এমন কথা অনেক মানুষের মুখেই শোনা যায়, “আমি অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করি কারণ আমি এমন অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যা পুরোপুরি অলৌকিক। আমার জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যার ফলে আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়ে গিয়েছি”। ভূত, জ্বিন, প্রেতাত্মা ইত্যাদির সাক্ষাৎ দর্শন পেয়েছেন, বা রাতের অন্ধকারে গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয়। আমার অনেক বন্ধুই আছে যারা আমাকে অলৌকিক সব ঘটনার কাহিনী শোনায় এবং জিজ্ঞাসা করে, ‘এর কি কোনো ব্যাখ্যা তোমার কাছে আছে?’ সব মিরাকলের ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়াটা সময় ও শ্রমের অপচয়। কিন্তু তারপরও কিছু মিরাকলের ব্যাখ্যা খুঁজে যেতে হয়। কোনো মিরাকল ঘটার পর সেটাকে এমন একটি সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় যেটি কিনা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

মিরাকলের ধরণের উপর ভিত্তি করে অনেকসময় কোনো নির্দিষ্ট ও অপ্রমাণিত সত্তা সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্তও নেয়া হয় যে ওই সত্তাটি তার অনুসারীদের দুরারোগ্য ব্যাধি পর্যন্ত নিরাময় করে দিতে পারে (যেমন, অন্ধের দৃষ্টি ফিরে পাওয়া, বন্ধ্যার সন্তান জন্ম দেয়া, এমনকি মৃতের জীবিত হয়ে ওঠা)। যেহেতু প্রকৃতির কোনো নিয়মেই এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব হয় না, সেজন্য এগুলোকে মিরাকল বলে ধরে নেয়া যায়। আর যেহেতু মিরাকল শুধুমাত্র অতি প্রাকৃতিক শক্তির কারণেই ঘটা সম্ভব হয় এবং সেক্ষেত্রে যা প্রমাণিত হয় তা হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব।

ড. রিচার্ড ডকিন্স তার ‘দ্য গড ডিলুশন’ বইয়ে তার এক ধার্মিক সহপাঠির এক অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি তার ভাষায় পড়া যাক,

“. . . সে একবার স্কটিশ দ্বীপপুঞ্জে ক্যাম্পিংএ গিয়েছিল। কোনো এক মাঝরাতে সে ও তার সঙ্গিনী স্বয়ং শয়তানের আওয়াজ শুনে তাদের তাঁবুর ভিতরেই জেগে উঠে। তার মতে ওই গায়েবি আওয়াজ পুরোপুরি শয়তানের (Satan or devil) মতই ছিল। এই ভীতিকর অভিজ্ঞতা আমার ওই বন্ধু জীবনে কখনোই ভুলতে পারে নি এবং এই ঘটনা তাকে আরো বেশি ধার্মিক ও সুশৃঙ্খল করে দেয়। ঘটনাটি আমার তরুন স্বত্ত্বাকে বেশ মুগ্ধ করে। আমি এই ঘটনা অক্সফোর্ডের Rose and Crown Inn এ অবস্থানরত কয়েকজন প্রাণিবিজ্ঞানীকে শোনাই। যাদের মধ্যে দুইজন বিখ্যাত ও অভিজ্ঞ পক্ষীবিশারদও সামিল ছিলেন। তারা এই ঘটনা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন আর গলা বড় করে বলেন, ‘ওটার নাম আসলে Manx Shearwater!’। তাদের একজন সাথে আরও যোগ করেন যে, এই প্রজাতির পাখি ওই রকম কর্কশ স্বরে শিস বাজাতে পারে। আর ওইরকম গগনবিদারী দানবীয় আওয়াজের কারণে স্থানীয়ভাবে অনেক এলাকায় ওই পাখিকে ডাকা হয়, ‘Devil Bird’”।

বেশ মজার অভিজ্ঞতা বলা যায়। মানব মস্তিস্কের ভিতরে একটি প্রথম শ্রেণীর সিমুলেশন সফটওয়ার কাজ করে। আমাদের চোখ আমাদের মস্তিস্ককে সবসময় সঠিক চিত্রটা দেখায় না। এটাকে আমরা optical illusion বা দৃষ্টিবিভ্রম বলে জানি। মস্তিস্ক যখন কোন তথ্য পায় তখন তার বেশ কয়েকটি সদৃশ অল্টারনেটও তার কাছে চলে যায়। ঠিক সেসময় মস্তিস্কের কাছে কোনো গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড থাকে না যে কিসের ভিত্তিতে সে এতগুলো অপশন থেকে কোনটিকে গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্যের স্থলে যদি মস্তিস্ক অন্য কোন তথ্য নির্বাচন করে ফেলে তখন মানুষ অন্য কিছু দেখতে থাকে যেটা আসলে বাস্তব নয়। আর এভাবেই দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে যায়। আর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল মস্তিস্কের এই সিমুলেশন সফটওয়ার সবচেয়ে পারদর্শী মানুষের মুখাবয়ব ও কন্ঠস্বর তৈরি করতে। মহাকাশবিজ্ঞানী অধ্যাপক কার্ল স্যাগান মেঘে, কচ্ছপের খোলে, গাছের বাকলে মানুষের মুখাবয়ব খোঁজার প্রবণতাকে বিবর্তনের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-

‘কোনো শিশু যখন প্রথম দেখতে শুরু করে তখন থেকেই সে মুখ চিনতে শুরু করে। এই ক্ষমতাটা আমাদের মস্তিস্কে রয়েছে। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে যেসব শিশু মুখ এবং মুখের ভাষা বুঝতে পারত না তারা তাদের বাবা-মাকে আকৃষ্ট করতে পারত না। একইভাবে তাদের এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যেত। বর্তমান যুগে শিশুরা খুব সহজেই অন্যদের মুখ চিনতে পারে এবং বাঁকা হাসির মাধ্যমে তার জবাবও দিতে পারে’।

