[প্রাককথনঃ আমি ঠিক করেছি এবারের বই-মেলায় প্রকাশিত আমার লিখিত ‘ব্যবধান’ বই থেকে দুটো গল্প পর্যায়ক্রমে ব্লগে প্রকাশ করবো পাঠকদেরকে আমার বইটা সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারনা দেয়ার জন্যে। বুদ্ধিমান পাঠকদের কেউ কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, “ভাইজান, এটাতো প্রকারান্তরে আপনার বইয়ের প্রচার চালানো!”, তবে তা হয়ত অস্বীকার করবো না। আফটার অল, একজন লেখক তো চায়তেই পারে যে তার বইয়ের প্রচারণা হোক। পর্যায়ক্রমে তৃতীয় গল্পটা ব্লগে প্রকাশ করবো গতবছর প্রকাশিত ‘রঙ দিয়ে যায় চেনা’ বইটা থেকে যেহেতু এবারের বইমেলাতেও অনুপম প্রকাশনীর ষ্টলে বইটা পাওয়া যাচ্ছে। প্রাককথনের আরেকটা উদ্দেশ্য হলো পাঠকদেরকে পাশাপাশি এটাও জানানো যে, বিদ্যাপ্রকাশ প্রকাশনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত তারিখ অনুযায়ী ‘ব্যবধান’ প্রকাশ করতে সমর্থ হয়নি। আগের দেয়া ১৯~২০ ফেব্রুয়ারীর সময়সীমা বেড়ে এখন ২৪ ফেব্রুয়ারীতে গিয়ে ঠেকেছে। বইটা ২৪~২৫ ফেব্রুয়ারী নাগাদ মেলাতে পাওয়া যাবে বিদ্যাপ্রকাশ প্রকাশনীর ষ্টলে। প্রকাশক কথা দিয়েছেন এবারের প্রতিশ্রুত তারিখ কোনোভাবেই তারা মিস্‌ করবেননা। আরেকটা কথা। ব্লগে প্রকাশিত গল্পে টুকটাক বানান, গ্রামার ভুল থাকতে পারে। তবে প্রুফ্ররীড-এর সময় প্রকাশক সেসব ঠিক করে নিয়েছেন। কাজেই মূল বইতে বানান-টানান শুদ্ধ পাবেন বলে আশা করা যায়]

।। এক।।
কাঁপা কাঁপা হাতে দলিলটায় সই করলেন অনীল ঠাকুর। পৈত্রিক ভিটে। গত সাত পুরুষ ধরে তাদের বসবাস এখানে। বাবা মারা যাওয়ার সময় শীর্ণ হাতখানা বাড়িয়ে অনীল ঠাকুরের হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন- দুঃখ, কষ্ট যা-ই আসুক না কেন, প্রাণ দিয়ে হলেও এ ভিটে যেন রক্ষা করে তার ছেলে। পৈত্রিক ভিটে হারানোর কষ্টের চেয়েও বাবাকে দেয়া কথাটা রাখতে না পারার কষ্টটাই যেন আজ বার বার কাঁটার মত গলায় বিঁধতে থাকলো অনীল ঠাকুরের। রহিম শেখ কড়কড়ে পাঁচ শ’ টাকার অনেকগুলো বান্ডিল এগিয়ে দিলো তার দিকে- “টাকাগুলো ঠিকঠাক মত গুনে নাও ঠাকুর। দ্যাখো পুরোটা আছে কিনা। তিনবার করে গোনো। টাকা-পয়সা তিনবার করে গোনা নবীর সুন্নাত”। “জ্বি আঁজ্ঞে, তিনবারই গুনছি”। মলিন সুরে উত্তর দিয়ে তিনবার করেই টাকাটা গুনলেন অনীল ঠাকুর। রহিম শেখ ক্ষমাতাবান মানুষ। তাছাড়া পৈত্রিক ভিটে বিক্রির তথ্যটা আপাততঃ গোপন রাখারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। কাজেই তার সামনে সুন্নাতের বরখেলাপ করার সাহস করবেন কেন অনীল ঠাকুর?

