অনুভূতি ব্যক্তির একটি সুপ্ত এবং একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার হওয়া সত্ত্বেও হর হামেশা এটাকে নিয়ে টানাটানিও কম হয় না। কয়েকটা ধাপ পার না হওয়া পর্যন্ত এটি জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়না। অনুভব এবং অনুভূতি একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যতিত অনুভূতির ধরণ, মাত্রা ইত্যাদি বুঝা প্রায় অসম্ভব। মানব মনের তিনটি স্তরের কথা আমরা জানতে পারি । চিন্তন, অনুভূতি, ইচ্ছা। যা মানুষের শুধুমাত্র পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ধারণ করা যায় না। মানব মনের অনুভূতি কোন স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া নয়, তাতে রয়েছে মস্তিষ্ক প্রসুত চিন্তা, অন্তদর্শন প্রভৃতি। আমাদের চিন্তনের উপদানগুলো কি হতে পারে? সংবেদন, প্রত্যক্ষ, স্মৃতি, কল্পনা, অবধারন ইত্যাদি চিন্তার অন্যতম উপাদান। তেমনি আমরা যদি অনুভূতির স্বরূপ চিহ্নিত করতে যাই তাহলে, অনুভূতির অন্তর্ভূক্ত মানসিক প্রক্রিয়াগুলোকে চিহ্নিত করা উচিৎ। সুখ-দুঃখ, ভয়, বেদনা, ক্রোধ, ভালাবাসা, আনন্দ, বিষাদ, আবেগ প্রভৃতিকে অনুভূতির আওতাধীন বলে ধরে নেয়া হয়। অনুভূতির মধ্যে আবেগ ও প্রক্ষোভ হচ্ছে মানব মনের একধরনের জটিল অনুভূতি। মানুষের আবেগ ও প্রক্ষোভ এর মত জটিল অনুভূতিকে সুনির্দিষ্টভাবে কোন ডকট্রিনে ফেলে ব্যাখ্যা করে ১০০ ভাগ সফল হওয়া যায় না। আবেগ তাড়িত অনুভূতিগুলিই বেশিরভাগ সময় বিতর্কিত এবং সমালোচিত হয়।

এই লেখাতে অন্তর্দশর্ন প্রসুত অনুভূতিগুলিকে ইংগিত করা হবে। কেননা সব অন্তর্প্রত্যক্ষণ কিন্তু অন্তর্দশর্ন নয়। অন্তর্দশর্নের মাধ্যমে ব্যক্তি তার অনুভূতিকে সুনির্দিষ্টভাবে একান্ত নিজের মত করে ভাবতে পারে এবং দায়টাও সম্পূর্ণরূপে তাকেই নিতে হয়। অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় একধরনের প্রতিক্রিয়া। প্রকাশের ধরনেরও বিভিন্ন উপায় রয়েছে। মৌখিক, লেখা-লেখি এবং শারীরিক ভাষায় অনুভূতির প্রকাশই বেশি মাত্রায় ব্যবহ্নত। আসল বিপত্তিটা ঘটে প্রকাশের পরই। একজন কোন বিষয়ের উপর তার যে নিজস্ব অনুভূতি প্রকাশ করেছে সেটা আর একজনের ব্যক্তিগত অনুভূতির পক্ষে গেলে তো ভাল, আর না গেলে একেবারে যা তা অবস্থা। একজনের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশে অন্যজনের অনুভূতিতে আঘাত প্রাপ্ত হয়। এমন যদি ঘটে তাহলে ব্যক্তির ব্যক্তিগত অনুভূতির নিরাপত্তা থাকলই বা কোথায়? কথাটায় যুক্তি আছে বটে। যদি তা ব্যক্তিগত আক্রমনের পর্যায়ে পড়ে। প্রত্যেকের অধিকার আছে তার নিজস্ব মত প্রকাশের। তাতে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ না থাকলে আইনগত কোন সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। মানুষের অনুভূতি অত্যন্ত ব্যপকতর পরিসরে বিস্তৃত। এবং সবই ব্যক্তিগত বিচার-বুদ্ধি-চিন্তা দ্বারা অনুভূত। এটা যেমন তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা তেমনি একই অনুভূতি প্রসুত কোন মতের সাথে মতানৈক্য হতে পারে সেটাও একইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা। বিস্তৃত পরিসরে একধরনের অনুভূতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে বিপরীত ধর্মী অনুভূতির স্বাধীনতা খর্ব করা যায় না। তাই রাষ্ট্র মানুষের অনুভূতির নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে না।

