আল্লাবাল্লার পাল্লায় পড়ে
একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি। গ্রামীণ সামাজিক ব্যবস্থায় কাকারা ছোট ভাতিজি,ভাতিজা আর বড় ভাই ছোট ভাইবোন সাথে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার প্রচলন ছিল। সে প্রচলিত নিয়মের সুবিধাভোগী হিসেবে পরীক্ষার পর বা গ্রীস্মের ছুটিতে কাকাদের শ্বশুর বাড়ি বেড়িয়েছি। ১৯৭১ সালেও আমাদের পরিবার প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিল কাকাদের শ্বশুর বাড়িতেই। আমার দুই কাকার শ্বশুর বাড়িই ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার বারাইল ও আগানগর নামে পাশাপাশি গ্রামে । থানা সদর থেকেও অনেক ভেতরে এ গ্রাম দুটি। সেখানকারই এক ঘর রায়তের কথা মনে পড়ে।
মা,বাবা ও দুই ছেলে। মা মৌসুমী পাগল ছিল। তাকে সবাই পান্ডার মা অথবা পাগলী বলে ডাকত। ভাল অবস্থায় পাগলী ডাকলে প্রতিবাদ করে পান্ডার মা ডাকতে বলত। কয়েক মাস বদ্ধ পাগল। কয়েক মাস ভাল। ভাল অবস্থায়ও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। তার আচরণ ও কথাবার্তায় বোকামির পরিচয়ও পাওয়া যেত। ভয় ডর ছিল না। আমের দিনে মাঝ রাতে উঠে আম কুড়াতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত। চিনিকাকার শ্বশুর বাড়ির গ্রামের ঐ বেড়াতে গেলে ঐ পরিবারটি অনেক বিষয়েই আমার কৌতূহল সৃষ্টি করত।
১৯৭১ সালে তো কয়েক মাসব্যাপীই তাদের দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। একদিন দেখলাম পান্ডার মা ডাল সম্ভার বা বাগাড় দিল এক অভিনব পদ্ধতিতে।মসুরি ডাল সিদ্ধ করে ভেঙ্গে রেখে দিয়েছে। তেল নেই বলে সম্ভার বা বাগাড় দিতে পারেনি। বাজার থেকে তেল আনার পর সোলা জ্বালিয়ে একটা চামচে তেল গরম করে পেঁয়াজ ফুটিয়ে ইতোমধ্যে ঠান্ডা হওয়া ডালে ঢেলে দিয়েছে। চুলা ধরায়নি। আর তা ই পান্ডারা দুই ভাই হাপুস হুপুস করে খেয়েছে। শুধু পান্ডার বাবা গাই গুই করেছে। শালি ………… বলে গালাগাল দিয়েছে।

