২০ মে চা শ্রমিকরা চা শ্রমিক দিবসপালন করে। ১৯২১ সালে ২০ মে, চা শ্রমিকদের উপর চা বাগানের মালিকদের নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলন করে। চা বাগানের মালিক ও সরকার মিলে আন্দোলন ব্যর্থ করে দিতে তাদের উপর নির্যাতন চালায়।নিহত হয় অগুনিত শ্রমিক । আমার উদ্দেশ্য ছিল এটা নিয়েই লেখা।পরিস্থিতি বর্ণনা করতে, ভারতবর্ষে চা বাগানের শুরুর কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। কিন্তু ইতিহাস সংক্ষেপ করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়েছে। বিষয়গুলো ধারাবাহিকতা রাখতে গিয়ে সাজানোর বদলে কিছু ব্যপার আরো এলোমেলো হয়ে গেছে।

চা বাগানের শ্রমিকদেরকে কুলি বলা হয়।আড়কাঠি ও গিরমিট প্রথার কারনে চা ম্যানেজার কুলিদের উপর একচ্ছত্র নির্যাতন করার অধিকার পায়। কোন শ্রমিক ইচ্ছে করলেই চাকরি থেকে ইস্তোফা দিতে পারতো না। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। দেয়া হতো আমানবিক শাস্তি । কুলিদের সাথে এ ধরনের আচরণ কোন অপরাধ হিসেবে গন্য হতো না। চাবুক বুটের লাথি ছিল কুলিদের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এভাবে মালিকদের হাতে শ্রমিকের মৃত্যুকেও সাধারণ ঘটনা হিসবে দেখা হতো। মালিকদের কথাই সেখানে রাষ্ট্রিয় আদেশ হিসেবে গণ্য হতো। শ্রমিকদের ইচ্ছা আনিচ্ছা বলতো কোন কিছু কল্পনাই করা যেতনা। বাগানে কুলিরা বাগানের ভিতরে ছাতা মাথায় হাটাও আপরাধ হিসেব গন্য হতো। পুরুষ কুলিদের বেতন চার আনা,মহিলাদের বেতন তিন আনা এবং শিশুদের বেতন দুই আনা। চা বাগানে শিশু শ্রম বৈধ এমন কি এই ২০১১ সালেও। কি পরিহাস! এই ইংরেজরা কৃতদাস প্রথা বাদ দিয়ে চালু করে এমনই বিভৎস আইন।

ওলন্দাজ বণিকরা ১৬১০ সালে প্রথম চীন থেকে চা আমাদনি শুরু করে।ইংরেজরা প্রথম চা আমদানি করতো চীন থেকে। চীন জাপান যুদ্ধের কারনে চীনের সাথে সম্পর্ক আবনতি হলে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজরা বিকল্প চা উৎপাদনের জন্য তাদের ভারতবর্ষের উপর নজর পড়ে। ১৮৩৫ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। তার নাম রয়েল সোসাইটিভারতবর্ষে চা উৎপাদনের করার জন্য অনুসন্ধান করাই এই কমিশনের কাজ। এই কমিটি কাজ শুরু করার আগেই শিলচর এবং করিমগঞ্জে চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়।( আমরা কি ইংরেজদের আগেই চা খেতে জানতাম নাকি??) এই বছরই প্রথম চীনের বাইরে বাণিজ্যিক ভাবে চা এর উৎপাদন কার্যক্রম গ্রহন করা হয়। ১৮৩৮ সালে সিলেট ও কাছাড়ে পরীক্ষামূলক ভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। ভারতবর্ষে আসামের লখিমপুরে, সিলেট ও কাছাড় জেলায় চা এর উৎপাদন ব্যাপকতা পায়।

