চৈত্রের একটি নিঝুম রাত।
ঘুমন্ত কর্মক্লান্ত নগরী, ঘুমন্ত প্রকৃতি।
চারিদিকে নীরবতা, প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা
মায়ের বুকে নিশ্চিন্তে , নিরাপদে ঘুমাচ্ছে নিষ্পাপ শিশু।
অঘোরে ঘুমাচ্ছে জীর্ণ-শীর্ণ বৃদ্ধ,
ঘুমাচ্ছে তরুণ-তরুণী।

হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে
বীভৎস আওয়াজ হতে শুরু করলো।
বিকট শব্দে , হৃৎপিন্ড কেঁপে
সকলের ঘুম ভেঙে গেল।
ভীষণ ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো দিকেদিকে।

কামান ও মর্টারের গর্জনে
বিস্ফারিত হতে লাগলো আকাশ-পাতাল।
গোলার আগুনে, জ্বলন্ত-নক্ষত্রের মতো
জ্বলে উঠল ধূলির ধরাতল।
রাতের নক্ষত্রগুলো গভীর বিস্ময়ে
তাকিয়ে রইলো অগ্নিলাল বাংলার পানে।

চারিদিকে গুলির ভয়ানক শব্দ
প্রকম্পিত দিক-দিগন্তর।
আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে
মানুষের আর্তনাদ।

কাপুরুষ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার নির্দেশে,
একটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনী-
লেলিয়ে দেয়া কুকুরের মতো
রক্তপিপাসু রাক্ষসের মতো
ঝাঁপিয়ে পড়ল; নিরপরাধ, নিরস্ত্র,ঘুমন্ত মানুষের উপর।

ছাত্র-শিক্ষকদের দেখা মাত্র গুলি
কিছু বুঝে উঠার আগেই গুলি
এক মুহূর্ত আগেও যে জীবন্ত ছিল সে এখন মৃত।
ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত মৃতদেহ গুলো
পড়ে রইল যেখানে সেখানে,
রাস্তা-ঘাটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে।

দেশের বুকে কীট-পতঙ্গের মতো
মরে পড়ে রইল দেশের অমূল্য-সম্পদ;
মেধাবী, তেজস্বী ছাত্ররা
মরে পড়ে রইলেন বিজ্ঞ শিক্ষকগন।

মেশিনগানের প্রবল বর্ষণে রক্ত-সিক্ত রাজপথ।
চারিদিকে তাজা রক্তের থৈথৈ
রক্তের হোলি খেলা,
রক্তের জোয়ার, রক্তের বন্যা।

সে রক্ত কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল,
লাল-গোলাপের মতো টকটকে লাল
রক্ত-জবার মতো লাল
আগুনের মতো টগবগে লাল
পলাশের মতো লাল
সূর্যের মতো জ্বলজ্বলে লাল
সদ্য-উদ্‌গিরিত লাভার মতো লাল
লালের চেয়েও বেশি টাটকা লাল।

কী বর্বর, কী অবর্ণনীয়, কী অ-লিখিতব্য সে দৃশ্য!
ঢাকা নগরী যেন একটি মরণ-কূপ,
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে জমেছিল
ছাত্র-শিক্ষকের লাশের স্তূপ।

নদীমাতৃক বাংলা মায়ের বুকে বয়ে গেছে
তারই সন্তানদের রক্তের নদী।
পৃথিবীর ইতিহাসে সে এক বর্বর রাত
একটি রক্তে ভেজা রাত
একটি কৃষ্ণ গহবর
একটি কাল-রাত,
২৫শে মার্চের রাত।