লিখেছেনঃ নাসিম মাহমুদ

সুইডেনের রয়েল ইনস্টিটিউট এর গবেষণাগারে বসে এক সুইডিশ বন্ধুর সাথে আলাপচারিতায় জানলাম সুইডেনে বাংলাদেশ মানে বন্যা, যুদ্ধ আর কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এছাড়া আরেকটি বিষয় হলো, যুদ্ধ শিশু। এই! দুঃখিত হলাম না। পশ্চিমা বিশ্বে আমাদের এর চেয়ে ভাল কোন পরিচয় আশা করাও কঠিন। কঠিনই ছিল যতদিন পর্যন্ত না ঐ একই বন্ধু জানাল কম্পিস (বন্ধু), তোমার দেশতো নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। তার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। আমারো। তখন জানলাম ড. ইউনুস নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। এরপর সে আমাকে বলতে লাগল কিভাবে নোবেল প্রাইজ দেয়া হবে, কিভাবে লুসিয়া সঙ্গীত গাওয়া হবে ইত্যাদি। মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আর টের পাচ্ছিলাম বুকের মধ্যে কেমন যেন করছে, কলজেটা কেমন যেন মোচর দিচ্ছে। পশ্চিমে এসে যে দেশ সম্পর্কে একটি ভাল কথা, আবারও বলছি, একটি ভাল কথাও শুনিনি, আজ কি তাদের রূপ।

(ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেয়া, প্রেসিডেন্ট মেডাল অব ফ্রীডম, আমেরিকা গ্রহন অনুষ্ঠানে)

আমার বন্ধুটি জানাল সুইডেনের সবকটি জাতীয় দৈনিকে, রেডিও, টেলিভিশনে বাংলাদেশের কথা এসেছে। এসেছে, ড. ইউনূস আর গ্রামীন ব্যাংকের কার্যক্রম। এগুলো শুনে আমার অনেক ভাল লাগলেও আবেগ ধরে রেখেছিলাম। তারপর আবার কিছুদিন যেতে না যেতেই শুনলাম, বাংলাদেশ ভিওআইপি নিয়ে কিছু একটা করেছে, পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। কি করেছে না করেছে, তার চেয়েও বড় কথা হলো, আমি যেসব ভিওআইপি দিয়ে বাংলাদেশে কথা বলতাম, তার অনেকগুলোই বাংলাদেশ সার্ভিস বন্ধ করে দিল অথবা দাম বাড়িয়ে দিল দুই থেকে সাত গুন। ক্ষতি যদি কিছু হয়, তা হয়েছে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের, আর লাভ কার হয়েছে, কথিত আছে তা বলতে পারবেন সম্ভবত ‘মোখলেস’ কিংবা ‘যদু’ (ছদ্ম নাম-অনিবার্য কারণ বশত কিছু তথ্য পরিমার্জন করা হল)।

এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেল। আমি বেলজিয়ামে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্কলারদের এক পার্টিতে এক কোনায় বসে গল্প করছি এক ফরাসী অর্থনীতির ছাত্রীর সঙ্গে। সে পৃথিবীর দারিদ্রমুক্তি নিয়ে ভাবছে। এই পার্টিতে প্রায় চল্লিশ জন স্কলার ছিল পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা। নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। প্রায় আকস্মিকভাবেই চারজনের একটি দল আমার সামনে এল, হেই তুমি বাংলাদেশের? চোখে বিস্ময়, তুমি গ্রামীণের দেশের? আমি বিনয়ের সাথে বললাম, হ্যাঁ। তাদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা আরও বেড়ে গেল। জানলাম ড. ইউনুস, গ্রামীণ ব্যাংক আর বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের পড়তে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। তারা আমার কাছ থেকেও কিছু শুনতে চাইল। আমি হিউম্যান কম্পিউটার ইন্টার‍্যাকশন নিয়ে গবেষণা করছি, ড. ইউনুস বা গ্রামীন ব্যাংক সম্পর্কে তেমন কিছু জানা ছিলনা। তাই দেশ নিয়ে একটু গর্ব করার আকশ্মিক শুধুমাত্র বাংলাদেশী হওয়ার কারনে সুযোগ আসলেও খুব বেশিক্ষন তথ্যবহুল কোন আলোচনা চালাতে পারলাম না। তখনও পর্যন্ত আমার জানা ছিলনা যে, ড, ইউনুস এর নোবেল জয় কিছুটা ভিন্নরকম। সারা পৃথিবী যখন দারিদ্র্য মুক্তি নিয়ে নানা কিছু করছে, তখন ড. ইউনুস এর তত্ত্বই তার একমাত্র মুক্তির পথ। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এই মুক্তির বানীটি তিনি কোন কাগজে কলমে করে দেখাননি। তিনি প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন ( বা বর্তমানে তারও বেশি) মানুষকে সাথে নিয়ে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই ব্যাংক রয়েছে। তারা মানুষকে ঋণ দিচ্ছে। অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে। তাতে দারিদ্র্য কমছে কি? দারিদ্র্য একটুও কমছে না। মাঝে কিছু মানুষের পরিবর্তন হচ্ছে, ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে। কিন্তু যে দরিদ্র, সে দরিদ্রই থেকে যাচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংক তথা ড, ইউনুস সেই চিরাচরিত প্রথার বেদীমূলে আঘাৎ হেনেছে। দরিদ্রতা থেকেও যে মুক্তিই পাওয়া যায় তা কাগজে কলমে নয় বরং কার্যকর ভাবে প্রমান করেছে। এখানে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বিষয় আলোচনায় আসবে।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে অনেক খারাপ দিক আলোচনায় আসে বা আনা হয়। যে বা যাহারা তা করছে তা আমি নিশ্চিত যে তা দূরভিসন্ধিমূলক অথবা অজ্ঞতাপ্রসূত। আজকাল সোস্যাল নেটওয়ার্ক ও ব্লগ এর যুগে এসব ছড়িয়েও পড়ছে বহু গুনে। আসল গুনটি আর কেউ খুঁজে না। আর স্বল্প পানির বাঙালীরা কার্যকারন না দেখেই খাবি খেয়েই যাচ্ছে।

প্রথম বিষয়ে আসি, অনেক খবর ও ব্লগে পড়েছি, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে মানুষ ভিটা বাড়ি বিক্রিতে বাধ্য হয়েছে। এটি একটি ভ্রান্ত ব্যাখ্যা। কেন? কিভাবে? গ্রামীণ ব্যাংক যে ঋণ দেয়, তার কোনরূপ গ্যারান্টি ছাড়াই দেয়। কেউ সে ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল কিছু করতে পারে। একটি বিষয় উল্লেখ্য, সেখানে লস বা ক্ষতিও হতে পারে। কেউ যদি ঋণ নিয়ে তা পরিশোধে অক্ষম হয়, গ্রামীণ ব্যাংক ঐ ঋণ গ্রহীতাকে নিয়ে কোর্ট কাচারী করে না! গ্রামীন ব্যাংকের কোনো কৌশুলী নেই! তাহলে ঐ ব্যক্তি ঋণ শোধ করে কেন? এই প্রশ্নের জবাব গ্রামীন ব্যাংক এর মডেলের মধ্যেই রয়েছে। কেউ লোন নিয়ে তা ঠিকভাবে পরিশোধ করলে, আবারও লোন পাবে সেই আশায়। সমাজের যে বঞ্চিত মানুষটির কাছে জীবনে কোন আশার আলো আসেনি, তার সামনে যখন এমন সম্ভাবমনার এক দরজা খোলা হয়, তখন স্বভাবতই সে ঋণ শোধ করতে আগ্রহী হয়। অর্থাৎ যে ভালভাবে ঋণ পরিশোধ করলো, নিজের কর্মদক্ষতাকে প্রয়োগ করে গ্রামীণের অর্থ নিয়ে, সে আরো সামনে এগুতে পারবে।
আমি অনেক পত্রপত্রিকা আর ব্লগে পড়েছি, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের যে উচ্চ হার তা সঠিক নয়। কেউ বলেছেন মিথ্যা, আবার কেউ এটাকে রীতিমত জোচ্চুরিও বলেছেন। কিন্তু একজনও এর প্রতাবাদও করেনি বা ব্যাখ্যাও করেনি। তারা সহজভাবে বলে দিয়েছেন, গ্রামীণের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জবরদস্তিমূলক নতুন ঋণ দিয়ে সেই ঋণের অর্থে পুরাতন ঋণ শোধ দেখানো হয়। এই ধারনা সর্ববৈ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। গ্রামীণ ব্যাংকের কোন ঋণ কেউ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, উপরে উল্লেখিত প্রথম শর্তেই বলা হয়েছে ভবিষ্যতে তার ঋণ গ্রহণের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে দ্বিতীয় ঋণ? যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের কথার প্রথম অংশ সত্য; দ্বিতীয় বারও তাকে ঋণ দেয়া হয়, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায়।

