করছেন তাঁর ক্ষেত্রে কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। সিন্ডিকেট সি ভি রামনের দেয়া সব শর্ত মেনে নিয়ে তাঁকে পদার্থবিজ্ঞানের ‘পালিত প্রফেসর’ হিসেবে নিয়োগ দিলেন।

১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিয়ে প্রফেসর সি ভি রামনের নতুন জীবন শুরু হলো। আগে দৈনিক প্রায় আট ঘন্টা সময় গবেষণার বাইরে থাকতে হতো। এখন সেই আট-ঘন্টাও যোগ হলো তাঁর গবেষণার সময়ের সাথে। টানা পনেরো বছর ছিলেন তিনি এই পদে। গবেষণা-ছাত্র নেবেন না ঠিক করলেও আস্তে আস্তে অনেক ছাত্র-গবেষক জুটে গিয়েছিল তাঁর। কে এস কৃষ্ণান, বিনয় ভূষণ রায়, কেদারেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, শেসাগিরি রাও প্রমুখ গবেষণা করেছেন এ সময় রামনের তত্ত্বাবধানে।

১৯১৯ সালে অমৃতলাল সরকারের মৃত্যুর পর আই-এ-সি-এস এর সেক্রেটারি নির্বাচিত হন রামন। বিশ্ববিদ্যালয় এবং এসোসিয়েশানের দুটো গবেষণাগারের সব দায়িত্ব তাঁর হাতে। সমানে চলছে গবেষণার কাজ।

১৯২১ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হলো ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি কংগ্রেস। স্যার আশুতোষ মুখার্জির বিশেষ অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে যোগ দিলেন রামন। এটাই রামনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। কয়েক দিনের এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণেই তাঁর সাথে দেখা হলো থমসন, রাদারফোর্ড, ব্র্যাগ সহ আরো অনেক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর। একটি অধিবেশনে রামন বসেছিলেন হলের পেছনের দিকে। একটু পরে সামনের সারি থেকে স্বয়ং রাদারফোর্ড উঠে দাঁড়িয়ে রামনকে ডেকে নিয়ে যত্ন করে নিজের পাশে বসালেন। এত বড় বিজ্ঞানীর এমন উদারতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন রামন।

অন্যান্য ট্যুরিস্টদের মত রামনও লন্ডন শহরের বিভিন্ন দ্রষ্টব্য ঘুরে ঘুরে দেখলেন। সেন্ট পল’স ক্যাথেড্রাল দেখতে গেলেন। ক্যাথেড্রালের হুইস্পারিং গ্যালারিতে গিয়ে মুগ্ধ হবার পাশাপাশি দ্রুত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে ফেললেন। পরে দুটো গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেছেন এর ওপর। একটা প্রকাশিত হয়েছে নেচার জার্নালে, অন্যটি রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ।