প্রায় বছর খানেক আগেই ওপারে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনীল ঠাকুর। মেয়ের বিয়ে দেয়া আর জমি-জিরাত বিক্রির ঝামেলা শেষ করতেই বছর খানেক লেগে গেল। ওপারে তাদের কোনো নিকটাত্মীয় নেই। তবে কিছুদিন আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বনগ্রামে। ওপারে পশ্চিমবঙ্গে। নতুন আত্মীয়তা সেখানে। তবু তাদেরকে ধরেই ছোটখাট একটা জমি কিনেছেন তিনি সেখানে। এখানকার পৈত্রিক ভিটে এবং জমি-জিরাত সবই প্রায় পানির দরে ছেড়ে দিয়েছেন। ঠিকমত দাম পেলে বসতী জমি ছাড়াও হয়ত এক-কানি আবাদী জমি কিনতে পারতেন বনগ্রামে। কিন্তু সেটা হয়নি। সবকিছু বেঁচেকিনে এবং মেয়ের বিয়ে দিয়ে টাকা-পয়সা যা অবশিষ্ট আছে হাতে, তাতে বনগ্রামে বড়জোর টিনের জোড়া ঘর তুলে কোনোমতে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন তিনি আপাতত। কিন্তু সংসার যে কীভাবে চলবে তা তিনি জানেননা। তবে তিনি কর্মঠ মানুষ। ভগবান একটা না একটা কাজের ব্যবস্থা নিশ্চয় করে দেবেন। এতগুলো পেট নিয়ে নিশ্চয় তাকে উপোষ রাখবেন না ভগবান।

মেয়েটার খুব একটা ভাল বিয়ে হয়নি। জাতে পাত্রপক্ষ ঠাকুরদের চেয়ে নীচে। ক্ষত্রীয়। তাছাড়া এমন কোনো আহামরি চাকরি করেনা জামাই। রেলওয়ে গার্ড। সারারাত ডিউটি। তবে সরকারি চাকরি করে বলে বাড়তি দুটো পয়সা কামানোর সুযোগ আছে নাকি ওখানে। সম্বন্ধ এনেছিলেন মেয়ের মেসোমশাই। ওনাদের দুঃসম্পর্কের কেমন নাকি আত্মীয় হয় পাত্রপক্ষ। মেয়ের মা পরিষ্কার না বলে দিয়েছিলেন। অমন ঘরে কেন তিনি বিয়ে দেবেন তার একমাত্র আদরের মেয়েকে? তার মেয়ে কী পানিতে পড়েছে নাকি? মাত্রতো ক্লাস নাইনে পড়ে। তবে কেন এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেয়া? কতদিন চোখের জল ফেলেছেন মেয়ের মা। কিন্তু ঠাকুরের যে হাত-পা বাঁধা। ওপারের পাত্রের খবর তাকে কে এনে দেবে? একটা যে পাওয়া গেছে, সেটাই তো তার কয় পুরুষের পূন্যি! কন্যাদান বাবদ যৌতুকের অনেকগুলো টাকা দেয়া লেগেছে পাত্রের বাবাকে। তবু খুব একটা আফসোস নেই ঠাকুরের। একবার ওপারে চলে গেলে তখন নাকি মেয়ে বিয়ে দেয়া বেশ কঠিন। এপার থেকে সব বেঁচে-কিনে বা জায়গাজমি বদলাবদলি করে যাওয়া পরিবার শুনলে ওপারের মানুষরাও নাকি নাক সিঁটকায়। তবে যে কোনো কারনেই হোক, ওপারের পাত্রদের কাছে নাকি এপারের মেয়েদের বেশ চাহিদা। কাজেই সুযোগটা হাতছাড়া করেননি ঠাকুর। এপারে থাকতে থাকতেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন ওপারে। এখন বাকি সবাইকে নিয়ে ওপারে চলে যাওয়ার যাত্রাটা ভগবানের আশীর্বাদে ঠিকঠাক মত হলেই হয়!