গ্রামের এক সরলমতি রমনী, যে জীবনে হয়ত পঞ্চাশ বা তদোর্ধ টাকাও কোনদিন স্পর্শ করেনি, গ্রামীণ ব্যাংক তাকেই হাজার টাকা ঋণ দিল। সেই রমনী একটি বাছুর বা ছাগল ক্রয় করল অথবা সব্জি চাষ করল। এরপর কোন দৈব দূর্বিপাকে যদি তার বাছুরটি মারা যায়, ঐ রমনী কিইবা করতে পারে? এই ক্ষেত্রে আসে দ্বিতীয় ঋণ এর বিষয়টি। আর প্রথম ঋণটি লেখা হয় দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ হিসেবে। ঐ রমনী ঐ দীর্ঘ মেয়াদী ঋণটি পরিশোধ করে যদি চলতি ঋণটি শোধ করার পরে তার পক্ষে বাড়তি কিছু শোধ সম্ভব হয় শুধুমাত্র তখনই। তাহলে এই প্রথম ও দ্বিতীয় ঋণটি সময়ের আবর্তে পরিশোধ করা আর কঠিনতর হয়না। এরপরও কেউ কেউ শোধ করতে পারে না। আর সে কারনেই, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের হার পুরোপুরি একশতভাগ নয়। কিছুটা কম, প্রায় ৯৮ ভাগ। গ্রামীণ ব্যাংক শুধুমাত্র যে সমস্যাটির মুখোমুখি হয় তা হলো, গ্রামের কোন কোন পরিবারের উপার্যনক্ষম পুরুষের অর্থসহ পলায়ন। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির কিছুই করার থাকেনা এবং ঋণ অনাদেয়ের সম্ভাবনা থেকে যায়।

এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে, গ্রমীন ব্যাংকে সাড়ে সাত মিলিয়ন (এই মূহুর্তে আরও অধিক) ঋণ গ্রহীতার মধ্যে শতটি অঘটনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বৈ কিছুই নয়। অথচ, সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে অর্ধ শিক্ষিত এক দঙ্গল স্বঘোষিত শুশীল ব্যক্তি কত কিইনা লিখছে ব্লগে আর পত্রিকায়। একটি সহজ কাল্পনিক উদাহরণ দেই, মেসার্স কালীপদ কোম্পানী, শিল্পঋণ সংঘ হতে ব্যবসার নামে ৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশে ও বিদেশে বাড়ি গাড়ী বানাল! ঐ ব্যাংকের কেউ হয়ত তার ভাগ পেল বা পেল না। এরপর তার আর ঋণ শোধ করার নাম নেই। ব্যাংক আদালতে গেল। সাত বছর মামলা চললো। এরপর মাল ক্রোক করে নিলাম হলো। দাম উঠল ২ কোটি টাকা। নিলামও কিনে নিল কালীপদের হারিয়ে যাওয়া ভাই তারাপদ। সরকারও খুশি! অতপর: কালীপদ ও তারাপদও সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল। এই ঠাকুর মামার ঝুলির গল্প কিন্তু নতুন নয়। কিন্তু কন্ঠ লেংগট (টাই) পরিহিত সমাজ যখন, গলা ফুলিয়ে বাক বাকুম করতে করতে জামার উপরের বোতাম ছিড়ে ফেলে, তখন বিষয়ে থাকে শুধুই গ্রামীন ব্যাংক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, গ্রামীণ ব্যাংক শুধুই একটি ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক তা কোন মাধুকরী এনজিওর নামের মাঝে লুকিয়ে রাখেনি। এটি নামেও ব্যাংক এবং এটি কোন দাতব্য চিকিৎসালয় অথবা যাকাত ফান্ড নয় যে, টাকা দিয়ে দিলাম ফি সাবি লিল্লাহ। তারপরেও গ্রামীণ ব্যাংক বিনা শর্তে ঋণ দিচ্ছে, সেই জনগোষ্ঠীকে যে কোন দিনই প্রথাগত ব্যাংক হতে ঋণ পায়না কারন সে কোন কোলেটেরাল বা গ্যারান্টি দিতে পারে না। সুদের হার নিয়েও অনেকে কাল্পনিক অনেক কথা বলে যাচ্ছে, আকছার। কিন্তু একটি কথা স্পষ্ট করা দরকার, গ্রামীন ব্যংকে কিন্তু সরকারেরও শেয়ার যেমন আছে তেমনি, সরকারের পক্ষ হতে নজরদারী করার জন্য ক্ষমতা সম্পন্ন কর্মকর্তাও আছেন।
অপর প্রসঙ্গটি হলো, কোন ব্যাংক বা অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা হেতু যদি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেও থাকে তার জন্য সমগ্র সুধী মহলে কেউ কি আজ পর্যন্ত কোন দিন ঐ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা মালিককে গালমন্দ করে মত প্রকাশ করেছেন কিনা? তা যদি না করে থাকেন তাহলে গ্রামীণ ব্যাংক আর ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে এটা প্রয়োগ করাটা কতটা সমীচিন বা আদৌ বিজ্ঞ আচরন হয়েছে কি না।

এবার আসি তার চরিত্র হনন প্রসঙ্গে। আমাদের মাননীয় দেশ নেত্রী তাকে অভিহিত করেছেন রক্তচোষা হিসেবে। অমনি এ দঙ্গল তল্পী বাহক শুরু করে দিল জপ নাম। তিনি হয়তো কথাচ্ছলে একবার বলেই ফেলেছেন, কিন্তু ‘রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শত গুন’ আধুনিক জামানায় এসে হয়ে গেল লক্ষগুন। সহস্র ব্লগে, পত্রিকায় সবাই এই একই মত তুলে ধরলেন। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার দেশের বড় বড় সব বিশ্লেষক, কথা সাহিত্যিক দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কিভাবে নিশ্চুপ থেকে এই অন্যায়ের প্রশ্রয় দিলেন। অনেকবার ভেবেছি আমি লিখি। আমিতো রাজা মন্ত্রী নিয়ে লিখিনি। শুধু পড়েছি আর মনের মধ্যে মরেছি শতবার। আমার জাতি আজ একজন আত্নত্যাগীকে রক্তচোষা বলেছে তাতে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখ পাইনি, বিব্রত বোধ করেছি। লজ্জায় মরমে মরেছি, যখন দেখেছি, কলম হাতে লোকগুলো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মানসচক্ষে ভেসে উঠেছে, মীরজাফর দাঁড়িয়ে আছে ভাগীরথীর তীরে, নিশ্চুপ। সে যদি একটু আঙ্গুলী ইশারা দেয়, ভারত শত বছরের গ্লানি থেকে বাঁচে, যেমনটি বেঁচে যেত পারত আজকে বাংলাদেশের উচ্চ সম্মান। দেশের মন্ত্রী পরিষদে, লেখক সমাজে, শিক্ষিত সমাজে, একজনও কি ছিলনা যে বলতে পারে, মাননীয় সরকার, তুমিই দেশের মা বাপ, মাথা ঠান্ডা রাখো।

