পার্থিব
লেখক : অনন্ত বিজয় দাশ ও সৈকত চৌধুরী
প্রকাশনা : শুদ্বস্বর (৯১, তৃতীয় তলা, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা)।
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১১
প্রচ্ছদ : শিবু কুমার শীল
পৃষ্ঠা : ১৩৫
মূল্য : ২২৫ টাকা

প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে কৃষিজীবী সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে আজকের একবিংশ শতাব্দীর নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে পদার্পণ পর্যন্ত মানব সভ্যতাকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হয়েছে। সমাজে এসেছে অনেক মৌলিক পরিবর্তন, মানুষের বিশ্বজনীন দৃষ্টিভংগিতেও এসেছে নতুনত্ব। পরিবার, সমাজকাঠামো, উৎপাদনব্যবস্থাতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। কিন্তু আজকের যুগেও সমাজে কিছু প্রাচীন কিছু রীতিনীতি, মিথ, প্রথা, বিশ্বাস, সংস্কার, আচারব্যবস্থা রয়ে গেছে যেগুলো এখনও জীবনধারণের অবিচ্ছেদ্দ অংশ হিসেবে মানব মনে টিকে রয়েছে। প্রাচীন এই বিশ্বাস সমূহে তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি, বরং স্থান কাল পাত্র ভেদে রূপ পাল্টিয়েছে মাত্র। তরুণ লেখকদ্বয় অনন্ত বিজয় দাশ এবং সৈকত চৌধুরী ‘পার্থিব’ বইতে সমাজে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা এই অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসসমূহকে বৈজ্ঞানিক মননের সাহায্যে ও যৌক্তিক কাঠামোতে বিশ্লেষণ করেছেন। বইয়ের নামকরণেই সে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ‘পার্থিব’ এই জগতের জল, বায়ু, আহার্যের স্বাদ নিয়ে আমরা সকলেই পার্থিব জগতে বেঁচে আছি। পার্থিব এই জগতকে কেন্দ্র করেই আমাদের দুঃখ, সুখ, ভালবাসা, আশা-আকাঙ্খা প্রভৃতি মানবীয় প্রবৃত্তিসমূহ আবর্তিত হয়। কিন্তু তারপরও একটু ভাল থাকার আশায় মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। ত্যাগ, প্রার্থনা, নৈবেদ্য নিবেদনের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে চায় সেই অতিপ্রাকৃত সত্তাকে। আর সেই সুযোগেই সমাজের কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ সেই অপার্থিব সত্তার ধবজাবাহী হয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে নানা অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক, কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করে তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন কেঁড়ে নেয়। ‘পার্থিব’ বইতে লেখকদ্বয় দীর্ঘকাল ধরে জনমানসে অবস্থিত কিছু অপার্থিব বিষয়সমূহকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং আজকের এই যুগের এসে এগুলো কতটুকু বাস্তবসম্পন্ন, বিজ্ঞানসম্মত তা অনুসন্ধান করেছেন।

বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা চর্চার তিন পথিকৃৎ আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ এবং হুমায়ুন আজাদকে। বইটিতে মোট চারটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।

‘মহাপ্লাবনের বাস্তবতা’ শিরোনামে স্থান পাওয়া প্রথম প্রবন্ধটিতে বহুশ্রুত এবং পঠিত হযরত নূহের সময়কালীন মহাপ্লাবনের ঘটনাটিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মহাপ্লাবনের এই ঘটনাটি সেমেটিক ধর্মগ্রন্থসমূহে বহুবার, বহুপ্রসংগে আলোচিত হয়েছে। ঈশ্বরবন্দনা ছেড়ে ঘোর পাপে নিমজ্জিত মানব জাতি যখন লোভ, হিংসা বিদ্বেষ আর অপরাধ প্রবণতার কারণে ভুলে গিয়েছিল ঈশ্বরকে, ক্রুদ্ধ ঈশ্বর তখন এক মহাপ্লাবনের সাহায্যে পৃথিবীকে পাপ ও পাপীমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে ঈশ্বরের কৃপায় হযরত নূহ, তার পরিবার এবং সঙ্গী-সাথীরা সেই মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পেলেন। পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমেই ঈশ্বর প্রাণের বিস্তার ঘটালেন এই পৃথিবীতে-সংক্ষেপে এটিই সেই মহাপ্লাবনের উপাখ্যান। আলোচ্য প্রবন্ধে তৌরাত শরীফ, বাইবেল, কোরানে বর্ণিত মহাপ্লাবনের তথ্যসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। লেখকদ্বয় একই সাথে স্থান, কাল পাত্র ভেদে প্রায় একই ঘটনার নিদর্শন দেখিয়েছেন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘মৎস্যপুরাণ’, রোমান উপাখ্যান, সুমেরিয়ান পুরাণ, আসামের লুসাই আদিবাসীদের লোকগাঁথা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চীনের ললোবাসীদের লোকগাঁথা, পূর্ব আফ্রিকার মাসাইদের লোকগাঁথা প্রভৃতি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহে।