অনীল ঠাকুর জীবনে কোনোদিন কল্পনাও করেননি তাকে দেশ ছেড়ে কখনও ওপারে চলে যেতে হবে। পরিচিতদের কেউ কেউ চলে গেছেন। অনীল ঠাকুর ইচ্ছে করেই তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি তারা যাওয়ার আগে। কারন-ফারনও জানতে চাননি। তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষ হলেও হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নিয়ে সামান্যও মাথা ঘামাননা। এটা তার নিজের দেশ। সাত পুরুষের জন্ম এখানে। তিনি নিজে যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গোপনে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন যুদ্ধকালীন সময়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বুক ফুলিয়ে ফিরে এসেছেন নিজের বাড়ীতে। স্বাধীন বাংলাদেশে তার অধিকার আর সবার মত। এদেশ যেমন একজন মুসলমানের, তেমন করে একজন হিন্দুরও। তিনি বাংলাদেশী। সেটাই তার বড় পরিচয়- না হিন্দু, না মুসলমান। তবে তিনি কেন অন্যদের দেখাদেখি ছোটখাট অযুহাতে দেশ ছেড়ে ওপারে চলে যাবেন? কাজেই, স্ত্রী বা আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কখনও ওপারের কিছু নিয়ে কোনো কথা বলতে এলে তিনি রীতিমত ফুঁসে উঠতেন।

সেই অনীল ঠাকুর স্বেচ্ছায় নির্বাসনের প্রস্তুতি নিলেন গোপনে গোপনে। কতদিন তিনি চোখের জল ফেলেছেন গোপনে! এই যে তার বাড়ী যেখানে তিনি জন্মেছেন, এই যে তার ছোট্ট শহর যেখানে তিনি দিনে দিনে বেড়ে উঠেছেন, এই যে তার বাড়ী থেকে সরকারি পাকা রাস্তায় ওঠার পথ যে পথ দিয়ে তিনি গত চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর ধরে হেঁটেছেন, সব কিছু ফেলে, লাখো স্মৃতিকে পায়ে দলে ওপারে চলে যেতে যে সীমাহীন মনকষ্ট তার আজ, তা নিয়ে ক্ষোভ আর অভিমানে কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে হয়না তার।

শুরুটা করলো আহাদ মিয়া। দেশে গন্ডগোল শুরু হলে ঠাকুরের প্রতিবেশী হরেন দত্ত ভারতে চলে গিয়ে স্বাধীনতার পর আর ফিরে এলোনা। তার জায়গায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে জায়গাজমি বদলাবদলি করে অনীল ঠাকুরের নতুন প্রতিবেশী হয়ে এলো আহাদ মিয়া। বেশ ধনী লোক। শহরে সবচেয়ে বড় বেকারীর দোকান দিলো। বেকারীর জন্যে সুবিশাল একটা কারখানা বানালো এবং বছর ঘুরতেই ঠাকুরের একতলা টিনের বাড়ীর পাশে সুদৃশ্য দোতলা দালান ওঠালো আহাদ মিয়া। ধনী প্রতিবেশী পেয়ে মনে মনে খুশীই হলেন ঠাকুর এই ভেবে যে, বিপদে-আপদে হয়ত খানিকটা সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে। কিন্তু আহাদ মিয়াই বরং উল্টে বিপদের সূচনাটা করলো। জমি ঘেরার নাম করে ঠাকুরের জমির সীমানার অন্তত চার, পাঁচ হাত ভেতরে এসে পাকা দেয়াল ওঠালো আহাদ মিয়া।

