প্রবাস পর্ব

যে সময়ে দেশের বাইরে পা রেখেছি , তার কিছু দিন পরেই সমস্ত পৃথিবীটা বদলাতে শুরু করেছে। অথচ দেখো তুমি -আমি -আমরা কত না স্বপ্ন দেখেছি এই পৃথিবীটা বদলাতে! একেবারে শেঁকড় থেকে উপড়ে ফেলে দেবো সীমাবদ্ধতার সমস্ত শৃংখলগুলো এমন সব স্বপ্নগুলোই তো দেখতাম আমরা। ঘন্টার পর ঘন্টা,প্রহরের পর প্রহর,  রাতের পর রাত; কী উন্মাতাল সে দিনগুলো আমাদের ! অথচ ভাংগনের যাত্রাটুকু যখন দেখলাম ,তখন খানিকটা আশাহতও হয়েছিলাম  সেই প্রথম ধাক্কায়। সমস্ত সম্ভাবনা নিয়েও সাম্যবাদী রাস্ট্রগুলোর পিলার যখন পড়তে শুরু করলো,হাল তখনও ছাড়ি নি আমরা। এখনও  ছাড়ছি না যেমন। অথচ আরেকটা ধাক্কা দেখলাম একেবারে সাম্রাজ্যবাদের পিঠে কোল বসে। মেলাতে পারি না একেক সময়। বুদ্ধির সীমাবদ্ধতায় আটকে যায় শেখা যুক্তিগুলো। সুচারু দাবাড়ুর মতো সুক্ষ্ন চালের কৌশলের কাছে পরাজিত হই,আহত হই। মাঝে মাঝে আশাহত যে হই না- সে কথাটাই বা কিভাবে অস্বীকার করি তোমার কাছে? আশাহত বেদনার সে কথাটুকুই না হয় আজকে তোমাকে বলি।

আবাল্য জেনে আসা, শুনে আসা  শত্রুর দেশে পা রাখলাম এক আগষ্ট মাসে। কানাডার এপারের নায়েগ্রা ফলসের পাশ দিয়ে পরিবহন বাস গ্রেহাউন্ড চলে গেল আমেরিকা-কানাডার সীমান্ত  শান্তি সেতুর দিকে। এক অভাবনীয় অনুভুতি সেদিন আমার ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল।  নিজেকে নানা প্রশ্ন করেও আমি উত্তর দিতে পারি নি সেদিন। কিসের এই উত্তেজনা আমার মধ্যে ভর করেছিল? সে কি সাম্রাজ্যবাদের কোলে নিজেকে বসিয়ে দেবার লজ্জা-ক্ষোভ-গ্লান? না কি,অজেয় শত্রুর অসীম পরাক্রমের কাছে মাথা নত করবার বেদনা?

এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই বাস থেকে নেমে অগ্রসর হলাম আমেরিকার ইমিগ্রশেন অফিসের দিকে । হাতে তখনো সযত্নে  ধরা বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট ।  সারাক্ষন ধরে থাকা এ গর্ব- গৌরবটুকুও সেদিন যেনো আমাকে বিদ্রুপ করছিলো অজান্তেই। বারবার মনে হচ্ছিলো, এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই সবুজ অহংকারটুকুকে আমরা শিক্ষিত মানুষেরা কতই না অবমাননা করে চলেছি প্রবাসে প্রতিদিন । বিভিন্ন সীমান্ত প্রবেশ পথে নানা তাচ্ছিলে- অবহেলায় বাংলাদেশের এই স্মারকখানি কতভাবে অপমানিত হচ্ছে। আমাদের কিছু কিছু মানুষের অসৎ ক্রিয়াকলাপের জন্য আজ অনেক দেশের প্রবেশ পথেই আমাদের  অহঙ্কার এই সবুজ পাসপোর্ট যেনো সবুজ আতঙ্ক।  সামনে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়ে সে আশঙ্কাটুকু বুকে নিয়েই আমার গর্বটুকু তুলে দিলাম আমেরিকান ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে ।  আজন্ম লালন করে আসা ঘৃনা ক্ষোভ আর যৌবনের সেই লড়াকু শ্লোগানকে এক নিমিষেই মুছে ফেলে আমি আজ সেই সাম্রাজ্যবাদের সূতিকাগার আমেরিকাতেই  প্রবেশের অনুমতি  চাচ্ছি। মুষ্টি ভিক্ষের মত লাল ইমিগ্রেশন অফিসারের দয়াদাক্ষিনের প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে থাকা আমি অতীতকে ভুলে যেতে চাচ্ছিলাম সেদিন । পেরেছিলাম কি  সে আত্মগ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ?