প্রাচীন সভ্যতাগুলো মূলত গড়ে উঠেছিল নদী তীরবর্তী অঞ্চলসমূহকে ঘিরে। আর নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সেই বন্যার সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা প্রাচীন মানুষকে বেশ আকর্ষণ করেছে। এ আকর্ষণের প্রভাব পড়ে গিয়েছে ঐ অঞ্চলের মানুষের চিন্তা চেতনায়, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মগ্রন্থে, পৌরাণিক গল্পে, আঞ্চলিক লোকগাঁথায়। সুতরাং বলা যায়, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস যেমন একটি বিশ্বজনীন ধারণা, নূহের মহাপ্লাবনের উপাখ্যানটিও একটি বিশ্বজনীন ধারণা। বিভিন্ন যুগে রচিত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মহাপ্লাবনের উপাখ্যানসমূহের মধ্যে কাহিনীর সামঞ্জস্য সেদিকেই দিক নির্দেশ করে। এই বিষয়টি লেখকদ্বয়ের লেখনীতে চমৎকারভাবে ফুটে ওঠেছে। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সাহায্যে এই ঘটনাটি ঘটার দাবি কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত, কিংবা আদৌ বাস্তবসম্মত কিনা সে উত্তর খোঁজা হয়েছে। বিজ্ঞানের মানদণ্ডের বিচারে মহাপ্লাবনের বাস্তবতা প্রমাণিত হয়নি।

৭৯২৬ মাইল পরিধির এই বিশাল আয়তনের পৃথিবীকে ডুবিয়ে দেবার মতো জলের উচ্চতা ২.৫ ইঞ্চির বেশি হওয়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অসম্ভব। অপরদিকে বিশ্বজুড়ে চল্লিশ দিন, চল্লিশ রাত ধরে বিরামহীন বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট ‘কথিত’ সেই প্লাবনে যদি ২.৫ ইঞ্চি জল জমে তাহলে দৈনিক বৃষ্টির পরিমাণ হবে .০৬২৫ মিলিমিটার। আমাদের এখানে শরৎকালে এর থেকে প্রায় ১০ গুণ(২০ মিলিমিটার) বেশি বৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, ৩০০ হাত লম্বা, ৫০ হাত চওড়া এবং ৩০ হাত উচ্চতার তিন তলা এই জাহাজে উদ্ভিদ এবং অনাবিষ্কৃত প্রজাতি বাদে ১০ রকম Phylum এর প্রাণীর জায়গা দেওয়া দূরের কথা, শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরকেই জায়গা দেওয়া অসম্ভব। প্রতি স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভাগে পড়ছে মাত্র ১.৯ বর্গমিটার জায়গা, যা নিঃসন্দেহে অপ্রতুল। অপরদিকে ক্ষুদ্র এই জাহাজে বিপুল পরিমাণ প্রাণীদের খাদ্যসংস্থান কিভাবে করা হবে কিংবা খাদ্য কোথায় স্টক করা হবে সেটাও প্রশ্নের বিষয়। অংকের হিসাবে মহাপ্লাবনের ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত মিথ্যেই প্রমাণিত হল। মহাপ্লাবনের ঘটনাটি সম্ভবত কোন স্থানীয় বন্যার অতিমাত্রায় অতিকথন। মহাপ্লাবনের মিথ এই প্রবন্ধে সার্থকভাবেই খণ্ডিত হয়েছে।