বেশিরভাগ মানুষই তাদের সাধারণ ধারণা থেকেই এই সব ইলুশনকে ধরে ফেলতে পারে কিন্তু অপরদিকে একটা বড় অংশই এই ইলুশন থেকে ডিলুশনের মধ্যে চলে যায়। একটু যুক্তিসহকারে চিন্তা করলেই এই ধরণের ইলুশন থেকে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কথা চিন্তা করাটা কত বড় বোকামি তা ন্যূনতম যুক্তিবোধসম্পন্ন যেকোনো ব্যাক্তিই বুঝতে পারবেন।

এবার ফিরে আসা যাক মিরাকল বিষয়ক আর্গুমেন্টে। মিরাকলের সাধারণ সংজ্ঞায় স্কট দার্শনিক ডেভিড হিউম বলেছেন,

“A miracle is a transgression of a law of nature by a particular volition of the Deity or by the interposition of some invisible agent”

ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে বলে দাবি করা হয় তাদের অনেকের কাছেই এর পিছনে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির হাতের অবস্থানের দাবি যৌক্তিক বলে মনে হয়। তবে অন্য যে কেউ, যাদের মধ্যে মনোবিজ্ঞানের সামান্য জ্ঞানও রয়েছে তাদের নিকট এমন দাবি খুব একটা যৌক্তিক কিছু মনে হয় না। কোনো স্বীকৃত জার্নালই কোনো লেখকের কোনো রচনাকে যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য ধরবে না যদি ওই রচনায় কোনো প্রকার মিরাকল বিষয়ক দাবির ছিঁটেফোঁটাও বর্তমান থাকে। আধুনিক বিজ্ঞানে এই ধরণের সকল দাবিকে হয় মিথ্যা না হলে কালেক্টিভ হ্যালুসিনেশন (collective hallucination) বলে উড়িয়ে দেয়া হয়।

এখানে এই কালেক্টিভ হ্যালুসিনেশন সম্পর্কে জানিয়ে রাখা দরকার। এটা হল সে ধরণের হালুসিনেশন যেটা কোনো রকম চিন্তার শক্তির মাধ্যমে ঘটে থাকে। এটা সাধারণত ঘটে যখন কেউ কোনো বিষয়ে তীব্রভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। এবং এটা সবচেয়ে বেশি ঘটে অতিরিক্ত ধার্মিক ব্যাক্তিদের মধ্যে। মিরাকুলাস বা অলৌকিক কোনো ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার তীব্র আশা-আকাঙ্খা নিয়ে যখন কেউ বসে থাকে তখন এমন হ্যালুসিনেশনের অভিজ্ঞতা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। একারণেই হিন্দুরা চাঁদে বাবা লোকনাথের মুখ দেখতে পায়, গণেশ ও গোপালের মূর্তিও তখন দুধ খেতে থাকে। একইভাবে কুকুরের ঘেউ ঘেউ করার মধ্যেও মুসলিমরা আল্লাহর নাম শুনতে পায় (এখানে দেখুন )। চার্চে মাতা মেরির মূর্তির চোখ থেকেও তখন অশ্রু ঝরতে থাকে। ১১ সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার সময় অনেক ব্যাক্তিই আগুনের কুণ্ডলীর মধ্যে শয়তানের মুখ দেখতে পেয়েছিল। আগুন এবং ধোঁয়ার মাঝে ভেসে ওঠা শয়তানের মুখের অনেকগুলো ছবি তখন বেশ আলোচিতও হয়েছিল। ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনাবলীর কথা না হয় উল্লেখ নাই করলাম। আর যারা এসবে অলৌকিক কিছু খুঁজে পায় না তারা তাদের মত প্রকাশ করলে তাদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসের “অভিযোগ” এনে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। চাঁদে লোকনাথ বাবার মুখ আমার বংশের প্রায় সবাই দেখেছে। ওই ঘটনা এমন এক সময়ের ছিল যখন আমি ঠিক নাস্তিক হই নি, সংশয়বাদীর পর্যায়ে রয়েছি। আমার মা ও বোন দুজনেই যেখানে চাঁদে লোকনাথ বাবার মুখ দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে পড়েছে আমি তখনও শুধু খুঁজেই চলেছি। শেষে মাকে সন্তুষ্ট করতে আমি অতি কষ্টে পূর্ণিমার চাঁদে একজন শ্বেতশুশ্রুমণ্ডিত এক বৃদ্ধের মুখ কল্পনা করে জানালাম, ‘আমি দর্শন পেয়েছি’। যদিও পরে আমি পূর্ণিমার চাঁদে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাণীর প্রতিকৃতিও দেখতে পেয়েছি। সেগুলোকে কেউ অবশ্য অলৌকিক দাবি করে না।

কালেক্টিভ হ্যালুসিনেশন যে সবসময় ধর্মীয় কারণেই ঘটে তা কিন্তু নয়। ১৮৯৭ সালে এডমন্ড প্যারিশ তার Hallucinations and Illusions: a study of the fallacies of perception বইয়ে এক ঘটনার কথা বর্ণনা করেছিলেন যেখানে একটি জাহাজের কয়েকজন নাবিক তাদের জাহাজের সদ্য প্রয়াত বাবুর্চির আত্মাকে দেখতে পেয়েছিল। তারা শুধু আত্মাটিকেই দেখেনি, তারা স্পষ্টভাবে সেটাকে পানির উপর দিয়েও হাঁটতে দেখতে পেয়েছিল। যেখানে তার হাঁটার ধরণ পর্যন্ত ঠিক ওই বাবুর্চির মত ছিল। পরে জানা যায় সেটা ছিল ঢেউয়ের তোড়ে উঠানামা করতে থাকা একটা ভাসমান ভাঙ্গা জাহাজের টুকরা।