জাহাজে করে লন্ডনে যাওয়া আসার পথে বিশাল সমুদ্রের রূপ দেখে মুগ্ধতার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো রামনের মন। গভীর সমুদ্রের রঙ দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলো এই ঘন নীল রঙের প্রকৃত রহস্য কী? ইতিপূর্বে লর্ড রেলেই আকাশের নীল রঙের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন অণুর সাথে আলোর কণার বিক্ষেপণের ফলে নীল বর্ণের আলোক তরঙ্গ বেশি দেখা যায় বলেই দিনের বেলায় আকাশের রঙ নীল। সমুদ্রের নীল রঙ সম্পর্কে লর্ড রেলেইর তত্ত্ব বেশ সরল। তাঁর মতে সমুদ্রের রঙ আসলে সমুদ্রের জলে আকাশের রঙের প্রতিফলন। রামন লর্ড রেলেইর এ-তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত করেন জাহাজে বসে করা কয়েকটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে। একটি পোলারাইজিং প্রিজমের মাধ্যমে সমুদ্রের জলে আকাশের প্রতিফলন আড়াল করার পরেও দেখা গেলো সমুদ্রের পানির রঙ ঘন নীল – যেন পানির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নীল রঙ। ফলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সমুদ্রের পানির নীল রঙ আকাশের রঙের প্রতিফলন নয়, পানিতে আলোক কণার বিক্ষেপণের ফল। তিনি সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতা থেকে পানি সংগ্রহ করে বোতল ভর্তি করে নিয়ে আসেন কলকাতায়। প্রিজম, টেলিস্কোপ ইত্যাদি নিয়ে গভীর সমুদ্রে রঙের খেলা পর্যবেক্ষণ করতে করতে অনেক উপাত্ত সংগ্রহ করেন রামন। কলকাতায় ফিরে এসে তরল পদার্থে এক্স-রে এবং দৃশ্যমান আলোকের বিক্ষেপণ সংক্রান্ত গবেষণায় মেতে ওঠেন তিনি।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ছাত্র শেসাগিরি রাওয়ের সহযোগিতায় রামন পানিতে আলোর আণবিক বিক্ষেপণের তীব্রতা পরিমাপ করেন। তাঁদের পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয় যে আইনস্টাইন-স্মোলুকাউস্কি’র তাপগতির পরিবর্তন সংক্রান্ত ধারণার সাহায্যে আণবিক বিক্ষেপণের গাণিতিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। ১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গবেষণা-পত্র “দি মলিকিউলার ডিফ্রাক্‌শান অব লাইট” [6]। ১০৩ পৃষ্ঠার এই বিশাল গবেষণা-পত্রে রামন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে আলোর বিক্ষেপণের ঘটনা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রামনের গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান করে। রামন তাঁর গবেষণা-পত্রে আলোর সাথে তরলের অণুর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট বিক্ষেপণের যে ব্যাখ্যা দেন তার সাথে আর্থার কম্পটনের ‘কম্পটন ইফেক্ট’-এর অনেক মিল আছে। কিন্তু রামন যখন এ ব্যাখ্যা দেন ‘কম্পটন ইফেক্ট’ তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কম্পটন ইফেক্ট – (যা তড়িৎচুম্বক কণা ফোটনের সাথে ইলেকট্রনের সংঘর্ষের ফলে ফোটন ও ইলেকট্রনের শক্তির তারতম্যের হিসেব দেয়) – আবিষ্কৃত হয় পরের বছর ১৯২৩ সালে। কম্পটন ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য আর্থার কম্পটন নোবেল পুরষ্কার পান ১৯২৭ সালে।

১৯২৩ সালের এপ্রিলে রামনের তত্ত্বাবধানে তাঁর ছাত্র রামনাথন পানির মধ্য দিয়ে আলোর বিক্ষেপণের অনেকগুলো জরুরি পরীক্ষা করেন। পানির মধ্যদিয়ে সূর্যালোক প্রবেশ করিয়ে বিপরীত দিক থেকে আলোর গতিপথ পর্যবেক্ষণ করা হয়। বিভিন্ন রকমের ফিল্টার ব্যবহার করে আলোর গতিপথ আলাদা করা হয়। পানিতে প্রবেশ করার পর যদি আলোর শক্তির কোন পরিবর্তন না হয়, তাহলে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘের কোন পরিবর্তন হবে না এবং আলোর বর্ণালীতে কোন পরিবর্তন দেখা যাবে না। কিন্তু আলোর বর্ণালীতে পরিবর্তন দেখা গেলো। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল যে পানি ঠিকমত বিশুদ্ধ না হবার কারণে এরকম হচ্ছে। কিন্তু খুবই পরিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করার পরেও একই ফল পাওয়া গেল। কে এস কৃষ্ণান তখন সবে যোগ দিয়েছেন রামনের গবেষণা-ছাত্র হিসেবে। তিনি শুরু করলেন বেন্‌জিন, গ্লিসারিন ইত্যাদি বিভিন্ন রকম তরলের মধ্য দিয়ে আলোর এই বিক্ষেপণের পরীক্ষণ।

১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে সি ভি রামনের নাম প্রস্তাব করা হয় রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য। গবেষণা ও প্রকাশিত গবেষণা-পত্রের ভিত্তিতে তাঁকে ফেলোশিপ দেয়া হয় ১৯২৪ সালের ১৫ নভেম্বর [7]। তরলে আলোক বিক্ষেপণের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে এসোসিয়েশানের গবেষণাগারে। ১৯২৭ পর্যন্ত চললো নানারকম পরীক্ষা। রামন হিসেব করে দেখেছেন যে দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গের ক্ষেত্রে সত্যিকারের কম্পটন এফেক্ট দেখা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার দৃশ্যমান আলোর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের (যেমন এক্স-রে)। আণবিক বিক্ষেপণ পরীক্ষার জন্য কম্পটনের হিসেবে কিছু পরিবর্তন করা দরকার। রামন সেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তনটুকু করে ফেললেন অনেকদিনের নিরলস পরিশ্রমের পর। পরবর্তীতে তা ‘কম্পটন-রামন ফর্মুলা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে [1]।

