পূর্ববর্তী পর্ব (পর্ব ৯)

ক্লিওপেট্রা যে-দিন অগাস্টাস সিজারের আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমনের কথা প্রথম শুনেছিলো, তার কি মনে হয়েছিলো জানি-না; যুদ্ধবহর নিয়ে অগাস্টাস যখন মাঝ সমুদ্রে, অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত আলেকজান্দ্রিয়ার অধিকার হারাতে হবে কিংবা ছেড়ে যেতে হবে ভেবে কি মনে হয়েছিলো ক্লিওপেট্রার, সেটা হয়তো জানার উপায় আমার নেই; তবে এইটুকু বলতে পারি, শহীদুল্লাহ হলে যেদিন পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়া স্টুডেন্টদের হল ছাড়ার নোটিশ দেয়া হলো, সেদিনের সে-কষ্ট আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের দুঃসংবাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমি এবং আমার মত অসংখ্য স্টুডেন্টদের নির্ভয় আশ্রয়স্থল, আমাদের রাজ্য, আমাদের রাজত্ব, যেখানে আমরা সবাই রাজা, সেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল। রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাজা যেমন মানতে পারে না, একদিন তাকে এই রাজত্ব ছেড়ে চলে যেতে হবে; আমিও তেমনি ভাবতে পারছিলাম না আমাকেও আমার এই রাজত্ব ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু বাস্তবের রাজার মত আমার কোনো ধরণের সেনাবাহিনী না থাকায় অথবা হল জীবনে একটা দিনের জন্যও নোংরা রাজনীতি না করার খেসারত হিসেবে যথাসময়ে আমাকে হল ছেড়ে যেতেই হবে।

কত অনাচার, কত অনিয়ম, কত অভিযোগ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। অথচ, আজ যখন ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে তখন বুঝতে পারছি, এই অভিযুক্ত অপরাধী বিশ্ববিদ্যালয়ই কি বিশাল অর্থবহ আমার কাছে, আমাদের কাছে। এই বাংলার শত শত মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে থাকে, অনাহারে থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথম খাবার ‘অন্ন’, সেটিই তাদের পূরণ হয় না, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তাদের জোটে না। তবু গরীব এই দেশে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানেরও পরে আসা ‘শিক্ষা’র ব্যবস্থা আমার হয়েছে, অনাহারী-ক্ষুধার্ত মানুষের অন্নের টাকায় আমার শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। হয়তো ধারণা করা হয়, একজন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকার বিনিময়ে যদি শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে দশজন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা যাবে। সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় দেশ আমাকে পড়ায়, খেটে খাওয়া মানুষ আমাকে পড়ায়, মাসিক চোদ্দ টাকার বিনিময়ে।

হলজীবনের শেষদিনগুলোতে এসে গভীর রাত্তিরে একা একা বেরিয়ে পড়ি ক্যাম্পাসে। তারপর রাতের নিস্তঃব্ধতায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, দেখি আমার দোয়েল চত্বর, আমার শহীদ মিনার, রাস্তায় ধূলিমাখা আল্‌পনা, কলাভবন আর পলাশীর মোড়; শাহবাগের মোড়ের কৃষ্ণচূড়া, রমনা পার্ক, টিএসসির মোড়ে প্লাস্টিকে ঢাকা চায়ের দোকান; লাইব্রেরীর দেয়ালে ছাত্র ইউনিয়নের পোস্টার, হাকিম চত্বরের বড় গাছটি; যৌক্তিক-অযৌক্তিক স্লোগানে লেখা দেয়ালে দেখি ‘নিপাত যাক’, দেখি ‘জেগে উঠো’, দেখি ‘মানি না, মানবো না’, দেখি ‘বন্ধ কর’, দেখি ‘মুক্তি চাই’, দেখি ‘ফাঁসি চাই’। রাতের নির্জনতায় ভাবি, এমন করে আর দেখা হবে না, সবকিছুকে বিদায় দিয়ে সময় হয়েছে চলে যাবার, ছেড়ে যাবার। বিদায় চারুকলা, বিদায় মলচত্ত্বর, বিদায় কার্জন হল, বিদায় মোকাররম ভবন। ভালো থেকো তোমরা, ভালো থাকুক আমার বিশ্ববিদ্যালয়।