‘মিরাকল ১৯-এর উনিশ বিশ!’ শিরোনামে স্থান পাওয়া দ্বিতীয় প্রবন্ধটি আমার দৃষ্টিতে এই বইয়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। আল-কোরানের কথিত ‘উনিশ’ মিরাকলের বিষয়টি মুসলিম জনমানসে দীর্ঘদীন দিন ধরেই বসত করে আসছে। বিশেষত ‘উনিশ’ মিরাকলকে কোরানের অলৌকিকতার অন্যতম নিদর্শন বলে বিবেচনা করা হয়। ধর্মগ্রন্থের সংখ্যাতাত্ত্বিক অলৌকিকতার দাবি নতুন কিছু নয়। রুশ গণিতবিদ এবং খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক ড. ইভান পেনিন দাবি করেছিলেন যে, ‘বাইবেল’ ধর্মগ্রন্থটি ৭ সংখ্যা দ্বারা চমৎকারভাবে আবদ্ধ। মিশরীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক রাশেদ খলিফা ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে কোরান শরীফের শব্দমালা, অক্ষর-বর্ণ ইত্যাদি বিশ্লেষণকারী একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করেন এবং কোরানের ৭৪ নং সুরা মুদাচ্ছির এর ৩০ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘১৯’ থেকে এমন একটি গাণিতিক থিওরী আবিষ্কার করেছেন বলে ঘোষণা দেন যা কোরানকে যা কোরানকে একদম ‘অলৌকিক’ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। তার দাবি হচ্ছে-কোরানের সুরা সংখ্যা থেকে শুরু করে এর আয়াত সংখ্যা, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ শব্দের অক্ষর সংখ্যা, কোরানের প্রথম ওহি ৯৬ নং সুরা আলাকের শব্দ সংখ্যা এবং এর সংখ্যাগত অবস্থান, কোরানের সর্বশেষ ওহী(১১০) সুরা নাসর এর প্রথম আয়াতের বর্ণ সংখ্যা এই সবকটিই ১৯ সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য। শুধু তাই নয়, রাশেদ খলিফা আরও দাবি করেন যে, কোরানে মিথ্যা আয়াত ঢুকিয়ে একে বিকৃত করা হয়েছে, বিভিন্ন পার্থক্য নিয়ে পৃথক কোরানের অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল। তিনি ‘United Submitters International’ নামে নতুন একটি ধর্মীয় গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন যার সদস্যরা নিজেদেরকে ‘মুসলমান’ হিসেবে পরিচয় দেবার পরিবর্তে ‘Submitter’ বলে পরিচয় দেয় এবং তাদের ধর্মকে ‘ইসলাম’ শব্দের পরিবর্তে “Submission” নাম দেওয়া হয়। রাশেদ নিজেকে রসুল দাবি করেন এবং কোরানের বিভিন্ন সুরায় নিজের নাম ঢুকিয়ে তার বক্তব্যের ‘ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা’ আদায়ের চেষ্টা করেন। অপরদিকে সুরা তওবার শেষের দুটি আয়াতকে(১২৮ ও ১২৯) মিথ্যা দাবি করে তার নিজের অনুবাদের কোরান থেকে বাদ দিয়ে দেন। ১৯৯০ সালের ৩১ জানুয়ারী অ্যারিজোনা রাজ্যের টুকসন মসজিদের ভেতরে রাশেদ খলিফার মৃতদেহ পাওয়া যায়। রাশেদের হত্যাকারী হিসেবে আমেরিকার ‘জামাতুল ফুরকা’ নামের একটি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনের দিকে আঙ্গুল ওঠে।