চা শিল্প যেহেতু শ্রমঘন শিল্প। চা বাগান গড়ে তুলতে প্রচুর শ্রমিকের দরকার হয়। পাহাড়ি জঙ্গল পরিস্কার করা,রাস্তাঘাট নির্মাণ গৃহ নির্মাণ করা প্রাথমিক কাজ। তাছাড়াও দ্রুত বর্ধণশীল আগাছা নিয়মিত পরিস্কার করতে দরকার হয় অনেক শ্রমিক।

আসামে ১৮২৬ সালে লোকসংখ্যা প্রতিবর্গমাইলে ৯জন এবং ১৮৫৩ তা বেড়ে হয় প্রতিবর্গমাইলে ৩০জন। সেই সময়ে আসামের সকল প্রাপ্তবয়স্ক লোক দিয়েও তার চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিলনা। সিলেটে ১৮৫৩ সালে লোক সংখ্যা ছিল প্রতিবর্গমাইলে ২০০জন।এ ছাড়া ও আসাম বা সিলেটের মানুষ চা বাগানে কাজ করাকে অসম্মান মনে করায় তারা কাজ করতে অনাগ্রহী ছিল

চা বাগান করতে হলে লোকজন তো লাগবেই।সহজ উপায়ে শ্রমিক সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে, শুরু করে লোক সংগ্রহের অনৈতিক কর্মকান্ড। স্থানীয় জনগণকে কাজে লাগানোর জন্য ১৮৩৪ সালে উল্লেখ যোগ্য দুটি পদক্ষেপ নেয়। এক ক্রীতদাস প্রথা বিলোপ্ত করণ এবং কৃষকদের খামারে উচ্চ হারে কর আরোপ। এমনকি পান সুপারির উপরও কর আরোপ করে। তবু শ্রমিক সংগ্রহের ক্ষেত্রে তা খুব প্রভাব ফেলতে পারেনা। চা রপ্তানির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ১৮৬৪৬৫ সালে রেল লাইন স্থাপন করে এবং প্রসারিত করে ১৯০৪ সালে চটগ্রামের সাথে সংযুক্ত করে। এই কারনে স্থানীয় শ্রমিকদের তোষামোদের চেয়ে বাহির থেকে শ্রমিক আমদানি অনেক সহজ হয়ে যায়।

তাই বলেই তো শ্রমিকরা রেল চেপে চা বাগানে কাজ করতে আসবার কোন কারন নাই। সেই সময়ে শ্রমিক বলতে মূলত কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রমিকেই বোঝানো হত। তখন মালয়শিয়া এবং পশ্চিম ভারতের দ্বীপ পুঞ্জে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রপ্তানি করা হতো। চা করেরা এই তথ্য আবগত থাকায় নতুন করে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের টোপ ফেলে।

বিহারের রাঁচী,হাজারিবাগ,সাঁওতাল পরগণা, ডুমকা ও গয়া, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, গঞ্জাম,সম্বলপুর ও চাইবাসা এবং মধ্য প্রদেশের রায়পুর, রামপুরহাট ও জব্বলপুর প্রভৃতি জেলা থেকে মূখ্যত শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়াও উত্তর প্রদেশ,পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি প্রদেশ থেকেও শ্রমিক সংগ্রহ করার হয়। নেপাল থেকেও এক পর্যায়ে শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়।

১৮৪১ সালের দিকে শ্রমিক প্রেরণ কার্যক্রম বেগবান করার জন্যফ্রি কনট্রাক্টরসপদ্ধতি তৈরি করে। এই আইনের বলে বড় অংকের টাকার বিনিময়ে কুলি সংগ্রহ করার জন্য চাকরেরা চুক্তি করেন স্থানীয় এজেন্টদের সাথে। লোভী এজেন্টরা ( এদেরকেই আড়কাঠি বলা হয়,এবং এই প্রক্রীয়াই আড়কাঠি আইন।) স্থানীয় কিছু ধুর্ত লোককে আড়কাঠি হিসেবে বাছাই করে। তারা অধিক মুনাফার আশায় নিজেদের মধ্যে শুরু করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। শ্রমিকদের দেখাতে থাকে নানান প্রলোভন। করতে থাকেন নানা রকমের মিথ্যাচার। তারা গ্রামে গ্রামে সুসজ্জিত বেশে গিয়ে চা কুলিদের সুখের জীবন ফুলিয়ে,ফাঁপিয়ে,বানিয়ে বলত। গরিব গৃহস্থের ছেলেমেয়েরা এসব শুনে সুখের স্বপ্ন দেখতো। তার পর ঐ আড়কাঠির হাত ধরে একদিন বাড়ি ছেড়ে পা বাড়াত। ছাগল গরুর ব্যবসার মতো কুলি ব্যবসা তখন জমজমাট। কোন ভাবে তাদের জাহাজের ঘাটে এনে দিতে পারলেই হাতে পেত কচকচে টাকা।