১৯২৮ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুটো মাস রামনের গবেষণাগারে প্রায় ‘ঘূর্ণিঝড়’ বয়ে গেলো। ভেঙ্কটেশ্বরণ গ্লিসারিন বিশুদ্ধ করে তার ভেতর দিয়ে আলোর বিক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যেখানে নীল বর্ণালী পাওয়ার কথা সেখানে হালকা সবুজ বর্ণালী পাওয়া যাচ্ছে যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য নীল বর্ণালীর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বড়। তার মানে আলো কিছুটা শক্তি হারাচ্ছে। আলোর বিকিরণে নতুন তত্ত্বের সম্ভাবনা পরিষ্কার। কিন্তু ভেঙ্কটেশ্বরণ ছিলেন খন্ডকালীন ছাত্র – কাজ করতেন অফিস ছুটির পর এবং ছুটির দিনে। রামন চাইলেন এমন কাউকে কাজটা দিতে যিনি দিনের আলোর পুরুটাই পরীক্ষণের কাজে লাগাতে পারবেন। ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয়ার সময় ক্লাস নেবেন না ঠিক করলেও রামন দেখেছেন তাঁর রিসার্চ-লেকচারগুলো শিক্ষার্থীরা দারুণ উপভোগ করে। তাই তিনি নিয়মিত ক্লাস নেয়া শুরু করেছেন। ফলে গবেষণার সময় থেকে কিছুটা সময় কম পড়ছে। রামন তাঁর সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র কে এস কৃষ্ণানকে বললেন তাঁর পুরো সময়টা এই গবেষণায় দেয়ার জন্য। কৃষ্ণান তখন সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের তত্ত্বীয় দিক নিয়ে গবেষণা করছিলেন।

রামনের নির্দেশনা অনুযায়ী জৈব তরল ও বাষ্পের মধ্যে আলোর বিক্ষেপণের ফলে বর্ণালীর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সেট করলেন এবং পরীক্ষণ শুরু করলেন। চমৎকার ফল পাওয়া যেতে শুরু করলো। রামন ভীষণ উৎকন্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে সবকিছু তদারকি করছেন। ফেব্রুয়ারির সাত তারিখ থেকে ষোল তারিখের মধ্যে রামন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে তাঁদের এতদিনের গবেষণা ‘ক্রেমার্স-হাইজেনবার্গ পদ্ধতি’র সাথে সংশ্লিষ্ট। ফোটন ও ইলেকট্রনের বিক্ষেপণের পরিমাণ হিসেব করার একটি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেন হেনড্রিক ক্রেমার্স ও ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ১৯২৫ সালে। রামন দেখলেন সে হিসেব তাঁর প্রাপ্ত উপাত্তের বেলাতেও প্রয়োগ করা যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে তিনি নেচার জার্নালে এ সংক্রান্ত ছোট্ট একটা নোট পাঠিয়ে দেন।

ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ রামন ঠিক করলেন বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের (spectroscope) সাহায্যে আলোর বিক্ষেপণে পরিবর্তিত বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করবেন। এসোসিয়েশানের ল্যাবোরেটরিতে আশুবাবু সারাদিন ধরে যন্ত্রপাতি সেট করলেন। সবকিছু ঠিকঠাক করতে করতে সূর্য ডুবে গেল। সূর্যালোকের অভাবে সেদিন আর কিছু করা গেলো না। পরদিন ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে সূর্য ওঠার পর পরই শুরু হলো পর্যবেক্ষণ। একটু পরেই দেখা গেলো নির্দিষ্ট বর্ণের আলোর বর্ণালীর পাশে আরেকটি ভিন্ন বর্ণের আলোক রেখা – “রামন রেখা”। আবিষ্কৃত হলো ‘রামন ইফেক্ট’। আশুবাবু একটা মার্কারি আর্ক সেট করলেন যেখান থেকে পাওয়া গেল এক বর্ণের উজ্জ্বল সাদা আলোক রেখা। এই আলোতে নীল বর্ণের তরঙ্গদৈর্ঘের চেয়ে লম্বা অন্যসব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রেখা ঢাকা পড়ে যাবার কথা। ঢাকা পড়ে গেলো ঠিকই – কেবল নীল-সবুজ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমানায় দুটো নতুন রেখা ছাড়া। এই নতুন রেখা সৃষ্টি হয়েছে যে বিক্ষেপণের প্রভাবে তার নাম দেয়া হলো ‘রামন ইফেক্ট’।

