(সাহিত্য চর্চার অভ্যাস আমার খুব ক্ষীণ। গল্প তো জীবনে লেখায় হয়নি তারপরেও মাথায় একটা থিম হঠাৎ জুড়ে বসল সেটাকে গল্প আকারে লিখে অনেক দুঃসাহস করে পাঠকদের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলাম। হয়ত ভাষার প্রাঞ্জলতার অভাব থাকতে পারে, শব্দ বিন্যাসও যথাযত নাও হতে পারে। তার জন্য অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)
জন অরণ্যের চিপা চাপার ফাঁক ফোকড় দিয়ে মঞ্চের দিকে ঠেলে ঠুলে এগুতে থাকে রইস উদ্দীন। আর হাত বিশেক সামনে এগুতে পারলেই মঞ্চটা ধরা দিবে আপনা থেকেই। মানুষগুলো এক একজন যেন শক্ত গাছের খুটির মত ক্রমশ স্তরীভুত হয়ে এখানটায় তৈরী করেছে জমাট বাধা পুরু দূর্ভেদ্য মানব প্রাচীর। নিষ্ফল চেষ্টা করে প্রাচীরের এদিক ওদিক ঢু মেরে ভেদ করতে ব্যর্থ হয়ে অস্থির চিত্তে জনতার গায়ে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় সেখানেই। কানে আসে বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে গানের সুরের অপূর্ব মূর্ছনা।
হুজুর তাকে বলেছে- “গান শরীয়ত বিরুদ্ধ কাজ। এটা অবিশ্বাসী কাফেরগো বেহাল্লাপনা। ইসলামে গানের কোন স্থান নেই। তবে হাম, নাদ করা যায়েজ আছে- এতে আল্লাহ খুশি হন”।
সুরের যাদুর মায়ার খেলায় বশীভুত হয়ে বেসুরা গলায় প্রচুর গান গেয়ে অল্প বয়সে বহু পাপ কামিয়েছে রইস। এ কথা মনে পড়তেই খোদার কাছে তওবা কেটে ক্ষমা চায় বারবার।
খোদা দয়ার সাগর, উম্মত হিসাবে নিশ্চই তাকে ক্ষমা করবেন, এই বিশ্বাস তার আছে।
দারিদ্রতার ছোবলে বিষেক্রান্ত হয়ে ১৬টা বছর পূর্ণ করেছে । লেখা পড়ার সুযোগ ঘটেনি।
অবশেষে মৌলানা চাচার পরামর্শে রইস কে ভর্তি করা হয় ঢাকার এক মাদ্রাসায়। ধর্মের পথে হাঁটলে খোদা যদি এই অভাবের দিনে একটু মুখ তুলে চায়!
মাদ্রাসায় আসার পর চলনে বলনে ও ভাবনার জগতে ব্যাপক ওলট পালট হয়ে গেছে তার। ধর্ম দর্শনে মন আচ্ছন্ন থাকে দিন-রাত। বুঝতে পারে-যা কিছু আমরা চোখে দর্শন করি, যা কানে শ্রবণ করি, যা কিছু স্পর্শ করা যায়, সব উপরওয়ালার দান, বিজ্ঞানীরা শুধু উছিলা মাত্র। ব্যক্তহীন শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে মস্তক, সৃষ্টির ক্যারিশমায় আবাক বিস্ময়ে বারবার শুকরিয়া আদায় করে ধন্য হয়। মাথায়- টুপি নিত্য সঙ্গী।
তার ভাল খাওয়া দাওয়ার উপর আলাদা নজর রাখে মাদ্রসা কর্তৃপক্ষ। খাবার দাবার নিয়ে সে পুরোপুরি দুশ্চিন্তা মুক্ত এখন। এই তো কাল তার প্রিয় গরুর মাংসের ভুনা, শুটকি চাটনি, ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছে পেট পুরে।
তার কোমল কাঁধে ভর করেছে ইসলাম বাঁচানোর বিশাল দায়িত্ব।
বড় হুজুর বলেছেন-“দেশ থেকে তাড়াতে হবে কাফের, মালাউনদের সংষ্কৃতি। কায়েম করতে হবে শরীয়া শাসন। রুখতে হবে প্রগতিশীলতার নামে অনৈস্লামিক সব চর্চা। বেগানা মেয়েরা বড্ড বাড় বেড়েছে, কি সাহস! তারা পু্রুষদের মত সম অধিকার চায়? তাদের করতে হবে বোরকায় অন্তঃরীন। তাগুতি নয়, আল্লার আইনে চলবে দেশ”।