(এ ছাড়াও তাদের অত্যাচার ছিল সীমাহীন।১৮৬১৬২ এই সময়ে কুলিদের উপর কুলি ব্যাবসায়িরা যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তা দাস ব্যবসায়ের আতঙ্ক ম্লান হয়ে গিয়েছিল।)

আড়কাঠিদের কাজ হচ্ছে কুলিদের জাহাজ ডিপোয় এনে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া ।একবার স্বাক্ষর করাতে পারলেই চা মালিকদের জিম্মায় চলে যেত। ততক্ষন পর্যন্ত তাদের আদর আপ্যায়ন ভালই হতো। হাত বদলে তারা এসে পড়তো জাহাজের কতৃপক্ষের কাছে।শুরু হতো তাদের উপর অমানবিক আচরণ। কুলিদের জন্য তো আর জাহাজের বাড়তি যোগান দেয়া যাবে না তাই ছাগল গরুর মতো তাদের জাহাজে উঠানো শুরু হল। জাহাজের ধারন ক্ষমতা যেখানে

২০০ জন সেখানে তোলা হতো ১০০০১২০০ কুলি।

শুয়ে থাকা তো দুরের কথা বসবার মতোও কোন স্থান ছিলনা। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাদের দিন কাটাতে হতো। খাওয়া দেওয়া হতো খুবই কম,যে টুকো খাবার না দিলেই নয়। জাহাজে ভ্রমনের ধাক্কার সাথে যোগ হতো রোগবালাই।কলেরা বসন্ত মহামারি রুপে দেখা দিল। কুলিদের জন্য জাহাজে কোন চিকুৎসার ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজনীয়তা কেউ মনে করেনি। কাতারে কাতারে লোক জাহাজে মারা যেত। জাহাজ আসে ভিড়ল বদরপুর বা কাঠিগড়ায়(পূর্বে এই দুটিই ছিল জাহাজ বন্দর)।জাহাজ যখন খালাস করা হচ্ছিল তখন কুলি এবং কুলেদর লাশ দুই সমান হারে নামছিল। অর্ধেক জীবন্তু এবং অর্ধেক নামছে লাশ হয়ে। রোগ বিস্তারের অজুহাতে লাশ গুলো ফেলে দেয়া হতো পানিতে। চোখের সামনে দেখতো সৎকার বিহীন ভাই,বাবা,চাচা,বন্ধুর লাশ পানিতে ফেলা হচ্ছে ঝুপঝাপ শব্দ করে।

যারা বেঁচে থাকল তাদের নিয়ে আসা হল শ্বাপদ সংকুল জঙ্গলে। যে সুখের দিনের কথা তারা চিন্তা করে জাহাজে উঠেছিল তা খুব দ্রুতই মিলিয়ে যেতে লাগল। জঙ্গলেই তাদের থাকতে হবে। এখানেই কাজ করতে হবে। মারতে হবে সাপ,বাঘ,ভাল্লুক, হাতি, বিষাক্ত পোকামাকর আথবা তাদের হাতেই হবে তাদের মৃত্যু। জীবজন্তুর সাথে এবং জঙ্গলের সাথে লড়াই করে কমে যেতে থাকে তাদের সংখ্যা। ম্যালেরিয়া,কালা জ্বর তাদের নিত্য সঙ্গী। চিকিৎসা বলতে কোন ব্যাপার তখন কুলিদের জন্য ছিলনা।

