সম্প্রতি জাতিসংঘও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীর সমঅধিকার ঘোষণা করলেও বর্তমানে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের বিচরণ একেবারেই কম। বিখ্যাত নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। উত্তর-আধুনিক এই যুগে সারাবিশ্ব যেখানে প্রযুক্তির জোয়ারে ভাসছে সেখানে নারীদের এই বিজ্ঞান বিচ্ছিন্নতা কেবল অস্বাভাবিক নয়, বেমানানও বটে। বস্তুত নারী-পুরুষের এ অসম অনুপাত বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত ও সংকটাপন্ন করে তুলতে পারে। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর পক্ষ থেকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। সেগুলোও প্রকাশ করা হবে

আধুনিক বিজ্ঞানের সফল পথচলায় নারীদের নগণ্য উপস্থিতিকে বিজ্ঞানের একটা বড় পরাজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কিন্তু কেন পিছিয়ে পড়ছেন নারী বিজ্ঞানীরা। তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে, বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা নারীদের বিজ্ঞানবিমুখ করে তুলছে। যে কারণে বিজ্ঞানের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন গবেষকের মতামত হলো, বড় ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নারী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। ফলে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীরা সচেতন অথবা অসচেতনভাবে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন। আবার একই সঙ্গে তাদের নিজের ঘর ও পারিবারিক জীবন সামলানোর অতিরিক্ত ঝামেলাও পোহাতে হচ্ছে। আর এসব প্রতিকূলতাই নারীদের বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকিনসন মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তা জো হ্যান্ডেলসম্যান ও তার কয়েকজন সহকর্র্মী মিলে গবেষণা করে দেখেছেন, বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে মূলত চারটি ক্ষেত্রে নারীরা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন_
এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা : বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন নারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা গেছে, বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে নারীদের নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারণ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও কখনও প্রকাশ্যেই নারীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণ করা হয়। আবার লোকচক্ষুর আড়ালেও তাদের প্রতি নানাভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়। যেমন_ বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ে বিশেষত প্রকৌশলবিদ্যা ও শরীর বিজ্ঞানে খুব কমসংখ্যক নারীকে পিএইচডি লেভেল পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। আর এ ধরনের অবমূল্যায়ন ও অশ্রদ্ধাজনিত আচরণের কারণে হীনমন্যতায় ভোগেন নারী বিজ্ঞানীরা। ফলে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার উৎসাহটাও তারা হারিয়ে ফেলেন।
কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবেশ
কর্মস্থলের প্রতিকূল পরিবেশ নারীদের বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। কারণ কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীরা তাদের কাজের বিরোধিতা করে ও তাদের বিভিন্ন সময় হেয়প্রতিপন্ন করে। সহকর্মীদের এই অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ও অবহেলার কারণে অনেক নারী তাদের পেশা বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র থেকে সরে আসতে বাধ্য হন।
অসচেতন পক্ষপাতিত্ব
বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন সচেতনভাবে নারীদের অবমূল্যায়ন করা হয়, তেমনি অসচেতনভাবেও অনেক সময় তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা বিজ্ঞানীদের কাজের মূল্যায়ন করেন তারা যদি আগে থেকেই জানেন, কাজটি কোন নারী করেছেন তাহলে স্বভাবগত কারণেই তারা সেই কাজের নিম্ন স্কোরিং করেন।
পরিবার এবং কাজের ক্ষেত্র সামলানোর জটিলতা পারিবারিক দায়-দায়িত্বের বেশিরভাগই মেয়েদের বহন করতে হয়। যে কারণে একাডেমিক ক্যারিয়ারের প্রতি তারা খুব বেশি মনোযোগী হতে পারেন না। বিশেষ করে বাচ্চা জন্মদানের সময় তারা দীর্ঘদিন কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। কিন্তু পরে যখন আবার কাজে ফিরে আসেন তখন দেখা যায়, কর্মস্থলের সঙ্গে তাদের একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে গেছে। যে কারণে পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশলগত কিংবা প্রযুক্তিগত কোনো কাজ করতে গিয়ে তারা সমস্যায় পড়েন। পাশাপাশি পারিবারিক বিভিন্ন ঝামেলাও তাদের কাজের ক্ষেত্রকে বাধাগ্রস্ত করে। আর এর ফলে কর্মক্ষেত্রে নারী বিজ্ঞানীদের আনুপাতিক হার ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।
