ছাত্র-ছাত্রীরা চলে যাবার পর ছাপড়ার ঘরটার মধ্যে সে একা হয়ে যায়। ভাঙ্গা বেড়া, ভাঙ্গা জানালা। অথচ এ ছাপড়ার ঘরটার মালিক হলো কোটিপতি। কোটিপতিদের কেউ এখানে থাকে না। লজিং মাস্টারদের জন্য নির্মিত এ ঘরটা তার কাছে বেশ লাগে। জানালার কাছে বসলে পশ্চিমের আকাশ দেখা যায়। বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে যখন বড় কোন জাহাজ যায়, তার মাস্তুল পর্যন্ত দেখা যায়। তার কাছে এ এক বিশাল প্রাপ্তি। একটা চাকরি হলে পরে নদীর পাড়ে ঘর ভাড়া নেবার সখ তার অনেকদিনের। সেই চাকরি তার হলো না। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
চাকরি খুঁজতে খুঁজতে একদিন সে বুড়ো হয়ে যাবে, তারপর গাছ-পালা আর পশু-পাখির মত তারও মৃত্যু হবে একদিন। মৃত্যু-র পূর্বে হাতে গোনা এই ক’টা দিন, একটু পেট ভবে খেয়ে মরতে পারলে মন্দ হতো না, পেট ভরলে না হয় একজন সঙ্গীর কথা ভাবা যেত। সেও বেশিদিনের জন্য নয়, মাত্র কয়েকদিনের জন্য। তারপর সমুদ্র পার থেকে ফিরে এসে হয়তো মরতে মন চাইতো না, তবুও হয়তো এখনকার মত খারাপ লাগতো না।
না, না, কথাটা ঠিক নয়। মানুষ দুঃখে থাকলে মরে যাবার আগে সুখ পায়, আর সুখে থাকলে মরে যাবার আগে দুঃখ পায়। এখন অবশ্য মরে গেলে কেউ জানবে না, এমনকি কাক-পক্ষীর কন্ঠ থেকেও কোন ধ্বনি উদ্গত হবে না। অথচ একটা সময় গেছে, যখন তার মৃত্যুতে কয়েকটা হরতাল হয়ে যেতে পারতো। অথবা দেশবাসী তার মৃত্যুতে গভীর শোক সাগরে ভেসে যেতে পারতো, যেমন হয়েছিল নুর হোসেনের বেলা। জাফর জয়নাল, দীপালি, নুর হোসেন সহ আরো কতজন তাকে বাঁচিয়ে রেখে গেছে, ব্যক্তিগত গাড়ি হাঁকিয়ে চলার জন্য। অথচ তার পেটেই এখন ভাত জুটে না। মাঝে মধ্যে মনে হয়, এখন একটা হুলস্থুল বেঁধে গেলে মন্দ হতো না। তাহলে সেও নায়ক হয়ে ওঠবার চেষ্টা করতে পারতো । তার চেনা জানা অনেক মেয়ে হয়তো, তার কথা ভেবে গোপনে চোখের জল ফেলতো। সে সুযোগ আর আসবে না। এখন গণতন্ত্র এসে গেছে। এরশাল সামরিক আসন থেকে নেমে এসে, গণতান্ত্রিক নেতা- নেত্রীদের পাশে ঠাঁই নিয়েছেন। তিনি, নিজেও এখন গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের জন্য আর লড়াই হবে না। তাহলে হুলস্থুল বাঁধবার সম্ভাবনাও নেই।
তবুও সে গৌরবময় মৃত্যুর স্বপ্ন দেখে।
এর নাম হলো স্বপ্ন।
চাইলেই কি আর এখন হুলস্থুল বাঁধানো যাবে? যেমন বাঁধিয়েছিল ১৫ ফ্রেবুয়ারী। জল কামান আর বন্দুক নিয়ে ছুটে এসেছিল দেশের অতন্দ্র প্রহরী। তারা গুলি চালিয়ে, খুন করে, নির্যাতন চালিয়ে, গণ গ্রেফতার করে দেশকে উদ্ধার করেছিল আসন্ন অন্ধকারের হাত থেকে। আর তাই সে এখন খেতে পারছে না।
তো এখন মরে গেলে, সে মৃত্যুতে কোন গৌরব থাকবে না।
নিজেই নিঃশব্দে হাসল। পরক্ষণে হাসিটুকু গোধূলি বেলার ফিকে আলোর মত দীর্ঘশ্বাসের আঁধারে ডুবে গেলো। অলস হাত ওঠে এলো পুরনো নথিপত্র। এটা একটা বাতিকে রূপ নিয়েছে। অতীতের পাতা উল্টে উল্টে ঘুরে বেড়ানোর নেশা, সিগারেটের ধোয়ার মত পাক খেয়ে খেয়ে সবকিছুকে ঝাপসা করে রাখে।