সে মাঝে মাঝেই নিজে রান্না বান্না করে স্বামী পুত্ররা কাজ কর্ম থেকে আসার আগে নিজে খেয়ে নিত। খাবারের ভালটুকুও মাঝে মাঝে আগে আগে খেয়ে নিত। এ নিয়ে স্বামী চড় থাপ্পড়সহ লাঠি পেটা করত। সাথে চলত প্রতিবেশিদের ইন্ধন। তারা এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করত। ছেলেদের কিন্তু এ নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না। পাগল মায়ের কাছে স্নেহ আশা করা বৃথা। ঘরে আছে। দুটি ভাতও ফুটিয়ে রাখে। যথেষ্ট। বদ্ধ পাগল হলে তো বাইরে কাজ কর্ম করে এসে নিজেদেরই রান্না করে মাকে খুঁজে এনে খাওয়াতে হয়। কাজেই মা যেটুকু করে এতেই খুশি। পান্ডার বাবা পান্ডার মাকে মা বানিয়ে তার খাওয়া নিয়ে অনুযোগ সৃষ্টি করত। প্রতিবেশীরাও সে তালে তাল মিলাত। পান্ডার বাবাকে স্বামীত্ব ফলাতে বলত।
আমি বেড়াতে গিয়ে খুব শক্ত কিছু বলতে না পারলেও একদিন এক প্রতিবেশির ইন্ধনের সময় মৃদু প্রতিবাদ করায় তৎক্ষণাৎ বলে ফেলল, আরে, একটু আল্লাবাল্লা করছি।
আল্লাবাল্লা মানে এমনি এমনি বলা। তাদের এ আল্লাবাল্লা যে আরেক নারী ও তাদের ছেলেদের জীবনে কী দুর্যোগ নামিয়ে আনে তা বিবেচনা করে না। পান্ডার মা যদিও মায়ের চেয়ে পাগল পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যই বেশি বহন করত, তবুও পান্ডার বাবা ও প্রতিবেশিরা তা মানতে পারত না। তাকে মা বানানোর অপচেষ্টায় পান্ডাদের জীবনে অস্বস্তি সৃষ্টি করত। পান্ডার বাবা ও প্রতিবেশিদের ধারণা —–
মা হওয়া নয় মুখের কথা
যদি না বুঝে সন্তানের ব্যথা
পাগলী পাগল অবস্থায় না হয় বুঝে না। ভাল অবস্থায়ও কেন খাবার নিয়ে এমন করবে? তবে পান্ডার মাকে এ গঞ্জনা দেওয়া পান্ডারা মোটেই পছন্দ করত না। সে পাগল হোক আর সুস্থ মস্তিষ্ক হোক সে তাদের মা। আমার মনে হতো মাকে তারা পাগল ভাবত না। আবার মায়ের কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশাও আহামরি কিছু ছিল না। মা আছে এ অনুভূতিতেই তারা বিভোর ছিল।

যেমন আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ নিয়ে আমার ভারতীয় আত্মীয়স্বজনরা এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা লালন করেন। আমাদের এদেশে অবস্থান নিয়ে তাদের কিছু ভীতি আছে। ভীতিটা সবটা সব সময় অহেতুক নয়। যেমনঃ ১৯৭১ সালে বাঙালী এবং হিন্দু হিসেবে দ্বিগুন ঝুঁকি ছিল। ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর আতংকে দিন কেটেছে। হিন্দুদের প্রতি গ্রামে প্রত্যক্ষ হুমকি ও ঝুঁকি এসেছিল এবং শহরে পরোক্ষ । ২০০১ সালে তো গ্রামের বাড়িতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সরাসরি মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবুও দেশ ত্যাগের চিন্তা মাথায় আসেনি। আনিও নি। তাছাড়া, সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তো অন্য অনেক বৈষম্যের শিকারই। তবুও আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালবাসি।

মনে করি সংবিধান সংশোধন করে আমার দেশ মাতাকে পাগল বানালেও এতো আমার মা। আমার জন্মভূমির মাটি। প্রতিবেশিরা যা ই বলুক। সরকার প্রধান যে নীতিই গ্রহণ করুক না কেন আমার দেশ তো আমারই। পান্ডাদের দুই ভাইয়ের পাগল মাকে নিয়ে থাকার মত আমিও এ মাটিকে নিয়েই থাকব। আমি তো মায়ানমারের লোকজনের মত উদ্বাস্তু হতে পারব না। আমি পশ্চিম বাংলায় গিয়ে অর্ধশত বছর পরও নিজের দেশের জন্য পুড়তে পারব না। ইউরোপ আর আমেরিকার বাঙ্গালীদেরও দেখেছি। দেশবিহীন এক সত্ত্বা। গ্রীণ কার্ড পেয়েও পরবাসের হাহাকার বুকে। আমার নিজস্ব দেশ আছে। একটা পতাকা আছে। একটা জাতীয় সংগীত আছে। আছে একটা মানচিত্র। এ সব থেকে তো আর আমার নাম মুছতে পারবে না হাজারবার সংবিধান কাটাকাটি করেও। অন্য কোথাও গিয়ে আমার এ অনুভূতি আমি হারাতে চাই না। জামাতহসহ অনেক রাজনৈতিক দলের আল্লাবাল্লার কারণে আমাদের কোন কোন সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীগত জীবন যাপনে যে দূর্যোগে পড়তে হয় তাকে আল্লাবাল্লা হিসেবেই উড়িয়ে দেওয়ার মত মনোবল আমাদের গড়ে তুলতে হবে।
(চলবে)