সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে

মা ছোটবেলায় একটা গল্প বলেই জিজ্ঞেস করতেন, কে সুখী?
গল্পটা ছিল — রাজার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে গোলাপ ফুল নিয়ে গন্ধ শুঁকতে গিয়ে একটা পাঁপড়ি ছিঁড়ে পায়ে পরাতে সে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। পায়ের যে জায়গাটায় পাঁপড়ি পড়েছে সে জায়গাটা লাল হয়ে আছে। আর ছোট মেয়ে ধুপধাপ শব্দ শুনে জিজ্ঞেস করল, কিসের শব্দ? ব্যাখ্যাসহ উত্তর শুনল যে এটা পাশের বাড়িতে মহিলাদের চিড়া কুটার শব্দ। দৃশ্যটি কল্পনা করে ছোট মেয়ের হাতের আঙ্গুলে ফোসকা পড়ে গেল। রাজার কোন মেয়ে বেশি সুখী? বড়টি না ছোটটি?

বিশ্লেষণ করে বলতাম, ছোট মেয়ে। বড় মেয়ের পায়ে নিদেন পক্ষে ফুলের পাঁপড়ি পড়েছে। কিন্তু ছোট মেয়ে তো শব্দ শুনেই হাতে ফোসকা। কাজেই ছোট মেয়ে বেশী আহ্লাদি। বেশি সুখী।

এখন হলে গল্পটিকে এত সোজা সাপটাভাবে নিতাম না। নিতে পারতাম না। বলতাম, যারা চিড়া কুটছে তারা বেশি সুখী। কাজ করছে। কিছু করে খাচ্ছে। যে কোন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে বাঁচার দক্ষতা তাদের আয়ত্বে।

মা হয়ত বলতেন, প্রশ্ন করছি কি আর তুই উত্তর দিলি কি?
আর আমি হৈ চৈ করে বলতাম, ঘায়ে মুর্ছা যাওয়া মেয়েদের সুখী বানাতে চাও কেন? খেটে খাওয়া নারীদের প্রসংগ গল্পে পরোক্ষভাবে কেন? সরাসরি তাদের সুখদুঃখের কথা বল। খেটে খাওয়া মানুষরা সব সময়ই কাহিনীর পার্শ্ব চরিত্র হয়েই থাকে কেন! শিশুতোষ কল্পকাহিনী ঢেলে সাজাবার সময় এসেছে।

আমার এ আখ্যানটি শুনে মা নিশ্চয়ই ভাবত,
কিসের মধ্যে কি!
পান্তা ভাতে ঘি।
সবখানেই বিপরীতধর্মী চিন্তা। বিকল্প কথাবার্তা। ছোট্টমণিদের রাজার মেয়ের গল্পের মধ্যে খেটে খাওয়া নারী। মিলল?
মিলেনি। মিলবেও না। মিলেও না। এই না মিলানোকে মিলাতেই তো সংগ্রাম। যুদ্ধ। আন্দোলন।

রাজা, রাণী, রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের গল্প কাহিনী শুনতে শুনতে শিশু বড় হয়ে প্রেসিডেন্টের বউকে রাণী ভাবে। পরে তাকে রাণীর মতই প্রধানমন্ত্রী বানায়। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ঘোড়ার বদলে বি এমডব্লিউ তে চড়ে প্রটোকল নিয়ে যানজট বানিয়ে ফেললেও জনতা প্রতিবাদ করে না। প্রেসিডেন্টের বেহায়াপনাকে মনে করে রাজাদের তো একাধিক নারী সঙ্গ থাকাই আভিজাত্যের লক্ষণ এবং রাজাদের একাধিক স্ত্রী রাখার চর্চা আদিকালেও ছিল। আমাদের প্রেসিডেন্ট আর এর ব্যতিক্রম কি? বাবাসহ পরিবারের সবাই খুন। কাজেই জীবিত উত্তরাধিকারীকে প্রধান মনোনীত কর। দলের রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘ হলেও নেতার যেন বড়ই অভাব। রাজতন্ত্রের এসব আবহ সৃষ্টিতেই আমার আপত্তি।

এসব রাজরাজড়ার গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে মগজ ধোলাই করার দিন শেষ।
‘মাগো সেই কথা বল
রাজার মেয়েকে পাষাণ করিতে ডাইনী করে কি ছল’।

এসব গল্প বা ছড়া এখনকার শিশুদের কাছে বলা অচল মুদ্রার মতই নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া প্রয়োজন।

এখনকার প্রজন্ম জানতে চাইবে —-

ডাইনী কেন ডাইনী হল,
মানুষ হল না কেন।
অথবা
মানবীকে কে ডাইনী বানাল?
বিবেক কাঁপল না কেন?

