গুহার আঁধারে প্রভাত পাখীর গান
এক লোক রাতের বেলা লাইটপোস্টের নীচে কি যেন খুঁজছে।
অন্য একজন পথচারী জিজ্ঞেস করছে, কি খুঁজছেন, ভাই,
লোকটির উত্তর, আংটি খুঁজছি।
কখন হারিয়েছেন? কীভাবে আঙ্গুল থেকে পড়ল?
আরে একটু আগে হারিয়েছি। ঐ কবরের পাশ দিয়ে আসার সময় আংটিটি আঙ্গুল থেকে খুলে হাতে নিয়ে দেখছিলাম।
পথচারীর বিস্ময়াভিভূত প্রশ্ন, আঙ্গুলের আংটি হাত নিয়ে দেখছিলেন? অন্ধকারে? আর হারিয়েছেন ঐ কবরের পাশে? তো এখানে খুঁজছেন কেন?
লোকটি চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত ভাব এনে বলল, কবরের পাশে তো আলো নেই। তাই আলোর নীচে খুঁজছি।
ও আচ্ছা। খুঁজেন। আংটি না পেলেও খুঁজতে সুবিধা।এই বলে পথচারী মুচকি হেসে কেটে পড়ল।

আমাদের বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ গড়ার প্রচেষ্টাও যেন কবরের পাশে অন্ধকারে আংটি হারিয়ে লাইটপোস্টের আলোর নীচে সুবিধাজনক জায়গায় খোঁজা।
আর অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করি অর্থাৎ আংটি হারানোর সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেই আংটি আঙ্গুলে না পড়ে হাতে নিয়ে চলা ফেরায়।

আলোকে তথা বিজ্ঞানকে নিয় যেতে হবে অন্ধকারে সেই কবরের পাশে —— যারা এখনও ধর্মকে মনে করে জীবনের পথ প্রদর্শক। ধর্মীয় রীতিনীতিকে কেন্দ্র করে যাপিত হয় জীবন।
স্বশিক্ষিত, সুশিক্ষিত, সজাগ, সচেতন, সক্ষম লোকদের কাছে অর্থাৎ আলোর নীচে হ্যাজাক জ্বালিয়ে লাভ কি!
কিছু কিছু লোক বিশ্বাসকে, প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যলেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হবে। যে ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস বিজ্ঞানকে মানে না, যুক্তিকে পুঁছে না, কুসংস্কারকে মুছে না,পৃথিবীকে জানে না। অনেকে বাস্তব জ্ঞানকে অস্বীকার করে অলৌকিক এক অস্তিত্বের আরাধনায় ব্যাপৃত।

ব্লগিং অর্থাৎ শুধু সফটওয়ারে যুক্তির চেতনা ও বিজ্ঞানের আলো ছড়ালে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে যুক্তিবাদী আর বিজ্ঞান মনষ্ক করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন মফস্বলে, গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন যুক্তিবাদী কার্যক্রম পরিচালনা।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠি পরকালের স্বর্গীয় জীবন যাপনের লোভে ইহকালের মায়া মমতাকে ছিন্ন করতে চায়। পারে না। মনোবেদনা পোষে রেখে প্রচলিত বিশ্বাসকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়।
যেমনঃ সামাজিক চর্চায়, সংস্কারে, দৃষ্টিভঙ্গিতে মা বাবার প্রতি মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে যে ধারণা তা থেকেই বুঝা যায় মা বাবার পরিবারে মেয়ের স্থান। আমি ছোটবেলায় দেখেছি এক মা মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে হঠাৎ করে মারা যাওয়াতে মৃত দেহ ঘরের বেড়া কেটে বের করতে হয়েছে। দরজা দিয়ে নয়। প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি —- মেয়ের বাড়িতে মরলে মেয়ের দেনা শোধ করার জন্য এ রীতির প্রয়োগ।
পালটা প্রশ্ন করেছি,মেয়ের বাড়ি দালান হলে কি করবে? ভাঙ্গবে?

উত্তর ছিল না। সামাজিক এ সংস্কারের উত্তর নেই। তবু একজন বলেছে, গরীব মানুষেরাই মেয়ের বাড়িতে এসে মরে।
ছেলে না থাকা মানেই গরীব। আরও ব্যাখ্যা হল ছেলে থাকলে কেউ মেয়ের বাড়ি এসে মরে না। কি অসঙ্গত, অসংস্কৃত,অবিবেচকের মত উত্তর!

বর্তমানে আমাদের অভিজ্ঞতা কি বলে? আমি তো আমার আশেপাশের ষাটোর্ধ বাবা মায়ের দশজনের অন্তত ছয়জনকেই মেয়ের তত্ত্বাবধানেই থাকতে দেখি। অনেকে আবার ছেলের কাছে থাকলেও মেয়ে সারাক্ষণ খোঁজ নেয়।
বাংলাদেশে আমাদের নরসিংদি এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিয়ের দিন মেয়েকে যখন বরকে বরণ করার জন্য ঘর থেকে বের করা হয় তখন তার হাতে একমুঠো ধান/ চাল দিয়ে বলা হয় ছিটিয়ে ছিটিয়ে বের হতে আর মনে মনে বলতে আমার মা বাবার ঋণ শোধ করে দিলাম। আর বাকিরা তখন কনের উপরে খই ছিটিয়ে দেয়।

কী প্রহসন! প্রথমত, মা বাবার দেওয়া ধান/ চালই ছিটায়, দ্বিতীয়ত, একমুঠো ধান/ চাল ছিটিয়েই প্রতিকীভাবে ঋণ শোধ করে, তৃতীয়ত, মেয়ে বলে বিয়ের একটু আগেই আজীবনের জন্য মা বাবার ঋণ,তাদের প্রতি দায় দায়িত্ব শেষ করে দিয়ে যায়। যৌতুক দিয়ে ফতুর হওয়া মা বাবার দায় একমুঠো ধান/ চাল ছিটিয়ে শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে এক বোঝা যৌতুক গ্রহণ করা বরকে বরণ করতে। মেয়েকে কত সহজে তার দায় দায়ত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়। আসলে পরগাছা মেয়ের কাছে কোন প্রত্যাশা থাকতে নেই বলেই মেয়েকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে তোলার চিন্তা মা বাবার মধ্যে কাজ করে না।

মা বাবার প্রতি ছেলে মেয়ের সমান দায় দায়িত্ব রয়েছে। ছোটবেলায় বাংলা রচনা শিখিয়েছে পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য। ঐ রচনায় বায়োজিদ বোস্তামীর একটা ঘটনাও রচনা বইয়ে দেয়া ছিল। অসুস্থ মা জল খেতে চেয়েছেন। ঘরের কলসীতে জল নেই। বায়োজিদ বোস্তামীর অনেক দূর পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে জল এনে দেখেন মা ঘুমিয়ে আছে। মাকে আর না ডেকে মায়ের শিয়রের কাছে বসেছিলেন। মা জেগে দেখেন ছেলে না ঘুমিয়ে জল নিয়ে তার শিয়রের কাছে জেগে বসে আছে। কোন মেয়ের এমন উদাহরণ পড়িনি। অর্থাৎ সন্তান হিসেবে মা বাবার প্রতি দায় দায়িত্ব , কর্তব্য, একনিষ্ঠতা সমাজ ছেলের কাছেই দাবি করে, প্রত্যাশা করে। আর এ দাবির ও প্রত্যাশার যৌক্তিকতা রয়েছে উত্তরাধিকার আইনসহ ছেলে সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্বে।
কাজেই এসব অনালোকিত জায়গায় যুক্তির আলো ফেলতে হবে।
(চলবে)