null

পারভেজ আলমকে নিয়ে এক ভাই বেরাদার প্রশংসা করতে গিয়ে বললেন “তরুণ বুদ্ধিজীবী”। শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আর বিড়ি ফুঁকতে থাকলাম। পাত্তা না পেয়ে হতাশ লোকটি বললেন “এই হলো তোমগো সমস্যা, নিজেরে বেশি বুদ্ধিমান ভাবো তোমরা। অন্য কারো প্রশংসা শুনতে চাও না”। এবার হাসতে গিয়ে বিড়ির ধোঁয়া নাকের তালুতে উঠলো। আমার চোখে দেখা পরিণত হতে থাকা এক দার্শনিককে বুদ্ধিজীবীর কোর্তা পরাতে দেখে হতাশ হলাম আরকি! পারভেজ আলমকে কেবল বুদ্ধিজীবী বলে আমার পাত্তা না পাবারই কথা।

“মুসলিম জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই” – প্রিয় এ মানুষের প্রকাশিত প্রথম বইয়ের নাম। বইটা হাতে নিয়ে খুঁটে খুঁটে প্রচ্ছদ দেখলাম। মানুষ শরত চৌধুরি এবং ব্লগার অন্যমনস্ক শরতের ফটোগ্রাফিকে প্রচ্ছদ বানিয়েছেন শিবু কুমার শীল। শ্লার প্রচ্ছদটা নিজেই দার্শনিক হয়ে উঠেছে। শিবু মশাইয়ের প্রচ্ছদের শানে নুযুল না জানলেও আমি যেভাবে দেখেছি, সেভাবে দারুন বলবোই বলবো। -কিছু ঝাপসা আলো, বহুত রঙিলা জিনিস। কিন্তু স্পষ্টই করা যাচ্ছে না। আমার কাছে মনে হয়েছে এ ঝাপসা আলোর আড়ালে মুসলিম জগতের জ্ঞানীরা বসে আছেন। চোরের মতো কিংবা লজ্জায় আড়ালে বসে আছেন, থাকবেন। আর এর প্রতিবাদে বা আপসোসে উপর এবং নিচ থেকে উঠে এসেছে দু’টা কালো দাগ। এমন প্রচ্ছদ দেখার পর বই পড়ার একটা গাইড লাইন পেলাম মনে হলো। বইয়ের নাম নিয়ে কিছু কথা আছে, যা শেষে বলবো।

এবার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ভুমিকা টুমিকা ছাড়িয়ে ভেতরে চলে যাই…।

মোহাম্মদ পরবর্তী মুসলিম দুনিয়ায় ধাপে ধাপে আসা চিন্তাবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসকদের নিয়ে ক্রমানুসারে লিখে গেছেন। এরকম শৃঙ্খলা ভালো লাগলো। ভাবতে অবাক লাগে তীব্র অন্ধকার ভেদ করে কি তুমুল লড়াই করেই না নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে হয়েছিলো মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া কিছু মানুষকে। এ যুদ্ধ অনেক কঠিন ছিলো, যখন কিনা একের পর হত্যা করা হয়েছে মুসলিম নক্ষত্রদের। ভাবি, ওরা কতো সাহসীই না ছিলো। এ সময়ে একজন হুমায়ুন আজাদের বেঁচে থাকা মিথ্যা হয়ে যায়, অথচ আমরা কিনা সোডিয়াম আলোর সভ্যতায় বসবাস করি। আর ওইদিকে ধর্ম সৃষ্টির অনেক নিকটবর্তী সময়ে বর্বর, মূর্খদের সমাজে যে সাহস কাদিরিয়া, মুতাযিলা সম্প্রদায় কিংবা আল কিন্দি, আল রাজী, আল ফারাবি, ইবনে সিনার মতো মানুষরা দেখিয়েছেন, তা অভূতপূর্ব।
পুরো বইতে মূলত কিছু অমুসলিম অথবা অর্ধ মুসলিমকে এক প্রকার জোর করে মুসলিম পরিচয় দিয়েছেন লেখক। অথবা এ অমুসলিমদেরকে “মুসলিম জগতের” মানুষ বলে বলতে চেয়েছেন। কিন্তু সে সম্ভবনা নেই বললেই চলে। অথবা তাই হলো, তাহলেইবা কি হলো! ধর্মীয় সংখ্যাধিক্য বিচারে জগত কিংবা অঞ্চল কিংবা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল স্বীকৃতি দিয়ে সে তথাকথিক অন্ধকার চিন্তাভাবনার নবায়নই হলো। এটা সুন্দর না। যদিও সত্য হতে পারে। এমন চর্চা সুখকর নয়।