পরদিন ১৯২৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সারা পৃথিবী জেনে গেলো ‘রামন ইফেক্ট’ আবিষ্কৃত হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো ‘নিউ থিওরি অব রেডিয়েশান’। মার্চের আট তারিখে নেচার জার্নালে পাঠানো হলো ‘রামন ইফেক্ট’ সংক্রান্ত নোট। কিন্তু একজন রেফারি তা প্রকাশযোগ্য নয় বলে পেপার প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু নেচার জার্নালের এডিটর দেখলেন এটা একটা সত্যিকারের যুগান্তকারী আবিষ্কার। নেচারে প্রকাশিত হলো ‘রামন ইফেক্ট’ আবিষ্কারের কথা।

রামন ইফেক্ট আলোক তরঙ্গের অজানা পথ খুলে দিয়েছে। শক্তির স্তর এবং অণু ও পরমাণুর গঠন বুঝতে অনেক সহায়তা করেছে রামন-ইফেক্ট। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখায় রামন ইফেক্ট কাজে লাগছে। জীববিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও অনেক শাখায় রামন-ইফেক্ট কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে।

১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার সি ভি রামনকে নাইট খেতাব দিলে রামনের নামের আগে ‘স্যার’ যুক্ত হয়। স্যার সি ভি রামন দ্রুত হয়ে ওঠেন ভারতীয় বিজ্ঞানের জগতের জীবন্ত কিংবদন্তী। সাধারণত বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কারের পর অনেক বছর লেগে যায় তার স্বীকৃতি পেতে। বিশেষ করে নোবেল পুরষ্কারের মত পুরষ্কার পাবার ক্ষেত্রে। কিন্তু রামনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটে গেলো মাত্র দু’বছরের মধ্যেই। ১৯৩০ সালেই ‘রামন ইফেক্ট’ আবিষ্কারের জন্য নোবেল-পুরষ্কার পেলেন স্যার সি ভি রামন। রামন যেন অনেক দিন আগে থেকেই জানতেন যে তিনি নোবেল পুরষ্কার পাবেন। এ ব্যাপারে কিছু কিছু ঘটনা খুবই আশ্চর্যজনক মনে হয়। ১৯২৪ সালের শেষে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার পর রামনকে যখন সম্বর্ধনা দেয়া হয় – রামন বলেছিলেন “আশা করছি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমি ভারতের জন্য নোবেল পুরষ্কার নিয়ে আসতে পারব” [1]। ঠিক পাঁচ বছর পরেই তিনি নোবেল পুরষ্কার পেলেন। শুধু তাই নয়, ১৯২৫ সালে শিল্পপতি জি ডি বিড়লা’র কাছে স্পেক্ট্রোগ্রাফ কেনার জন্য টাকা চেয়ে লেখা এক চিঠিতে লেখেন – “আমি যদি এই যন্ত্রটা পাই, তাহলে ভারতের জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিতে পারবো”।

১৯৩০ সালের অক্টোবরে নোবেল পুরষ্কার ঘোষিত হয়। ডিসেম্বরের দশ তারিখে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুদিনে সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল ফাউন্ডেশানে আনুষ্ঠানিক ভাবে নোবেল পুরষ্কার হাতে তুলে দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য রামনের জাহাজের টিকেটের ব্যবস্থা করতে গেলে নোবেল কর্তৃপক্ষ একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনার মুখোমুখি হন। সি ভি রামন তাঁর নিজের জন্য ও তাঁর স্ত্রী লোকসুন্দরীর জন্য জাহাজের দুটো টিকেট বুক করে রেখেছেন ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে। অথচ সেই সময় নোবেল কমিটির মিটিং-ও হয়নি। নোবেল পুরষ্কারের ব্যাপারে রামনের মধ্যে এক ধরণের নেশা কাজ করতো। তিনি জানতেন নোবেল পুরষ্কার-ই হলো একজন বিজ্ঞানীর কাজের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। কিন্তু এ ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত তিনি ছিলেন কীভাবে?