মনে পড়ছিল ভারতে বামপন্থী নেতা  সোমনাথ চট্রোপাধ্যায় একবার অষ্ট্রেলিয়া সফর বাতিল করেছিলেন। তিনি তখন ভারতের লোকসভার স্পিকার । তাঁর প্রোটকল অফিসারের কাছে শুনলেন,অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় তাঁকে বাধ্যতামুলক পায়ের জুতো জোড়া খুলতে হবে বিমান বন্দরের নিরাপত্তার জন্য । তিনি জানতে চাইলেন,ভারতেও কি অস্ট্রেলিয়ার স্পিকারকে বিমান বন্দরে জুতো খুলতে হয়? তাঁর প্রটোকল অফিসার বললেন, অষ্ট্রেলিয়ার স্পিকারকে ভারতে ভি আই পি মর্যাদার জন্য এটা করতে হবে না । সোমনাথ চট্রোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, ভারতের লোক সভার স্পিকারের মান সম্মান রক্ষার জন্যেই তিনি অষ্ট্রেলিয়া সফর বাতিল করলেন।

অথচ আমাদের নেতারা নিজের মান সম্মান বাঁচানোর জন্যে দেশকে হেয় করে হলেও বিদেশে আশ্রয় নিতেও কার্পন্য করেন না। তোমাকে বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই,আজকাল যেনো বাংলাদেশের চোর-ডাকাত-দূর্নীতিবাজ আর বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের দ্বিতীয় বাসস্থান হয়ে উঠছে প্রবাসের অসংখ্য দেশ । সুবিধে মত সময়ের অপেক্ষায় আপাত আশ্রয়ের জন্য দেশকে হেয় করার এমন কোন পন্থা আজ আর বাকী নেই  যা প্রয়োগ করা হয় না। ক্ষমতার পালাবদলে একদিন এরাই আবার দেশে গিয়ে লুট-তরাজ করে। পাঠিয়ে দেয় আরেক গ্রুপকে । একবার  তুমিই ভাব,  সরকারী পৃষ্টপোষকতায় দুনীর্তির দায়ে জেলে আটক কোন নেতাকে বিদেশে পাঠায় কোন সভ্য দেশ? নিজের দেশের কাছে যে অপরাধী,অন্যদেশে তাকে ঠেলে ধাক্কে পাঠিয়ে দেয়া কি কোন সভ্যতার নিদর্শন ?

বাংলাদেশের কোন তুচ্ছ ঘটনায়ও আমেরিকা- ব্রিটেন- অষ্ট্রেলিয়ায় মিছিল হয় । মিছিল না হলেও নিজেদের ভাড়া করা ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়,প্রকাশ করা হয় । কী তার উদ্দেশ্য? নিজের পঙ্কিলতাকে নিজেরা ধুঁয়ে মুছে ছাপছুঁতর করার সাহস নেই । অক্ষমতা অথবা অপকর্মের জন্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েই এরা থেমে থাকে না, সেটাকে নির্লজ্জের মত বাইরে প্রকাশ করার ধৃষ্টতাও দেখায়  । দেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি এদের দায় কতটুকু?  নিজের আর দেশের প্রতি আত্ম-মর্যাদার কতটুকু অবশেষ  থাকলে এ রকম হতে পারে । তাই তো স্বাধীনতার এতগুলো বছর চলে গেছে, নাই নাই করেও অর্জনও হয়েছে অনেক কিছুই । অথচ বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করার মত অহংকারটুকু ঢাকা পড়ে গেছে এ সবের জন্যেই ।

সেদিন আমেরিকা প্রবেশের সময় মনে পড়ছিলো কোন এক সন্ধ্যা সান্নিধ্যে আমরা বসেছিলাম তোমার কলেজ হোষ্টেলের পাশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে । মার্ক্সবাদের পোকা তখন কিলবিল করে সারাক্ষন । সহসা আমি বললাম,‘জানো, পৃথিবীতে দু’ শ্রেনীর মানুষ আছে।’