লক্ষ্য অর্জনে রইস ক্লান্তিহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বেশ তৎপরতার সাথে। ছুটে চলেছে বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের বিভিন্ন জেলার মৌলানা মাশায়েকদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি মিছিল, মিটিং, ওয়াজ মাহফিলে।
গোপন আত্মঘাতী দলে নিবন্ধন করে সে এখন বেহেস্ত পথ যাত্রী। যাত্রা বিড়ম্বনার বাধা টপকাতে গভীর রাতে চাঁদের টিমটিমে আলোয় শেয়াল কুকুরের ডাক উপেক্ষা করে নিয়েছে সশস্ত্র ট্রেনিং।
শেষ বারের মত বুকে হাত দিয়ে বেহেস্তের টিকেট (বোমার উপস্থিতিটা) পরখ করে নেয় -সব ঠিক ঠাক আছে কি না।
না, সামনে এগুনোর আর কোন উপায় নেই। এখানেই তার কাজ সারতে হবে।
চারপাশে নীরবে চোখ বুলিয়া বুঝার চেষ্টা করে নেয় নিশানা বরাবর আছে কিনা।
উপস্থিত হাজার মানুষের চোখ মুখ জুড়ে খুশির দীপ্তিমান উচ্ছ্বলতা, ব্যস্ত কঠিন জীবনের মধ্যে সামান্য আনন্দের ঝলকানি আর হৈ হুল্লোর দেখে বুকের ভিতর হৃদপিন্ডটা কে জানি হঠাৎ খামছি দিয়ে চেপে ধরে।
টের পাচ্ছে বোমার উপর রাখা হাতটা কেমন কাঁপতে শুরু করেছে, ঠিক জায়গা মত আঙ্গুল বসাতে পারছে না, অবশ লাগছে। পরক্ষনে ভাবে এ নিশ্চই শয়তানের কারসাজি, তার মহৎ কাজে বাধা দিতে শয়তান তার শিরা উপশিরায় প্রবেশ করেছে। মনে মনে ভাবে শয়তান কে পশ্রয় দেয়া চলবে না কোনমতেই। সে তো এসেছে ইসলাম রক্ষায়। এই কাফের মালাউনদের রক্ষা করে সে দোজকের লেলিহান শিখার জ্বলানি হতে যাবে কোন দুঃখে।
ভীড়ের প্রচন্ড তাপ ও মানসিক দ্বন্দ্বের নিরন্তর সংঘর্ষে শরীর ফুড়ে খেজুর রসের মত গড়িয়ে পড়া ফোটা ফোটা লোনা জলে শরীর ভিজে জব জবে হয়। হাতে আর বেশী সময় নেই- সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব উপড়ে ফেলে মনকে ইস্পাতের মত শক্ত করে।“নারায়ে তকবির, আল্লাহ‌ আকবর”- বলে চিৎকার দিতেই রক্তের গতি দ্রুত হয়ে উঠে, কাঁপা কাঁপা হাতেই দাঁতে দাঁত চেপে সজোরে চাপ বসিয়ে দেয় বোমার বাটনে।
কতক্ষন সে পড়ে ছিল বুঝতে পারে না। হুস ফিরলে দেখে, সে ভেসে আছে জমাট বাধা রক্ত ভেলায়। ছিড়ে ফেটে কুটি কুটি হওয়া মানব দেহের হাত, পা, মাথা, চোখ সহ বিভিন্ন আঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার গা ঘেঁষে চারপাশে বিশাল এলাকা জুড়ে। রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত অসংখ্য মানুষের বিকৃত লাশ ভেসে আছে রক্ত সমুদ্রে। আহত মানুষদের যন্ত্রনার চিৎকার আহাজারিতে সে হত বিহ্বল। বাঁচতে চাওয়া ভয়ার্ত মানুষদের উচ্চ বিলাপে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছোটা ছুটি দেখে সে দিক বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ে। তাজা রক্তের তীব্র গন্ধে তার পেট মোচড় মেরে বেড়িয়ে আসতে চায় গরুর মাংসের ভুনা।