“Griffiths(1967-70) reported that some 84,915 laborers landed in Assam between 1863 and 1866 of which over 30,000 died by january”

আধিকাংশ চা বাগানের মালিকই তখন বৃটিশ কোম্পানি। ভারতবর্ষে তখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাধতে শুরু করে। এই আন্দোনলের কিছুটা বাতাস পায় চা শ্রমিকরাও। ক্ষুধা,রুগ ভোগ,মৃত্যু, নিজ আপনজন থেকে দূরে থাকা, এবং আদৌ ফিরে যাবার অনিশ্চয়তা তাদের বিদ্রোহী করে তোলে।

তখন ১৯২০ সাল। শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাগান থেকে বাগানে। বিদেশি মালিকদের সব রকমের ব্যবসা বাণিজ্যে ও চা বাগান বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো শ্রমিক আন্দোলনের হাল ধরার মতো বলতে গেলে কেউ ছিলনা। অদক্ষ ভাবে আন্দোলন গড়াতে থাকে। রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তারাও চা বগান থেকে বের হয়ে আসে। ইসহাক কাজলের বর্ণনা করেছেন:

১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও গণজাগরণ চা শ্রমিকদের অনুপ্রাণিত করে। এ সময় থেকে চা শ্রমিকদের শোষণবিরোধী সংগ্রাম সম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় শক্তি সংগ্রামের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। চরগুলা অঞ্চলের চাশ্রমিকগণ ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে চা বাগান থেকে বের হয়ে স্ত্রী,পুত্র,পরিজন, নিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে। এ চা শ্রমিক আন্দোলনকে চরগোলা এক্রডাস বলা হয়। সিলেট ও কাছাড়ের প্রায় ত্রিশ হাজার চাশ্রমিক এ অন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাদের দাবি ছিল একটি ইংরেজ মালিকেদর অধীনে কাজ করবেন না। তাদের নিজের আবাসভূমিতে ফিরে যাবে।

১৯২১ সালের ৩ মার্চ অনিপুর চা বগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক বেরিয়ে আসলে শ্রমিকদের মধ্যে বাগান ছাড়ার তৎপরতা দেখা যায়।দলে দলে শ্রমিকরা বাগান থেকে বের হতে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই নিজের গ্রামে ফিরে যাবে। আমার মনে হয় অসহযোগ আন্দোলন তাদের কে পুরনো গ্রামের সেই কথা আবার মনে করিয়ে দেয়। কুলিরা বুঝতে পারে, চা মালিকরা তাদের প্রতারণা করে জঙ্গলে বন্দি করে রেখেছে। তাদের সোনালী অতীতে ফিরে যাওয়ার বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস অনুভব করে। পাগলের মতো কোন চিন্তা না করে বেরিয়ে যায় মাথা গোজার ঠাঁই ছেড়ে। কি ভাবে যাবে? কি খাবে? এসব চিন্তা তাদের একটি বারের জন্যও থামাতে পারে না। তারা বেরিয়ে পড়ে অজানার গন্তব্যে। কি হবে আর থেকে এখানেও তো ধুকে ধুকে মরছি তো একবার বেরিয়ে দেখি না কি হয়। বন্দি জীবনের কারনে তাদের বাহিরের পৃথিবীটাও ছিল অপরিচিত। এই অপরিচিত পৃথিবীত বেরিয়ে আসে স্ত্রী,পুত্র, কন্যার হাত ধরে। কি ভাবে যাবে ? রাস্তাঘাট চিনবে কি করে? তারা তো কেবল জানে চাঁদপুর জাহাজ ঘাট। সেখানে যেতে পারলেই জাহাজে চড়ে বাড়ি ফিরা যাবে। জাহাজ ঘাট যাবে কি করে? সবাই জড়ো হতে থাকে রেলস্টেশনে। চা করেরা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শ্রমিকদের রেলের টিকেট না দেওয়ার নির্দেশ দেয় উপায় খুব সহজে বেরিয়ে যায়। হাঁট। এই রেল লাইল ধরেই হাঁট। সবাই সেই রেল লাইল ধরেই হাঁটতে থাকে চাঁদপুর জাহাজ ঘাটের উদ্দেশ্যে।