‘সেটা আর না জানার কি আছে ?’আমাকে অবাক করে দিয়ে তুমি বললে,‘ ডাক্তার আর রোগী । এই দু’ধরনের মানুষই তো আমি দেখি সকাল থেকে সন্ধ্যে। বিশ্বাস না হয় এখনি কোন রোগের কথা বল,দেখবে চারপাশে কত ডাক্তার,কত উপদেশ,কত ওষুধের প্রেসক্রিপশন। আর যদি বল যে তুমি একজন ডাক্তার,দেখো কত রোগী,কত রোগ তোমার চারপাশে । তাই তো বললাম,পৃথিবীতে মানুষ দুই শ্রেনীর,ডাক্তার আর রোগী ।‘

সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর সমস্ত ধকল তোমার এমন হালকা চালের কথাতে কর্পূরের মত উবে যায়  অন্যদিনগুলোর মতোই। আমি বললাম,‘ আর একটু পরেই তোমাকে আমার একটা সমস্যার কথা বলতাম রোগী সেজে। কিন্ত এখন আর বলবো না । তবে যেটা বলবো তা হলো আমেরিকা যাবার চেষ্টাটা বাদ দিয়ে দিলাম । আজকে আমার টোফেল পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা হলে আর গেলাম না ।’

‘ঠিকই করেছো শোষকের দেশে না যেয়ে। বরং শোষিত হয়েই না হয় থাকি আমরা।  হে মহানিঃস্ব কমরেড,দারিদ্র্য রেখার অনেকখানি নীচে আজকে আমার অবস্থান, তোমার চেয়েও বিঘতখানিক নীচে। সোজা হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি,পকেটে টাকাকড়ি কিছুই নেই। টি এস সির ডাসে যাবো সে রিক্সা ভাড়াটা পর্যন্ত নেই । হেঁটে যাবো, শরীরে ক্যালোরির ভান্ডারেও মহাআকাল । পকেটে টাকাকড়ি কিছু আছে?’

রাস্তায় নেমে এ্যানেক্স ভবনের সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে তোমার হাতখানি সজোরে ধরে ফেলি আমি । জানুয়ারী মাসের শীতে তোমার উষ্ণতায় ভাগ নিতে চেষ্টা করি কখনও । এ ভাবেই কেটে যায় আমাদের ঘোর লাগা সাহসী সময় । কখনও নিমগ্ন থাকি অন্য সকল চিন্তার ভেতর ।

সেদিনও আমেরিকান ইমিগ্রেশন অফিসে এই সব পাঁচমিশেলী চিন্তায় আটকে যাচ্ছিল বর্তমানের অবস্থানটুকু । হঠাৎ চমকে উঠি ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্নে ,‘ আমেরিকাতে কোথায় যাবে?’

বললাম,‘ নিউ ইয়র্ক সিটিতে ?’

‘কতদিন থাকবে? বিশেষ কোন পরিকল্পনা? না, শুধুই ভ্রমন ।’

‘এই কিছু জায়গা দেখবো , যেমন  স্ট্যাচু অব লিবার্টি, টুইন টাওয়ার, ম্যানহাটেন এই সব । সপ্তাহ দুইয়ের বেশী লাগবে না ।’

হাসিমুখে পাসপোর্টটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,‘গুড লাক, শুভ হোক তোমার আমেরিকা ভ্রমন ।’

বেশ খানিকটা অবাকই হলাম । শত্রুর আসনে বসিয়ে রেখেছি যাদের এতকাল ধরে,অথচ কী বিনয় আর সৌজন্যবোধ এদের । কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না অনেক কিছুই । ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম ধীরে ধীরে ।