সে নিঃশ্বাস নিতে পারে না, দম আটকে আসে।
উঃ চারিদিকে কি বীভৎস করুন দৃশ্য! সে আর সহ্য করতে পারে না।
ছেড়া ফাটা লাশের পর লাশ ডিঙিয়ে ঘন রক্তের লাল গালিচা বিছানো পথের উপর দিয়ে পালাতে থাকে দ্রুত। তার কিশোর মনে জুড়ে তীব্র বেগে বইতে থাকে কৃত কর্মের অপরাধ বোধের ঝড়ো হাওয়া। অব্যক্ত নিদারুন মানসিক অস্থিরতায় ছট ফট করতে থাকে মন। থেকে থেকে কাঁটা দিয়ে কেঁপে উঠে সারা শরীর।
এক মূহুর্ত- সে আর এই নরক নগরীতে থাকতে চায় না। সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে যাবে নিজ গ্রামে। দারিদ্রতার মাঝে, অনাবিল সবুজের কাছে, খেত ফসলের গন্ধের কাছে, মোড়গ ডাকা স্নীগ্ধ ভোরের কাছে, বাবা-মার শীতল স্নেহের ছায়ায়।
বাস ষ্ট্যান্ডে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনক্রমে উঠে পড়ে পঁপ পঁপ তীক্ষ্ণ হর্ন বাজিয়ে যাত্রার উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করা বাসে। পেছনের সীট খালি পেয়ে সেখানে হেলান দিয়ে বসে নিঃশব্দে। যাত্রীরা যে যার মত ব্যস্ত। সেও ঢুব দেয় দুর্ভাবনার অথৈ সাগরে।
ঢিমে তাল গতিতে আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে ছুটতে ছুটতে ঘন্টা তিনেক পর বাস থেমে পড়ে গন্তব্যে। এখান থেকে তার গ্রাম প্রায় আরো দু’মাইলের পথ।
উদ্যমহীন ভারী পায়ে চলতে চলতে এলো মেলো চিন্তায় রইস উদভ্রান্ত । টের পায় প্রকৃতিও আজ তাকে ঘৃনা ভরে প্রত্যাখান করছে। তার চির চেনা গ্রামের মাতাল হাওয়া তাকে আজ বুকে টেনে আলিঙ্গন করছেনা, বেদনায় কালো হয়ে আছে যেন নীল আকাশ, গাছের ডাল পালা কেমন মড়ার মত নিথর পড়ে আছে, বাঁশঝাড় গুলো দুলে উঠছেনা বাতাসে, পাখিরা বন্ধ করেছে কিচির মিচির, কুকুর গুলো তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ চিৎকার তুলে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে।
ক্লান্ত বিষন্ন অবসাদগ্রস্থ দেহ মনটাকে টেনে হিঁচড়ে কোন মতে বাড়ির কাছা কাছি টেনে আনতেই শুনতে পায় দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে আসা গুমড়ে উঠা কান্নার ভেজা শব্দ।
দুরু দুরু বুকে এগিয়ে আসে, আরো কাছে। দেখে, তার বাড়ীর উঠানে মাথায় টুপি পড়া বেশ কিছু লোকের শান্ত সুস্থির নীরব জটলা। কয়েকজন লোক খাটিয়ার মত কি যেন কাঁধে তুলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বুকটা অজানা শংকায় চ্যাৎ করে উঠে। এ তো লাশ! কার লাশ! ভাবতেই, হঠাৎ বন্য হাওয়া লাশের উপর বিছিয়ে দেয়া সাদা চাদড়টি উড়িয়ে নিয়ে উন্মুক্ত করে লাশের পরিচিতি। স্তম্ভিত বিষ্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখে- এটা তো বোমারু রইস উদ্দীনেরই বিকৃত লাশ!