এই যেনো ভাল।
আবেদন পত্রের অনেকগুলো ফটোকপি, এখনো সযত্নে রেখে দিয়েছে। এক সময় ভাবতো বিয়ে করবে, সন্তান হবে,নাতি-নাতনিদের দেখাবে। এখন আর ভাবে না। আবেদনপত্রগুলো উল্টে পাল্টে দেখে, আর এলোমেলো কিছু চিরকুট। তারপর হাত ওঠে আসে প্রথম যৌবনের কবিতার মত করে লেখা, আকুতি মাখানো প্রেমপত্র, যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, দে’য়া হয়নি। আজো সযত্নে রেখে দিয়েছে। গৃহশিক্ষতার অবসরে এই হলো তার জগত, তার সংসার।
ছবিটা দেখে। যতবার দেখে, ততবারই সে চমকে যায়। এ চমকটুকু আছে বলেই বারবার দেখে। ভাঁজ করা একটা কাগজের ভেতর, খুব যত্ন করে রাখা। টগবগে এক তরুণ, চোখে মুখে প্রতিরোধের আগুন। প্রতিবারের মত এবারও ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। ছবিটা একখন্ড কাগজ থেকে বেরিয়ে সদর্পে এগিয়ে যায়। খালি গা। শার্টটা প্যান্টের ওপর বাঁধা। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের মুখোমুখি। চারদিক থেকে ভেসে আসে প্রতিরোধের শ্লোগান। ইট-পাটকেল, টিয়ার গ্যাস তারপর “মহান শাসক’-দের প্রিয় বুলেট, প্রতিষ্ঠান রক্ষার বুলেট, দেশ রক্ষার বুলেট, গদি রক্ষার বুলেট, শান্তি রক্ষার বুলেট, জানমালের নিরপত্তা রক্ষার বুলেট – সবগুলো বুলেট একসাথে ছুটে এসেছিল। চারদিকে ভয়াবহ আর্তনাদ, ছুটাছুটি। সে হতভম্ব হয়ে ভাবছিল, খাকি পোশাক পড়লেই কি মানুষ পাল্টে যায় ? হুকুমের দাস হয়ে যায় ? ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আর বাঙালীতে কোন ভেদ থাকে না ?
হেঁচকা টানে তার চৈতন্য এসেছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কনক। তারপরই তার কানে এলো কর্কশ ধ্বনি. “ভাগ হারামজাদা, সব পাগলা কুত্তা অইয়্যা গেছে।“ তার কথা শেষ না হতেই মফিজ যার সাথে রাজনৈতিক মত পার্থক্য অনেক, হাত চেপে ধরে দৌড়াতে শুরু করলো। দোয়েল চত্বরের সামনে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে মফিজ বললো, “কবিতা মারাচ্ছিলি, যা সোজা হলে চইলা যা, হলে গিয়া কাপড়-চোপড় বদলায়া আয়”।
তখনো ঘোর । নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তার সর্বাঙ্গ লাল। কখন যে জল-কামানের হামলা হয়েছিল, মনেই করতে পারলো না।
হলের সামনে এসে দেখলো, চারদিক কেমন নিঝুম। প্রথম ভাবলো, রুমে কেউ নেই। তবুও কড়া নাড়লো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো আরমান। তাকে দেখেই চমকে গেলো, “কি ব্যাপার, কি হয়েছে ?” উত্তরের অপেক্ষা না করে তাকে নিয়ে গেলো পাশের রুমে।
ক্লান্ত কন্ঠে সে বললো, “গুলি হয়েছে, জাফর, জয়নাল. দীপালিসহ অনেকে মারা গেছে।“
“কি লাভ এসব করে?” আরমান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো।
সে আরমানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, হাঁফাচ্ছে। তার শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে বিড়বিড় করে বললো, “ এ রক্ত বৃথা যাবে না”।