একদা পরাক্রমশালী, পরাজিত রাজ্যহারা রাজা যেমন বিধ্বস্ত হয়ে অন্যে রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে, তেমন করে আমি ঢাকা শহরের একপ্রান্তে গিয়ে উঠি এক নিভৃত কক্ষে। প্রথম দিনেই বাড়ীওয়ালার নির্দেশ, ‘রাত এগারোটার মধ্যে বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যাবে, তার আগেই বাসায় ফিরতে হবে’। হায়, জীবন! যে-পাখি সমস্ত আকাশ তার নিজের রাজ্য বানিয়ে উড়ে বেড়িয়েছে এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত, সে-পাখি আজ বন্দী হবে ছোট্ট খাঁচায়; যে-দুঃসাহসী যোদ্ধা মৃত্যুদণ্ডের ভয় পদদলিত করে আঘাত হেনেছে রাজসিংহাসনে, তাকে আজ দেখানো হচ্ছে তীর-ধনুকের ভয়। কিন্তু ঢাকার বাড়ীওয়ালা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেনারেল, বিশ্বের সর্বোচ্চ সংবিধান। কোন ধরণের বাছ-বিচার ছাড়াই নরকে যাবার জন্য ঢাকায় একটি বাড়ীর মালিক হওয়াই যথেষ্ট।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে চলে আসার পরও বিভিন্ন উপলক্ষ্য-অনুপলক্ষ্যে, কারণে-অকারণে ক্যাম্পাসে যেতে থাকি; একবার যে এর আঙ্গিনায় গেছে তার পক্ষে আর মুখ ফিরিয়ে নেয়া যে সম্ভব নয়।ক্ষুদ্র এক তথাকথিত বাসা কিংবা ফ্ল্যাটে জীবন যেন মানায় না। সমুদ্রে যার বিচরণ, শিশিরে তার চলবে কেন? তবুও জীবনের সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিয়ম অনুযায়ী জীবন চলে যায়। ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য কোথাও আছে, কোথাও নেই। বুঝতে পারি, শত চেষ্টা করলেও আমি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পারবো না। ছাত্র জীবন শেষ হয়ে গেল। রাস্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল রংয়ের বাস দেখে কখনো কখনো স্মৃতিতে ফিরে যাই; তাকিয়ে থেকে দেখি, কি প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসে মেতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। মনে হয়, ডেকে জিজ্ঞেস করি কেমন আছে কার্জন হল, কেমন আছে দোয়েল চত্বর। কত ইতিহাস, কত কাব্য মহাকাব্যের জন্ম দেয়া এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আমার ঝাপসা চোখ পরিষ্কার হয়ে উঠতে উঠতে দেখতে পাই, ইতিমধ্যে তারা অনেকদূর চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। আর এদিকে আমাকে ছুটতে হবে জীবনের পথে, একেবারে বিপরীত দিকে।

সময়ের চিরন্তন নিয়মগুলো মেনে চলে সামনে হাঁটতে থাকে জীবন। শুধুই এগিয়ে যেতে চাওয়া, শুধুই এগিয়ে যাওয়া। এর মাঝে অনেক সময় চলে গেছে, অনেক চাকুরী করে ফেলেছি, কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনও করেছি। পূরণ হয়েছে অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার, অনেক স্বপ্নের; আবার অপূর্ণ রয়ে গেছে অনেক ইচ্ছা। উত্থান-পতনের জীবনেও এসে গেছে অনেক পরিবর্তন। কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের ধারায় পরিবর্তিতরুপে একসময় আবার ফিরেও এসেছি কল্পরাজ্যের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। তারপর আবারো সামনে এগিয়ে চলা। কেটে গেছে অনেক সময়। তারপর হঠাৎ একদিন অনিচ্ছাকৃত এক আগামীকে বরণ করে নেয়া। জীবনে অনেক পুস্তকের অনেক বাক্য আমাকে পড়তে হয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারকারী বাক্য হয়তো- ‘ভিসা টাইপ এফ১, ইউনাইটেড স্টেটস্ অব অ্যামেরিকা’। অ্যামেরিকান এম্বাসী থেকে ভিসা হাতে নিয়ে ভাবি, চোদ্দ টাকার ঋণ কি আমার শোধ হয়েছে। কোনো চুক্তির পাতায় লেখা নেই এ-ঋণের কথা, তবু লেখা আছে বিবেকের পাতায়। এ-ঋণ কখনো শোধ হবার নয়, শোধ করা যায় না; তবে স্বীকার কিংবা অস্বীকার করা যায়।

হবেই না-হয় যানজটে আটকা পড়ে থাকতে, ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে; আমার মা-বোন-বউ-মেয়েকে দেখে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বখাটে না-হয় বাজে কথাই বলবে, তাই বলেতো আমি পালিয়ে থাকবো না, আমার মত আরেকজনকে এইসব অনাচারে একা ফেলে রেখে দূরে থাকবো না। অনেক কিছুই থাকবে না, অনেক কিছুই হয়তো পাবো না। কিন্তু দোয়েল পাখিতো পাবো, বর্ণমালাতো পাবো, মায়ের ভাষাতো পাবো। কলমির ফুল, বর্ষার কদমতো পাবো। আমি এদেরকে ছেড়ে কি করে থাকবো; আমি কেমন করে ছেড়ে থাকবো সবুজ ধানের মাঠ, সাদা বক, শীতের কুয়াশা, মাছরাঙ্গা আর এক-ঝাঁক পায়রা; কেমন করে ভুলে থাকবো খেজুরের রস, শালিক পাখি, রসুনের বাগান। আমার রক্তের মাঝে বয়ে চলে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা; আমার শিরায় শিরায় বৈশাখী মেলা, বসন্তের মাতাল সমীরণ; আমার নয়ন জুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ, তারা ভরা রাত। আমার জন্য অপেক্ষা ক’রো বাংলাদেশ, অপেক্ষা ক’রো টিএসসি চত্বর, অপেক্ষা ক’রো বকুলতলা; আমি আসছি, ফিরে আসছি, ফিরে আসছি আমার অবাক রূপসী বাংলায়।

(সমাপ্ত)

[email protected]
February 21, 2011