প্রবন্ধের প্রথম অংশে লেখকদ্বয় আমাদেরকে ‘Pareidolia’ নামক ভ্রান্ত অনুভূতি, Ernest Vincent Wright রচিত উপন্যাস “Gadsby: Champion of Youth’ যেটিতে একটিও ইংরেজী ‘E’ স্বরবর্ণটি ব্যবহার করা হয়নি, প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় স্থানসমূহে উপস্থিত ফিবোনক্কির রাশিমালা, ২০১১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর সংগঠিত টুইন টাওয়ার হামলায় সেখানকার জনসাধারণের মাঝে ‘১১’ সংখ্যা নিয়ে সৃষ্ট অতিলৌকিক-আধিভৌতিক পঠভূমি ইত্যাদি বিষয়াদির সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। এই তথ্যসমূহ একাধারে যেমন প্রবন্ধের শ্রীবৃদ্ধি করেছে, তেমনি পাঠকদের নতুন কিছু তথ্যাবলী জানার সুযোগ করে দিয়েছে। পরবর্তীতে লেখকগণ বিভিন্ন স্বীকৃত এবং নির্ভরযোগ্য তথ্যভাণ্ডার থেকে কোরানের সুরা সংখ্যা, আয়াতসংখ্যা, কোরানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও তার বর্ণসংখ্যা, কোরানের বর্ণ ও শব্দসংখ্যা, কোরানে ‘আল্লাহ’ শব্দটির সংখ্যা, সুরা আলাক, সুরা নাসর, হরুফে মুকাত্তাত এর বর্ণসংখ্যা প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এদের কোনটিই ১৯ সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য নয়। দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে লেখকদ্বয় দেখিয়েছেন যে, উনিশ নিয়ে কোরানের অলৌকিকত্ব প্রমাণের রাশেদ খলিফার দাবি অন্তঃসারশূণ্য। রাশেদ খলিফা কোরানের অলৌকিকত্ব প্রমাণের জন্য কোরানের আয়াতে যেমন পরিবর্তন করেছেন তেমনি আয়াত কেটে কমিয়ে দিয়েছেন, ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

‘মিরাকল ১৯-এর উনিশ-বিশ!’ এর মতো ‘প্রতিষ্ঠিত কোন মিথ’ খণ্ডনকারী লেখা বাংলা ভাষায় এর আগে হয়ত রচিত হয়নি। প্রবন্ধে উল্লখিত তথ্যসমূহ এবং এর রেফারেন্স তালিকার দিকে চোখ বুলালেই বোঝা যায়, এটি লিখতে লেখকদ্বয়কে কতটুকু পরিশ্রম করতে হয়েছে। অসাধারণ এই লেখাটির জন্য লেখকদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

বইয়ের তৃতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম হচ্ছে ‘ভগবদগীতায় বিজ্ঞান অন্বেষণ এবং অন্যান্য’। হিন্দু ধর্মাম্বলীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবতগীতার বিজ্ঞানময়তা সম্পর্কিত যে মিথ সাধারণ হিন্দুদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে, এই প্রবন্ধে তা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রবন্ধের প্রথমেই আন্তর্জাতিক হিন্দু সংগঠন “ISKON” প্রকাশিত “হরেকৃষ্ণ” পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ঐ খবরে আইনস্টাইন ও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মাঝে একটি কথোপকথন উল্লেখ করা হয়। খবরের ভাষ্য অনুযায়ী আইনস্টাইন সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দেন এবং সংস্কৃত না জানার জন্য তাদেরকে ভৎর্সনা করেন। আইনস্টাইন আরও জানান তিনি নিয়মিত গীতা অধ্যয়ন করেন, যার ফলে পদার্থবিজ্ঞানের অতিদূর্বোধ্য আপেক্ষিক তত্ত্ব তার কাছে সূর্যের আলোর মতো সহজ সরল হয়ে যায়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এই কথোপকথন কবে কোথায় অনুষ্ঠিত হল তার কোন তথ্যসূত্র এই খবরে উল্লেখ করা হয়নি। ঐ খবরের লেখক হয়ত কৌশলে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র, ভারতীয়রা গীতা’র চর্চা করে বলেই বুঝতে পেরেছিলেন। তবে এই প্রবন্ধে তার বিপরীত চিত্রও দেখানো হয়েছে যেখানে দেখা যায়, আধুনিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের অকথ্য-অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে ইসকনের অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য স্বামী প্রভুপাদ ও তার শিষ্যরা বিজ্ঞানের দর্শনকে ‘কূপমণ্ডুক দর্শন’, বিজ্ঞানীরা মহামূর্খ, নির্বোধ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করা কতগুলো কুয়ার ব্যাঙ, বিকৃত মস্তিষ্কধারী কতগুলো কুকু্‌র, উট, গাধা বলে অভিহিত করেছেন। নোবেল পুরষ্কারকে তারা অভিহিত করেছেন ‘গর্দভের নোবেল’ হিসেবে। ইসকনের শঠতা, ভণ্ডামি, নির্বুদ্ধিতা এ দুটি উদাহরণের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে গীতার অতীত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, গীতা মোটেই কোন একক ব্যক্তি দ্বারা প্রণীত নয়। অনেক ভারতীয় ঐতিহাসিক, পশ্চিমা পণ্ডিত গীতাকে আদি মহাভারতের অঙ্গ বলে মনে করেন না, বরং পরবর্তীকালে পল্লবিত মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত সংযোজন বলে মনে করেন। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণসহ বিভিন্ন গীতা বিশেষজ্ঞর মত হচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ চতুর্থ শতকের মধ্যে ভগবদগীতা পর্যায়ক্রমে রচিত, পরিবর্ধিত এবং মহাভারতে সংযুক্ত হয়েছিল।