অনীল ঠাকুর নিম্নবিত্ত মানুষ। বাজারে ছোটখাট একটা মুদি দোকান আছে তার। আর আছে গোটা পাঁচেক দুধেল গাই। প্রচুর দুধ দেয় গরুগুলো। প্রতিদিন এত দুধ হয় যে, ঘি বানিয়ে দোকানে বিক্রি করা ছাড়াও দুধওয়ালারা বাড়ির ওপর এসে নিয়মিত দুধ কিনে নিয়ে যায়। আবাদী জমা-জমি যা আছে, তাতে বছরের চালের খোরাকটা মোটামুটি চলে যায়। তিনি দরিদ্র না হলেও এতটা বাড়তি টাকা-পয়সা তার নেই যা দিয়ে আহাদ মিয়ার বিরুদ্ধে তিনি মামলা লড়তে পারবেন। কাজেই, তিনি সালিশ ডাকেন। আরেক প্রতিবেশী রশিদ মিয়ার জমির মধ্যেও সামান্য একটু ঢুকে গেছে আহাদ মিয়ার দেয়াল। কাজেই রশিদ মিয়াকে সাথে নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্যদের কাছে আহাদ মিয়ার বিরুদ্ধে সালিশী বসান অনীল ঠাকুর।

স্থানীয় আমিন ডেকে মাপ-জোক করা হয় জমির। আমিন গোপনে পয়সা খেয়ে আহাদ মিয়ার পক্ষে মত দেয়- জমির মাপ নাকি ঠিকই আছে। জনসমক্ষেই ফুঁসে ওঠে আহাদ মিয়া। সালিশে উপস্থিত ঠাকুরসহ সবার উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে বলে ওঠে, “মালাউনের বাচ্চার কত্তবড় সাহস দেকেচেন! ‘মাল্‌’ টা কিনা আমার সাথে লড়তে এসেচে! শালাকে আমি এমন শিক্ষা দেবো যেন ল্যাজ তুলে হেঁদুদের দেশে পালানো লাগে”। ঠাকুরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রশিদ মিয়া আহাদ মিয়ার কথার মৃদু প্রতিবাদ করতে গিয়েও শেষপর্যন্ত সাহস করেনা। আহাদ মিয়ার শান-শৌকত ও প্রাচুর্য্যের তুলনায় মধ্যবিত্ত রশিদ মিয়া কোন্‌ ছার? তাছাড়া আহাদ মিয়া এলাকার অন্যতম বুজুর্গ। একেবারে পাক্কা মুসলমান। চোখে সুরমা, মেহেদী মাখানো খুবসুরত লম্বা দাঁড়ি, পরনে পা অবধি লম্বা সৌদি জোব্বা এবং মাথায় জিন্নাহ টুপী। স্থানীয় গণ্যমান্যদের কাছে সেকারনেই যথেষ্ট সমীহের পাত্র আহাদ মিয়া। কাজেই তাকে থামানোর চেষ্টা করেনা কেউ। বরং একরাশ লজ্জা ও অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে মুখ নীচু করে সালিশের স্থান ত্যাগ করেন অনীল ঠাকুর।