নোবেল পুরষ্কার পাবার পর খ্যাতি ও সাফল্যের শীর্ষে উঠে গেলেন সি ভি রামন। মহেন্দ্রলাল সরকারের স্বপ্ন সার্থক হলো রামনের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শুধুমাত্র নিজের দেশে আইএসিএস-এ গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কার নিয়ে এসেছেন রামন। আর কী চাই? অনেক ছাত্র-ই রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠলো। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের অনেকেই – যারা রামনের সর্বভারতীয় পরিচয়ের চেয়েও রামনকে একটু বেশি নিজেদের লোক মনে করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্সের অন্যান্য বাঙালি অধ্যাপকদের মনে কিছুটা ঈর্ষার মেঘ স্বাভাবিক ভাবেই জমতে শুরু করলো। ব্যাক্তিত্বের সংঘাত স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এতদিন যাঁরা রামনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন তাঁরাই আস্তে আস্তে রামনের খুঁত বের করতে শুরু করলেন। রামনের ক্ষুরধার জিভ থেকে যে সোজাসাপ্‌টা কথাগুলো সব সময় বেরোয় সেই অপ্রিয় সত্যকথাগুলো কেউ আর সহ্য করতে রাজি নন। ‘রামন-ইফেক্ট’ আবিষ্কারের অনেক কাজই করেছেন তাঁর ছাত্র কে এস কৃষ্ণান। অথচ রামন কৃষ্ণানকে ‘রামন-ইফেক্ট’ আবিষ্কারের কোন কৃতিত্বই দেননি, পুরোটাই নিজের করে নিয়েছেন। ডিপার্টমেন্টে এ নিয়ে কথা উঠলে বদরাগী রামন মুখে যা আসে তাই বললেন। রামনের বেশির ভাগ গবেষণা-ছাত্রই দক্ষিণ ভারতীয়। এ ব্যাপারে রামনকে ‘বাঙালি-বিদ্বেষী’ বলে অপবাদ দেয়া হলো। রামনের মন উঠে গেলো কলকাতা থেকে।

১৯৩২ সালের শেষের দিকে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক স্যার মার্টিন ফরস্টার অবসরে গেলে নতুন পরিচালক পদ গ্রহণ করার জন্য লর্ড রাদারফোর্ডকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু রাদারফোর্ড বললেন – “ইন্ডিয়ার জন্য এখন তো আর ইংল্যান্ড থেকে কাউকে নিয়ে যাবার দরকার নেই যেখানে সি ভি রামনের মত যোগ্য লোক রয়েছেন”। ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের কাউন্সিল রামনকে পরিচালক পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন। রামন কলকাতায় আই-এ-সি-এস এর দায়িত্ব উপযুক্ত কারো হাতে না দিয়ে কীভাবে ব্যাঙ্গালোরে যাবেন? এসোসিয়েশানের সুনাম এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তখন অনেক ভালো। রামন ভাবলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের নামে অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করবেন এবং সেই পদে যিনি আসবেন তাঁর হাতেই তুলে দেবেন এসোসিয়েশানের সব দায়িত্ব।

এদিকে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তখন এলাহাবাদে। ১৯২১ সালে ইউরোপ থেকে ফিরে এসে তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডিপার্টমেন্টের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে তাঁর কোন ল্যাবোরেটরি ছিল না। ফলে গবেষণার সুযোগের জন্য তিনি এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এলাহাবাদেও তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছিলেন না। ফলে দশ বছরের মধ্যেই তিনি কলকাতায় ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। এসোসিয়েশানে মহেন্দ্রলাল সরকারের নামে নতুন পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার কথা শোনার পর তিনি সেই পদের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন। সি ভি রামনকে চিঠি লিখে জানালেন নিজের আগ্রহের কথা। প্রফেসর মেঘনাদ সাহা সেই পদের জন্য খুবই যোগ্য মানুষ। কিন্তু রামনের মনে হলো সাহার চেয়ে কৃষ্ণান-ই বেশি উপযুক্ত নতুন এই পদের জন্য। তিনি মেঘনাদ সাহাকে লিখে জানালেন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা। মেঘনাদ সাহা চিঠি পেয়ে খুবই অপমানিত বোধ করলেন। ফল যা হলো তা সাংঘাতিক। এসোসিয়েশানের কাউন্সিল মিটিং-এ রামনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় দাঁড় করানো হলো। কাউন্সিলের ভোটে এসোসিয়েশানের পদ থেকে রামনকে সরিয়ে দেয়া হলো। তবে পদত্যাগ করার আগে রামন ‘মহেন্দ্রলাল সরকার প্রফেসর’ পদে কে এস কৃষ্ণানের নিয়োগ নিশ্চিত করে যান [3]। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও পদত্যাগ করলেন রামন।

