কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও- গায়ে?
হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।
না’ই হলে সতী তবু ত তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি’
তোমাদের ছেলে আমাদেরই মত, তারা আমাদের জ্ঞাতি;
(কাজী নজরুল ইসলাম)

বারাঙ্গনা। বারবণিতা। আমাদের সকলের কাছে একটি ঘৃণ্য নাম, একটি অস্পৃশ্য নাম, একটি কলুষিত নাম। তার ছায়াও আমাদের কারো কাম্য নয়, তার সংস্পর্শ আমাদের কারো কাম্য নয়।আমরা যারা ভদ্র সমাজের বাসিন্দা, তারা তার নাম শুনা মাত্রই আঁতকে উঠি, ভয়ে শিউরে উঠি, ঘৃণায় শিরশির করে উঠি। তার নাম শুনে আমাদের কারো কারো জাত যায়, কেউ কেউ অপবিত্র বোধ করি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখি কেন সে বারাঙ্গনা হলো, কে তাকে বারাঙ্গনা বনালো, কে তাকে ঠেলে দিলো এই অন্ধকার পথে? না আমরা তা কখনো ভাবিনা। কারণ তা ভাবার আমাদের কোন দরকার নেই, সময় নেই।

দরিদ্র পিতা দারিদ্রের কারণে তার কন্যাকে বিক্রি করে দিয়েছে এমন ঘটনা বিরল নয়। ভণ্ড-প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ছলে বলে কৌশলে অন্য কারো হাতে তুলে দিয়েছে এমন ঘটনা বিরল নয়। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত গ্রাম্য- সরল-অবলা মেয়েকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারী-ব্যবসায়ী দালাল শহরে এনে বিক্রি করে দিয়েছে এমন ঘটনা বিরল নয় । এভাবে যদি একটি মেয়ে বারাঙ্গনা হয় তবে সেটা কি তার অপরাধ নাকি যারা তাকে বারাঙ্গনা বানালো তাদের অপরাধ? সমাজের চোখে মেয়েটির অপরাধ কারণ আমাদের সমাজে সব অপরাধের বোঝা মেয়েদেরকে বহন করতে হয়, সব কলঙ্কের কালিমা মেয়েদের গায়ে লেপন করা হয়।

একজন গৃহকর্মীকে কেন তার কর্মক্ষেত্রে অপদস্থ হতে হবে? কেন সে তার সম্মান নিয়ে কাজ করতে পারবেনা? গৃহকর্মীকে (দাসী) পুরুষের জন্য হালাল ঘোষণা করা হয়েছে। পবিত্র কোরানে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট একাধিক আয়াত রয়েছে । যার কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। তাই যেকোন বিবেক বিবর্জিত ধার্মিক পুরুষ তার সামর্থ্য অনুসারে সংখ্যাবিহীন দাসী রেখে তাদের সাথে অনায়াসে অবারিত যৌনলীলা চালিয়ে যেতে পারে। তাতে ধর্মীয় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই বরং আল্লাহ পাক স্বয়ং নিজে আয়াত নাজিল করে এ মহান কাজে মোমিন মুসলিম ভাইদের উৎসাহ প্রদান করেছেন। মানবাধিকারের ব্যাপারে ধর্ম বেশ অনুদার হলেও এ ব্যাপারে বেশ উদার। কর্মক্ষেত্রে ধর্ষিতা হয়ে অনেক নারীগৃহকর্মী পতিতা বৃত্তিকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। কতজন নারীগৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে ধর্ষিতা হন তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ এক্ষেত্রে নারীটিকেই সমাজ অসতী ঘোষণা করে, পতিতা ঘোষণা করে। তাই সে লজ্জায় মুখ বুজে মূক হয়ে থাকে। আর এভাবে যদি একজন নারী বারাঙ্গনা হয় সেক্ষেত্রে কে দায়ী? সে নারীটি নাকি ধর্ষণে উৎসাহ কারী গ্রন্থটি, নাকি সে গ্রন্থের অনুসারী পুরুষগুলো? অন্য যে কোন পেশাজীবী মানুষ যদি সম্মানিত হন তাদের নিজ নিজ পেশায়, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তাহলে একজন গৃহকর্মী কেন সম্মান পাবেননা তার পেশায় তার কর্মক্ষেত্রে? মহান আল্লাহ তালা এ কেমন বিধান লিখে দিয়েছেন তাদের জন্যে? তাকে চরম অসম্মান করার এ কী রকম পবিত্র-বাণী? এ রকম ঘৃণ্যবাণী কীভাবে কোন গ্রন্থে স্থান পেতে পারে?