ধরে নেয়া যাক কোন রাষ্ট্র বাল্য বিবাহ, একই সাথে বহু স্ত্রী গ্রহণ, সতীদাহের মত প্রভৃতি প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করল। অথচ যে সমস্ত নাগরিকের বর্ণিত কার্যক্রমে ধর্মীয়ভাবে বাধা নেই বলে তারা কাজটিকে অনৈতিক বা বেআইনি মনে করেন না, তারা যদি ঐ নিষিদ্ধ ঘোষনাকে তাদের ধর্মানুভূতির উপর আঘাত হিসেবে ধরে নেয় তবে সেক্ষেত্রে কি কারো ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা হলো? বা ধর্মানুভূতির অনিরাপত্তার জন্য কি হুতাশ হওয়া যাবে? যদি এই সমস্ত অমানবিক প্রথাসমূহ রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধও না হয় এবং কোন একজন ব্যক্তি যদি এই সমস্ত কু-প্রথার বিরুদ্ধে সুচ্চার হন তবে তার বিরুদ্ধে কি ধর্মানুভূতির উপর আঘাতকারী হিসেবে অভিযোগ আনয়ন করা যাবে? যেহেতু আস্তিক, নাস্তিক, ধার্মিক সবাই মানুষ সেহেতু মানবতার প্রশ্ন সবার কাছেই একই রূপে প্রযোজ্য। অনুভূতির সাথে সুখ-দুঃখ, ভয়, বেদনা, ক্রোধ, ভালাবাসা, আনন্দ, বিষাদ, আবেগ ইত্যাদি জড়িত। কোন নির্দিষ্ট মতবাদ, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতির প্রতি মানুষের ভালবাসা বা আবেগ জড়িয়ে থাকতে পারে। বা অনেক দিন একই অবস্থাতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় নিজের অজান্তেই মানুষ কোন না কোন সংস্কৃতি বা প্রথায় অনুরক্ত হয়ে পড়ে। কোনটা কু-প্রথা, কোনটা অপসংস্কৃতি এসবকে তফাৎ করার মত চেষ্টা অনেকেই আপাতত করে না। কোন কু-প্রথাকে বা অপসংস্কৃতিকে যদি কোন সম্প্রদায় সংঘবদ্ধভাবে লালন করে থাকে তো কথাই নেই। তার শিকড় ছড়িয়ে পড়ে অনুসারীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বুঝে হোক বা না বুঝে হোক মনের মধ্যে ধারণ করে রাখে সযত্নে। কেউ যখন অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাবে এর বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন তারা মনে করে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং সতর্ক থাকে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য। অথবা মনে করে এটা তাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। এমনকি তারা প্রতিবাদ, সমাবেশ, আন্দোলনও গড়ে তুলে তাদের অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য। আমাদের দেশের খ্যাতনামা এবং মুক্তচিন্তার অনেক লেখককেও শাস্তির দাবী জানানো হয়েছে এসব আন্দোলন-সমাবেশ থেকে। রাষ্ট্রিয় আইনের উপর আস্তা রাখতে না পেরে আবার শক্তিও প্রয়োগ করেছে বিভিন্নভাবে। প্রতিনিয়ত হুমকি-ধামকি দিয়ে চলেছে। অপরাধ, অনুভূতিতে আঘাত। তাদের অনুভূতির আবরণটি এতই পাতলা যে, এক বৃহৎ সম্প্রদায় কর্তৃক সহস্র বছর ধরে লালন করা সংঘবদ্ধ অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হয়ে চূরমার হয়ে যাওয়ার আশঙ্খা থাকে মাত্র কয়েকজন মুক্তচিন্তার লেখকদের লেখনিতে।