পড়তে পড়তে যতো সামনে গেছি, ততোই তথ্য পেয়েছি। তথ্যের বিন্যাসে পারভেজ আলম আসলেই নিপুন কাজ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে চিনি বলেই বলছি, যতো ভালো বলতে পারেন, পারভেজ আলম ততো ভালো লিখতে পারেননি। বইয়ের বেশিরভাগ অংশই বলার ঢংয়ে লিখে গেছেন। যতটুকু বলেছেন ততটুকু ঠিক আছে, কিন্তু যখনই উনি কিছু লিখতে গেছেন, তখনই খেই হারিয়েছেন। যেমন শেষেরদিকে “মুসলিমদের জ্ঞান চর্চায় পতন এবং বাঙলাদেশে এর প্রভাব” অংশে লেখকের বলার ঢং নেই। বরং রচনা লেখায় মনোযোগ দিয়েছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন।

তথ্যসমূহ উপস্থাপনা করতে গিয়ে লেখকের যতটুকু ভাষ্য ছিলো, ততটুকু পড়ার সময় বইয়ের ভূমিকার প্রথম দু’লাইনের কথা বারবার মনে হচ্ছিলো। “এ পুস্তক রচনার উদ্দেশ্য নেহায়েৎই ব্যবহারিক। মূলত বাস্তব কিছু প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই এই কাজে হাত দেয়া”। ‘মুসলিম’ জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ের ইতিহাস লিখতে গিয়ে একটুও উগ্র হননি লেখক। যদিও এ ধরনের ভূমিকায় লেখককে ঠিক মানিয়েছে বলে মনে হয় না। বইয়ে বর্ণিত কয়েকটি সম্প্রদায় এবং ব্যক্তির চিন্তা ভাবনায় যে নির্যাতন মুসলমানরা চালিয়েছেন, তার যথার্থ প্রতিক্রিয়া লেখক করতে পারেননি। উল্টো তিনি লিখতে চেয়েছেন মুসলমানদের কোন স্বর্ণযুগের কথা, যা একেবারেই অবান্তর। যারা ওই স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা তাদেরকে বাতিল করেছে হত্যা এবং নির্যাতনের মাধ্যমে। যেখানে মুসলমানরা ওই সময়কে স্বর্ণযুগ বা হীরকযুগ বলে স্বীকার করছে না, সেখানে লেখক কেন সেটা চাপিয়ে দিচ্ছেন, বুঝিনি। এটা কি অনিচ্ছার সৌজন্যতা, নাকি লেখক হিসেবে টিকে থাকার কৌশল, নাকি কল্পিত নির্যাতনের ভয়…! আমি আসলে কোনভাবেই শনাক্ত করতে পারছি না। তবে, এ যদি হয় কৌশল, তাহলে স্বাগত জানাই। কারণ লেখক পারভেজ আলমের টিকে থাকা দরকার। সহজিয়াবাদ, সুফিবাদ, বৈষ্ণববাদ পার করে আসা এ অঞ্চলের মানুষরা কতটুকু মানবতাবাদী হতে পেরেছে, তা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। এমন অবস্থায় থেকে লেখক যদি এ মৌলবাদি অঞ্চলে সুন্দর সহাবস্থান সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে চান, তবে সেটাই একটা বড় যুদ্ধ। যদিও ধর্মের অজ্ঞতায় সবই বাতিল হয়ে যায়।

পারভেজ আলমের ব্লগের লেখালেখিতে আমার ধারনা হয়েছিলো লোকটা অযথা লেখাকে টেনেটুনে লম্বা করেন। কিন্তু বই পড়তে গিয়ে খুব রাগ হলো এর উল্টো অবস্থানে গিয়ে। প্রচুর তথ্য সম্বলিত এ বইটিকে কোন মৌলিক ক্যাটাগরিতে ফেলতে পারিনি। কোনভাবেই এটাকে নির্বাচিত বিষয়ের ইতিহাসের বইও বলা যাচ্ছে না, আবার প্রবন্ধ সংকলনও বলা যাচ্ছে না। দু’টোর একটি রূপও লেখক দিতে পারেননি। মৌলিক ইতিহাসের বই হলে বইটি আরেকটু ছোট হয়ে আসতো এবং প্রবন্ধের বই হলে বইটির পরিধি আরো বিস্তৃত হতো। শেষেরটি হওয়ার খুব সুযোগ ছিলো। মনে করি তাই হওয়া উচিত ছিলো।

বই পড়তে পড়তে ঘোরাক্রান্ত হবার মজা নিতে ভালোবাসি। স্পষ্ট করে বলছি, প্রচুর বানান ভুল না থাকলে বইটি পড়ে আমি সর্বোচ্চ নেশা করতে পারতাম। বারবার তৎকালীন আরব সমাজে ঘুরে আসতে চেয়েছি। কিন্তু ভুল বানান আর ক্ষেত্র বিশেষে ভাষার অসংগতি আমাকে বারবার ব্যর্থ করেছে। লেখককে সুমধুর নিন্দা জানাচ্ছি নিজ সৃষ্টির প্রতি পর্যাপ্ত দরদ দেখাননি বলে।

