সখি, ভালবাসা কারে কয়? <আগের পর্ব :  পর্ব-১পর্ব -২পর্ব-৩| পর্ব-৪ | পর্ব-৫>

কেন হীরার আংটি কিংবা সোনার গয়না হয়ে উঠে ভালবাসার উপঢৌকন ?

প্রিন্স উইলিয়াম এবং কেট বিয়ে করেছেন। মিডিয়ার গরম খবর এটি। এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের নাগরিক হিসেবে আমার অবশ্য এই  সব অথর্ব রাজা রাণী আর  তাদের সুপুত্র কিংবা কুপুত্রদের বিয়ে নিয়ে কোন আগ্রহ ছিলো না কখনই। কেবল বিনোদন হিসেবে মাঝে মধ্যে এ ধরনের খবরে চোখ বোলানোই সার হত। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে এই কেট উইলিয়ামের বিয়ে নিয়ে মিডিয়া যা শুরু করেছে তাতে আমি রীতিমতো হতভম্ব। এই একদিন আগে আমেরিকার উপর দিয়ে বয়ে গেছে সময়কালের ভয়ঙ্করী প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। চারশ’র মতো লোক মারা গেছে। আলাবামার অবস্থা তো যাচ্ছেতাই, এমনকি আমি যে জর্জিয়া স্টেটে থাকি সেখানকার আশেপাশের বেশ কিছু বাড়িঘড় ভেঙ্গেছে, মানুষও মারা গেছে কম বেশি।  অথচ সিএনএন-এর মত সংবাদমাধ্যম সেসব কিছু বাদ দিয়ে কেবল কেট আর  উইলিয়ামের বিয়ের আয়োজন  প্রচার করে চলেছে সারা দিন ধরে- যেন পৃথিবীতে এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু! কেট কোন রাস্তা দিয়ে হেটে গেছেন, কীরকম পোষাক পড়েছেন, বিয়ের পরে কীভাবে ব্যালকনিতে পরষ্পরকে চুম্বন করলেন, আট টি স্তরের কত বড় আয়তনের কেক ছিলো বিয়েতে, কীভাবে তারা জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন – এগুলো  নিয়ে বিশ্লেষনের পর বিশ্লেষণ চলছে। অবশ্য মিডিয়ার আর  কী দোষ। আমার মতো আদার ব্যাপারীর এই রাজকীয় বিয়ে নিয়ে আগ্রহ না থাকলেও সাড়া বিশ্বের মানুষের আগ্রহের কমতি দেখছি না!  ৫০০০ পুলিশ অফিসার সহ আর্মি নেভি আর এয়ারফোর্সের নিয়োগদান সহ কেবল নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই নাকি খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার। কাজেই পুরো বিয়ের আয়োজনের খরচ কত হতে পারে সহজেই অনুমেয়! নিঃসন্দেহে এই বিশাল খরচের বড় একটা অংশের ব্যয়ভার বহন করতে হয় সেই জনগণকেই। তাতেও যে কারো কোন আপত্তি আছে তা মনে হচ্ছে না। খোদ বাকিংহাম প্যালেসের বাইরেই নাকি প্রায় ৫০০,০০০ মানুষ জমায়েত হয়েছিলো বর বধুকে একনজর  দেখার জন্য। কাজেই এই অপব্যয়িতাকে  সাদরে গ্রহণ করার ব্যাপারে নিরাসক্ত হলে আপনিও আমার মত বিবর্তনীয়ভাবে ‘মিসফিট’ বলে বিবেচিত হয়ে যাবেন!