কালেক্টিভ হ্যালুসিনেশনের মতই আরেকটি ঘটনা লক্ষ্য করা যায় যেটি হল Pareidolia।এর অর্থ হল, এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় যা অস্পষ্ট ও এলোমেলো উদ্দীপনার কারণে ইলুশন সৃষ্টি করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহী উদ্দীপকের প্রভাবে প্রত্যক্ষণ বা উপলব্ধি হয় বলে আমাদের ৫টি ইন্দ্রিয়ের যেকোনো একটির জন্য ইলুশন হতে পারে। তবে এই ইলুশনের জন্য আমাদের ইন্দ্রিয় দায়ী নয়, স্নায়ুসংকেত বিশ্লেষণে মস্তিস্কের অক্ষমতাই এই ধরণের বিভ্রম সৃষ্টি করে। মানব মনের একটি লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা যা দেখি তা তৎক্ষণাৎ (অনেক সময় অজান্তেই) আমাদের চেনা জগতের সাথে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। এই ধরণের বিভ্রমের অনেক নিদর্শনই আমরা দেখতে পেয়েছি। ২০০৬ সালে এক পাকিস্তানি মৎসজীবি এক ধরণের সামুদ্রিক মাছের পেটের মধ্যে আরবি অক্ষরে আল্লাহর নাম দেখতে পান। ২০০৭ সালের অক্টোবরে অ্যালেন স্টোন নামের এক ব্যাক্তি একটি কুড়িয়ে পাওয়া পাথরে খাঁজকাটা দাগের মধ্যে জেসাসের প্রতিকৃতি খুঁজে পেয়েছিলেন। মাসকয়েক আগে ব্রাজিলের এক ধর্মযাজক ইউএসবি কেবলের লোগোকে শয়তানের প্রতীকের মত দেখতে বলে দেশে ইউএসবি কেবল নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন। এই ঘটনাগুলোর সবই Pareidolia অথবা কালেক্টিভ হ্যালুসিনেশনের উদাহরণ। মানুষের দুর্বল অনুভুতির স্থান বলে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে গুজব ছড়ায় বেশি। আর ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে বেশিরভাগ সময় এই সব গুজবের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করতে দেয়া হয় না। ধার্মিকরা রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে সর্বত্র সবকিছুর মধ্যেই তাদের স্রষ্টা ও তাদের ধর্মের প্রবর্তকের নাম খুঁজে চলেছে। গাছের ডালে, ফলের খোসা থেকে শুরু করে পশুর কাটা মাংসে এমনকি মাছের আঁইশের মধ্যেও তারা তাদের ঈশ্বরের নাম খুঁজে বের করেছে। নিজেদের ধর্মের প্রচারে তারা এগুলোকে তাদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে। ধর্মভীরু সাধারণ মানুষেরা এসব দাবি অবিশ্বাস তো দূরের কথা সামান্যতম সন্দেহ করার কথাও ভাবতে পারে না। বিভিন্ন ফলে ঈশ্বরের নামের ছবি দেখেই তারা উদ্বেলিত হয়ে উঠে অথচ একবারও ভেবে দেখে না ওগুলো যে ফটোশপের কারসাজিও হতে পারে, এমনকি কোনো মানুষ নিজের হাতেও ওই নামগুলো লিখতে পারে। এই Pareidolia এর উদাহরণ বিশ্বের সব জায়গাতেই দেখা যায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো ধর্মের গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে একটি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নিচের ছবিটিতে একটি মৌমাছিরা তাদের মৌচাকে আল্লাহর নাম লিখে রেখেছে বলে একবার দাবি করা হয়েছিল।
ALLAH IN HONEY-COMB

কিন্তু নিচের এই ছবিটিতেই দেখুন কিভাবে ফটোশপের মাধ্যমে মৌচাকের উপর “Wodan rules” কথাটা লিখা হয়েছে।
WODEN RULES

আবার নিচের ছবির মাধ্যমে অনেকে দাবি করেছে আকাশে মেঘের মধ্যেও আল্লাহর নাম দেখা গেছে। মেঘের আকার এবং অবস্থান প্রতি মূহুর্তেই পরিবর্তিত হয় এবং কত রকমের ডিজাইন তৈরি হতে পারে তার গণনা করাই সম্ভব নয়। ছবিটিকে যে অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা হয়েছে সে দিক থেকে এমন মনে হলেও অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে মেঘরাশিটি অন্যরকম দেখাবে।
ALLAH IN CLOUD
এই ছবিটিকেও খুব সহজেই ফটোশপে তৈরি করা যাবে। তাছাড়া আমরা মৌচাকে যেমন লেখা দেখেছি, এখানে লেখাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা। একই লেখক দুই জায়গায় স্বাক্ষর করলে নিশ্চয় দুই রকম স্বাক্ষর দিবেন না।
খ্রিস্টানরাও বিভিন্ন সময় মেঘে কিংবা জানালার শার্সিতে মেরির ছবি দেখতে পায়। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রেই উপরের কথাগুলোই প্রযোজ্য
MERY

এবার দেখুন, কি ভাবে এক ফালি বেগুনের মধ্যেও আল্লাহর নাম খুঁজে বের করা হয়েছে। কয়েকটা বেগুন নিয়ে আপনি যদি বারবার কাটতে থাকেন তবে কোনো না কোনো সময় আপনার কল্পনার চিত্রটি আপনি বেগুনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।
EGGPLANTS

অর্থাৎ সব ধর্মেই বিভিন্ন রকমের অলৌকিকতার হাস্যকর দাবি রয়েছে। যেসব অলৌকিকতার দাবির সাথে আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেয়াটা ধার্মিকদের কারণে অনেক সময় বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠে এবং তারা এ ধরণের ঘটনার উপযুক্ত ব্যাখ্যা কেউ যাতে না দিতে পারে তার জন্য সর্বশক্তি নিযুক্ত করে।