আরমান বললো, “সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে কি করতে পারবি তোরা, আমি বুঝি না”।
সে বললো, “ আমাকে একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট দে, রঙ মাখা কাপড় নিয়ে বেরুলে গ্রেফতার করা সহজ হয়ে যাবে”।
পাশের রুম থেকে রেজোয়ান বেরিয়ে এলো। তার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেও হাঁফাচ্ছে, খালি গা, তার শরীরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। পরক্ষণেই ভেসে এলো, নারী কন্ঠের হাসি।
আরমান চলে গেল তার রুমে। সে তার পিছু নিতেই রেজোয়ান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো. “আপনি এখানেই বসেন।“
সে ঘাড় নীচু করে বসে রইলো।
আরমান তার শার্ট-প্যান্ট নিয়ে এলে সে সে-গুলো পড়ে বেরিয়ে গেলো।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“অপরাজয়ের পাদদেশে।“
মিছিলে মিছিলে এ যেনো এক অন্য রকম ক্যাম্পাস। সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে জাতীয় নেতাদের জন্য। চারদিকে গুঞ্জন. “আমরা সামরিক আইন ভেঙেছি, এবার তোমরা এসে হাল ধর”।
তার পেটে তখন আগুন। সকালে পায়ে হেঁটে এসেছিল ক্যাম্পাসে। দেখা হয়ে গেল বারেক ভাইয়ের সাথে। কটন মিলের শ্রমিক। বারেক ভাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “মুখ তো শুকনা, কিছু খান নাই?”
সে ঘাড় নাড়লো। কোথা থেকে আবার কনক এসে হাজির। বারেক ভাই বললো, “মিছিল-মিটিং তো সারাদিনই চলবো মনে অয়, চলেন খাইয়া আই।“
সে আর কনক এক সঙ্গে বললো, “পকেটে পয়সা নাই।“
বারেক ভাই মুচকি হেসে বললো, “চলেন, পয়সার চিন্তা কইরেন না।“

ডাল-ভাত খেয়ে শাহবাগের মোড় থেকে চারুকলার সামনে আসতে না আসতে দেখতে পেল, ক্যাম্পাস থেকে ছাত্ররা পাগলের মত দৌড়ে যে যেদিক পারছে, পালাচ্ছে। তাদেরকে হেঁটে আসতে দেখে চিৎকার করে কয়েকজন বলে উঠলো, “ঐ দিক যায়েন না, মিলিটারি হামলা করছে”।
এটা কি ’৭১? কিন্তু সে তো গত হয়েছে অনেকদিন। মিলিটারি হামলা করেছে? ভাষ্যকাররা ভুল দেখেনি তো?
সে এগিয়ে যেতেই বাঁধা দিল বারেক ভাই।
কনক আর বারেক ভাই চট করে তাকে নিয়ে পার্কের ভেতর ঢুকে পড়লো। ওখানে ছোট ছোট অনেক জটলা। সবাই দেখছে, ছাত্রদের লাঠিপেটা করতে করতে একটার পর একটা ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। ছোট জটলার ভেতর থেকে সে তীব্র ঘৃণায় একটা ঢিল ছুড়ে মারলো। অমনি চারদিক থেকে আওয়াজ এলো, “ঢিল মারে কে, অহন ঢিল মারলে পার্কেও হামলা করবো”।
অক্ষম ক্রোধে সে কাঁপছিল।
বারেক ভাই বললো, “খালি হাত আর একটা দুইটা ঢিল মাইরা কি করবেন, কিচ্ছু করতে পারবেন না। বন্দুকের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরতে অইবো”। বারেক ভাই সব সময় গরম গরম কথা বলে।
সে বারেক ভাইয়ের এই বিপ্লবী কথায় কান দিল না।
কনক চিৎকার করে বললো, “বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, সামরিক জান্তা খতম কর”। তার এ কথায় কেউ আমল না দিলে সে দু’একবার বলে থেমে যায়।
“জাতীয় নেতারা আসেননি?”