তাই আমার মতো বিবর্তনীয়ভাবে মিসফিট হবার হাত থেকে বাঁচতে হলে দুচারটি কথা জেনে রাখতে পারেন। প্রিন্স উইলিয়াম তার হবু বধু কেট মিডেলটনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আট বছর ধরে প্রেম করার পর ২০১০ সালের নভেম্বরের ১৬ তারিখ। প্রায় ৮ ক্যারট হীরার আংটিটি উইলিয়াম কেট কে সে সময় উপহার দিয়েছেন,  সেটি একসময় তার মা প্রিন্স ডায়না পরতেন। কাজেই আংটিটি নিয়ে উইলিয়ামের আবেগ সহজেই অনুমেয়। তিনি সেটা মিডিয়ায় বলেছেনও –‘এটা আমার মায়ের বিয়ের অঙ্গুরি। কাজেই এটা আমার কাছে অবশ্যই বিশেষ কিছু। আমি চাই যে আমার মার স্মৃতি আমার বিয়ের সময় অক্ষুন্ন থাকুক’। কাজেই  এই আংটির পেছনে এত আবেগময় স্মৃতি জড়িত যে, কখনো যদি এই আংটি নিলামে উঠে, তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরাও এই আংটিটি কেনার জন্য দরদাম করতে ভয় পাবেন। এমনকি যদি শুধু হীরার মূল্যমান হিসবেও বিচার করি,   তাহলেও খোলাবাজারে এ ধরণের আংটি ২০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০  ডলার পর্যন্ত হতে পারে।

কিন্তু কেন এত  ব্যয়বহুল বিনিয়োগ? হয়তো ভাবছেন রাজারাজরাদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। তারা যদি হীরার আংটি নিয়ে লালায়িত না হন, তো হবে কে? কিন্তু আপনি খুঁজলেই দেখতে পাবেন, সাধারণদের মধ্যেও হিরের আংটি নিয়ে বিহ্বলতা কম নয়।

আমার অফিসের এক বান্ধবী প্রায় ৩/৪ ক্যারেটের এক ডায়মণ্ডের রিং পরে অফিসে আসে (যদিও ওটা সত্যিকারের  হীরা কিনা আমার কিছুটা সন্দেহ আছে)।  হীরকখচিত আঙ্গুল দুলিয়ে দুলিয়ে এমনভাবে কথা বলে যে,  হীরার আংটিটার দিকে যে কারো নজর যেতে বাধ্য। আর সুযোগ পেলেই সে সবাইকে শুনিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে গল্প শোনায় – কোন সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কোন হীরক রাজার দেশ থেকে তার প্রেমিক এই বিশাল এই হীরার আংটি বানিয়ে নিয়ে এসেছিলো, আর কত রোমান্টিকভাবে তাকে বিয়ের প্রস্তাব  করেছিলো!

আমার অফিসের আরেক  কলিগ  গ্রাজুয়েশন করে নতুন চাকরী শুরু করেছে। কিন্তু বেচারা গার্লফ্রেণ্ডকে বিয়ে করতে পারছে না, কারণ  গার্লফ্রেন্ডকে তুষ্ট করার মতো হীরের আংটি কেনার মত  সামর্থ নাকি এখনো অর্জন করতে পারেনি।  তার গার্লফ্রেণ্ড নাকি এমনি তে খুব ভাল, কোন কিছুই চায় না তার কাছে, কিন্তু একটি কথা নাকি সম্পর্কের প্রথমেই তাকে বলে দিয়েছে – বাগদানের সময় যেন তেন হীরের আংটি হলে কিন্তু তার চলবে না। এমন আংটি দিয়ে তাকে প্রপোজ করতে হবে – যেন সেটা সাবাইকে দেখিয়ে বাহবা কুড়াতে পারে।  বেচারা বয়ফ্রেণ্ডটি এখন চোখ কান বুজে চাকরি করছে, টাকা জমাচ্ছে। ওভারটাইম করে টু-পাইস একটু বেশি কামানো যায় কিনা – তার নানা ফন্দি ফিকির খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।  হীরের আংটি দিয়ে প্রেমিকার মন তুষ্ট করতে হবে না!