মিরাকলের পিছনে ঈশ্বরের হাতের দাবি

কোন সভ্যতা যতই বিজ্ঞানমনস্ক বা যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠুক না কেন, অলৌকিক ঘটনাপ্রবাহে বিশ্বাসকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দেয়া যায় না। মানুষের প্রকৃতিই এমন যে আমরা অবিশ্বাস্য ও অস্বাভাবিকতাকেই বেশি ভালবাসি। সাধারণ ভাষায় বলে দেয়া যায় মিরাকল বলতে সেসব ঘটনাকে বোঝায় যেগুলোকে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মের লংঘনই হল মিরাকল। তাহলে এখন আমরা এই মিরাকলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা শুরু করছি। আমরা দেখব কোনো মিরাকল ঘটলে তা ঈশ্বর নামক হাইপোথিসিসকে দাঁড়াতে কতটুকু সাহায্য করতে পারে। ঈশ্বর না হোক, অন্য কোনো অতি প্রাকৃতিক শক্তির পক্ষেই বা সেটা কত বড় প্রমাণ হতে পারে সেটাও আমরা দেখব।
ধরা যাক, E (evidence of miracle) সমর্থন করে H (hypothesis of god’s existence) কে।
এখন,
(1) P(H/E&K) > P(H/K) [ যেখানে K হল background knowledge about concept of god এবং P(x/y) বলতে বোঝায় এর y কারণে x এর সম্ভাব্যতা]
আবার,
(2) P(H/E&K) > P(~H/K)
এখন (1.) সত্য হবে যদি এবং কেবল যদি
(3) P(E/H&K) > P(E/K) সত্য হয়
যখন P(H/K) ≠ 0 তখন (3) কে লেখা যায়
(4) P(E/H&K) > P(E/~H&K)

এখন আমরা (4) এ একটা দূর্বলতা দেখতে পাচ্ছি। একজন মানুষ ঠিক কোন কারণে (4) কে সত্য বলে মেনে নিবে তা স্পষ্ট নয়। কারণ ~H কে ব্যাখ্যা করা যায় H এর প্রতিদ্বন্দী হাইপোথিসিসগুলোর একটি ডিসজাঙ্কশন হিসেবে। এখানে মিরাকল হিসেবে আসা হাইপোথিসিসগুলোর সাপেক্ষে E এর সম্ভাব্যতা 1 হতে পারে। কিন্তু এই ডিসজাঙ্কশনের অন্য সকল সদস্যের সাপেক্ষে E এর সম্ভাব্যতা 0 থেকে 1 এর মধ্যে ওঠানামা করে। তাছাড়া এমন কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ নাই যে এই সমস্ত ডিসজাঙ্কশনের সাপেক্ষে E এর সম্ভাব্যতা, H এর সাপেক্ষের E এর সম্ভাব্যতার তুলনায় কম হতে পারে। আর এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে
P(E/H&K) ≠ 1
কাজেই দেখা যায়, মিরাকল ঘটলেও সেটা ঈশ্বরতত্ত্বের হাইপোথিসিসকে খুব একটা সাহায্য করে না।

সব ধর্মেই কোনো না কোনো ধরণের মিরাকলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সব ধর্ম যদিও অনেকটা একই ছাঁচে তৈরি হয়েছে তবুও এক ধর্মের মিরাকলের প্রমাণকে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবেও কিন্তু ব্যবহার করা যায়। বলা যায় কোনো মিরাকলের অস্তিত্ব (যেটি হয়তো কোনো ধর্মের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়) অন্য যে কোনো মিরাকলের বিরুদ্ধেও একটি প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে (যেটি আবার আরেকটি ধর্মের সপক্ষে ব্যবহৃত কোনো প্রমাণ)। হিউমের ভাষায় উল্লেখ করা যায়,
1. E, H অপেক্ষা H` এর সম্ভাব্যতাকে বাড়িয়ে দেয়
2. H এবং H` পরষ্পরবিরোধী
সুতরাং বলা যায় E, H এর সম্ভাব্যতাকে কমিয়ে দেয়
আরেকটি আর্গুমেন্ট দেখানো যায়
1. E এমন একটি প্রমাণ যেটি H এর পক্ষে এবং H` এর বিপক্ষে
2. E` এমন একটি প্রমাণ যেটি H`এর পক্ষে এবং H এর বিপক্ষে
3. H এবং H` পরষ্পরবিরোধী
সুতরাং E, E` এর বিপক্ষে একটি প্রমাণ এবং ভাইস ভার্সা।

আমরা স্বাভাবিকভাবেই ভেবে দেখতে পারি যদি ইসলামিক গড সত্য হয় তবে তিনি কখনোই এত মানুষ থাকতে চাঁদে শিবের অবতার লোকনাথ বাবার মুখ বসিয়ে দিবেন না। আবার হিন্দু গড সত্য হলে তারও কোনো দায় পড়েনি কুকুরের মুখ দিয়ে আল্লাহর নাম উচ্চারন করানোর। কোনো মুসলিম যেমন কোনো হিন্দু মিরাকলের দাবি দেখে সেটাকে হাস্যকর ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারে না, হিন্দুদের কাছেও ইসলামিক মিরাকলগুলোকে ঠিক ততটাই হাস্যকর মনে হয়। এবং এসব কথা অন্য সকল ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সোজা ভাষায় এক ধর্মের অনুসারীর কাছে তার নিজ ধর্মের মিরাকলগুলো ব্যতীত অন্য সব ধর্মের মিরাকলের দাবিগুলোকে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না (সংশয়বাদীরা অবশ্য ব্যতিক্রম)। ঠিক একইভাবে যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা যায় তবে সব মিরাকল সম্পর্কে মোটামুটি একই ধারণা পাওয়া যায়।

আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা

এই ধরণের অভিজ্ঞতার কথা প্রায়ই শোনা যায়- “ ‘আমি যখন আমার সৃষ্টিকর্তার কথা চিন্তা করি, যখন তার কাছে প্রার্থনা করি তখন আমার মনে এক অন্যরকম শান্তি অনুভূত হয়। এই মানসিক শান্তি আমি অন্য কোনোভাবেই অনুভব করি না। এর পরও কি তুমি বলবে ঈশ্বর নেই?’” এই ধরণের আধ্যাত্মিক বা মরমী অভিজ্ঞতাকে অবশ্য কোনো ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। এই অনুভূতি পরিমাপ করার মত কোনো পদ্ধতিও মনে হয় আবিষ্কৃত হয় নি। কাজেই এই ধরণের অনুভূতির অভিজ্ঞতা কাউকে অন্য কোনোভাবে প্রদান করা সম্ভব কিনা তাও বলা যায় না। আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করা যায় নিউরোসাইকোলজির মাধ্যমে। এই রকম চিন্তা মাথায় আসে মস্তিস্কের কজাল অপারেটরের (causal operator) মাধ্যমে। এই কজাল অপারেটর যখন বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করতে যায় তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মানুষের মন পরিবেশকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তার কল্পনাশক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন অবাস্তব ধারণাকে নিয়ে আসে। এগুলো ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আসতে পারে, (যেমন স্বপ্ন, দিবাস্বপ্ন এবং আরও অনেক ধরণের কল্পনা) তেমনি একটি সমাজেও প্রভাব বিস্তার করে ফেলতে পারে। মানুষ যতদিন পৃথিবীতে তাদের টিকে থাকা নিয়ে সচেতন থাকবে হয়ত ততদিন তারা তাদের চারপাশের সকল বস্তুকে নিয়ে আনমনেই এই ধরণের অবাস্তব ধারণা তৈরি করতে থাকবে এবং এইভাবেই তারা দৈত্য, দানব, ভুত-প্রেত, দেবদূত, ফেরেশতা, ঈশ্বরসহ আরও অনেক অতিপ্রাকৃতিক সত্তার জন্ম দিতে থাকবে। এই ধরণের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দাবি আস্তিকদের কাছে অকাট্য ও অখণ্ডনীয় বলে মনে হলেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এগুলো অগ্রহণযোগ্য । যেমন, ঈশ্বরকে অনেকে বর্ণনা করেন এভাবে, “…the dazzling obscurity of the secret silence, outshining all brilliance with the intensity of their darkness”. এখন এই ধরণের বিবরনকে কিভাবে যাচাই করবেন। আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত এই ধরণের দাবি কখনোই বাস্তবমুখী হতে পারে না। এধরণের উক্তির অসংলগ্নতা মাপারও কোন গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নাই। তাই এই ধরণের সাইকোলজিকাল হাইপোথিসিসকে প্রত্যাখ্যান করাটা মোটেও অযৌক্তিক হয় না।

আরেক ধরণের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হয় নিজের আবেগের মাধ্যমে। বাইবেলে যেমন দেখা যায়, স্বপ্নে জোসেফের সাথে ফেরেশতা এসে কথা বলে। আমার আরেক নিকটাত্মীয়ের (মাসি বা খালা) অভিজ্ঞতার কথা এখন বর্ণনা করা যাক। ভারতের দূরদর্শন চ্যানেলে সবসময় ধর্মীয় সিরিয়াল দেখানো হয়। অনেকেই ভারতে হিন্দু মৌলবাদের উত্থানের অন্যতম কারণ হিসেবে এই ধরণের টিভি অনুষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে থাকেন। আমার সেই আত্মীয়ের অন্যতম প্রিয় একটি সিরিয়াল ছিল ডিডি বাংলায় প্রচারিত ‘মহাপ্রভু’। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীনির্ভর নাটকটি তখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। একদিন সেই মাসি সকালে উঠে সবাইকে জানালেন তিনি রাতে স্বপ্নে দেখেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার বাড়িতে আসছেন। তিনি দেখেছেন নিমাই চরিত্রের অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তকে তার সমস্ত দলবল সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কীর্তন করতে করতে তার গৃহে পদার্পন করতে। এরপর তিনি সম্ভাব্য সব বিজ্ঞজনের সাথে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে ‘মহাপ্রভূকে স্বাগত’ জানাতে বা বরণ করে নিতে বাড়িতে এক বড় ধরনের হরিলুটের বা কীর্তনের আয়োজন করা হবে। যা ভাবা হল তাই করা হল। একবারের জন্যও কেউ ভেবে দেখল না যে, প্রিয় চরিত্রের প্রিয় অভিনেতাকে স্বপ্নে দেখাটা অতি স্বাভাবিক একটা ঘটনা। ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা আসলে যে এমনই হয়, স্বাভাবিককে তখন আর স্বাভাবিক মনে হয় না, সাধারণকে সাধারণ বলে মনে হয় না একইভাবে লৌকিককেও লৌকিক বলে মনে হয় না তখন। আমি নিজে কতবার স্বপ্নে দেখি নিজেকে স্পাইডারম্যানের সাথে কথা বলতে, এক্স ম্যানদের মধ্যে ঢুকে যেতে। এক্ষেত্রে আমার কি রকম আয়োজন করা উচিত আমাকে কেউ বলে দিবেন কি??

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মিরাকল বা ধর্মগ্রন্থের অলৌকিকতার উপরে মুক্তমনাসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আলোচনা করা হয়েছে। বাইবেলে বর্ণিত আরেকটি মিরাকলের দিকে এখন চোখ রাখা যাক। লক্ষ করলে দেখা যায় এই গসপেলের কাহিনীগুলো বর্ণনার সময়ের দিক থেকে যতই এগিয়ে নেয়া যায় কাহিনী আরো বেশি চমকপ্রদ হতে থাকে। জেসাসের রোগী নিরাময়ের ভার্সগুলি দেখুন। প্রথমে থাকছে সবচেয়ে পুরনো মার্কের বর্ণনাঃ

That evening, at sundown, they brought to him all who were sick or possessed with demons. … And he healed many who were sick with various diseases, and cast out many demons. … (1:32-34)

এখন একই ঘটনাকে পরবর্তী দুই রচয়িতা ম্যাথু এবং লিউকের বিবরণে পড়া যাক। প্রথমে ম্যাথুঃ

That evening they brought to him many who were possessed with demons; and he cast out the spirits with a word, and healed all who were sick. (8:16)

এখন পড়ুন লিউকের বর্ণনাঃ

Now when the sun was setting, all those who had any that were sick with various diseases brought them to him; and he laid his hands on every one of them and healed them. (4:40)