এই প্রবন্ধে বেদ, শতপথ ব্রাহ্মণ, শুক্লযজুর্বেদ, মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ বিভিন্ন শ্লোক বা উদ্ধৃতি তুলে ধরে দেখানো হয়েছে যে, ভারতবর্ষে ‘সূর্য’কেই দেবতাশ্রেষ্ঠ বিষ্ণু হিসেবে গণ্য করা হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঋগবেদের ১/১৫৪/৪-৬, ১/১১৫/৪, ১০/৩৭ নং সূক্তে সূর্য এবং বিষ্ণু উভয়কে জ্যোতির উৎস, অন্ন উৎপাদক, জগতের রক্ষাকর্তা হিসেবে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঋগবেদের বিভিন্ন সূক্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সূর্য, বিষ্ণু, সবিতা একই দেবতা, অশ্বীদয় তাদের রথের ঘোড়া। সৌরজগতে সূর্য কতিপয় গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি নক্ষত্র মাত্র। প্রশ্ন হচ্ছে, এই গ্যাসীয় পিণ্ড কি আমাদের এই পৃথিবীতে মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করতে পারে? প্রাচীনকালে মানুষের মাঝে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথাযথ বিকাশ হয়নি বলে তারা এই ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়েছেন। কিন্তু আজকের যুগে এসেও ডিগ্রিধারী, জ্ঞানীগুণী, রথীমহারথীরা কিভাবে কৃষ্ণকে বিষ্ণুর(সূর্যের) অবতার বলে ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে দাবি করেন, পূজো দেন- এই প্রবন্ধে সে প্রশ্নই তোলা হয়েছে।

প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে গীতার বক্তব্য ও আধুনিক বিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞানের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। গীতার বক্তব্য কোন অংশে বৈজ্ঞানিক তো নয়ই, বরংচ তা প্রাচীনকালের হাস্যকর সব ধারণা আর অপবিজ্ঞানে ভরপুর। তাই সনাতন ধর্মাম্বলীদের প্রতি গীতায় বিজ্ঞান অনুসন্ধান না করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। শেষে দেখা যাবে, কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়েছে।

প্রবন্ধের শেষাংশে দেখানো হয়েছে যে, কিভাবে গীতায় শ্রীভগবানের বিভিন্ন উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তৎকালীন যুগের শাসকগোষ্ঠী সমাজে তাদের অমানবিক চাতুর্বর্ণ প্রথাটি টিকিয়ে রাখত। ভগবদগীতা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের নিজস্ব কাঠামো, শাসন-শোষণ, চাতুর্বর্ণ প্রথা টিকিয়ে রাখার জন্য সুদীর্ঘ সময় ধরে সুকৌশলে রচিত। এটি কোন দেবতার মুখঃনিসৃত বাণী নয়, নয় অলৌকিক কিছু। আলোচ্য প্রবন্ধে সে সত্যটাকেই তুলে ধরা হয়েছে।