“আইছে আর গেছে, তারপরই এই কান্ড“
আরেকজন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, “ আমরা আন্দোলন করুম, আর উনারা হের ফল ভোগ করবো কিন্তু বিপদের সময় হেগোর দেহা পাইবেন না।“
ট্রাক তখনো যাচ্ছে। এর যেন শেষ নেই। এ যেন যুদ্ধরত দেশ। সৈনিকদের চোখে মুখে বিজয়ের আভা।
ট্রাকের পেছনে হঠাৎ আরমানকে দেখে আঁতকে উঠলো সে। প্রথম বিশ্বাস হয়নি, ঘাড় বেঁকে যতক্ষণ দেখা গেল, তাকিয়ে রইলো এবং নিশ্চিত হলো এ আরমানই। মনে হলো, কাতরাচ্ছে।
নিজের অজান্তে তার চোখ ভিজে গেলো।

রোকেয়া হলের সামনে পাগল মত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোহন রায়হান। এ যেন মাঝিবিহীন নৌকা। চারদিকে খন্ড খন্ড মিছিল। হাল ধরবার কেউ নেই। ১৫ ফেব্রুয়ারি হরতালের ঘোষণা মোহন রায়হানের কন্ঠ থেকে।
জগন্নাথ কলেজের ক্যান্টিনে সে, কনক আর রহিম ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ধর্মঘটের কথা ছড়িয়ে দিতেই একটা জটলা, তারপর লাঠি নিয়ে কোর্ট চত্বরে, কোর্ট চত্বর থেকে রাস্তায়। পুলিশ ফিরে গেল, দেশ রক্ষার সেনা বাহিনী এলো, গুলি আর জল কামানে রাস্তা আবারো রণক্ষেত্র হয়ে উঠলো। ছাত্রদের লাশ পড়লো। দেশ রক্ষা শেষে সেনা বাহিনী ফিরে গেল ব্যারাকে।

“স্যার, কি দেখতাছেন অমন মনোযোগ দিয়া?”
চোখ তুলে তাকায় সে। জগতটা অচেনা লাগে। চোখ আর মগজের কোষে তখনো ঘোর। নিশার কথায় সম্বিত ফিরে পায় সে। “না, তেমন কিছু না। নিজের একটা ছবি।“
“কই, দেহি, দেহি” বলে এগিয়ে এলো নিশা।
সে তাকে ছবিটা দেখাতে চাইলো না, বললো.”ছবিটা না দেখালে কিছু মনে করবে?”
“কার ছবি,…?”
পত্রিকার কাটিং ভাঁজ করে রাখতে রাখতে বললো, “আমার ছবি।“
“বুঝছি।“ বলে মুচকি হেসে নিশা চলে গেল।
নিশা চলে গেলে সে মনে মনে ভাবলো, “এসব ছবির মানুষগুলো বাস্তব জগতে রয়ে গেছে বলেই পালাবদলের নাটকে কেউ কেউ খুব ভাগ্যবান হয়।“

নিশা বেরিয়ে যেতেই দরজার ফাঁক দিয়ে ওর বাবাকে যেতে দেখলো। মূল বাড়ি থেকে আলাদা এই ছাপড়ার ঘরটায় পড়াবার বিনিময়ে সে থাকতে আর খেতে পায়। বড় কৃতজ্ঞবোধ করে সে। বড় দয়ালু আর মহান এই ধন কুবের। একদিন তুমুল ঝড়ের সময় তার নিজের ছেলেকে পাঠিয়ে, তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো, মূল বাড়িতে। ঝড় থেমে গেলে সে আবার চলে এসেছিল ছাপড়ার ঘরে। এটা তার সারাজীবনের শ্রেষ্ঠতম পাওয়া। এখানে থাকা খাওয়া হারাবার ভয়ে সে খুব সাবধান। কারো সাথে নিজের মনের কথাটি খুলে বলে না। বলা যায় না।
ছয়জন ছাত্র ছাত্রী। কে কখন এসে যায়, বলা যায় না। এ ভয় থেকেই কেউ আসবার আগেই কাগজগুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করে। চোখ দু’টো আবারো আটকে যায় ছবির ওপর। সেনা বাহিনীর বন্দুকের গুলি খেয়ে যারা সেদিন জগন্নাথ কলেজের প্রতিবাদী মিছিলে মরেছিলো, তাদের মৃত্যুর জন্য সেনা বাহিনী নয়, যেন সে নিজেই দায়ী। জাতীয় নেতারাও দায়ী নয়। তারা তো আন্দোলন করতে বলেনি, নিজেরাও করেনি। পরে সেই আন্দোলনকে শুধু হাইজ্যাক করেছে। নাটকের শেষ অংকে তারা হয়ে গেলো আপোষহীন নেত্রী, নেতা।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ভাবে, “কে জানে বারেক ভাই আজ কোথায়, কটন মিল বন্ধ হয়ে যাবার পর সে যে কোথায় চলে গেলো, কেউ জানে না।“