তাই এই আন্দোলন মুল্লকে চল আন্দোলন হিসেবে বেশি পরিচিত।

বিদ্রোহী শ্রমিকদের মুখে তখন ধ্বনিত হচ্ছে, গান্ধীজি কী জয়, বন্দে মাতরম, আল্লাহু আকবর।দল বেঁধে তারা হাঁটতে থাকে রেল লাইন ধরে। এ সময় হবিগঞ্জের কংগ্রেস নেতা শিবেন্দ্র বিশ্বাস এগিয়ে আসেন। তার নেতৃত্বে কর্মীরা পথে পথে শ্রমিকদের রাত্রিযাপন ও খাদ্য সরবরাহ করতে থাকে। স্থানীয় স্বদেশী কর্মীরা তাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা দেন এবং শ্রমিকদের মানসিক শক্তি ও সাহস যোগান।পথে মৃত্যু হয় অনেক শ্রমিকের।তবু চলা থামেনা।

ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হাজার হাজার শ্রমিকরা এসে জড়ো হয় জাহাজ ঘাটে। জনপ্রিয় নেতা হরদয়াল নাগের নেতৃত্বে এদের জন্য চিড়া ও চাউল ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শ্রমিকদের রান্না করার মনোবল এবং শক্তি কোনটাই ছিলনা। তারা কাঁচা চাউল চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন।

যখনই স্টিমার ঘাটে এসে ভীড়ে অমনি প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠে। সবাই ধাক্কা ধাক্কি করে স্টিমারে উঠতে ব্যস্ত হয়ে যায়। জাহাজ কর্মচারীরা চায় টিকেট। টিকেট কাটতে লাগে টাকা। কুলিদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কোথায় পাবে টাকা? কোথায় টিকেট? অনেক অনুনয় বিনয় করেও জাহাজ কর্মীদের মন টলানো যায়না। এক পর্যায়ে জাহাজ তাদের সাথে ধাক্কা ধাক্কি শুরু হয়। সিঁড়ি দিয়ে একসাথে উঠতে গিয়ে ঝপাঝপ পড়ে পানিতে।

পরিস্থিতির উপর সরকারেরও তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছিল।তাই প্রস্তুত রেখেছিল পুলিশ বাহিনী। হুইসেল বাজতেই একদল সশস্ত্র পুলিশ এগিয়ে আসে। জাহাজের সিঁড়ি লক্ষকরে গুলি ছোড়তে থাকে। জাহাজের সিঁড়ি থেকে শ্রমিকদের রক্তাক্ত দেহ পরতে থাকে পানিতে।শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অল্প সময়েই জাহাজ ঘাট শুন্য হয়ে যায়।

এই আক্রমনে কত জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল? কত জন আহত হয়েছিল। তার কোন হিসাব নেই। লোকজন শুধু নদীতে লাশের সারি ভেসে যেতে দেখেছে।

গান্ধীজি কি জয়, গান্ধীজি কি জয় বলে যে শ্রমিকরা স্লোগান দিচ্ছিল। সেই গান্ধীজিকে ই শ্রমিকদের এই আন্দোলনে সমর্থন জানানোর অনুরুধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা করতে অস্বীকার করে শ্রমিকদের বাগানে ফিরে যেতে বলেন।