একটু পরেই আন্তঃরাজ্য সড়ক পথ  ১৯০ ধরে বাসটি বাফেলো সিটির দিকে চলতে শুরু করে দিলো । বাইরে তাকিয়ে আছি প্রথম দেখার অনুভূতির জন্যে ।  একেবারে নিবিড় প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্ব, অথচ প্রথম দেখাতেই  মনে হয় নিজ নিজ বৈচিত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি দু’টো দেশ।  রাস্তার সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে রাষ্ট্রব্যবস্থার ধরণটুকুও আলাদা। আমেরিকাতে বাইরে তাকালেই রাস্তাগুলোকে মনে হয় একটু বেশী চওড়া। কানাডাতে যেখানে মাত্র দু’এক লেনের সড়ক পথ -একমাত্র কিছু আন্তঃ রাজ্য  মহাসড়ক বাদ দিলে। অথচ সীমান্তের এপারেই দেখা যাচ্ছে অসংখ্য লেনের সর্পিল সড়কগুলো ।  আশপাশের ঘর বাড়িগুলো কেমন দারিদ্র্যে চিহূ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় । জানালা দিয়ে বাইরের মানুষজনের পোশাক পরিচ্ছদেও তেমন আভিজাত্যের ছাপ নেই। বরং কিছু কালো মানুষের উদ্ভট পোশাকের চলাফেরা দেখে আপাত মন খারাপ করেই বাইরে থেকে চোখ নামিয়ে আনলাম।

অসংখ্য অজানা, অচেনা স্মৃতিরা আমাকে এমন ভাবে ভিড় করে ধরেছিলো সেদিন  যে, কখন যে পাশের সিটে এক যাত্রী এসে বসেছে সেটা খেয়ালই করিনি । নিজেকে জানালার দিকে আরও একটু সরিয়ে নিলাম আমি। প্রায় চল্লিশের কোঠায় পৌঁছানো এক ভদ্রলোক হাতের ব্যাগপত্র মাথার উপরের নিদিষ্ট জায়গায় রেখে বসলেন পাশে। মাঝারি গড়ন, একটু ফর্সাটে গায়ের রং। দেখলে সহজে মনে হয় পাকিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের হবেন ।

হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন,‘আমি আশরাফ, আশরাফ আল এলাহি ।’

নিজের পরিচয় দিয়ে আবারও আমি বাইরে তাকালাম । বাসটি তখন আন্তঃরাজ্য সড়ক পথ  ১৯০ ধরে   বাফেলো সিটি বাস টার্মিনালে পৌঁছে গেছে ।

যে রাস্তায় মোড় নিয়ে বাসটি টার্মিনালে ঢুকে গেল, তার পাশেই বিরাটাকায় ঝকে ঝকে তক তকে একটা ভবন। ছাদ পর্যন্ত উঁচু বিশাল কাঁচে ঘেরা ভবনগুলো দেখলেই সহজেই বোঝা যায়  এগুলো চার্চ । মাথার উপরে বিশালাকায় ক্রস চিহূ আর চত্ত্বরের সুনিপুনভাবে ছেঁটে রাখা গাছগুলো সহজেই আশপাশের অন্যান্য ভবনগুলো থেকে চার্চগুলোকে পৃথক করে রাখে । এ ক্ষেত্রেও কোন ব্যতিক্রম দেখলাম না । ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেও ধর্মের প্রভাব থেকে যে মানুষকে পৃথক করা যায় নি, আমেরিকার এই পরম যত্নে লালন করা চার্চগুলো তার সাক্ষ্যই বহন করছে ।

টার্মিনালে অনেকেই বাস থেকে নেমে গেলেন । আমি আর সহযাত্রী আশরাফ বাসেই বসে রইলাম । মাত্র বছরখানিক প্রবাসে থেকে বুঝেছি  শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য কোন বর্ণের দুই জন মানুষ একত্র হলেই একটু প্রাণ খুলে কথা বলতে চেষ্টা করে।  এর পেছনের কারণ ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষনে বলা যায় । কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়েছে , অশ্বেতাঙ্গ মানুষগুলোও একধরনের বৈষম্য পোষন করে নিজেদের মধ্যে । প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী হলে তো কথাই নেই। নিজের অজ্ঞাতেই শ্বেতাঙ্গ মানুষদেরকে দেয়ালের অন্য প্রান্তে ঠেলে দিয়েই আমরা একটু নিশ্চিন্ত হই । একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেই । একটু মনের মত করে নিজেদের সুখ দুঃখকে ভাগাভাগি করি । ঠিক আমাদের দেখে আসা, শিখে আসা মানসিকতার মতই ।

তুমিই অসংখ্যবার বলতে,‘ আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে কিভাবে প্রতি নিয়ত লালন করে চলেছি নিজেদের অজান্তেই। আমাদের কথা বার্তায়, হাবে ভাবে ভংগীতে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে এমন ভাবে কথা বলছি যে, তাতে স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিচ্ছি আমরা আলাদা ।’

আমি প্রশ্ন করতাম ,‘যেমন?’

