আমি ইদানীং বেশ সাহসী হয়ে উঠছি। তার প্রমাণ হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আমার এই লেখা। হুমায়ুন আজাদেরই কোন এক প্রবন্ধে পড়েছিলাম স্যামুয়েলসন নামে এক ভদ্রলোক সেই ব্যাক্তির সাথে কথাই বলতে চাননি যার লেখার তুলনায় পড়ার পরিমান কম। হুমায়ুন আজাদের বই বলতে আমি পড়েছি তাঁর অসাধারণ গ্রন্থ ‘নারী’, ‘আমার অবিশ্বাস’, ‘ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ ইত্যাদি প্রবন্ধ গ্রন্থ, উনার কিছু কবিতা (“শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থ থেকে) এবং উপন্যাস পড়েছি ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এবং ‘মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ’। এছাড়া সংগ্রহে আছে এখনো পড়া হয়নি এমন বই হল “লাল নীল দীপাবলী”, “শুভব্রত ও তার সম্পর্কিত সুসমাচার”, “দ্বিতীয় লিঙ্গ” এবং আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে একটি সম্পাদনা গ্রন্থ। আমার জানার ক্ষুদ্র পরিসরের মাঝে যে হুমায়ুন আজাদ তাঁকে নিয়েই দু’কলম লিখতে বসলাম।

হুমায়ুন আজাদের পরিচয় হিসেবে তার নামের আগে অনেকগুলো বিশেষণ লাগানো যায় যার প্রত্যেকটিকেই তিনি সত্য বলে প্রমাণ করেছেন নিজের যোগ্যতা, কীর্তি এবং আচরণের দ্বারা। তিনি আমাদের দেশের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, কবি, ঔপন্যাসিক, কিশোর সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক-সর্বোপরি এদেশের গুরত্বপূর্ণ বহুমাত্রিক সাহিত্যিকদের মাঝে একজন। তবে তাঁকে সকলের মাঝে অন্যতম করে তুলেছে এবং অগণিত মানুষের কাছে প্রিয় ও অনুরাগভাজন এবং অনেক মানুষের কাছে অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর করে তুলেছে তাঁর প্রথাবিরোধিতা, সত্যনিষ্ঠা, স্পষ্টবাদিতা এবং যুক্তিপ্রিয়তা ও যৌক্তিকতা।

তিনি সবসময় বলেছেন নিজেকে কবি হিসেবে ভাবতে তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু লেখকের দায়িত্ববোধ থেকে তিনি সাহিত্যের প্রায় সকল ক্ষেত্রে রেখেছেন নিজের সরবতা ও অসাধারণ লেখার যোগ্যতার স্বাক্ষর। তবে যে কারণে তিনি সবচেয়ে বেশি নন্দিত এবং নিন্দিত হয়েছেন তা হল সকল ধরণের গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের বিপক্ষে নিজের যৌক্তিক ও সাবলীল লেখনী। তাঁর সবচেয়ে বেশি আলোচিত দুটি গ্রন্থের নাম সম্ভবত “আমার অবিশ্বাস” এবং “নারী”।