পাশ্চাত্যের মত আমাদের দেশেও মেয়েদের মধ্যে গয়নাগাটি পছন্দ করার চল আছে।  শুধু চল বললে ভুল হবে, বিয়ের সময় কতভরি সোনার গয়না দিয়ে বৌকে কেমনভাবে সাজানো হল – সেটা সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। একটা সুযোগ পেলে অনেক মেয়েই বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া গয়নাগাটি বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের দেখিয়ে কিংবা কোন বিয়ে বাড়িতে বা বড় কোন পার্টিতে গলা কিংবা কানে স্বর্ণালঙ্কারের ঝলক দেখিয়ে সবার মাঝে বাহবা কুড়াতে পছন্দ করে – এগুলো আমরা হর-হামেশাই দেখি। কেন পাশ্চাত্যে হীরের আংটি কিংবা আমাদের দেশে সোনার গয়না মেয়েদের এত পছন্দের? এই প্রশ্নটা আমার বরাবরই মনে খচ খচ করত।  হীরার অঙ্গুরি সোনার গয়নার কোন ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই। ভাত, মাংস, পোলাও কোরমা খেয়ে যেমন উদরপুর্তি করা যায়, বিলাস বহুল বাড়িতে থেকে গা এলিয়ে দিয়ে আরাম আয়েশ করা যায়, মার্সিডিস কিংবা রোলস রয়েসে বসে রাজার হালে ঘুরে বেড়ানো যায়, আই ফোনে যেমন সেকেন্ডে সেকেন্ডে কথা বলা যায়, আই প্যাডে যেমন রেস্তারায় বসে কফিরে পেয়ালা হাতে নিয়ে ব্রাউস করা যায় – হীরা কিংবা সোনার সেরকম কোন ব্যবহারিক উপযোগিতা কেউ কখনোই খুঁজে পায়নি। অথচ তারপরেও হীরা বা সোনার গয়নার জন্য সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে মেয়েরা।  আর ছেলেরাও ভালবাসার প্রমাণ হিসেবে রাজ রাজ্য চষে হাজির করে প্রায়োগিক ভাবে মূল্যহীন কিন্তু নারীর কাছে অমূল্য সেই সব রত্ন পাথর আর সোনা দানা। কিন্তু কেন?

উত্তরটা খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক পরে।  ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন তথা যৌনতার নির্বাচনের মধ্যেই যে এই জটিল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে ছিলো সেটা কি আর আমি তখন জানতাম?

প্রানিজগত থেকেই শুরু করি। যৌনতার নির্বাচনের বহুল প্রচলিত ময়ূরের পেখমের উদাহরণটি আবারো এখানে চলে আসবে।  আমরা জানি, ময়ূরের দীর্ঘ পেখম টিকে আছে মূলতঃ  নারী ময়ূর বা ময়ূরীর পছন্দ তথা যৌনতার নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে। কি ভাবে? ১৯৭৫ সালে ইসরাইলী জীববিজ্ঞানী আমোতজ জাহাভি (Amtoz Zahavi) প্রস্তাব করলেন যে, ময়ূরীর এই দীর্ঘ পেখম  ময়ূরের কাছে প্রতিভাত হয় এক ধরণের ‘ফিটনেস ইণ্ডিকেটর’ বা সুস্বাস্থ্যের মাপকাঠি হিসেবে।  জাহাবির মতে, সততার সাথে সুস্বাস্থ্যের বিজ্ঞাপন দিতে গেলে  এমন একটা  কিছুর মাধ্যমে সেটা প্রকাশ করতে হবে যাতে খরচের প্রাচুর্যটা এমনকি সাদা চোখেও ধরা পড়ে।  সোজা ভাষায় সেই বিজ্ঞপিত অঙ্গটিকে নিঃসন্দেহে হতে হবে ‘কস্টলি অর্নামেন্ট’।  ঠিক এজন্যই যৌনতার অলঙ্কারগুলো প্রায় সবসময়ই হয় বেঢপ আকারে বিবর্ধিত, ব্যয়বহুল, অপব্যায়ী কিংবা জবরজং ধরণের জটিল কিছু।