‘যেমন অনেকেই বলি, উনি হিন্দু হলেও খুব ভালো। আবার বলি,উনি মুসলমান অথচ কী ভাল মানুষ।’

আমি প্রশ্ন করতাম ,‘এতে দোষের কিছু আছে?’

‘দোষের এই যে, উনাকে ভাল বলে বুঝিয়ে দিচ্ছি, আসলে উনিই ভাল, অন্য সব হিন্দু কিংবা মুসলমান  খারাপ। তাছাড়া শুধু এটাই নয়, আমরা  নিজের বর্ণের কিংবা গোত্রের মানুষজন দেখলে কেমন নৈকট্য বোধ করি । অনেকেই আবার নিরাপদও বোধ করি।  করি না কি?’

আমি বলি ,‘হ্যা করি। এটা বোধ হয় খুব সহজাত। সম্প্রদায় কেন, অন্য পেশার মানুষজনেরাও নিজ নিজ মানুষের কাছে কী রকম স্বচ্ছন্দ বোধ করে ,তুমিই বলো ।’

আমার খোঁচাটা ঠিকই বুঝতে তুমি। মুখে  মুগ্ধতার দ্যুতি ছড়িয়ে বলতে,‘ বুঝেছি, আমি আর আমার ডাক্তার বন্ধুদের সামনে  ডাক্তারি আলাপ করবো না। তুমি থাকলে তো নয়ই। আর যাই হই, সাম্প্রদায়িকতার অপবাদ আর নিতে চাই না, বুঝলে।’ আমি তোমার দিকে একটু সরে এসে তোমাকে ভালবাসতে চেষ্টা করতাম   হাতে হাতের স্পর্শটুকু লাগতেই তুমি বলতে,‘কি অসভ্যতা হচ্ছে ,শুনি?’

হঠাৎ খেয়াল হলো পাশের ছিটে বসা আশরাফ আল এলাহি আমাকে ডাকার চেষ্টা করছে । আমি হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশের কোন এক নির্জন স্থানে তোমার সান্নিধ্য থেকে নিষ্ঠুরের মত নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এলাম মুহুর্তেই আশরাফের কাছে ।

তখনও বাস ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বাফেলো বাস টার্মিনালে। আশরাফকে বললাম ,‘দুঃখিত, তুমি কি কিছু বলছিলে আমাকে?’

আশরাফ বলল,‘বলছিলাম তুমি নামবে কিনা?’

‘না , এই  কিছু সময় আগেই তো নামতে হলো ইমিগ্রেশনে । তুমি কি কানাডা থেকে আসছো?’, আমি প্রশ্ন করলাম ।

‘না , কানাডা যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না । যেতে দিলো না কানাডা ইমিগ্রেশন । তা থাক সে কথা । তুমি কি মুসলমান ?’, আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করলো আশরাফ । এটা বোধ হয় পাকিস্তানী কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানের একটা কমন  প্রশ্ন । এশিয়ান চেহারা দেখলেই এই ব্যক্তিগত প্রশ্নটা করবেই । তাছাড়া বাংলাদেশী শুনলে তো কথাই নেই । আমি বরাবরের মত এবারও এড়িয়ে যাবার মত করে উত্তর দিলাম ,‘কেন বলতো , মুসলমান হলে তোমার কি কোন সুবিধে হবে ?’

আশরাফ আমার বিরক্তি বুঝলো। অনেকে যদিও সেটাও বোঝে না। বারবার দুঃখিত দুঃখিত বলতে লাগলে। আমি আশরাফকে একটু সহজ করার জন্য অন্য প্রসংগে চলে গেলাম । বললাম ,‘ তুমি বুঝি অনেক দিন থেকে আমেরিকা আছো ?’