মনে হয় তেতো কথা বেশি বলছি। হ্যাঁ, তাই বলবো। একজন পারভেজ আলমকে ভালো কিংবা উত্তম নয়, বরং উৎকৃষ্ট দেখতে চাই। তাই বলছি ভাষার ব্যবহারে আরো উন্নত হতে পারতেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে অক্ষরব্যবসায়ীদের কাছাকাছি চলে গেছেন। নামকরা ‘মুসলিম’ ব্যক্তিদের অনুচ্ছেদগুলো শুরুর সময় বিশেষনের যে ছড়াছড়ি, তাতে প্রত্যেকবারই মনে হবে এই বুঝি শ্রেষ্ঠ! কিন্তু না, এর পরের জনই শ্রেষ্ঠ। যদিও শ্রেষ্ঠত্বের মৌলিক পার্থক্য নিরূপনে ব্যর্থ হয়েছেন লেখক।

‘বেচারা’ শব্দটির কথা বলছি। পারভেজ আলমের গায়ে এ শব্দটি ঠাঁসানোর কিছুটা পথ খোলা আছে। তা হচ্ছে রেফারেন্সের ব্যবহারে। বইয়ের শেষে রেফারেন্সের পৃষ্ঠায় মোট ২৪টি সূত্রের উল্লেখ আছে। কিন্তু বিভিন্ন পৃষ্ঠার পাদটীকায় রেফারেন্সে উল্লেখ করেছেন সর্বসাকুল্যে ৫টি মৌলিক সূত্র। এটা কোন সমস্যা নয়, সমস্যা ভিন্ন যায়গায়। একটি সূত্র খুব বেশি ব্যবহার করেছেন, সমস্যা সেখানেই। বইটি নিয়ে কেউ বিরোধিতা করতে চাইলে এর অপব্যবহার হবে। মূল বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে ত্যানা প্যাঁচানির এ সুযোগ না দিলেও পারতেন। ব্লগে পরিচিত ‘একজন ভালো নাস্তিক’ রূপটা আসলেই পারভেজ আলমের শত্রু। তাই বলে কি সহনশীলতা দোষের কিছু? আরে না! তা নয়। কিন্তু সহনশীল পারভেজ আলম সহনশীলতার যে প্যাকেজ নিয়েছেন, তার মাঝে থাকা সরলতাটুকু একটি ভালো বিষয় নিয়ে বিরোধিতার সুযোগ করে দেয়। খারাপ বলতে এতটুকুই।

এবার বলবো নাম প্রসঙ্গে। নামটা ভালো লাগেনি মোটেও। মুসলিম জগতের লড়াইটা ধর্মতাত্ত্বিক। জ্ঞানতাত্ত্বিক নয়। আর বইয়ে বর্ণিত ঘটনাসমূহ মুসলমানদের আত্মহত্যার কাহিনী। যার কারণেই এখন মুসলমানদেরকে নিতে হয় নিকৃষ্ট সব কৌশল। পৃথিবীর যাবতীয় আবিষ্কারকে কোরআনের ভেতরে ঢুকানোর যে হাস্যকর প্রবণতা মুসলমানদের মধ্যে আছে, এইযে একটা অবিচারিক ডিফল্ট সিদ্ধান্ত- এসবের কোন প্রয়োজন হতো না। যদি মুসলমানরা তাদের জ্ঞানী সন্তানদের প্রতি অনায্য হত্যা এবং নির্যাতন চাপিয়ে না দিতেন, মুসলমানরা এখন দাপিয়ে বেড়াতে পারতো পৃথিবীময়। তাদের বিশ্বাসের কেশও কেউ ছিঁড়তে পারতো না।

পুরো বইয়ে ভালো লেগেছে ‘আল রাজি’, ‘পতন ও অন্ধকার যুগ’, ‘মুসলিমদের জ্ঞানচর্চায় পতন এবং বাঙলাদেশে এর প্রভাব’ এবং ‘পরিশিষ্ট’। সবচে’ ভালো লেগেছে ‘বইটা’। আমি এ ধরনের একটি বইয়ের অভাববোধ করতাম। মুসলমানদের মধ্যে যারা বিজ্ঞান এবং দর্শন নিয়ে কাজ করেছেন, একই মলাটে তাদের বেশিরভাগকে এক করা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রিয় পারভেজ আলমকে অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতা এরকম একটি জোশিলা কাজ করার জন্য। আশাকরি পরবর্তী বই এ সাফল্যকেও ছাড়িয়ে যাবে। দার্শনিক পারভেজ আলম বেড়ে উঠুক সুষম জ্ঞানে।

(এ প্রথম কারো বই পড়ে প্রতিক্রিয়া জানালাম)