মানবতার পক্ষের যে কোন কথা অমানবিকদের বিপক্ষেই যাবে নিশ্চিত। তারা যে কোন প্রশিদ্ধ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের লোকই হোন না কেন উক্ত প্রসংগে তারা অবশ্যই অমানবিক। চুরি করাকে অপরাধ বা অনৈতিক হিসেবে ব্যাখ্যা করা কি চুরের অনুভূতিতে আঘাত? আমাদের সমাজে আমরা বহু কুসংস্কার, কু-প্রথাকে লালন করে আসছি যুগ যুগ ধরে। নিজস্ব অনুভূতিতে গেঁথে রেখেছি বদ্ধমুল করে। এক সম্প্রদায়ের চিন্তাধারার সাথে আর এক সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা না মেলার জন্য আমরা জড়িয়ে পড়ছি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। জংগি সংগটনগুলো বিচারালয়ে হামলা করছে বিচার ব্যবস্থা তাদের অনুভূতি প্রসুত প্রস্তাবনা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না বলে। সিনেমা হলে বোমা হামলা, পহেলা বৈশাখে বোমা হামলা করা হয় ঐ একই কারনে। তারা কোন ধরনের অনুভূতিকে লালন করছে? তা কি কখনো মানবতার পক্ষে যাবে? কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে প্রভূর বুলিকে শিরোধার্য করে নিয়ে চরম অমানবিক কাজে লিপ্ত হওয়াও তাদের কাছে দোষের কিছু না। যুক্তির নিরীখে মানবতা-নৈতিকতা নির্ণয় করা তাদের কাজ না, প্রভুই বলে দেবেন কোনটা অমানবিক আর কোনটা অনৈতিক।

মানব মনের অনুভূতি কোন স্বতন্ত্র সত্তা নয়। মানব শিশু জম্মে পর এটার কার্যকারিতা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বিভিন্ন চিন্তাধারা, চেতনা, শিক্ষা, পরিবেশ প্রভৃতির প্রভাবে অনুভূতি পরিপুষ্টতা লাভ করতে থাকে। চেতনা-শিক্ষা-পরিবেশ মানুষের অনুভূতির গতিপথ পাল্টে দিতে পারে। অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও উদার চেতনাধারী হওয়ার উদাহরণ যেমন রয়েছে তেমনি এর বিপরীত উদাহরণও কম নয়। বিশেষ করে জংগী বা ধর্মীয় দলগুলোর রিক্রুটিং পদ্ধতির দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে তারা একজন ছাত্রকে টার্গেট করে নিয়মিত প্রেষণা দিয়ে কর্মীতে পরিনত করে। পাল্টে দেয় তার স্বাভাবিক গতিপথ। অনেক পরিবার জানতেই পারেনা তাদের মেধাবী সন্তানটি জড়িয়ে পড়েছে ধর্মীয় রাজনীতির নামে এসমস্ত ঘৃনিত অপরাধের সাথে। শুনানো হয় শান্তির বাণী আর হাতে তুলে দেয়া হয় অস্ত্র। ঘৃণা করতে শেখায় বিপক্ষ অনুভূতির মানুষকে। নিজের অবস্থানকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীতে মুড়িয়ে অন্য সব কিছুকে একেবারে বাতিল করে দিতে শেখায় এবং এমনকি আত্মঘাতি হতেও বদ্ধপরিকর করে তুলে। আবেগ মিশানো অনুভূতিই নিরীহ ছেলেটিকে দাঁড় করিয়ে দেয় সমস্ত মানবতার বিরুদ্ধে, নৈতিকতার বিরুদ্ধে। এছাড়াও পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধ অনুরাগ বা আবেগ বশতঃ বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও আমরা অনেকেই এমন কিছু প্রথা বা কুসংস্কারকে বহন করে চলেছি যেখানে মানবতা ও নৈতিকতা প্রতিনিয়ত হুচট খাচ্ছে।

সূত্রঃ
সমাজদর্শন- শ্রী প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত।
ধর্মানুভূতির উপকথা- হুমায়ুন আজাদ।