প্রায় সব মেয়েই স্বপ্ন দেখে কারো ভালবাসা পাবার, একটি সুখের ঘর বাঁধার। কনকনে শীতের রাতে সবাই যখন কম্বল মুড়িয়ে ঘুমায় তখন একজন বারাঙ্গনা অনিদ্র চোখে রঙ মেখে শীতে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে পড়ে জীবিকার অন্বেষণে। কিন্তু কেন , কেন সে এ পথে গেল, কে নিয়ে গেল তাকে, কে তাকে বাধ্য করল? সমাজ তাকে নষ্ট বলে। আবার সমাজের মুখোশ পড়া সাধু পুরুষেরাই তার সাথে রাতের আঁধারে ক্ষণিকের অভিসারে যায়। তারা তাকে কখনো ভালবেসে আলিঙ্গন করেনা। করে শুধু কলুষিত পৌরুষ নিবৃত্তির ঘৃণ্য স্পর্শ। সেই স্পর্শে নেই কোন প্রেম, আছে শুধু বিকলাঙ্গ কাম। একটি রাতে সে বিক্রি হয় কয়েকটি হাতে। সেখানে তার কোন অনুভূতি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। আছে শুধু প্রয়োজন, শুধু পেটের দায়।নিজের খাদ্য জোগাড় করতে গিয়ে সে নিজেই হয়ে যায় সাধু পুরুষের খাদ্য। অনেক বীর পুরুষই তার কাজের পারিশ্রমিক দেয়না। পারিশ্রমিক চাইলে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে পুড়িয়ে দেয় তাদের শবীর, মার ধোর করে।

তার কৃত্রিম হাসির আড়ালে রয়েছে অকৃত্রিম কান্না। সোডিয়াম বাতির আলোয় তার টলমলে অশ্রুবিন্দু ঝলমল করে। তার বক্ষে চাপা আছে অনেক বছরের কষ্ট, অনেক বছরের যন্ত্রণা। অন্তর দহনের উত্তপ্ত ধোঁয়া তার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে। তার শরীরে রক্তের পরিবর্তে প্রবাহিত হয় নীল যন্ত্রণার গরল-প্রবাহ। তার কৃত্রিম চাকচিক্য আর সাজ সজ্জার আড়ালে আছে নীল ব্যথা। আমরা তার লিপস্টিক মাখা রাঙা ঠোঁটগুলো দেখি। দেখিনা সেই ঠোঁটের আড়ালে তার অস্পষ্ট চাপা কান্নায় কম্পমান ওষ্ঠ-অধর। আমরা তার পাউডার মাখা চকচকে গাল দেখি, কিন্তু পাউডারের আড়ালে হাজারো কষ্টের ছাপ পড়া তার পাণ্ডুর কপোলগুলো দেখিনা। দেখিনা সেই কপোলে শুকিয়ে থাকা অশ্রুর দাগ। আমরা তার চোখে কামনার ইশারা দেখি, দেখি পুরুষ ভোলানোর জন্যে আঁকা কাজল। কিন্তু দেখিনা সেই কালো কাজলের আড়ালে তার স্বচ্ছ আঁখিজল। দেখিনা বিষণ্ন দুটি চোখে অশ্রুর সুগভীর সরোবর।

কেন সে হয়েছে নিশাচর ? অন্ধকার রাতে ভয়ানক অন্ধকার পথে কেন সে পা বাড়ায়, কে তাকে ঠেলে দিল এ শ্বাপদসংকুল পথে? জগতের কুৎসীৎতম জগতটি কেন সে বেছে নিল? বহুদিনের তন্দ্রায় কাতর ঢুলু ঢুলু চোখে কাজল মেখে কোন কাজলকালো পথে যায় সে? কেন সে আরামের ঘুমটুকু বিসর্জন দিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিশীথ রাতে? কেন তার স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে থেকে যায় চিরতরে? নিঝুম রাতে নিভৃত গৃহশয্যা ছেড়ে কোন অনিশ্চিত পথে বেরিয়ে যায় সে? হয়ত কেউ তাকে বিক্রি করেছে ; হয়ত কেউ তাকে বাধ্য করেছে বিক্রি হতে হাতে হাতে, হাটে হাটে। তিমির রাতের অতল আঁধারের মতোই অতলান্ত অনেক কারণ রয়েছে। নেপথ্যে রয়েছে অনেকেই , আমরা তাদের জানিনা।
তাদের সন্তানদের আমরা জারজ বলে গালি দিই। বলি অসতী মায়ের অপবিত্র সন্তান। কিন্তু তাদের জন্মদাতা আজ্ঞাতনামা কুলাঙ্গার পিতার উদ্দেশ্যে আমরা কখনো কিছু বলিনা। তারা সব সময় থেকে যায় নেপথ্যে , লোক চক্ষুর অন্তরালে।কারণ সব কলঙ্কের অংশীদার নারী, বৈধব্য ও বিবাহের চিহ্ন বহনকারী শুধু একতরফাভাবে নারী। সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় নারীকে। কবি নজরুল বলেছেন,
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!
অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!

আমার মতে পৃথিবীতে কোন জারজ সন্তান জন্ম গ্রহন করেনা। কোন কোন শিশুর জন্ম অপ্রত্যাশিত হতে পারে, কিন্তু কোন শিশু জারজ হতে পারেনা। কারণ একটি নিষ্পাপ নবজাতক জানেনা তার জন্মের প্রক্রিয়া।এবং সেখানে তার কোন ভুমিকা নেই। তার জন্মে যদি কোন অন্যায় থেকে থাকে সেটা তার বাবা মা করেছে , নিষ্কলুষ শিশুটি নয়। তাই তো কবি নজরুল বলেছেন,
“তব সন্তানে জারজ বলিয়া কোন গোঁড়া পাড়ে গালি?”