সামরিক জান্তাকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে কনক নিজেই উচ্ছেদ হয়ে গেল পৃথিবী থেকে।
ছবিটার উপর দিয়ে রহিম হেঁটে চলে গেলো চালের আড়তে।
এক সপ্তাহ পর রক্তাক্ত দাগ নিয়ে মুক্তি পেয়েছিল আরমান। সে এখন বড় ব্যবসায়ী। দামী গাড়ি হাঁকিয়ে চলে।
স্বপন ভাইয়ের গাড়ির তীব্র হর্নে ছবিটা সরে যায় রাস্তার একপাশে, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে গাড়ি রাজকীয় ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় সংসদ ভবনে।
বাদশা ভাই এখনো আন্দোলনের মাঠে ক্লান্ত হাতে বৈঠা ধরে বসে আছে, কখন আবার যাত্রী আসবে। বাদশা ভাই বোকা। সে জানে না, ব্রিটিশ আমল থেকে হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া আন্দোলনের ফসল দেখতে দেখতে মানুষ এখন আর নড়ে না, চড়ে না। পাথরের মত চুপ।
শিবলী ভাই কোথায়? হায় বেচারা! সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রথম গ্রেফতার হলো। সামরিক শাসন গেল, শিবলী ভাইয়ের পালিয়ে বেড়ানোর দিন আর শেষ হলো না। সে ঠিক মনে করতে পারলো না, কতদিন আগে শেষবার দেখা হয়েছিলো। কন্ঠে তার সেই আগুন। আশ্চর্য মানুষ। সে ভেবে পায়নি কেমন করে ওরা হাইজ্যাকারদের রুখবে।
ছাপড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই তার চোখের ওপর দিয়ে ওড়ে যায় অসংখ্য মাছি। সে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে বুড়িগঙ্গা সেতু-র নিচে। সেতু-র নিচে ভাসমান নাগরিকদের বসবাস। কার কাছে যেনো শুনেছিল, এখানে টুকাইগুলোকে বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। তার ভয় হয়, তবুও সে এগোয়। কিছুদূর যেতে না যেতে সে থমকে দাঁড়ায়।
বিদ্যুৎ ছিল না বলেই হয়তো মশাল মিছিলটাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। সে চট করে ঘুরে আসে। মিছিলটা গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসে। সে দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলোর কম্পন দেখে। মিছিলটা নৌকার মত দুলতে দুলতে এগিয়ে আসে, একেবারে সামনে এসে যায় কিন্তু সেটি না থেমে এগিয়ে যায়, এগিয়ে যেতে যেতে তার চোখের আড়াল হয়ে যায়, কিন্তু মিছলে উত্থিত শব্দগুলো তখনো বাতাসে ভাসতে থাকে, “দুনিয়ার মজদুর…..। “
তাদের আন্দোলন শেষে হয়ে গেছে সেই কবে। এরশাদের পতনের পরপরই, বিপুল বিজয় উৎসবের মধ্য দিয়ে, যাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বাংলাদেশের। নতুন দেশটাকে দেখবার জন্য সে আবারো পা বাড়ায় অন্ধকার সেতু-র নিচে।