প্রথমেই দু’একটা প্রশ্ন….
বর্তমান বাঙালীর পরিচয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন? বাঙালী হিন্দু, বাঙালী মুসলমান ইত্যাদিরূপে? নাকি হিন্দু বাঙালী, মুসলমান বাঙালী রূপে? নাকি কেবলি বাঙালী রূপে?
১২০১ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় মুসলমান শাসকদের শাসনামলে বাঙালী কতখানি মুসলমান হতে পেরেছিল?
হিন্দু সেন শাসনামলে বাঙালীরা কতখানি হিন্দু ছিল? তাদের হিন্দুত্ব আর বাঙালীত্বর মধ্যে কোনটা প্রকট ছিল বলে মনে করেন?
আরো আগে এই জনপদে ছিল বৌদ্ধদের শাসনামল। দলে দলে এ জনপদের মানুষ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। বাঙালীর বাঙালীত্ব বিকাশে এই বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের প্রভাব বেশি নাকি বাংলার সমাজ ও জনচরিত্রের প্রভাব বেশি?
আবহমানকাল ধরে বাঙালী বাংলার বাইরের বিবিধ ধর্ম গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে এসে আজও তার বাঙালীত্বকে কতখানি ধরে রেখেছে?
সব মিলিয়ে বাঙালীর ধর্মকে কী নাম দেয়া যায়?

আমি বাঙালীর ধর্মের নাম দিলাম ‘বাঙালীত্ব।‌‌‌‌’ ‘বাঙাল’ নামটা দিলেই ভাল হত। তা দিলাম না, কারণ ‘বাঙাল’ শব্দটিকে পশ্চিমবঙ্গের লোকজন আমাদের হীনভাবে প্রকাশ করতে ব্যবহার করে এবং আমরাও ‘বাঙাল’ শব্দটিতে মনে হয় একটু আনকমফোর্ট ফিল করি, যদিও আমাদের পরিচয় বাঙাল দিয়ে প্রকাশটা আমার যথার্থ মনে হয়।

এবার আরেকটি প্রশ্ন। বাঙালীত্বকে পিছনে ফেলে বাঙালীরা কবে তাদের হিন্দু-মুসলমান পরিচয়টাকে বড় করে দেখতে শুরু করল?

বাংলার বৌদ্ধ শাসনামলের পূর্বে অত্র এলাকার মানুষের ধর্ম কী ছিল তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু পাওয়া যায় না। তবে হিন্দু ব্রাম্মণ্যবাদের চর্চা তখন ছিল না, যা ছিল তা বিভিন্ন ট্রাইবাল ধর্মসমষ্টি। বর্তমান ট্রাইবাল ধর্মগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে বিভিন্ন প্রকৃতি পূজার মধ্যেই যে তাদের ধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চর্যাপদের (রচনাকাল ৯৮০-১০৫৩, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে আরো ২০০ বছর পূর্বে) ভাষাকে যদি আমরা ঐ সময়কার কোন একটি স্থানিক ভাষা হিসেবে না ধরে (যেহেতু এর লেখক অনেক) ঐ এলাকার মোটামুটি সার্বজনীন ভাষা ধরি তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় যে বর্তমান বাংলা ভাষা তখন ধীরে ধীরে গাঠনিক রূপ নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাঙালীদের সমাজ এবং জনচরিত্র তার পূর্বেই রূপলাভ করেছে বলে ধরে নেয়া যায়। দীর্ঘ সময়ে বাঙালীরা এরপরে বিভিন্ন ধর্মের সংস্পর্ষে এসেছে, কিন্তু তাতে তাদের সমাজ ও জনচরিত্র তথা বাঙালীত্বে কতখানি পরিবর্তন হয়েছে, এটাই প্রশ্ন।