“নারী” সম্পর্কে এত কম পরিসরে কিছু বলা খুবই কষ্টকর, তাই শুধু বলতে চাই “নারী” আমাকে নিজেকে “মানুষ” বলে ভাবতে শিখিয়েছে। “নারী” বইটি লেখার পিছনের প্রচেষ্টা জেনে আমি বিস্মিত ও শ্রদ্ধানত হয়েছি। বুঝেছি বই রাতারাতি “প্রসব” হয়না। জানার জন্য অনেক অধ্যবসায়, পরিশ্রম করে তবেই অন্য কাউকে সে বিষয়টা সম্পর্কে জানানোর যোগ্যতা অর্জন করা যায়। এই বই লেখার আগে উনি এডিনবরাসহ নানা স্থান থেকে নারীবাদ সংশ্লিষ্ট যত বই সংগ্রহ করেছিলেন সব পড়েছেন তিনি। তারপর লিখেছেন। এধরণের শ্রদ্ধা ও অধ্যবসায় তার প্রতিটি লেখার পেছনেই ছিল। উপরে উল্লিখিত স্যামুয়েলসনের কথাটি হুমায়ুন আজাদ প্রচন্ডভাবে চর্চা করেছেন। তার প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি লাইন পড়লেই বোঝা যায় উনার জ্ঞানের পরিধি কত বিশাল ছিল এবং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় উনার লেখার পরিমাণ উনার পড়ার ও জানার তুলনায় খুবই সামান্য ছিল। এ ব্যাপারটা দিয়েই হুমায়ুন আজাদ তার প্রতি আমার সিংহভাগ শ্রদ্ধা অর্জন করে নিয়েছেন।

তার লেখায় আমি আরো পেয়েছি সৌন্দর্যের প্রতি অসীম ভালবাসা ও আকর্ষণ। একারণেই আমি যতবার উনার “সুখী বোধ করছি বা সুখী বোধ করি” এধরণের লাইন পড়ি, নিজেও এক ধরণের সুখ পাই। তার কবিতাগুলো নিখাদ অনুভূতির আকর। কখনো তাতে থেকে সৌন্দর্য, কখনো কদর্যতা, কখনো ভালবাসা, কখনো বিতৃষ্ণা, কখনো হাহাকার, কখনো তৃষ্ণা, কখনো বেদনা, কখনো সুখ, কখনোবা অনেক অনুভবের সমন্বয়- আর এসবকিছুর মাঝে থাকে তীব্রতা, অনুভবে থরথর করে কাঁপার মত প্রচন্ডতা।

আমি উনার কাছ থেকেই প্রথম পাঠ পাই সূক্ষ্ম ও স্বতন্ত্র উপলব্ধির ধারণার। আমি তার একথাটা অনেক মূল্য দিই-

‘ভক্ত কখনো আমি হ’তে পারিনি, যদিও আমি অনেকেরই অনুরাগী।’

রবীন্দ্রনাথ, এলিয়ট, দান্তেসহ সকল প্রতিভাবানদের কর্মের অনুরাগী ছিলেন তিনি। তাদের সৃষ্ট চরণগুলোর দ্যোতনায় শিহরিত ও মুগ্ধ হয়েছিলান তিনি, কিন্তু তাদের অযৌক্তিক কোন দর্শনকে বা ধারণা বিশ্বাস বা গ্রহন করেননি। এবং আমার মতে এদের পায়ে না পড়ে, তাদের অন্ধ পূজা না করেই উনি এই প্রতিভাবানদের কর্মের ও যোগ্যতার উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছিলেন, নির্বোধের মত মাথা না দেখে শুধু পা জড়িয়ে ধরে তাদেরকে বিব্রত করেননি।

তার উপন্যাসগুলো পড়তে অনেক কষ্ট হয়, কারণ সেগুলো আমার মাথায় প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। “পাক সার জমিন সাদ বাদ” শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে অনেক চাপের মধ্যে রেখেছে। মন্দিরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে নায়কের মাঝে যে প্রচন্ড অনুভূতির সৃষ্টি হয় তা আমার মাঝেও হয়েছিল। “মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ” পড়ার ক্ষেত্রেও সেই একই অস্বস্তি ও অসুস্থতা অনুভব করেছি। ভেতরটা তছনছ করে দেয়ার এই যে প্রলঙ্কর তীব্রতা এর কারণে আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।

