গতকাল মধ্যরাতে কবর থেকে উঠে এসেছে রহমান। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই তার এই উত্থান। আমি জানতাম ওর যা হতচ্ছাড়া স্বভাব তাতে করে বেশিদিন টিকতে পারবে না ওখানে। কোন স্কুলেই এক সপ্তাহের বেশি যায়নি সে, এ জন্য অশিক্ষিতই থেকে গেল সারা জীবন। আমরা বন্ধুরা যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ডিগ্রি কুড়িয়ে বেড়াচ্ছি, রহমান সেখানে দিব্যি দেশজুড়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছে তার এই হতচ্ছাড়া স্বভাব। আমরা মানে আমি আর ও পাড়ার সফদার যেদিন রিটায়ার্ড করে বাড়ি ফিরলাম। তার হপ্তা খানেকের মধ্যে রহমান যেন কোথায় থেকে উদয় হল! কর্মক্ষেত্রে ইতিমধ্যে পটল তুলেছে আমাদের অনেক বন্ধুই। রহমান এসেছে মাটির টানে। ইনফ্যাক্ট, আমরাও তাই। ধর্মে নাকি আছে, মানুষ যে স্থানের মাটি দিয়ে তৈরি সে-স্থানেই তার সাথে তার যমদূতের সাক্ষাৎ ঘটবে। আমাদের তৈরি এই গ্রামের স্যঁাতসেঁতে মাটি দিয়েই হওয়ার কথা। আমার ত্বক দেখলে দিব্যি বোঝা যায়। আর রহমান তো মরে সেটা প্রমাণ করলই। আর সুফিয়ানকে দেখলেই বোঝা যেত ও এখানকার না – যেমন বুদ্ধি তেমন চেহারাই। তাই তো মরলও ঐ সাদাদের দেশে। মাটিও হল ওখানে। ও দেশে ফিরছে না দেখে আমরা কত গালিগালাজ করেছি। ওর যে দেশ ওটাই তাই বা কে জানতো !

রহমান কবর থেকে উঠেই সোজা চলে এসেছে আমার কাছে। এই মধ্যরাতে ঘুম থেকে তুলে মেজাজ গরম করে বলে – শ্যালা, আমি যে মরলাম, তুই তো একটুও কাঁদলিনা! সাধে কি আর লোকে তোকে গন্ডারের সহোদর বলে।

আমি চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম- আমি জানতাম তুই ঠিকই ফিরে আসবি। খালি খালি কান্নার অপচয় ঘটিয়ে লাভ কি, বল্!

ঐ মধ্যরাতে রহমান এক কাপ চা খেয়ে বিদেয় হল। আমার স্ত্রী অতি বিরক্তের সাথে ওটা বানিয়ে দিল।

এ কয়দিনে রহমানের ভিটে-মাটি নিজের বৌ-সন্তান না থাকায় ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। রহমানের স্বভাব ওদেরও অজানা নই। যে সব পাওনাদাররা রহমানকে বিষন্ন মনে মাপ করে দিয়েছিল, তারা আবার ধরনা ধরছে পাওনা আদায়ের জন্য। বিকেলে এসে আমার কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার করে গেছে ও। ধারের টাকাই ধার শোধ দেওয়া আর কি!

ঐদিকে শহরে রহমানের উত্থানের খবরে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। দলে দলে সাংবাদিকরা আসছে এবং দফায় দফায় সাক্ষাৎকার নিচ্ছে রহমানের। তবে সুবিধাজনক কোন তথ্য বের করতে পারছে না রহমানের মুখ থেকে। ফলত, যে যার মত ছেপে দিচ্ছে খবর। আমার স্ত্রী সেই রাতের সেই সামান্য চা বানানোর ঘটনাকে কেচ্ছা বানিয়ে বেশ সেজে-গুজে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা পেপার লিখেছে, ‘একি দজ্জাল নাকি আল্লাহর নেক অলির উত্থার – রহস্যের ঘোর কাটছে না কিছুতেই!!’ আমেরিকার একটি দৈনিক লিখেছে, ‘মধ্যরাতে বাংলাদেশের এক গোরস্থান থেকে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক টেরোরিস্ট ওসামা বিন লাদেন! বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত হস্তান্তরিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে আফগান-ইরাকের কথা।’ রহমানের সাথে লাদেনের চেহারার কোন মিলই নেই। আমেরিকার সরকারকে বোঝাতে নিশ্চয় বড় রকমের বেগ পোয়াতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। কিংবা সমস্যার সমাধান ঘটাতে হলিউডীয় প্রযুক্তির সহায়তাই রহমানকে ভালো করে লাদেনীয় মেকআপ করিয়ে আমেরিকায় পাঠানো যেতে পারে। সেই সাথে ওকে আরবের ল্যাঙ্গুয়েজটা শিখিয়ে নেওয়া খুব জরুরী। বিনা খরচে আমেরিকার বিশেষ অতিথি হওয়ার সুযোগটা নিশ্চয় হাতছাড়া করতে চাইবে না রহমান।