ময়ূরের পেখম  কেবল ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সস্তা প্রচারণা নয়। ময়ূরের পেখম দীর্ঘ, ভারী আর ভয়ানক বিপদসঙ্কুল। দীর্ঘ পেখম এত অনায়াসে তৈরি করা যায় না, আর এমনকি এই বেয়াক্কেলে পেখমের কারণে তার শিকারীদের চোখে পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেক।  বেচারা ময়ূরকে কেবল নিজের দেহটিকেই বয়ে বেড়াতে হয় না, টেনে হিচড়ে নিয়ে বেড়াতে হয় তার পশ্চাৎদেশের সাথে জুড়ে থাকা এই অবিশ্বাস্য বড় ধরণের বাড়তি একটা পেখমের ঝাঁপি (জাহাভির মতে এই বিলাসিতা এমনই দৃষ্টিকটু যে এটা প্রায় পঙ্গুত্বের সামিল, তার তত্ত্বের নামই এজন্য Handicap principle)।  এজন্য ময়ূরকে হতে হয় স্বাস্থ্যবান এবং নিরোগ। কখনো সখনো কোন স্বাস্থ্যহীন ময়ূরের দীর্ঘ পেখম গজাতে পারে বটে, কিন্তু সেটা বয়ে নিয়ে বেড়িয়ে খাবার খোঁজা, কিংবা শিকারীরা তাড়া করলে দ্রুত দৌঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া সেই স্বাস্থ্যহীন ময়ূরের পক্ষে দুঃসাধ্যই হবে।  কেবল মাত্র প্রচণ্ড শক্তিশালী কিংবা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ময়ূরের পক্ষেই এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে এ ধরণের পেখমের বিলাসিতা ধারণ করা সম্ভব হয় ।

তাই পেখমওয়ালা বিলাসী ময়ূর  ময়ূরীর পালের কাছে গিয়ে সোচ্চারে ঘোষণা করতে পারে –

“এই যে মহীয়সী ময়ূরী,আমার ন্যাজের দিকে তাকাও; দেখো –  আমি সুস্থ, আমি সুন্দর! আমি এমনই স্বাস্থবান আর  শক্তিশালী যে, আমি আমার ষাট ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পেখম বয়ে বেড়াতে পারি অবলীলায়। আমি  আমার খাদ্য আর দৈহিক পুষ্টিকে সাইফন করে আমার পেখমের আকার আকৃতিকে তোমারই জন্য বর্ন্যাঢ্য  করে রেখেছি।  কোন শিকারী আমাকে পেছন থেকে আক্রমণ করে পরাস্ত করতে পারে না। ভারী লেজ থাকা সত্ত্বেও আমি উসেইন বোল্টের মত এক  দৌড়ে শিকারীকে পেছনে ফেলে দিতে পারি,  আমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্দান্ত, আমার দেহ কোন রোগ জীবাণুর আবাসস্থল নয়। তুমি দেখলেই বুঝবে – উজ্জ্বল পেখম আর  অন্য সব কিছু মিলিয়ে আমার সঞ্চিত সম্পদ  অঢেল; ধন সম্পদ আর  প্রচুর্যে আমি ভরপুর। আমাকে সঙ্গি হিসেবে নির্বাচণ করলে তুমি সুখে থাকবে হে নারী…’’।