১৯৩৩ সালে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক পদে যোগ দিলেন রামন। হিটলারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আইনস্টাইন সহ আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানী ইউরোপ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন এ সময়। রামন ভাবলেন এঁদের কাউকে যদি ভারতে নিয়ে আসা যায় তাহলে ভারতের বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব। ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার পক্ষপাতী ছিলেন না রামন। তাঁর মতে এ দেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়ে বিদেশী পরিবেশে কেবল বিদেশীদের নকল করতে শিখে, নিজেদের চিন্তাভাবনা নিজেদের দেশে কাজে লাগানোর শিক্ষা পায় না। ফলে তারা নিজের দেশে ফিরে এলেও দেশের কোন কাজে লাগে না। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই আবার বিদেশে চলে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইউরোপের যেসব বিজ্ঞানী এখন দেশ বদলাচ্ছেন তাঁদেরকে যদি ভারতে নিয়ে আসা যায় তাহলে ভারতে বসেই ইউরোপীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব। কাজ শুরু করে দিলেন রামন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক ম্যাক্স বর্নের জন্য ইনস্টিটিউটে পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষ প্রফেসর পদ সৃষ্টি করলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেক পথিকৃৎ শ্রোডিংগারের কাছেও চিঠি লিখলেন। কিন্তু চিঠি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় শ্রোডিংগার ডাবলিনে চলে গেছেন। রামনের তালিকায় আরো অনেকের নাম ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে বেশিদূর আগাতে পারলেন না তিনি – প্রশাসনিক জটিলতায়। নিজের আকাশচুম্বী অহংবোধের কারণে ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে তিনি নিজে যেটা ভালো মনে করেছেন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন পরিচালনা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই। ফলে এখানেও সমস্যা হলো। পরিচালক পদ থেকে সরে আসতে হলো তাঁকে। তবে ইনস্টিটিউটে তাঁর প্রফেসর পদ বহাল রইলো।

১৯৩৪ সালে রামন প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স এবং সারা ভারতের প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের একাডেমির ফেলোশিপ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। রামন ছিলেন একাডেমির প্রথম সভাপতি। পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের প্রসিডিংস পৃথিবীর সেরা জার্নালের তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন রামন। এই চৌদ্দ বছরে তিনি অনেক বিচিত্র বিষয়ে গবেষণা করেছেন। কঠিন পদার্থের থার্মো-অপটিক, ফটো-ইলাস্টিক, ম্যাগনেটো-অপটিক বিহেভিয়ার, সেকেন্ড অর্ডার রামন ইফেক্ট, ইনফ্রারেড স্পেক্ট্রোস্কপি ইত্যাদি বিষয়ে রামনের বিখ্যাত সব গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয়েছে এই সময়। তাঁর ছাত্র কৃষ্ণান সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সে নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাঁকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হয়। কৃস্টাল ম্যাগনেটিজমের ওপর তাঁর সংগৃহীত সব উপাত্ত নষ্ট হয়ে যায় [8]।