দেখা যাচ্ছে, মার্কের মতে সকল রোগীকে জেসাসের নিকট আনা হয়েছিল এবং তাদের অনেকেই আরোগ্য লাভ করেছিল। ম্যাথুর মতে রোগীদের অনেককে আনা হয়েছিল এবং তাদের সবাই আরোগ্য লাভ করেছিল। সবশেষে লিউকের মতে দেখা যায় সকল রোগীকেই আনা হয়েছিল এবং তাদের সকলেই আরোগ্য লাভ করেছিল। ধর্মীয় মিরাকলগুলো সব এভাবেই বিবর্তিত হতে থাকে। আর্চিবল্ড রবার্টসনের ভাষায় “আমরা একটা কিংবদন্তীর প্রগতিশীল পদচারনার সাক্ষী হতে পারছি”।

আবার মিরাকলের সাধারণ সংজ্ঞায় ফিরে আসা যাক। প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের লঙ্ঘনই হল মিরাকল। কিন্তু এই সংজ্ঞাতেই পরষ্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রকৃতির নিয়মে পানি কখনো ওয়াইনে পরিণত হতে পারে না। এখন একটি রিপোর্ট যদি করা হয় যে, ‘কিছু পানি ওয়াইনে পরিণত হয়েছে’ তবে সমস্যা দানা বাঁধে। প্রকৃতির নিয়ম ‘পানি কখনো ওয়াইনে পরিণত হতে পারে না’ যদি সত্য হয় তবে ‘কিছু পানি ওয়াইনে পরিণত হয়েছে’ এই দাবিটি মিথ্যা বলে বিবেচিত হয়। আর যদি ওই অলৌকিক দাবিটিই সত্য হয় তবে প্রকৃতির নিয়মকেই (‘পানি কখনো ওয়াইনে পরিণত হতে পারে না’) মিথ্যা বলে ধরে নিতে হবে।

প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে মানুষের ধারণা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যেভাবেই এগুলো পরিবর্তিত হয়েছে সেভাবেই ঈশ্বরকে এই নিয়মগুলোর সাথে সংযুক্ত রাখার প্রয়াসও সমান তালে চলেছে। প্রাকৃতিক নিয়মগুলো সম্পর্কে আধুনিক ধারণার সূত্রপাত হয় সপ্তদশ শতকের দিকে। আধুনিককালে প্রাকৃতিক নিয়ম বা প্রকৃতির নিয়ম বলতে কী বোঝায় সেটা নিয়ে দার্শনিকরা সুদীর্ঘ বিতর্ক করেছেন, এবং প্রথম দেখায় যতটা মনে হয় প্রশ্নটা আসলে তার চেয়েও সূক্ষ্ণ। আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাকৃতিক নিয়মগুলোকে সাধারণত গণিতের ভাষায় লেখা হয়, নিয়মগুলো হতে পারে একদম পূর্ণাঙ্গ অথবা প্রায় কাছাকাছি, কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই কোনো ধরণের ব্যতিক্রম ছাড়াই কাজ করতে হবে- সার্বিক ভাবে না হলেও অন্তত নির্ধারিত কিছু শর্ত সাপেক্ষে। এই মহাবিশ্ব যেহেতু প্রকৃতির নিয়ম দ্বারাই পরিচালিত হয় ধর্মবাদীরা যুক্তি দেখায়, ‘সবকিছু যখন একদম নিয়ম মোতাবেক চলছে তখন নিশ্চয়ই ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেছে এবং নিয়ন্ত্রণও করে চলেছে’। আবার কোন অনিয়ম বা নিয়মের লঙ্ঘন ঘটলেও বলা হয়, ‘ঈশ্বর আছে, কারণ ঈশ্বরই একমাত্র নিয়মভঙ্গের কারণ হতে পারে’। বিষয়টি একজন যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে শুধু কৌতুক উদ্রেককরই হতে পারে।

ব্রিটিশ দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল এ বিষয়ে বেশ সুন্দর করেই সারমর্ম টেনেছেন,
‘আমরা কোন উক্তিকেই প্রকৃতির নিয়ম বলে মেনে নিতে পারি না। আবার এর সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক কোন দাবিকেও সত্য বলে ধরে নিতে পারি না। অপ্রমাণিত কোন দাবিকে হয় অবিশ্বাস করা উচিত অথবা সংশয় প্রকাশ করা উচিত, নতুবা ওই দাবি যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় নি বলে মেনে নেয়া উচিত’।

প্রকৃতির নিয়ম কিভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে এর কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমরা এখনও পাই নি। আমরা এখন আলোচনা করব এই প্রকৃতির নিয়ম কি আদৌ লঙ্ঘন করা সম্ভব? প্রকৃতির নিয়মকে দুই প্রকারে ভাগ করা হয়েছে। একটি হল Descriptive Law বা বর্ণনামূলক নিয়ম এবং অপরটি Prescriptive Law বা নির্দেশমূলক নিয়ম। আমরা উদাহরন হিসেবে এখানে বয়েলের সূত্রটিকে ব্যবহার করছি।

বয়েলের সূত্র অনুসারে-
‘স্থির তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট ভরের কোন গ্যাসের আয়তন ওই গ্যাসের উপর প্রযুক্ত চাপের ব্যস্তানুপাতিক।’
অর্থাৎ, গ্যাসের উপর চাপ বাড়লে আয়তন কমে, চাপ হ্রাস পেলে আয়তন বাড়ে। এই নিয়মটি একটি বর্ণনামূলক নিয়ম, নির্দেশমূলক নয়। এটি নির্দেশ করে না গ্যাসের কি রকম আচরণ করা উচিত। এটি শুধু বর্ণনা করে গ্যাসের আচরণ সবসময় কিরকম হয়। এখন যদি কখনও এমন দেখা যায় কোনো গ্যাসের আচরণ এই নিয়মকে ভেঙ্গে দিয়েছে তখন এই স্বীকৃত নিয়মটিই ভুল বলে প্রমাণিত হবে এবং এই নিয়মকে আবার নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। তখন ওই নিয়মের লঙ্ঘনকে আর মিরাকল বলে মনে হবে না কারণ নতুন নিয়ম অনুসারে কোনো নিয়মই লঙ্ঘিত হয় নি।