তাই ময়ূরীকে আকর্ষণের জন্য স্বভাবগতভাবেই ময়ূরকে বিলাসী হতে হয়। আমরা যতই অপচয়কারীকে ‘শয়তানের ভাই’ বলে গালমন্দ করি না কেন, অপচয় এবং ব্যয়বাহুল্য জৈবজগতে যৌনসম্পর্ক গঠণের (sexual courtship)  এক  অত্যাবশকীয় নিয়ামক।একটা পুরুষ কোকিলকে তার অতিরিক্ত বিশ ভাগ শক্তি ব্যয় করতে নিজের গলাকে সুরেলো করে তুলতে। কারণ এই সুরেলো গলাই তার আকর্ষণের হাতিয়ার। ঠিক একই কারণে হরিণের শিংকে হতে হয় বর্ণাঢ্য, তার প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি।   তার মানে, যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির বিবর্তন হতে গেলে অপচয়প্রবণতার প্রকাশ হতে হবে  একরকম  অবশ্যাম্ভাবী।  এটা যে কেউই বুঝবে যে, একটা ময়ূর তার পেখম না থাকলে বরং আরো ভালভাবে চলে ফিরে বেড়াতে পারতো। তার এই বেঢপ পেখমের পেছনে এত  শক্তি অপচয় না করে  খেয়ে দেয়ে আমোদ ফুর্তি করে বেড়াতে পারতো। পেখমের পিছনে শক্তি খরচ না করে শক্তি সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করতে পারতো। কিন্তু যৌনতার নির্বাচনী চাপ তাদের মানস জগতে অবিরতভাবে কাজ করে যায় বলেই, সে পেখম গঠনের ব্যাপারে নির্লিপ্তভাবে অপব্যায়ী হয়ে উঠে; উঠতে তাকে হবেই।বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রকৃতিতে দৃষ্টিকটু রকমের অপব্যয়িতাই হচ্ছে সততার সাথে নিজের সম্পদকে অন্যের সামনে তুলে ধরার একমাত্র সহজ মাধ্যম।

নীচে একটি টেবিলের সাহায্যে দেখানোর চেষ্টা করা হল, কীভাবে নারী অভিরুচিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতিতে ব্যয়বহুল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা নানা অপব্যয়ী বৈশিষ্টের উদ্ভব ঘটেছে-

মানব সমাজেও কি আমরা এরকমের  অপব্যয়িতার হাজারো প্রমাণ পাই না? যাদের বেশি টাকা পয়সা আছে, তারা দামী অট্টালিকা বানায়, বনেদী এলাকায় থাকে, রোলস রয়েস কিংবা পাজেরো গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়, সৌখিন এবং দামী ডিজাইনার ব্র্যাণ্ডের পোষাক আশাক কিংবা জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়। বৈষয়িক দিক থেকে চিন্তা করলে এগুলোর কোনটারই কিন্তু দরকার ছিলো না। বরং দামী গাড়ি কিংবা পোশাক আশাকের পেছনে নিয়মিত অর্থ ব্যয় না করে টাকাগুলো ব্যাঙ্কে তুলে রাখলে অপব্যয়িতার হাত থেকে মুক্ত থাকা যেত, পয়সা কড়িও একটু বেশি জমতো। কিন্তু তাই কি হয়?  কোন পয়সাওয়ালাই কেবল সুইস ব্যাংকে তার সব টাকা পয়সা তুলে রেখে ছেঁড়া গেঞ্জি, পায়জামা আর ছেড়া স্যাণ্ডেল পরে টো টো করে ঘুরে বেড়ায় না। বরং উলটো – নিজের অর্জিত সম্পদের সংকেতকে বস্তুনিষ্ঠভাবে অন্যের কাছে তুলে ধরতে চায় – আর  রাজপ্রাসাদোপম বাড়ি কিংবা দামী গাড়ি, জুতো জামা কেন্দ্রিক অপব্যয়িতাগুলোই হচ্ছে তাদের জন্য সর্বসাধারণের কাছে সম্পদ প্রকাশের ‘ফিটনেস মার্কার’।