এবার আসি সুদখোর প্রসঙ্গে, প্রথমে প্রিয় পাঠক, একটি ব্যাংকের নাম মনে করার চেষ্টা করুন, যেটা সুদ নেয় না, নামে বা বেনামে। ড. ইউনুস সুদ খেয়ে কি অর্জন করেছেন? মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা যে ঋণ দেয়, সেতো মিলিয়ন টাকা আয় করে, সে টাকা কোথায়? ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোনরূপ কোন লাভ নেননা। প্রিয় পাঠক, বিশ্বাস না হলে আগের লাইনটি আবার পড়ৃন। গ্রামীণ ব্যাংকে পদাধিকার অনুযায়ী যে বেতন পান, তাই ই তার আয়। যে বেতনও দেশের হিসেবে খুব বেশি নয়। একজন সচিবের সমপর্যায়ের বেতন। তিনি একটি দালানের এক তলায় থাকেন, যার অন্যান্য তলাগুলোতে গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তারা থাকেন। তার পোশাক পরিচ্ছদ অতি স্বাধারন। বিশ্বের যতসব নামকরা মান্যগন্যদের সাথে ওনার সাক্ষাৎ হয়, উনার গায়ে থাকে সাধারন গ্রামীনের পাঞ্জাবী বা ফতুয়া আর পাজামা। কোটি টাকা যার হাত দিয়ে প্রতিদিন আসছে যাচ্ছে, এই হচ্ছে তার হাল। আর তিনিই কিন্তু সমাজের কারো কারো চেখে সুদখোর।

ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নোবেল প্রাপ্তির বহু আগে থেকে তার কাজের বিষয়ে নানা আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা আন্তর্জাতিক মহলে হয়ে আসছে বা হচ্ছে। এটা একেবারেই নতুন নয়। নতুন হলো, যখন কোন বিদেশী কেউ ‘ফেউ’ দিল, কান নিয়েছে চিলে, অমনি দলে দঙ্গলে সবাই ছুটলো চিলের পেছনে। সাবাস বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, বিদেশী সেই সাংবাদিক কি না কি বলেছে তার অর্থ বুঝে কিংবা না বুঝেই দেশের আক্ষরিক অর্থেই প্রায় সকল পত্রপত্রিকা এই খবরটি গুরুত্বের সাথে ছাপাল। কোন প্রতিষ্ঠানই এর বিরুদ্ধে প্রথমেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলনা বা ভিত্তি যাচাই করলো না। বরং আচরনটা শুরুতে এমনই ছিল যেন, যেন তারা এমন একটি মোক্ষম অস্ত্রের অপেক্ষায়ই করছিল। যে দেশের সাংবাদিক এই কাজ করেছেন, আজ আমার দেশের কোন সংবাদপত্র ঐ দেশের কোন সম্মানিত ব্যক্তির সম্পর্কে সত্য জেনেও এমন কোন সংবাদ প্রচারের সাহস রাখে? তারা আমাদের আঙ্গুল কেটে ফেলবে না। কিন্তু লজ্জাজনক হলেও সত্য সেই ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতার এত বছর পরও একটি প্রতিষ্ঠানেরও গড়ে উঠেনি। ঐ দেশের মানুষ ভুল করে, ঐ দেশের মানুষও জেলে যায়, তার প্রমান তাদের দেশেও জেল জরিমানা আছে; তারাও ঘরে তালা লাগায়। তাহলে আমাদের দেশের বিষয়ে সেই ব্যক্তি যখন আঙ্গুলী প্রদর্শন করলো, তখন আমাদের মামলাবাজগুলো কোথায় ছিল। তাতে তাদের অসম্মান হয়নি। ঐ সাংবাদিক যতই সত্য বলুক না কেন, উপস্থাপনের কারনে এবং ভাবগত কারনে তা অসম্মানজনক। এখন আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত যে তহবিল তহুরূপ বা আন্য কোন অসৎ ঘটনা ঘটেনি, বিষয়টির সুরাহা হয়ে গেছে। অথচ আমাদের তথাকথিত ব্লগার আর স্বঘোষিত শিক্ষিত বা সুশীল ব্যক্তিরা ভুল আচরনের উদ্দেশ্যে বা মৌলিকতা ও মোটিভ যাচাই আজও করেননি। কোথায় সংকট ব্যক্তিত্বে বা মেরুদণ্ডে?