এই বইয়ের শেষ প্রবন্ধটির শিরোনাম “ঈশ্বর ও ধর্ম প্রসঙ্গঃ সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে”। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ধারণ করে আসা কিছু বিষয়ে বিশ্বাস ও আরাধনার থেকে ক্রমশ সংগঠিত ও জটিল হয়ে ওঠা ধর্মকে এই প্রবন্ধে সংশয়বাদী ও যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। ধর্মের পুঁজি হচ্ছে বিশ্বাস। আর তাই বিশ্বাস বনাম যুক্তির লড়াইয়ে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ধর্মকেই বেছে নিয়েছেন। আদতে মানুষের বিশ্বাস ব্যতীত ধর্মের কোন আলাদা অস্তিত্বই নেই। এই প্রবন্ধে স্রষ্টার বিশ্বাসের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হয়েছে এবং এই বিশ্বাসে যে যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি প্রাধান্য পায় সেদিকেও আলোকপাত করা হয়েছে। সৃষ্টির আদিকারণ, উদ্দেশ্যবাদী যুক্তির দূর্বলতা ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য ধর্মের মধ্যে অসংখ্য সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য, ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ও সরল আলোচনা রয়েছে এই প্রবন্ধে। ধর্মশাস্ত্রের অলৌকিকতা বিশ্লেষণ, অলৌকিকতা প্রমাণের দায়ভার, কোরানের ওহী অবতরণ পদ্ধতি নিয়ে কিছু সংশয়ী বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে এতে। মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ আল-কোরানের অলৌকিকতা সম্পর্কিত বেশ কিছু দাবি যেমন কোরানের রচনাপদ্ধতি, এর ছন্দময়তা, কোরানের বিজ্ঞানময়তা, কোরানে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব, কোরান নাজিলের পদ্ধতি, ইসলামে নারীর অধিকার, নবী মুহাম্মদের কর্মকান্ড সম্পর্কিত বেশ কিছু বিষয়ে বিজ্ঞান ও যুক্তির মানদণ্ডে গঠনমূলক আলোচনা রয়েছে। আজকের স্যাটেলাইটের যুগে পিস টিভি ও ইসলামিক টিভির একমুখী প্রচারণার বিপরীতে এই প্রবন্ধ পাঠককে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে, চিন্তার নতুন খোরাক যোগাবে।

এত সব উৎকর্ষতার ভিড়েও বইটির কিছু ত্রুটি লক্ষণীয়। বইটির সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে এর প্রচ্ছদ। সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিছু অলৌকিকতার দাবিকে খণ্ডন করে রচিত এই বইয়ের প্রচ্ছদ মোটেও ‘লৌকিক’ কোন বিষয়কে ইঙ্গিত করেনা। বইয়ের চারটি প্রবন্ধের কোনটিতেই স্বতন্ত্রভাবে সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধের লেখকের নাম উল্লেখিত হয়নি। ফলে কোন প্রবন্ধটি কার রচনা, কিংবা কোনটি যৌথভাবে লেখা হয়েছে তা পাঠকের অজানাই থেকে যাচ্ছে। এছাড়াও বেশ কিছু মুদ্রণজনিত প্রমাদ বইটিকে কিছুটা হলেও শ্রীহীন করেছে। অপরদিকে ১৩৫ পৃষ্ঠা বইয়ের মূল্য ২২৫ টাকা ধরাটাকেও আমার কাছে বেশি মনে হয়েছে। পুরো বইমেলা জুড়েই আমরা বইয়ের মূল্যের এই উর্ধবগতি লক্ষ করেছি যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়।

প্রতি বছর বইমেলায় গৎবাঁধা গল্প, উপন্যাস, কবিতার বইয়ের ভীড়ে ‘পার্থিব’ এর মতো এমন কিছু বইও বের হয় যেগুলো মানুষকে নতুন করে ভাবতে প্রেরণা জোগায়, যুগ যুগ ধরে অপবিশ্বাস-কুসংস্কারের ঘুঁণে ধরা সমাজে এক নতুন দ্রোহের পথ দেখায়। শুদ্ধস্বর প্রকাশনীকে এই বইটি প্রকাশের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। লেখকদ্বয়ের কাছ থেকে ভবিষ্যতে এ ধরণের আরো বই আশা করছি।

ধন্যবাদ।