নিজের সম্পদকে তথা ব্যয়বহুল অলঙ্কারগুলোকে সততার সাথে প্রকাশ করে নিজের ‘ফিটনেস’কে বিজ্ঞাপিত করতে চায় সকলেই।  সম্পদ বলতে কেবল শুধু বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা, জুতো জামার কথাই আমি বোঝাচ্ছি না, সেই সাথে আমাদের বিজ্ঞাপিত সম্পদের তালিকায় চলে  আসবে শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞান, সাহস, দৈহিক শক্তি, সঙ্গিত প্রতিভা, বাকচাতুর্য, সুদর্শন চেহারা, কৃষ্টি, নৃত্যপটুতা, প্রগতিশিলতা, অধিকার সচেতনতা, উদ্ভাবনী শক্তি, দৈহিক সৌন্দর্য, সততা, নৈতিকতা, দয়াপরবশতা, রসিকতা, হাস্যরসপ্রিয়তা সহ অনেক কিছুই। কারণ দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে মানুষ শিখেছে যে এই দৃষ্টিনন্দন গুণাবলীগুলোর প্রতিটিই বিপরীত লিঙ্গের কাছে হয়ে উঠে আকর্ষণের বস্তু, আর সম্ভবতঃ যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরেই সেগুলো মানব সমাজে বিকশিত হয়েছে বিপরীত লিঙ্গের বিভিন্ন চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে। কিন্তু তার পরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি এর কোনটিই বিয়ের সময় হীরার আংটির মতো গুরুত্বপূর্ণ ‘ভালবাসার উপঢৌকন’ হিসেবে উঠে আসে না। কিন্তু কেন?

চিত্রঃ যৌনতার নির্বাচন যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে, প্রকৃতিতে দৃষ্টিকটু রকমের অপব্যয়িতাই হচ্ছে সততার সাথে নিজের সম্পদকে অন্যের সামনে তুলে ধরার একমাত্র সহজ মাধ্যম। সেজন্যই কি হীরার আংটি মানব সমাজে এত পছন্দনীয় ‘নাপশাল গিফট’?

হীরার আংটি দিয়ে প্রস্তাব না করে আপনি আপনার প্রেমিকাকে  বাজার থেকে একটা আইদাহ আলু কিনে কিংবা সিলেটি কমলালেবু নিয়ে এসে প্রস্তাব করতে পারতেন। যত হাস্যকরই শোনাক না কেন, আলু কিংবা কমলালেবুর ব্যবহারিক উপযোগিতা কিন্তু হীরা কিংবা সোনাদানার চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষুধার সময় আলু খেয়ে কিংবা মনের আনন্দে কমলা চিবিয়ে আপনি খিদে দূর করতে পারেন। কিন্তু হীরার আংটি দিয়ে সেসব কিছুই আপনি করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরেও বাগদানের রোমান্টিক সময়ে  হীরার বদলে আলু নিয়ে হাজির হলে, আপনার কপালে কী দূর্গতি হবে সেটা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে!  আলু পটল তো কোন ছার, এমনকি দামী গাড়ি বাড়ি, কম্পিউটার, আই ফোন কোনকিছু দিয়েই আপনি বিয়ের সম্পর্ক তৈরি করতে পারেবন না, যদিও এগুলোর সবগুলোরই কিছু না কিছু ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে। রহস্যটি হল, জাহাভির হ্যাণ্ডিক্যাপ প্রিন্সিপাল অনুযায়ী, বিয়ের প্রস্তাবের (প্রাণিজগতে অবশ্য যৌনসম্পর্কের) উপহার এমন হতে হবে যার কোন ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই (এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা হতে পারে ময়ুরের পেখমের অপকারী), কিন্তু  বিপরীত লিঙ্গের চোখে তা হতে হবে অমূল্য। জৈববিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘কোর্টশিপ গিফট’ (courtship gift) বা ‘নাপশাল গিফট’ (nuptial gift)[1],[2]।  গাড়ি বাড়ি, আইদাহ আলু কিংবা আইফোন সবকিছুরই ব্যবহারিক কিছু না কিছু উপযোগিতা আছে পুরুষের কাছে। তাই সেগুলো কখনোই ‘কোর্টশিপ গিফট’ হয়ে উঠার যোগ্য নয়। কোর্টশিপ গিফট গতে পারে কেবল হীরা কিংবা স্বর্ণালঙ্কারের মত অপদ্রব্যগুলোই, যেগুলোর কোনই ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই পুরুষের কাছে, অথচ নারীর মানসপটে সেটি অমূল্য এক ‘ফিটনেস মার্কার’।