আগেই বলেছি, ড. ইউনুস নোবেল প্রাপ্তির বহু আগে থেকেই পৃথিবীতে পরিচিত নাম। তিনি বাংলাদেশের ধজ্বা ধরে সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন। আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকার বহু দেশ তাকে আমন্ত্রন জানিয়েছেন তার কর্ম কৌশল জানার জন্য তিনি এগিয়ে গেছেন, বিশ্বকে শিখিয়েছেন দারিদ্র্য মুক্তির পথ। পৃথিবীর অনেক নেতা ও ভবিষ্যৎ নেত্রীত্ব তাদের জনদরদী মনোভাবের কারনে ইউনুসকে আমন্ত্রন জানিয়েছেন, সহায়তা চেয়েছেন। আরকানসাসের গভর্নর বিল ক্লিনটন যিনি পরবর্তীতে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ব রাজনীতির প্রথম সারির ব্যক্তি হয়েছেন, ড. ইউনুসকে আমন্ত্রন জানান ও গ্রামীণব্যাংকের কর্মপন্থা জেনে আমেরিকায়, গ্রামীন ব্যাংকের আদলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ ব্যাংকের প্রধান ছিলেন আমেরিকার বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন। এই ঘটনার এখনকার নয়, গ্রামীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মধ্যের ঘটনা। এই দুই বিশ্ব নেতা নেত্রী ড. ইউনুসের ভাবধারা দ্বারা এতটাই মুগ্ধ হন এবং তার কার্যক্রমের দ্বারা এতটাই অনুপ্রানিত হন যে, পরবর্তিতে আমেরিকায় এর কার্যক্রম বাড়াতে থাকেন।

ড. মোহাম্মদ ইউনুস শুধুমাত্র ক্ষুদ্রঋণ ধারনার প্রবক্তাই নন, তিনি সামাজিক ব্যবসা নামের এক অনন্য সুন্দর ব্যবসার প্রবর্তক। এই বিশেষ ব্যবসায় সমাজের ধনাঢ্য শ্রেনী যেমন সেবা বা দানের মনোভাব পোষন করতে পারবে, একই সাথে সে তার সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত পাবে। এবং মধ্যখানে একশ্রনীর মানুষ এমন সুবিধা পাবে, যা আগে কোনদিন পেত না। সরাসরি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যার সুযোগ প্রার্থনা করছি- গ্রামীন ব্যাংক বিশ্ব শ্রেষ্ঠ জুতার কোম্পানী অ্যাডিডাসকে বললো, বিশ্বসেরা কোম্পানী হিসেবে তাদের কিছু সামাজিক দায়িত্ব আছে। কিন্তু কি? কিভাবে? পৃথিবীর কেউ খালি পায়ে হাটবে না, এমন একটা মটো হোক। হোক। হোলও তাই! শুরু হবে বাংলাদেশ থেকে। অ্যাডিডাস অতি সস্তায় (প্রায় এক ডলার) মূল্যে বাংলাদেশে জুতা বিক্রি করবে! পণ্য উৎপাদন, বিপনন, ইত্যাদিতে যা খরচ তা অ্যাডিডাস দিবে। কোম্পানী শুরু হলো, জুতা তৈরি হলো, বিক্রি হলো অল্প লাভে। এভাবে অল্প অল্প লাভ জমে যেদিন অ্যাডিডাস তার বাংলাদেশের জুতা উৎপাদন খাতের তার বিনিয়োগ উঠিয়ে নিবে, সেদিন থেকে আর কোন অর্থ সে নেবে না। এরপর এই কোম্পানীর মালিক আর অ্যাডিডিস নয়। কিন্তু এর উৎপাদন ও বিক্রি চলতে থাকবে। এটি এমন একটি চ্যারিটি যেখানে একটি টাকা বা ডলারের অসীম সংখ্যক জীবন। এই একই রকম মহৎ উদ্দেশ্যে চলছে, পৃথিবী বিখ্যাত দুগ্ধজাত পন্যের কোম্পানী ডাননের সাথে গ্রামীন ডানন। অথচ সেখানেও মামলা মোকদ্দমায় আজ দৃশ্যত হীনবল এই শতাব্দীর মহান এই বাংলাদেশী মহাপুরুষ।