উনার লেখার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল তা আমাকে বিশ্বাস করতে হয়না আর ফেলেও দেয়া যায় না- তা আমাকে শুধু বলে ভাবতে, চিন্তা করতে। এজন্যই তিনি আমার এত শ্রদ্ধেয়। তার প্রবন্ধ ও কথায় যে যুক্তি দেখেছি, যে বলিষ্ঠতা দেখেছি, যে শক্তি দেখেছি তা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে চর্চা করার চেষ্টা করি কিন্তু সেভাবে পারিনা। তবু জানি এই চেষ্টা করে যাবার মাঝেই আমার জীবন একটু কম ব্যর্থ হবার গৌরব অর্জন করবে।

উনি বলে গেছেনঃ

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে
(কাব্যগ্রন্থঃ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু)
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালে একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এককণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
একফোঁটা সবুজের জন্যে

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুক্ষের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাব কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোট দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে

আমরা কি সেই ছোট্ট স্বপ্নটা বুকে ধরে রাখতে পারিনা যার জন্য মারা যাবার সম্ভাবনা রেখেছিলেন এই মহাকায়?

সবশেষে সেই অমিত শক্তিধর, সৌন্দর্যে ভরপুর লাইনগুলো তুলে দিলাম যা পড়ে সেইরকম স্তব্ধ মুগ্ধতায় এখনো বসে থাকি যেমনটি ছিলাম প্রথম পড়ার পরঃ

‘আমি জানি, ভালো ক’রেই জানি, কিছু অপেক্ষা ক’রে নেই আমার জন্যে; কোনো বিস্মৃতির বিষন্ন জলধারা, কোনো প্রেতলোক, কোনো পুনরুত্থান, কোনো বিচারক, কোনো স্বর্গ, কোনো নরক; আমি আছি, একদিন থাকবো না, মিশে যাবো, অপরিচিত হয়ে যাবো, জানবো না আমি ছিলাম। নিরর্থক সব পুণ্যশ্লোক, তাৎপর্যহীন সমস্ত প্রার্থনা, হাস্যকর উদ্ধত সমাধি; মৃত্যুর পর যে-কোনো জায়গায়ই আমি প’ড়ে থাকতে পারি,-জঙ্গলে, জলাভূমিতে, পথের পাশে, পাহাড়ের চুড়োয়, নদীতে, মরুভূমিতে, তুষারস্তূপে। কিছুই অপবিত্র নয়, যেমন কিছুই পবিত্র নয়; কিন্তু সব কিছুই সুন্দর, সবচেয়ে সুন্দর এই তাৎপর্যহীন জীবন। অমরতা চাইনা আমি, বেঁচে থাকতে চাইনা একশো বছর; আমি প্রস্তুত, তবে আজ নয়। চ’লে যাওয়ার পর কিছু চাইনা আমি; দেহ বা দ্রাক্ষা, ওষ্ঠ বা অমৃত, বা অমরতা; তবে এখনি যেতে চাইনা; তাৎপর্যহীন জীবনকে আমার ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে আমি আরো কিছুকাল তাৎপর্যপূর্ণ ক’রে যেতে চাই। আরো কিছুকাল আমি নক্ষত্র দেখতে চাই, নারী দেখতে চাই, শিশির ছুঁতে চাই, ঘাসের গন্ধ পেতে চাই, পানীয়র স্বাদ পেতে চাই, বর্ণমালা আর ধ্বনিপুঞ্জের সাথে জড়িয়ে থাকতে চাই, মগজে আলোড়ন বোধ করতে চাই। আরো কিছুদিন আমি হেসে যেতে চাই। একদিন নামবে অন্ধকার-মহাজগতের থেকে বিপুল, মহাকালের থেকে অনন্ত; কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি আরো কিছু দূর যেতে চাই।’

আমিও ঘুমিয়ে পড়ার আগে আরো কিছুদূর যেতে চাই…আর এই প্রেরণা যিনি দিয়েছেন, আমাকে যিনি “নারী” থেকে “মানুষ” হবার চেষ্টায় রত হওয়ার উপলব্ধি দিয়েছেন সেই হুমায়ুন আজাদ স্যারকে শ্রদ্ধা।