সবচেয়ে পাশবিক ঘটনাটি ঘটেছে চাঁদপুর রেলস্টেশনে। রেলইয়ার্ডে ৩,০০০,০০০ শ্রমিক জড়ো হয়েছিল। ২০ মে তাদেরও জাহাজ ঘাটে পৌঁছনোর কথা। রাতের অন্ধকারে গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা রেলওয়ে ইয়ার্ড ঘিরে ফেলে। সরকার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ এলাকায় কোন লোকজনকে যেতে নিষেধ করা হয়। সরলপ্রাণ ক্লান্ত শ্রমিকরা রহস্যটা বুঝতে পারেনি। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে অচেতন । কমিশনার কে, সি,দে এর নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা ঘুমন্ত শ্রমিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আকাশ বতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলে গুর্খা বাহিনী।

এখানেও কতজন নিহত ,কত জন আহত হয়েছে তারও কোন হিসেব করা হয়নি। বাগান মালিকরা ভেবেছিল ত্রাসের সঞ্চার করে তাদের আবার বাগানে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই একটি অতিরিক্ত কামরাসহ রেলগাড়ী স্টেশনে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য খুব একটা সফল হয়নি। আক্রমনের ফলে সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকরা। মাড়োয়ারী পাট ব্যবসায়ীরা তাদের পাটের গুদামে এবং মানুষজন তাদের বাড়ি ঘরে আশ্রয় দেয়।

চাঁদপুর চা শ্রমিকদের উপর হামলার প্রতিবাদে ডাকা হলো হরতাল। রেল ও জাহাজ কোম্পানির কর্মীরা এই হরতালে সমর্থন জানায় এবং প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ গ্রহন করে। ধর্মঘট পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রেল কর্মচারীদের এই ধর্মঘট আড়াই মাস স্থায়ী হয় এবং ৪,৫০০ কর্মী চাকরিচ্যুত হয়। জাহাজ কর্মীদের ধর্মঘট চলে ছয় সপ্তাহ। এদিকে চাশ্রমিকদের খাদ্য যোগানোর জন্য হারাধন নাগের নেতৃত্বে রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। জনসাধারণ উদার ভাবে সাহায্যে হাত বাড়ান। এক পর্যায়ে সরকার শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ করতে চাইলে শ্রমিকরা তা নিতে অস্বীকার করে। কিছুদিন পরেই শ্রমিকদের মধ্যে কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেয়। বহু শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। এই মহামারী নিয়ন্ত্রন আনতে স্বেচ্ছাসেবকরা প্রাণান্ত পরিশ্রম করে।

রেলস্টেশান থেকে পন্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত সহ নেতৃস্থিনীয় শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করেন। জেলখানা কতৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে পন্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত অনশন করে প্রাণ বিসর্জন দেন।

তারপর কি হয়??? তারপর রাজনীতি।

) এ মর্মান্তিক ঘটনার পরও যেসব শ্রমিক নিজমুল্লুকে যতে একান্ত ইচ্ছুক, কোম্পানি তাদের যাবার ব্যবস্থা করবে।

) কিছু কংগ্রেস কর্মী গিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।

) বাকীরা আসামে ফিরে গিয়ে আবার কাজ পাবে।

) কোম্পানি তাদের কাজ পেতে কোন অসুবিধার সৃষ্টি করবে না।

ছেলে ভোলানো চার দফার আপোষের মাধ্যমে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।

অসহযোগ আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশে চা শ্রমিকদের যৌথ প্রতিরোধ প্রথমবারের মতো দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। অনেের মতে এই সংগ্রাম ছিল চা শ্রমিকদের শ্রেণীগত চেতনার উন্মেষ ও যৌথ সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষার বিহঃপ্রকাশ

১। বালাদেশর চা শিল্প ও শ্রম:রসময় মোহান্ত

২।সুরমা উপত্যকার চাশ্রমিক আন্দোলন অতীত ও বর্তমান:ইসহাক কাজল

৩। http://www.uncorneredmarket.com/photos/picture/5600777049/

৪।http://rasheeka.wordpress.com/

ছবি দিতে পারছি না।