বৌদ্ধদের শাসনামলে শুরু হয়ে বাঙালীর বাঙালীত্বর পূর্ণ বিকাশ হয়েছে পাল ও সেন বংশের হিন্দু শাসনামলে। ধর্ম বাঙালীর চিন্তা-চেতনা-সমাজ-সংস্কৃতিতে যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো তাহলে বাঙালীরা কখনোই এত সহজেই গণহারে বৌদ্ধ ছেড়ে হিন্দু আবার হিন্দু ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারত না। ধর্ম প্রকট রূপে বিরাজ করলে অবশ্যই তাদের নিজেদের মধ্যে এমন কিছু গ্রুপ বা সংগঠন গড়ে উঠত যাতে তারা নিজেদের ধর্মকে অন্য ধর্মের হাত থেকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। অন্য ধর্মের লোক এসে এদেশে যত সহজে ধর্ম প্রচার করেছে তা সম্ভব হয়েছে কেবল ধর্মের প্রতি বাঙালীর উদাসীনতার জন্যই।

১২০১ সালে বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের পর থেকে প্রায় ১৮০০ সাল পর্যন্ত মুসলমান শাসকগণ এদেশে ইসলাম প্রচার করতে এসে নিজেরাই অনেকসময় এদেশী বাঙালীত্ব তথা উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছেন।এটাই তাদের এদেশে ইসলাম প্রচারে সহায়তা করেছে। বর্তমানে আমরা ইসলামের যে পাকি-আফগানি-জামাতি ভার্সন প্রত্যক্ষ করছি বা যাকে সহি ইসলাম বলা হয় সেরকম ইসলাম প্রচার করার চেষ্টা করলে তারা কোনভাবেই এতটা সফল হতো না। এ প্রেক্ষাপটে এটাও বলা যায় যে ঔপনিবেশিক প্রভুসুলভ আচরণ প্রদর্শন না করে বাঙালীদের সাথে মিশে গেলে এদেশে খ্রীস্টানরাও তাদের ধর্ম প্রচারে অনেক এগিয়ে যেতে পারত। ইতিহাসে আমরা আরেকবার বাঙালীদের গণহারে ধর্মান্তরকরণ দেখতে পেতাম।

এবার আসি আসল কথায়। খিলজীরা বাঙালীদের একটি বিশেষ অঙ্গের খানিকটা চামড়া কেটে দিয়ে বলল যে তোমরা মুসলমান হয়ে গিয়েছ। তাদের বিশেষ কাজে তেমন কোন সমস্যা না হওয়ায় বাঙালীরা এটাকে কিছু মনে করল না। কারটা ‘কাটা’ আর কারটা ‘আকাটা’ তা তাদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। ‘সুন্নতে খতনা’ নামক এ কাজটির মাধ্যমে বাঙালীদের আরেকটি পরিচয় হল বটে কিন্তু বাঙালী বুঝতে পারল না যে তারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বাঙালী হিন্দু বা বাঙালী মুসলমান নামক কোন পরিচয় তাদের জন্ম নিল না। বরং আরব-আফগান থেকে আসা শাসকরা অনেকেই খানিকটা বাঙালীত্ব লাভ করল।

এরপর ইংরেজক শাসকরা বুঝতে পারল এই ‘কাটা’ আর ‘আকাটা’দের মধ্যে বিভাজন তৈরী করতে পারলেই তাদের ঔপনিবেশিক শাসন অনেক সহজ হয়। তারা একদিন দুদলকে ডেকে ন্যাংটা করে সামনাসামনি দাঁড় করাল। তারপর দেখাল যে “তোমাদের দু’দলের বিশেষ অঙ্গটা একরকম নয়, তোমাদের একদলেরটা ‘কাটা’ এবং অন্যদলেরটা ‘আকাটা’। সুতরাং তোমরা কখনোই এক নও”। তারপর ‘আকাটা’দলের বিশেষ অঙ্গে কিছু চোচড়া পাতার গুড়ো দেয়া হল এবং ‘কাটা’দের মেখে দেয়া হল কিছু মরিচের গুড়ো। তারপর তাদের জিজ্ঞেস করা হল, “তোমাদের কেমন অনুভূত হচ্ছে?” একদল বলল খাউজানির কথা, আরেকদল বলল জ্বলুনি, পুড়ুনির কথা। তারপর তাদের বোঝানো হল, “দেখ, তোমাদের চুলকায় আর ওদের জ্বালায়। তার মানে এখানেও তোমরা ভিন্ন”। এবার ইংরেজরা ‘কাটা’দেরকে বোঝাল যে তোমাদের দেশটারও ‘সুন্নতে খতনা’ করা দরকার। ১৯০৫ সালে ‘বাঙালীত্বে’র সুন্নতে খতনা করা হল। একেবারে মাঝখান থেকে কেটে। গোড়ার অংশটা পশ্চিমবঙ্গ, আগার অংশটা পূর্ববঙ্গ। তবে ১৯১১ সালেই কিছু বিশেষজ্ঞ সার্জন দ্বিখণ্ডিত বাঙালীত্বকে আবার সেলাই করে জুড়িয়ে দিলেন। তবে বাঙালী এবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমান।

