{ নীচের লিফলেটটি নারীপক্ষ কর্তৃক(বাংলাদশেরে একট নারী সংগঠন)লিখিত ও প্রচারিত}
৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ঐতিহাসিকভাবে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত। ১৮৫৭ সালে ৮ই মার্চ নিউইয়র্ক শহরে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা বিপদজনক ও অমানবিক কর্ম পরিবেশ, স্বল্প মজুরী ও দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল বের করে। তাদের সেই মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়। তিন বছর পর ১৮৬০ সালের ৮ই মার্চ নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়।

এইসব ঘটনা ধারার সম্মিলনে নারীদের বিভিন্নমুখী প্রতিবাদী ভূমিকার প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশ, সমর্থন দান ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীর প্রতীক হিসাবে একটি দিনকে চিহ্নিত করার উপলব্ধি জাগে। অতঃপর ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারে ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
নারী আন্দোলনের এই প্রতিবাদী ধারাকে তুলে ধরে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্‌যাপন কমিটি’ গঠিত হয় যার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নারীপক্ষ। বিগত ২০ বছর ধরে এই কমিটি দিবসটি উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে নারী আন্দোলনের বিভিন্ন দাবী তুলে ধরছে। এবার নারীপক্ষ “নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নারী-পুরুষের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা সমুন্নত রাখা” বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে দিবসটি উদ্‌যাপন করছে।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও নারীরা ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়; হত্যা, ধর্ষণ ও দোররা মারাসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এবং কোন কোন নারী বাধ্য হচ্ছে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে। মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া আজও স্বপ্ন মাত্র।
২০০১ সালে হাইকোর্ট ফতোয়ার নামে বিচার বহির্ভূত বিভিন্ন শাস্তি প্রদানের ঘটনা যেমন: দোররা বা বেত্রাঘাত, হিল্ল্লা বিয়ে, একঘরে করে রাখা ইত্যাদি বন্ধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন। সেইসাথে দন্ডবিধিসহ প্রচলিত অন্যান্য আইন অনুযায়ী শুধু ফতোয়াদানকারী নয় তাদের সহযোগীদেরও শাস্তি বিধান করার নির্দেশ পুনঃব্যক্ত করেন।
তারপরও থামেনি ফতোয়া, বন্ধ হয়নি দোররা এবং অস্বাভাবিক মৃত্যু। তার প্রমাণ মাত্র কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া হেনা ধর্ষণ ও দোররা মেরে হত্যার ঘটনা।
২৩ জানুয়ারী ২০১১ শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের ১৪/১৫ বছরের কিশোরী হেনাকে তার চাচাতো ভাই মাহবুব ধর্ষণ করে। এরপর ধর্ষণকারীর স্ত্রী ও তার আত্মীয়স্বজন হেনাকে নির্যাতন করে মারাত্মকভাবে জখম করে। গ্রাম্য চিকিৎসক দ্বারা জখম সারানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে হেনার বাবা হেনাকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করে। নির্যাতনকারীরা হেনার বাবাকে হাসপাতালে যেতে বাধা দেয় এবং গ্রামের প্রভাবশালীরা হেনাকে নিয়ে সালিশ বসায়। সালিশকারীরা গুরুতর আহত হেনাকে দোররা মেরে মৃতপ্রায় করে ফেলে। তারা হেনাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে না দিয়ে জোরপূর্বক বাড়ীতে ফেরত যেতে বাধ্য করে। ৩১ জানুয়ারী ২০১১ হেনার মৃত্যু হয়।
হেনাকে দোররা মারা ও হত্যা করা প্রতিদিন নারী নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনার একটি ঘটনা মাত্র। ধর্ম ব্যবহার করে নারীর প্রতি এ ধরনের সহিংসতার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে এই যে, সাধারণ মানুষ এর কোন প্রতিবাদ করে না, কারণ তারা ধর্মভীরু এবং এর হোতারা স্বভাবতই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ।

সরকারের কাছে আমাদের দাবী
• হাইকোর্টকে যাতে বারবার হস্তক্ষেপ করতে না হয় সে লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও তথ্য মন্ত্রণালয় বরাবর হাইকোর্টের নির্দেশনা কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্থানীয়ভাবে সরকারী ও বেসরকারী সংগঠনকে সাথে নিয়ে অনতিবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে ।
• ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনতিবিলম্বে নারীর প্রতি সহিংসতার হাতিয়ার ফতোয়া বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
• মহিলা, শিশু, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণায়ের যৌথ দায়িত্বে জেলা ও উপজেলার নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক কমিটিকে ফতোয়াসহ নারীকে উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও এর ফলাফল পরিবীক্ষণ করতে হবে।
আমাদের করণীয়
• হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ এলাকায় সরকারের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা।
• জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, পারিবারিক বিরোধ নিরসন, নারী ও শিশু কল্যাণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটিসমূহের কার্যক্রমকে পর্যবেক্ষণ; সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্টদের কাছে তা সরবরাহ করা।
• নিজ নিজ এলাকায় নারী নির্যাতনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এ বিষয়ে স্থানীয় প্রচার মাধ্যমে তথ্য প্রেরণ করা