মানবীকে ডাইনী বানানোর গাজাখুরি অপপ্রয়াসের যুগ গত। চিন্তা চেতনার জগতে আনতে হবে আমূল পরিবর্তন।
তাছাড়া, রাজার সুখী মেয়ের হওয়ার গল্পের পাশাপাশি চলে রাজপুত্রের রাজ্য রক্ষার ও রাজ্য জয়ের বীরত্বের কাহিনী। রাজকন্যার সাথে রাজত্ব লাভের গল্প। রাজকন্যাকে কাঠির স্পর্শে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়, কিন্তু রাজপুত্রকে কখনও নয়। যে গল্প ছেলে শিশুকে করে সাহসী আর মেয়ে শিশুকে করে আহ্বলাদি ও নির্ভরশীল, সে গল্প, সেই রাজ – রাজরার কথা হোক আজ নির্বাসিত অধ্যায়।
তাছাড়া দিন অবশ্য সমাগত। তিউনিশিয়া,মিশর, লিবিয়া । এর পর? পারস্য অঞ্চল। আরব? এরপর? এরপর গনতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলে জৈবিক উত্তরাধিকার হবে লোককাহিনী। গান্ধী, জিয়া, শেখ, কুমারাতুঙ্গা,ভুট্টোর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা দখল করবে রাজনীতি জানা যোগ্যতা। বাড়বে জনতার রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনতার প্রত্যেকেই সরকার ।

চেতনায় নিষিদ্ধ পার্কিং

দীর্ঘ ভ্রমণে রাস্তায় চলতে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে গরুর দুধের চা খাওয়া আমার এক ধরণের নেশা। শখ। আনন্দ। তৃপ্তি। ড্রাইভারকে আগেই বলে দেই কাপ যেন গরম জল দিয়ে ধুইয়ে দেয়। গাড়িতে বসেই সাধারণত চা খাই। মাঝে মাঝে পায়ের আড়মোড়া ভাঙতে নামি। নিয়মিত অফিসের কাজে যাই বলে দুয়েকটা চায়ের দোকান পরিচিত হয়ে গেছে। যেমন মানিকগঞ্জের উথুলি ও ধামরাইয়ের বাথুলিতে। বেশ যত্নের সাথে চা বানায়। সম্মানের সাথে পরিবেশন করে। তবে চায়ের দাম অন্যদের চেয়ে বেশিই নেয় এবং দাম বেশি দিতে অনেকের মন করে খচখচ।

আমার এক সহকর্মী একদিন বলেই বসল, চায়ের দাম আমাদের কাছ থেকে বেশি নেন কেন?
আমি পরে তাকে বুঝিয়ে বলি, নেবেই তো। গরম জল দিয়ে কাপ ধুতেই তো আরেক কাপ চায়ের ফুটানো জল লাগে। পরিচ্ছন্ন কাপ চাই। গরম পানিতে ধোয়া কাপ চাই। পয়সা খরচ করতে আপত্তি থাকা উচিত নয়।

সহকর্মীটির উত্তর, পরিষ্কার কাপ তো আমি চাইতেই পারি। ক্রেতা হিসেবে এ আমার অধিকার।
হ্যাঁ,এ আপনার অধিকার। আর তা করতে যে খরচ তা ও তো আপনাকেই দিতে হবে।
দামী রেস্টুরেন্টে বসে এক কাপ চায়ের দাম দশ টাকা দিতে যার কোন আপত্তি নেই, রাস্তার পাশে দশ টাকার চেয়ে বেশি সেবা পেয়েও পাঁচ টাকা দিতেই লাগে তার বিপত্তি।

এরপর সহকর্মীটি যে সব কথাবার্তা বলেছেন তা বিশ্লেষণ ছাড়া শুধু সাদামাটা অর্থ করলেও দাঁড়ায় — আমরা গাড়ি চড়ে এমন দোকানে চা খাই এটাই তো অনেক! দোকানের ডাট বাড়ে।
আর আমি ভাবি — আমাদের গাড়িটি তার দোকানের সামনে থামিয়েছি মানে কি আমাদের তিন কাপ চা বানাতে ছয় কাপের খাটূনি, জল ও সময় ব্যয় করে ভর্তুকি দিতে হবে! আসলে এ ভর্তুকিই একটা শ্রেনী আরেকটা শ্রেনীর কাছে পাওনা বলে মনে করে। আর এটাই তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির পাঠ।
গ্রামের রাস্তার পাশে আমার অফিসের গাড়ী থামলে দোকানী আহ্বলাদ প্রকাশ করলেও জেলা শহরে কিন্তু কোন দোকানী তা করতে দিবে না। সামনে গাড়ি থাকলে তার ক্রেতা আসবে না বলে পার্কিং নিষিদ্ধ। দোকান নাকি ঢাকা পড়ে যায়। মফস্বল শহরে তো ক্রেতা বিক্রেতা সবাই চেনা। পরস্পরের পরিচিত। এখানে গাড়িটি চেনাচেনির জন্য বা কেনাবেচার জন্য কোন বাধাই নয়। হাটাহাটিতে হয়তো বাধা। আর ঢাকায় দোকানের সামনে পার্কিং নিষিদ্ধ যান জটের জটিলতার কারণে। গ্রামের দোকানীর চিন্তা চেতনায় পার্কিং নেই, তবে জেলা শহরের ও ঢাকার দোকানীর ও লোকজনের চিন্তা চেতনায়ও পার্কিং রয়েছে। গাড়ি যত্রতত্র পার্কিং এ পথচারীও বিরক্ত কিন্তু গ্রামে গঞ্জে দোকানের সামনে পার্কিং গ্রহণযোগ্য আর তাদের চেতনায় নিষিদ্ধ পার্কিং। তারা কোথাও আটকে থাকে না, আটকে রাখে না।
(চলবে)