গবেষক পিটার সজু এবং রবার্ট সেইমোর ২০০৫ সালের ‘Costly but worthless gifts facilitate courtship’ নামের একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘কোর্টশিপ গিফট’-ই কার্যকরী যা হবে দৃষ্টিকটুভাবে অপব্যয়ী এবং ব্যবহারিকভাবে মূল্যহীন [3]। মানব সমাজের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে সেজন্যই হীরার আংটি কিংবা স্বর্ণালঙ্কার খুব চমৎকার একটি  ‘কোর্টশিপ গিফট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একটি কারণ এর কোন ব্যবহারিক মূল্য পুরুষের কাছে নেই। কোন পুরুষই হীরা কিংবা সোনার জন্য লালায়িত থাকে না। হীরা বা সোনা দোকানে নিয়ে বেঁচে দেয়া ছাড়া একজন পুরুষ কিছুই করতে পারে না। সেটা নিয়ে সে বাঁচতে পারে না, সেটা খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে না, পারে না আমোদিত হতে। কেবল একটি কাজই সে হীরা দিয়ে করতে পারে – নারীকে উপহার দিয়ে  দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, আর ভালবাসার সম্পর্কের সূচনা করতে- হতে পারে সেই সম্পর্ক স্বল্পমেয়াদী কিংবা দীর্ঘমেয়াদী।  শোনা যায়, কুখ্যাত ‘লুলপুরুষ’ আজিজ মুহম্মদ ভাই নাকি স্বল্পমেয়াদী সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে হীরার অলঙ্কারের উপর নির্ভর করতেন। চলচিত্রের নায়িকা, গায়িকা, অভিনেত্রী, মডেল  থেকে শুরু করে খবর পাঠিকা সহ শোবিজের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সুন্দরী ললনাদের শয্যাসঙ্গি করার অভিপ্রায়ে তাদের পৃথিবীর আধুনিক নামি দামি  কোম্পানির জুয়েলারি পাঠাতেন।   আজিজ মুহম্মদ ভাই তার স্বল্পমেয়াদী সম্পর্ক বা শর্ট টার্ম স্ট্র্যাটিজির জন্য যে ধরণের বিনিয়োগ করতেন দেখা গেছে, সে ধরণের বিনিয়োগ একই রকম কার্যকরী লং-টার্ম স্ট্র্যাটিজির ক্ষেত্রেও।  সেজন্যই বাংলাদেশের বিয়েতে সোনাদানা কিংবা পাশ্চাত্যে হীরার অংটি  বৈবাহিক সম্পর্কের সূচনায় এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

মেরোলিন মনোরোর কথা আমরা সবাই জানি। পঞ্চাশ ষাটের দশকের সুদর্শনা অভিনেত্রী ছিলেন তিনি, এবং মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যাবার আগ পর্যন্ত ছিলেন বহু পুরুষের হার্টথ্রব। অভিনয়ের পাশাপাশি ভাল গানও গাইতেন মনোরো। মনোরোর গাওয়া চমৎকার গান আছে ‘Diamonds Are a Girl’s Best Friend’ নামে। মেরোলিন মনোরো গানটি গেয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে ‘Gentlemen Prefer Blondes’ নামের একটি ছবির জন্য । গানের কথাগুলো এরকমের –

The French were bred to die for love
They delight in fighting duels
But I prefer a man who lives
And gives expensive jewels
A kiss on the hand may be quite continental
But diamonds are a girl’s best friend

A kiss may be grand but it won’t pay the rental
On your humble flat, or help you at the automat
Men grow cold as girls grow old
And we all lose our charms in the end
But square cut or pear shaped
These rocks don’t lose their shape
Diamonds are a girl’s best friend…