তারপর আশরাফ  বলে যেতে লাগলো অনর্গল ওর অভিবাসনের পেছনের কাহিনী । কিছুক্ষন আগের আমার খোঁচাটা  ও অতি সহজেই হজম করে নিলো। আশরাফ এসেছে পাকিস্তান থেকে । ওর জন্ম যদিও ইরানে । ওর বাবা শাহের অনুসারী কমিউনিষ্ট । ১৯৭৯ সালে খোমেনীর তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের সময় হাজার হাজার শাহের অনুসারীকে খুন করা হয় । সে সময় আশরাফের বয়স বিশ বছর। পরিবারে সাথে তেহরান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আসে আশরাফ । তারপর সেখান থেকে আমেরিকা আসে ১৯৯০ সালে। সে থেকে আমেরিকাতেই আছে। কিন্তু প্রচন্ড আমেরিকা বিরোধী। আমেরিকাতে মুসলমানদের কোন আশা ভরসা নেই। আমেরিকানরা হাড়ে-মাংশে মুসলমান বিদ্ধেষী । আশরাফের এহেন অন্তহীন অভিযোগের পাহাড় ।

আমি প্রশ্ন করি ,‘পাকিস্তান থেকে চলে এলে কেনো? কিংবা ইরানেও তো চলে যেতে পারতে ?’

আশরাফ পাকিস্তানকে আর নিরাপদ মনে করে না। কারণ, শিয়া সম্প্রদায়কে পাকিস্তানে সুন্নি মুসলমানেরা তো হামেশাই মেরে ফেলছে। শিয়াদের মসজিদে বোমা মারছে । মিছিলে গুলি করে পাখির মত মানুষ মারছে। এবং এসব তো হচ্ছে সরকারি মদদেই। আর ইরানেও শাহের পর তেমন কোন উন্নতি হয় নি। খোমেনী ইসলামী বিপ্লবের নামে ইরানকে শাহের সময় থেকেও অনেক পেছনে নিয়ে গেছে ।

আশরাফ নিজের জন্মভূমিকে আর নিরাপদ মনে করে না। নিরাপদ মনে করছে না আরেক ইসলামী দেশ পাকিস্তানকেও। নিজের সম্প্রদায় অর্থ্যাৎ শিয়া সম্প্রদায়ও তাকে আর  নিরাপত্তা দিতে   পারছে না। বেঁচে থাকার জন্য তাই আমেরিকাতেই আশ্রয় নিয়েছে আশরাফ। নিজের জন্মভূমি তাকে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা দিতে পারেনি।  সেই নিরাপত্তাটুকু দিয়েছে যে আমেরিকা, তাকেও শত্রুর আসনে বসিয়েছে আশরাফ। বাফেলো থেকে নিউ ইয়র্ক সিটি তখনও অনেকটা দূর। প্রায় সাত- আট ঘন্টার রাস্তা। আমার পাশে বসা সহযাত্রীর সুসান্নিধ্য লাভের আশায় আশরাফকে আবারও আরেকটা  অপ্রিয় সত্য কথা বললাম না।

শুধু বললাম,‘ তোমাকে তো বলাই হয়নি । আমি বাংলাদেশের মানুষ ।   তুমি হয়তো জানো, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরেছিলো। আর তার অধিকাংশই মুসলমান। আর তুমি আজ যে আমেরিকাতে তোমার মুসলমান ভাইদের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছ এদের কিন্তু প্রায় সবাই অমুসলিম। তাহলে কি হলো ব্যাপারটা। মুসলমানদের কাছ থেকে প্রাণ বাঁচাতে তোমাকে আশ্রয় ভিক্ষে করতে হয়েছে অমুসলিমদের কাছে। কিছুক্ষন আগে তুমি যে আমাকে জিজ্ঞাস করলে আমি মুসলমান কিনা? আমি মুসলমান কি অমুসলমান সেটা কি খুব মুখ্য ?’

আশরাফ আল এলাহি আমার কথা কতটুকু হূদয়ে ধারণ করতে পারলো বোঝা গেলো না। বাফেলো টার্মিনাল ছাড়িয়ে বাসটি আবারও আন্তঃরাজ্য সড়ক পথ  ১৯০ ধরে চলা শুরু করে দিলো নিউ ইয়র্ক সিটির দিকে।