অনীল ঠাকুর প্রাথমিকভাবে হাল ছেড়ে দিলেও রশিদ মিয়া ছাড়েনা। জেলা শহর থেকে সরকারি বড় আমিন ডেকে আনা হয়। স্থানীয় আমিনকেও খবর দেয়া হয়। নতুন করে ফের জমির মাপ-জোক করা হয় স্থানীয় গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে। এদফা দেখা যায়, আহাদ মিয়ার পাকা দেয়াল তার জমির নিজস্ব সীমানা ছাড়িয়ে সত্যি সত্যিই রশিদ মিয়ার ও ঠাকুরের জমির মধ্যে ঢুকে গেছে। সালিশে আহাদ মিয়াকে নির্দেশ দেয়া হয় দেয়াল ভেঙ্গে মাপমত পিছিয়ে যেতে। আহাদ মিয়া রশিদ মিয়ার জমির দিকের দেয়াল ভেঙ্গে দুহাত পেছনে সরে এসে নতুন দেয়াল ওঠালেও ঠাকুরের দিকের দেয়াল অবিকল তেমনটাই রেখে দেয়। নিজের সমস্যা মিটে যাওয়ায় শান্তিপ্রিয়, নিরীহ ও দূর্বলমনা রশিদ মিয়া ঠাকুরের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হলেও ঠাকুরের পক্ষ হয়ে পূনর্বার সালিশী বসানোর দেন-দরবার করতে ততটা আগ্রহ দেখায়না। এরপর অনেকদিন পর্যন্ত স্থানীয় গণ্যমান্যদের দূয়ারে দূয়ারে একা একাই ঘুরে ঘুরে এক সময় হাল ছেড়ে দেন অনীল ঠাকুর। যতটা না জমি হারানোর দুঃখ, তার চেয়েও ওপার থেকে বদলাবদলি করে আসা ভীনদেশী আহাদ মিয়ার কাছে পরাজিত হওয়ার অপমান ও সন্মানহানীর লজ্জা যেন কুরে কুরে খায় অনীল ঠাকুরকে। এই প্রথমবারের মত তার মনে হয় তিনি আসলে একজন হিন্দু; এবং সম্ভবত তার অনেক পরে এসে একজন বাংলাদেশী।

অনীল ঠাকুর সবচেয়ে বেশী ভেঙ্গে পড়েন তার দুধেল গাইগুলোর মৃত্যুতে। কে যেন শত্রুতা করে রাতের আঁধারে গোয়াল ঘরে ঢুকে গরুর খৈল-ভূষিতে এন্‌ড্রিন বিষ মিশিয়ে দিয়ে যায়। পরদিন সকালে গরুগুলোকে মৃত অবস্থায় দেখে অনীল ঠাকুরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। শুধু যে নিয়মিত ইনকামের একটা রাস্তা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় সেজন্যে নয়, বরং ধর্মীয় কারনে গরুগুলোর সবিশেষ যত্ন নেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে যেন নিজের সন্তানের মতই স্নেহ করতেন অনীল ঠাকুর। কাজেই, দুঃখ-শোকে তিনি প্রায় পাগলের মত হয়ে যান। এরপর শোক সামলে উঠে রশিদ মিয়ার পরামর্শে থানায় জিডি করতে যান তিনি। ওসি কেইস নিলেও তাৎক্ষণিক কাউকে সরজমিনে তদন্ত করতে পাঠায়না। সন্দেহভাজন হিসেবে আহাদ মিয়ার সংশ্লিষ্টতার কথা কেইসে উল্লেখ করার অনুরোধ করা হলে পুলিশ তাতেও অপারগতা জানায়। বরং তদন্তসাপেক্ষ একটা সাধারন শত্রুতামূলক কেইস হিসেবে এটাকে নথিভূক্ত করা হয় থানায়। পুলিশ যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনীল ঠাকুরকে দেখিয়ে দেয়- তিনি একজন হিন্দু। দেশের ওপর থেকে মনটা সেদিনই চিরদিনের জন্যে উঠে যায় অনীল ঠাকুরের। সেদিন রাতেই খুব ঠান্ডা মাথায় তিনি সিদ্ধান্তটা নেন। দেশ ছেড়ে ওপারে চলে যাবেন। গোপনে এবং তা চিরদিনের জন্যে। নিভৃত নির্বাসন।