এ থেকে বোঝা যায় এই নিয়ম লঙ্ঘনের ধারণাটি বর্ণনামূলক ও নির্দেশমূলক দুই ধরণের নিয়মের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এই প্রকৃতি কি রকম আচরন করে, বর্ণনামূলক নিয়ম তার বর্ণনা দেয় মাত্র। আর যেহেতু এগুলো শুধুই বিবরণ, ফলে নিয়ম ভাঙ্গার ধারণা এক্ষেত্রে খাটে না। যেটা ভাঙ্গতে পারে সে হল নির্দেশমূলক নিয়ম। প্রকৃতির ক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কারণ- নির্দেশমূলক নিয়ম মনুষ্যসৃষ্ট একটি ধারণা। আর সংজ্ঞানুসারে যেহেতু মিরাকল হল এমন কোন নিয়মের লঙ্ঘন যেটিকে লঙ্ঘন করা অসম্ভব, ফলে প্রকৃতিতে সংঘটিত মিরাকলের পরস্পরবিরোধী সংজ্ঞা আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে । কাজেই এই ধরণের দাবিকেও অসার বলে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।

কাকতালীয় ঘটনাসমূহ

মিরাকল হিসেবে যেসব ঘটনার দৃষ্টান্ত আনা হয় তার অনেকগুলোকেই উড়িয়ে দেয়া যায় স্রেফ কাকতালীয় বা coincidence হিসেবে। কিন্তু দাবিদাররা এক্ষেত্রে বলে, ‘কোনো ঘটনা কাকতালীয় হওয়ারও একটা সীমা আছে। কিন্তু এতগুলো ঘটনার একসাথে ঘটে যাওয়াটাকে কোনোমতেই কাকতালীয় বলা যায় না। এর পিছনে অবশ্যই কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির হাত আছে’। এখন আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আপনাদের শোনাই। প্রথমে সকল আস্তিকদের উদ্দেশ্যে আমার একটি প্রশ্ন আছে। আপনাদের মধ্যে কতজন আছেন যারা ‘নজর লাগা’তে বিশ্বাস করেন? মানে একথা বিশ্বাস করেন যে, কারও মালিকানায় থাকা কোন পণ্য যদি অন্য কারো খুব পছন্দ হয় বা অন্য কেউ যদি সেটার প্রশংসা করে তবে সেই পণ্যটি যেকোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ নজর অবশ্য মানুষের উপরেও লাগতে পারে। এ ধরণের কুসংস্কার ব্যাপকভাবে পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। এরকম বিশ্বাস করার মত মানুষ এখন অবশ্য বেশ কমে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষিত ও মডার্ন ধার্মিকরা অবশ্য এদেরকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়। যা হোক, এখন সেই ঘটনাটা বলি,

স্কুলে থাকতে প্রায়ই আমার পিসির (ফুফু) গ্রামের বাসায় বেড়াতে যেতাম। এমনই একবার গ্রামে গিয়ে বিকালে ঘুরতে ঘুরতে পরিচিত এক বৃদ্ধার সাথে দেখা হল। বিভিন্ন কথার সাথে ওই বৃদ্ধা আমার পরনে থাকা টিশার্টটির খুব প্রশংসা করে। আমিও তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গ্রামের আরও অনেক জায়গা ঘুরে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসি। আমার পিসতুতো বোন তখন কিছু একটা লিখছিল। হঠাৎ তার কলমের কালি উপচে পড়ায় সে কলমটি আমাকে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতে বলে। জানালাটি আমার কাছেই ছিল। কলমটি সাবধানে ধরে আমি জানালার দিকে ছুঁড়ে দিলাম। জানালায় কোন গ্রিল ছিল না। ছিল কতগুলো শিক বা রড। শিকগুলোর ব্যাস হয় ১-১.৫ সে.মি. এর মত। একেকটি শিকের মধ্যে ব্যবধান থাকে ৯-১০ সে.মি.। আমি কলমটিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আনুভুমিক ভাবে। এবং কলমটি বিন্দুমাত্র দিক পরিবর্তন না করে সোজা একটি শিকের উপরে মুখোমুখিভাবে গিয়ে পড়ে। যেখানে শিকগুলোর মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা ছিল প্রায় ১০ গুণ। কথা এখানেই শেষ নয়। শিকগুলো ছিল সিলিন্ডার আকৃতির। এখন কোন কলম যদি আনুভুমিকভাবে গিয়ে উল্লম্ব কোনো সরু সিলিন্ডার আকৃতির শিকের উপর গিয়ে আঘাত করে তবে সেই কলমটি দিক পরিবর্তিত হয়ে যেকোনো দিকে যেতে পারে। কিন্তু কলমটি শিকে লেগে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ফিরে এসে আমার টিশার্টের উপর পড়ে টিশার্টের বারটা বাজিয়ে দেয়।

আস্তিকরা যেসব ঘটনাকে শুধু কাকতালীয় বলে মেনে নিতে পারে সেগুলোর তুলনায় আমার এই ঘটনাকে অনেক বড় মিরাকল বলা যায়। তারা সেই মিরাকলের পিছনে অতিপ্রাকৃতিক কারণ দাঁড় করিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের দাবি করে বসে। এখন তারা কি আমার এই ঘটনার কারণ হিসেবে ‘নজর লাগা’য় বিশ্বাস করবেন?

গত ফুটবল বিশ্বকাপে জার্মানির অক্টোপাস পল জার্মানির প্রত্যেকটি ম্যাচের ফল আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখে সারা বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। জার্মানির মত একটি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ সেটাকে শুধু বিনোদনের খোরাক হিসেবেই দেখেছিল। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন ওই অক্টোপাস যদি আরবীয় কোন রাষ্ট্রে বা ভারতে থেকে অমন কাজ করত তবে সেদেশের জনগণ সেই অক্টোপাসকে কি বানাত! হয় সেটা হত আল্লাহর কুদরতের এক উজ্জ্বল নিদর্শন অথবা হিন্দুধর্মের কল্কিকে একাদশ অবস্থানে ঠেলে দিয়ে দশম অবতার হিসেবে ‘অষ্টপদাবতার’ এর আবির্ভাব হত। [হয়ত কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে তবে একটি তথ্য আমি সংযোজন করছি। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ অক্টোপাস পলকে নিয়ে উন্মাদনাকে চিহ্নিত করেছিলেন পশ্চিমা বিশ্বের ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার নিদর্শন’ হিসেবে। যদিও তিনি কয়েকদিন আগে একবার দাবি করেছিলেন, ‘ইসলামের শত্রু রাষ্ট্রগুলো (ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র্‌, ফ্রান্স) তাদের পাপের খেসারত দিয়ে বিশ্বকাপ থেকে আগে আগে বিদায় নিয়ে নিয়েছে’। যদিও তার নিজের দেশ বিশ্বকাপেই কোয়ালিফাই করেনি। নিজের বিশ্বাসকে সমর্থন করে এমন মিরাকল ছাড়া অন্য সব ধরণের অলৌকিকতার দাবিকে সবাই কেমন দৃষ্টি নিয়ে দেখেন তারই একটা উদাহরণ আনলাম এখানে।]