কিন্তু তাতে কী? ১৯৪৭ এ এসে বাঙালীত্বকে দ্বিখণ্ডিত করে পূনরায় সুন্নতে খতনা করা হল। চেষ্টা করা হল বাঙালীর সাথে একেবারেই জাত-গোষ্টি-সমাজ-সংস্কৃতিতে ভিন্ন আরেকজন ‘কাটা’র সাথে জুড়ে দিতে। যেহেতু ভিন্ন জাত-গোষ্ঠীর অঙ্গটি বাঙালীদের মত অর্ধেক কাটা ছিল না, তাই ওটাকে সেলাই করে সংযুক্ত করে দেয়া গেল না; কোনরকরমে সুতো দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হল।

বাঙালীর প্রাণের ধর্ম ‘বাঙালীত্ব’ এবার আরেকজনের কাটা অঙ্গের সাথে ঝুলে রইল। পাকিস্তানীরা এবার ঝুলে থাকা অর্ধেক বাঙালীত্বর পূনরায় সুন্নতে খতনা করার প্রস্তুতি নিল। বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে বাঙালী মুসলমানদের খাটি মুসলমান বানানোর পায়তারা করল। বাঙালী সে প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করল।

ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালী স্বাধীন হল। কয়েক বছর পেরোতেই স্বাধীনতার পক্ষশক্তিকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে অর্ধেক অঙ্গটিকে আবার সুন্নতে খতনা করলেন। এরশাদ এসে তার বাকি চামড়াটুকুও ছিড়তে উদ্যত হল। বাঙালী এবার ‘বাঙালী মুসলমান’ থেকে ‘মুসলমান বাঙালী’তে রূপান্তরিত হল। বি.এন.পি-জামাত, আওয়ামী লীগ বর্তমানের প্রত্যেকটা সরকারই এখন বাঙালীর বাঙালীত্বটিকে চেঁছে চেঁছে একেবারেই পাতলা বানিয়ে ফেলেছে। মুসলমান বাঙালী থেকে এবার প্রচেষ্টা চলছে বাঙালী শব্দটাকেই মুছে ফেলার। ওপারের বাঙালীরাও এখন আর ‘বাঙালী হিন্দু’ নেই, এতদিনে তারাও ‘হিন্দু বাঙালী’ হয়ে উঠেছে। বাঙালীত্বের এ ক্রমাগত সুন্নতে খতনা প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যগুলো শীগ্রই হারিয়ে ফেলব। এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিরোধ খুব জরুরী বলে মনে করছি।

এ প্রসঙ্গে ব্লগার ‘দূরের পাখি’র কটা লাইন জুড়ে দিলাম।

বাঙালি মানে হিন্দু পোলা চেইত্যা গিয়া কওয়া, আল্লার কসম তোরে আমি খাইয়ালামু । বাঙালি মানে তারাবির নামাযের পরে আল্লার দরবারে দীর্ঘ প্রার্থণা যাতে বাবা ভোলানাথের পানি পড়ায় কাজ হয় । বাঙালি মানে সারাজীবনে একবারও কেবলার দিকে উষ্ঠা না খাইয়া, গানে কীর্তনে আল্লা রাসুলের গুনগান গাওয়া ।

বাঙালি যখনি মুসলমান হইতে গেছে তখনি ফরায়েজী হইছে, খেলাফতি স্বপ্নদোষী হইছে । আর রাস্তায় শান্ডার তেল বিক্রিকারী যেমন সুর কইরা গায়, স্বপ্নদোষে যারে পায়, বুকের হাড্ডি জাইগায় যায় , তেমনি বাঙাল বুকের হাড্ডি জাইগা গেছে । বাঙালি যখনি মুসলমান হইতে গেছে , রাজাকার হইছে, হিজবুতি হইছে, তালেবানি হইছে । বাঙালি আর থাকতে পারে নাই ।