ভারতের স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৪৮ সালে রামন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। স্বাধীন ভারত সরকার তাঁকে দেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেন। এসময় রামন নিজের জন্য একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। ব্যাঙ্গালোরে ইনস্টিটিউটের জন্য দশ একর জমি পাওয়া গিয়েছিল মহিশূরের রাজার কাছ থেকে। ওখান থেকে কিছু জমি রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জন্য দেয়া হলো। রামন নিজের ও স্ত্রীর সমস্ত সঞ্চয় ঢেলেও প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করাতে পারলেন না। তিনি চাঁদা সংগ্রহে নেমে পড়লেন। সরকারের কাছে সাহায্য চাওয়ার বদলে তিনি সাধারণের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহকেই প্রাধান্য দিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি যুক্তি দেখালেন “আমাদের সব বিখ্যাত মনীষীরাই ভিক্ষুক ছিলেন – বৌদ্ধ, শঙ্করাচার্য, এমন কি মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত” [1]। কিন্তু চাঁদা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করা গেলেও টিকিয়ে রাখার মত অর্থ জোগাড় হলো না। এবার একজন প্রাক্তন ছাত্রের সহযোগিতায় দুটো রাসায়নিক কারখানা খুলে সেগুলোর লভ্যাংশ থেকে ইনস্টিটিউট চালানোর ব্যবস্থা করলেন। ষাট বছর বয়সে রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন করে পরবর্তী বাইশ বছরে তাঁর এই প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রায় দু’শ গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেছেন রামন। জীবনের শেষের দিকে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সময় কাটিয়েছেন অনেক। তাদেরকে নিজের প্রতিষ্ঠান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন প্রায় প্রতিদিন।

১৯৫৪ সালে রামনকে ভারত রত্ন উপাধি দেয়া হয়। ১৯৫৭ সালে দেয়া হয় লেনিন শান্তি পুরষ্কার। জীবনের শেষ কয়েকটি বছরে তিনি সব ধরণের সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ ফিরিয়ে দেন। রয়েল সোসাইটির ইতিহাসে এটা ছিল একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা।

১৯৭০ সালের ২১শে নভেম্বর রামনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর অনেকদিন আগেই তিনি বলেছিলেন – মৃত্যুর পর যেন কোন রকমের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করা না হয় তাঁর জন্য। তিনি বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিলেও, সারাজীবন মাথায় একটা টুপি বা পাগড়ির আচ্ছাদন দিয়ে রাখলেও – ধর্ম নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি। তাঁর মাথার পাগড়ি সম্পর্কে একবার প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “এটা না থাকলে কি সেদিন রাদারফোর্ড আমাকে চিনতে পারতেন? এটা আমার পরিচয়”। তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর ইনস্টিটিউটের বাগানে তাঁকে সমাহিত করা হয় এবং কোন ধরণের সমাধি-ফলক বা সমাধি-সৌধ এর বদলে সেখানে একটা গাছ লাগিয়ে দেয়া হয়।

রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বাগানে এই গাছের নিচে রামনকে সমাহিত করা হয়।

রামন ইফেক্ট আবিষ্কারের দিনটি স্মরণে ২৮শে ফেব্রুয়ারি তারিখ-কে ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর এ দিনটিতে সারা ভারতের সবগুলো বিজ্ঞান গবেষণাগার সবার জন্য খুলে দেয়া হয়। জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে এ দিনটির ভূমিকা অনেক [5]।

মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে রামন নীল আকাশের দিকে হাত তুলে তাঁর প্রিয় ছাত্র রামসেশনকে বলেছিলেন “এর চেয়ে সুন্দর আর কোন কিছু দেখেছো তুমি?” “এই সৌন্দর্য-ই সুখ”। রামন তাঁর আবিষ্কৃত নানা রঙের আলোর খেলায় প্রকৃত সৌন্দর্য তথা প্রকৃত সুখ হয়তো খুঁজে পেয়েছিলেন।

তথ্যসূত্রঃ
[1] S. Ramaseshan, C. Ramachandra. C. V. Raman A Pictorial Biography. Bangalore: The Indian Academy of Sciences, 1988.
[2] C. V. Raman. Unsymmetrical diffraction-bands due to a rectangular aperture. Philosophical Magazine 1906;12:494.
[3] G. Venkataraman. Journey into Light Life and Science of C. V. Raman. New Delhi: Penguin Books, 1994.
[4] এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়. ভারতীয় বিজ্ঞানঃ উত্তরণের কাল. ্কলকাতা: কেমব্রিজ ইন্ডিয়া, ২০০৫.
[5] শ্যামল চক্রবর্তী. বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ ১৯৯৯.
[6] C. V. Raman. Molecular diffraction of light. Calcutta: Calcutta University Press, 1922.
[7] Rajinder Singh. The story of C. V. Raman’s resignation from the Fellowship of the Royal Society of London. CURRENT SCIENCE 2002;83 (9).
[8] Pranab Bandyopadhyay. Great Indian Scientists. Delhi: Book Club, 1993.