মানুষ কেন তাহলে এই মিরাকলের অভিজ্ঞতা লাভ করে? জন হস্পার্স এ ব্যাপারে মন্তব্য করেন, ‘বিষয়টা আশ্চর্যজনক যে মানুষ যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনাকেই মিরাকল বলে বিশ্বাস করে ফেলে যদি ওই ঘটনা তাদের অনুকূলে ঘটে থাকে। বিমান দূর্ঘটনায় একশ’ যাত্রী মারা গেলে এবং একজন বেঁচে গেলে জীবিতের পরিবার সে ঘটনাকে বলে মিরাকল। কিন্তু বাকি একশজন নিহতের পরিবার সেটাকে কি বলে?’

সোজা ভাষায় যে সব মানুষ তাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে অত্যন্ত আবেগপ্রবন তারা খুব সহজেই কোনো ঘটনাকে অলৌকিক বলে বিশ্বাস করে নেয়। কোনো ঘটনার কারণ তার খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলে কিংবা খুঁজে বের করার ইচ্ছা না থাকলে তারা সেই ঘটনার পিছনের কারণ হিসেবে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির (যেমন ঈশ্বর) কথা টেনে আনেন। যেমনটি ভারতবর্ষের অন্যতম কিংবদন্তী দার্শনিক রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেছিলেন, ‘অজ্ঞানতার অপর নাম হল ঈশ্বর। আমরা আমাদের অজ্ঞানতাকে স্বীকার করতে লজ্জা পাই এবং তার জন্য ভারী গোছের কোনো নামের আড়ালে আত্মগোপন করি। এই ভারী আড়ালটিই হল ঈশ্বর’।

যে প্রশ্নটি থেকে যায় সেটা হল, ‘মিরাকল কখনও যদি নাই ঘটে তবে এর মানে কি ভবিষ্যতেও কখনো ঘটবে না?’ এই প্রশ্নের জবাবে সংশয়বাদীও থাকা যায় আবার চাইলে নিয়ম ভঙ্গের মিরাকলের আর্গুমেন্টটি আবার ব্যবহার করা যায়। এখন কারও জীবনে এমন অলৌকিক সব অভিজ্ঞতা যদি হয়েই থাকে তিনি নিজে সেটাকে সত্যি সত্যি অলৌকিক হিসেবে বিশ্বাস হয়তো করতে পারেন, তিনি সেটাকে তার যুক্তি দিয়ে যাচাই করবেন, না অন্ধভাবে ঈশ্বরের লীলা বলে মেনে নিবেন এটা তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে সেটা অন্যরাও যে একইভাবে নিবে এমনটা চিন্তা করা নির্বুদ্ধিতা। কাজেই কেউ কোনো ঘটনাকে মিরাকল মনে করলেও তার পিছনে ঈশ্বর বা এই জাতীয় অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কারসাজি খোঁজার চেষ্টা করা আক্ষরিক অর্থেই অর্থহীন।

সবশেষে যে প্রশ্ন আসে সেটা হল যে, ‘এই সব মিরাকল থেকে আমরা কি সিদ্ধান্ত নিতে পারি’? নিম্নোক্ত কারণে এ প্রশ্নের উত্তর হবে ‘কিছুই না’। এ ধরণের মিরাকল থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সিদ্ধান্তগ্রহণ তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যদি ওই মিরাকলের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত ব্যাখ্যায় ঈশ্বর বর্তমান থাকে। অথবা বলা যায়, আমরা যদি ধরেই নিই ঈশ্বর নিজ হাতে ওই মিরাকলটি ঘটিয়েছেন। যেখানে আর কোনো ব্যাখ্যায় ওই কাকতালীয় মিরাকলটি বর্ণনা করা যায় না, সেক্ষেত্রে আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে উপসংহার টেনে দিতে পারি। তবে সেটা শুধুই আরেকটি হাইপোথিসিস থেকে যাবে। যেহেতু কাকতালীয় মিরাকল ঘটতে প্রকৃতির কোনো নিয়ম ভঙ্গেরও প্রয়োজন হয় না, আবার এইসবকে প্রাকৃতিকভাবে ব্যাখ্যাতীতও বলা যায় না। কারণ এ ধরণের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম থেকেই প্রদান করা যায়।]

সহায়ক গ্রন্থপুঞ্ছিঃ

• Enquiries Concerning the Human Understanding – David Hume
• The Demon-Haunted World – Carl Dagan
• Atheism – A Philosophical Justification – Michael Martin
• The Skeptic’s Dictionary – Robert Todd Carroll
• The Existence of God – Richard Swinburne
• The Non-Existence of God – Nicholas Everitt
• The God Delusion – Richard Dawkins
• The Grand Design – Stephen Hawking & Leonard Mlodinow
• Atheism: The Case Against God – George H. Smith
• Handbook of the psychology of religion – Raymond F. Paloutzian & Crystal L. Park
• The Neuropsychology of Religious and Spiritual Experience – Andrew B. Newberg and Stephanie K. Newberg

• মিরাকল ১৯ এর উনিশ বিশ, পার্থিব – অনন্ত বিজয় দাশ ও সৈকত চৌধুরী

• তোমার ক্ষয় – রাহুল সাংকৃত্যায়ন