গানটি ইউটিউব থেকে শোনা যেতে পারে এখান থেকে –

httpv://www.youtube.com/watch?v=0L8sHIU8YAg

আরেকটা বিখ্যাত গান আছে ‘ডায়মন্ডস আর ফর এভার’ নামে। গানটি ১৯৭১ সালের শন কনরি অভিনিত জেমস বন্ডের একটি সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিলো। গায়িকা ছিলেন শার্লি ব্যাসি, পঞ্চাশের দশকের আরেকজন জনপ্রিয় শিল্পী (এবং আমার এখনো প্রিয় গায়িকা)। গানের কথাগুলো এরকমের –

Diamonds are forever,
They are all I need to please me,
They can stimulate and tease me,
They won’t leave in the night,
I’ve no fear that they might desert me.

Diamonds are forever,
Hold one up and then caress it,
Touch it, stroke it and undress it,
I can see every part,
Nothing hides in the heart to hurt me.

I don’t need love,
For what good will love do me?
Diamonds never lie to me,
For when love’s gone,
They’ll luster on….

গানটি শোনা যাবে এখান থেকে –

httpv://www.youtube.com/watch?v=D7_u_46e3Dc

আমাদের দেশ সহ ভারতবর্ষে হীরার মত সোনাকেও ভালবাসার খুব মূল্যবান উপঢৌকন হিসেবে ধরা হয়, এবং সেটাও একই কারণে। সোনা দানার কোন ব্যবহারিক উপযোগিতা পুরুষদের কাছে নেই, কিন্তু বহু নারীর কাছেই তা অমূল্য।

কেন ভারতবর্ষের নারীরা স্বর্ণালঙ্কার ভালবাসে? এর ব্যাখ্যা হিসেবে জনপ্রিয় rediff.com ওয়েবসাইটে দেখলাম বলা হয়েছে[4] –

‘স্বর্ণালঙ্কার (ভারতীয়) নারীর জন্য কেবল কেবল শক্তিশালী আবেগই তৈরি করে না, পাশাপাশি নারীর অবয়বকে সার্বিক পূর্ণতা দেয়।  নারী স্বর্ণালঙ্কার পরে নিজেকে মনে করে লাস্যময়ী, সুন্দরী,  সফল, আত্মপ্রত্যয়ী,  এবং যৌনাবেদনময়ী’।

রোমান কবি অভিড প্রায় একহাজার বছর আগে তার একটি লেখায় বলে গিয়েছিলেন,

“নারীরা কবিতা ভালবাসে। কিন্তু তার জন্য মূল্যবান কিছু উপহার দাও। … Gold buys honor; gold procures love”

অভিডের মৃত্যুর পর সহস্র বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু তবুও আমরা সেই স্বর্ণযুগেই পড়ে রয়েছি!

(দেখি কতদিন চালানো যায়…)

[৫ম পর্ব]

:line:

তথ্যসূত্রঃ

[1] Randy Thornhill, Sexual Selection and Nuptial Feeding Behavior, in bittacus apicalis (insecta: mecoptera), The American Naturalist, 1976.

[2] K Vahed, The function of nuptial feeding in insects: a review of empirical studies. Biol. Rev. 73, 43–78, 1998

[3] Peter D Sozou and  Robert M Seymour, Costly but worthless gifts facilitate courtship, Proceedings of the royal society of london, 272 (1575),  pp. 1877-1884, 2005.
[4] “Wearing gold not only enhances strong emotional feelings for its wearer but also completes a woman’s appearance – it makes women feel indulgent, beautiful, successful, confident and sexy. Women who wear gold jewellery consider it to be an integral part of their appearance, and consider it as a necessary item rather than just an accessory.”; Why do people wear gold jewellery?, http://www.rediff.com/money/2007/may/23gold1.htm;

উৎসর্গ: @Nourtia Nil এবং Tasbih Chowdhury (নতুন প্রেম শুভ হোক)

সখি, ভালবাসা কারে কয়? <আগের পর্ব : পর্ব-১পর্ব -২পর্ব-৩| পর্ব-৪| পর্ব-৫>