।। দুই।।
গতকাল বিকেল থেকেই মনটা ভীষন খারাপ মিজানের। খুব কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে সে। অশোক বারবার করে অনুরোধ করেছে ব্যাপারটা কাউকে না জানাতে। ভগবানের কিরে দিয়েছে, মা কালির কিরে দিয়েছে, এমনকি শেষপর্যন্ত আল্লাহরও কিরে দিয়েছে যেন মিজান কথাটা কাউকে না জানায়। অশোকরা ভারতে চলে যাচ্ছে। আজ রাতে। চিরদিনের জন্যে। আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবেনা ওদের সাথে। যদিও বড় হয়ে এখানে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অশোক, কিন্তু মিজানের শিশুমনও বুঝে গেছে যে এটা আসলে ‘ওয়ান ওয়ে জার্নি’। সে জানে অশোকরা আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা। অশোকের দিদির এদেশে বিয়ে হলেও না হয় একটা কথা ছিল। দিদিকে দেখতে অশোক হয়ত এদেশে আসতো। কিন্তু সেটাও তো হয়নি। কাজেই এটা যে কেবল স্বান্তনা, সেটা ঠিকই বুঝে যায় মিজান।

মিজান ক্লাস ফোর-এ পড়ে। অশোকও তাই। ওরা দুজনই স্থানীয় সরকারি বয়েজ স্কুলের ছাত্র এবং প্রতিদিন একসাথেই স্কুলে যায়। জন্ম থেকেই পাশাপাশি বড় হচ্ছে দুজন। অশোকদের পরিবারের সাথে খুবই ঘনিষ্টতা মিজানদের পরিবারের। মিজানের কোনো বড় বোন নেই। আশোকের দিদিই যেন তার বড় বোন। কত আদর করেন দিদি তাকে। অশোকের সাথে মিজানের কখনও ঝগড়া হলে দিদি সবসময় মিজানের পক্ষ নেন। সেই দিদির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে খুব মন খারাপ হয়েছিল মিজানের। আর যখন শুনলো, বিয়ে এদেশে হচ্ছেনা, হচ্ছে ভারতে, তখন কী যে মন খারাপ হয়েছিল মিজানের! প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল সে। মিজানের অনেক বড় কোনো ভাই থাকলে দিদির সাথে নিশ্চয় তার বিয়ে দিয়ে দিতো সে যেন দিদি সারাজীবন তাদের বাড়ীতে থাকতে পারেন।

গতকালও অশোকদের বাড়ীতে গিয়েছিল মিজান। কাকিমা মানে অশোকের মা বাতাসা, মুড়কি কত কিছু খেতে দিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু মিজানের মন এত খারাপ ছিল যে সে তেমন কিছুই খায়নি। কাকিমা মিজানের মাথায় বার বার কেন জানি হাত বুলালেন। ঝরঝর করে দুচোখের পানি ফেললেন। মিজান সবই বুঝলো। কিন্তু কিচ্ছু বললো না মুখে। অশোক আল্লাহর কিরে দিয়েছে। নইলে কাকিমাকে অন্তত মিজান জিজ্ঞেস করতো কেন ওনারা বাড়ীঘর ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন। অশোকদের বাড়ীর উঠোনে খুব বড় করে নতুন একটা মাটির চূলা বানানো হয়েছে গর্ত খুঁড়ে। মিজান ফিস ফিস করে অশোকের কাছে জানতে চেয়েছিল বাড়ীঘর ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার আগে আগে নতুন করে চূলা বানানোর রহস্য। অশোক জানিয়েছিল এটা নাকি বাড়তি সাবধানতা। লোক দেখানো। ওরা যে দু’একদিনের মধ্যে সবকিছু বেঁচেকিনে ওপারে চলে যাচ্ছে, তা জানলে শত্রুরা নাকি ওদের ক্ষতি করতে পারে। সেকারনেই বাবার বুদ্ধিতে অশোকের মা নতুন চুলা বানিয়েছেন বাড়ীর উঠোনে।