তবে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, নারী বিজ্ঞানীদের অবস্থানগত বৈষম্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কোনো ব্যতিক্রমী ধারা লক্ষ্য করা যায় না। পূর্ব অ্যাংলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন পর্যায়ে মূল অবস্থানগুলোতেই রয়েছেন পুরুষরা। সে কারণে কর্মক্ষেত্রে নারীরা উচ্চপদস্থ পুরুষ কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে ক্যারিয়ারের উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সম্প্রতি আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের প্রায় ৫০ হাজার নারী তাদের অর্জিত জ্ঞান ও প্রকৌশলগত দক্ষতাকে কোনো কাজেই লাগাচ্ছেন না। যদিও দেশের অর্থনীতির জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
বিজ্ঞানে নারীদের জন্য গৃহীত কিছু পদক্ষেপ
নিরবচ্ছিন্ন ও সফল বিজ্ঞান চর্চার স্বার্থেই নারীদের কর্মক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন বোধ করছে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই নারী-পুরুষের অসমতা কমাতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত ও প্রকৌশলগত ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় নারী বিজ্ঞানীদের জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদানের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিজ্ঞান চর্চায় সংস্কৃতিগত পরিবর্তন আনতে যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল, ক্যামব্রিজ, হেরিয়ট ওয়াট ও অক্সফোর্ডসহ মোট দশটি বিশ্ববিদ্যালয় এই কর্মসূচি পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজ্ঞান চর্চা থেকে নারী বিজ্ঞানীদের ঝরে পড়া রোধে অ্যাথেনা প্রজেক্ট এবং সায়েন্টিফিক উইমেন্স নেটওয়ার্ক (ঝডঅঘ) যে ছয়টি বিষয় সুবিধা-কর্মসূচির আওতাভুক্ত করেছে
তা হলো_
১. প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সব পর্যায় থেকে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য গৃহীত উদ্যোগ ও কার্যক্রম তুলে ধরা।
২. বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের অসম উপস্থিতিকে ভারসাম্য অবস্থায় আনতে সাংস্কৃতিক ও মনোভাবগত পরিবর্তন ঘটানো।
৩. বিজ্ঞান চর্চা থেকে উচ্চহারে নারীদের ঝরে পড়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।
৪. বিজ্ঞানভিত্তিক পেশায় নারীদের স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি চুক্তিগুলোর একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সে কারণে এসব চুক্তি সংশোধনের পরিকল্পনা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
৫. বিজ্ঞানে পিএইচডি করার পর একটা স্থায়ী একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলা নারীদের জন্য অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ ক্ষেত্রে সংস্থাটি কতগুলো কার্যকরী বিষয় বিবেচনাধীন রেখেছে।
৬. বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবস্থাপনা এবং নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের অভাব নারী বিজ্ঞানীদের পিছিয়ে পড়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। আর এ বিষয়টিই যাচাইয়ের চেষ্টা করছে সোয়ান প্রজেক্ট।
আরও যা করণীয়
উলি্লখিত ছয়টি কর্মসূচির পাশাপাশি আরও কতগুলো বিষয়ে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছেন নারী বিজ্ঞানীরা, যা তাদের কর্মক্ষেত্র এবং পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করবে। যেমন_ কর্মস্থলে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা এবং শিশুর যত্নের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা। পাশাপাশি নারী বিজ্ঞানীদের জন্য সুবিধাজনক কাজের সময়ও নির্ধারণ করতে হবে। নারী বিজ্ঞানীদের চাহিদা অনুযায়ী এসব ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ‘সোয়ান’ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হলে তা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রথাগত কিছু ধারণা তাদের বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের অনেক আধুনিক চিন্তাশীল মানুষও মনে করেন, মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় জন্মগতভাবে কম মেধাবী, যে কারণে এটা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া হয়, বিজ্ঞান নিয়ে পড়লে মেয়েরা খারাপ ফল করবে। আর এ আশঙ্কা থেকে বাবা-মাও তাদের মেয়েসন্তানকে বিজ্ঞান পড়াতে উৎসাহী হন না। এ সম্পর্কে ঢাবির চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী শান্তা বলেন, ‘ক্লাসে সবসময় মধ্যম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলাম বলে ভয় ছিল হয়তো বিজ্ঞান বিভাগে পড়লে ভালো করতে পারব না। তাছাড়া বাবা-মাও চাননি আমি বিজ্ঞানে পড়ি। যে কারণে এখনও আমার মধ্যে বিজ্ঞানভীতি কাজ করে। এমনকি পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো বই পড়তেও তেমন আগ্রহ বোধ করি না।’ টঙ্গি ক্রিস্ট্যাল কলেজ একাদশ শ্রেণী ব্যবসায় শাখার ছাত্রী তানিয়া আক্তার বলেন, আমার বিজ্ঞান বিষয়ক পড়ার আগ্রহ থাকলেও প্রয়োজনীয় সূযোগ সুবিধার অভাবে আর তা হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের সহযোগিতা জরুরি। একই অভিমত ব্যাক্ত করেন একই কলেজের সাবেকুন নাহার।
কৃতজ্ঞতা: ডিসকাশন প্রজেক্ট