রহমানের কাছ থেকে পানি পড়া নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ। রহমান পানিতে ফুঁ দেবে না কিছুতেই। মানুষজন বাধ্য হয়ে রহমান উত্থানের পর প্রথম যে পুকুরে গোসল করেছিল সেই পুকুরের পানি এখন দেদারে গিলছে। পুকুরের পানির দশা বেহাল দেখে লিটার প্রতি ২টাকা করে নিচ্ছে পুকুরের মালিক রহিম মোল্লা। রহিম মোল্লার ছোটভাই রব মোল্লা জনগণকে তার পুকুর দেখিয়ে বলছে, বাবা হযরত রহমান এই পুকুরেই দ্বিতীয় দিন গোসল সেরেছেন। আসেন লিটার প্রতি মাত্র ১টাকা! শহর থেকে প্রশাসনের লোক এসেছে, ১৫% ভ্যাট আদায় করা হবে এই টাকা থেকে।

গতকাল পানি পড়া নিতে আসা একটি বাস গ্রামের সরু রাস্তা ধরে আসার সময় খাদে পড়ে জনা বিশেক মানুষ মারা গেছে – এদের বেশিরভাগই সুস্থ ছিল, মৃত্যু পথযাত্রি আত্মীয়-স্বজনদের জন্য পানি পড়া নিতে এসেছিল। ভেবে অবাক লাগছে, ধর্মের কথা ঠিক হলে, এই খাদের পচা পানি দিয়েই আল্লাহ্ তৈরি করেছিলেন এতগুলো মানুষ। একেই বলে আল্লাহর কুদরত!

গ্রামের উত্তর দিকের ফাঁকা জায়গাটিতে মেলা বসেছে। বিক্রি হচ্ছে জিলিপি, পেয়াজি, চপ, শিঙ্গাড়া ও হাতপাখা। এবং অবশ্যই পানি। মানুষজন প্রথমেই যে জিনিসটি কিনছে তা হল হাতপাখা। এই গরমে এটার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণে। দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। হাতপাখার ব্যবসা করেই জনা কয়েক পাকা ঘর তুলে ফেলতে পারবে। যারা দিনে দিনে বাড়ি ফিরে যেতে পারছে না, তারা আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের স্কুলের সাদ ও বারান্দাতে। সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে বিদ্যাপীঠ। এ কয়দিনে হালকা বসতিপূর্ণ প্রান্তিক গ্রামটি ঢাকা শহরের কোলাহলকেও হার মানিয়েছে। শহর থেকে এমপির লোকজন ঘুরে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছে, এ বছরেই গ্রামের রাস্তা-ঘাট আরও উন্নত করে দেওয়া হবে। বিরোধী দল বলে বেড়াচ্ছে, সরকার তার ব্যর্থতা থেকে জনগণকে মুখ ফেরানোর জন্য এ এক নতুন খেল শুরু করেছে।

যাকে নিয়ে এই উৎসব, এত আয়োজন সেই রহমানই হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেল। অলি-গলি তন্ন-তন্ন করে কোথাও হদিশ মিলল না তার। দিন কতক পরে মধ্যরাতে আমার বাড়িতে হাজির রহমান। আমার স্ত্রী বেশ আগ্রহের সাথে চা বানাতে গেল। কানে কানে বলে গেল টেবিলের জলভর্তী পানিতে একটু ফুঁ দিয়ে নিতে। রহমান চা না খেয়েই উঠে গেল। ও খুব পরিশ্রান্ত, বিশ্রামের বড় দরকার। কবর পর্যন্ত আমি এগিয়ে দিলাম ওকে। দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আমার চোখ বেয়ে। ‘কান্নার অপচয় করে লাভ নেই, আমি কিন্তু তোকে আর তোর বউকে মাঝে-মধ্যে এসে জালিয়ে যাব।’ ‘আমিই বা আর কতদিন!’ – হাসতে হাসতে বলেছিলাম।

পরদিন রহমানের কবর পাকা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল একটি মহল – রহমান যাতে আর সটকে আসতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। অন্য একটি মহল বিষয়টি বুঝতে পেরে কবর পাকা করার বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে পড়লো।

আমার স্ত্রীর এখন মাথা ব্যথা একদমই সেরে গেছে। ওকে বলা হয়নি সেদিন পানিতে ফুঁ-টা আমিই দিয়েছিলাম।

মোজাফ্ফর হোসেন
সম্পাদক, শাশ্বতিকী