অশোকদের শত্রু যে আহাদ মিয়া, সেটা অন্তত মিজান জানে। জমি ঘিরে পাকা দেয়াল ওঠানো নিয়ে কত গ্যাঞ্জাম হলো! অশোকদের জমিসহ ওদের জমির খানিকটাও দেয়াল তুলে ঘিরে নিয়েছিল আহাদ মিয়া। অশোকের বাবা আর তার আব্বা মিলে তখন কত্ত মিটিং করলেন দফায় দফায়! এলাকার লোকজন নিয়ে সালিশও বসালেন। মিজান বরং খুশীই হয়েছিল। কেননা মিটিং-এর সুবাদে নিয়মিত’র তুলনায় অনেক বেশীবার তখন অশোকের সাথে তার দেখা হতো দিনেরাতে। দিদির সাথেও দেখা হতো। দিদি এমনিতেই ঘন ঘন ওদের বাসায় আসতেন মিজানের মায়ের সাথে গল্প করতে। জমাজমির গ্যাঞ্জামে আসা-যাওয়া আরও বেড়ে গিয়েছিল। মিজান কী যে খুশী হতো দিদি ওদের বাসায় এলে! সেই দিদি বিয়ে হয়ে ওপারে চলে গেল। আর এখন চলে যাচ্ছে অশোক, তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা, তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা, তার খেলার সাথী এবং তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু।

অশোক আল্লাহর কিরে দিয়েছে। কাজেই মিজান চিৎকার করে কাঁদতে পারলোনা ওদের বিদায়ে। কাকিমা’র শাড়ীর আঁচল ধরে অনুরোধ করতে পারলোনা যেন ওনারা ভারতে চলে না যান। আব্বা-মা’কে মিজান অনুরোধ করতে পারলোনা যেন কাকা আর কাকিমাকে তারা যেন ধরে রাখেন। যেন যেতে না দেন ওপারে। এমনকি ওদের বিদায়ের ক্ষণে বাড়ীর গেইটে দাঁড়িয়ে ওদেরকে চোখের শেষ দেখাটাও দেখতে পারলোনা সে।

অশোক তার সবগুলো ভাল খেলনা মিজানকে দিয়ে দিয়েছে। স্মৃতি হিসেবে। মিজান যেন খেলনাগুলো যত্ন করে রেখে দেয়- যাতে খেলনাগুলো দেখে অন্তত অশোকের কথা মনে পড়ে তার। মিজানও তার ভাল খেলনাগুলো অশোককে দিতে চেয়েছিল। অশোক নেয়নি। ওরা নাকি প্রায় খালি হাতেই ওপারে যাচ্ছে। কোনো জিনিষপত্র সাথে নেয়া যাবে না। বাবা-মা তেমনটাই বলে দিয়েছেন। সন্ধ্যার আগ দিয়ে খেলনাগুলো হাতে করে বাড়ীতে ফিরে আসে মিজান। অশোকের খেলনাগুলো তার মায়ের অপরিচিত নয়। মা জিজ্ঞেস করেন খেলনাগুলো তার কাছে কেন। উত্তরে মিজান এই প্রথম মিথ্যা বলে তার মা’কে, “অশোকের দিদি নাকি ওপার থেকে অনেকগুলো নতুন খেলনা পাঠিয়েছেন ও’র জন্যে। পুরোনো খেলনাগুলো সেজন্যেই আমাকে দিয়ে দিলো অশোক”।

অশোকদের ওপারে যাওয়ার যাত্রা, এদেশ ছেড়ে চিরদিনের নিভৃত নির্বাসন যেন নির্বিঘ্ন ও নির্ঝঞ্জাট হয়; শত্রুতো দূরে থাক, কাক-পক্ষীও যেন তা টের না পায় তা নিশ্চিত করতে নিজের মায়ের কাছেও অবলীলায় মিথ্যে বলে মিজান। নিজের গৃহস্থালী কাজে ব্যস্ত থাকায় মা অতটা লক্ষ্য করেননা। তবে একটু খেয়াল করলেই তিনি হয়ত পরিষ্কার দেখতে পেতেন মিজানের দুচোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তখন।

[সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তবে গল্পের কিছু কিছু বিষয় খানিকটা অতিরঞ্জিত এবং চরিত্রগুলো কাল্পনিক]

পরবর্তী গল্পঃ রায়ট