জীবনের ২০টা বছর পার করে দিয়ে ২০টা বছর হা হুতাশ করে এবার অনেক আশা আকাঙ্খার পর আমি একুশে বইমেলায় যাবার একটা ভালো সুযোগ পাই। যদিও আরেকটু হলে এই সুযোগও পিছলায়ে যেতে লাগসিল! যা হোক, সে কথা পরে হবে। আগে আমার প্রথম দিনের প্রথম বইমেলা দর্শনের বয়ান দেই।

এমনিতেই বইয়ের ব্যপারে আমি ইকটু আধপাগল টাইপ । বড় কোন লাইব্রেরী, বইয়ের দোকান অথবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ীতে গেলেও আমি হা করে চারপাশে উদ্ভ্রান্তের মত তাকাতে থাকি। সেখানে বইমেলায় গেলে কি অবস্থা দেখা দেবে তা চিন্তা করে আমি আগে থেকে নিজেকে অটো সাজেশন দেয়ার চেষ্টা করছিলাম যে পাগলামি করব না, উদ্ভ্রান্তের মত আচরণ করব না ।

আমি প্রথম বইমেলায় গেলাম ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখ সম্ভবত বিকাল ৪.৩০এ, আমার আরেক ক্লাসমেটকে সাথে নিয়ে । বইমেলায় ঢোকার আগেই আমাদের অতি প্রিয় রায়হান ভাইকে একটা ফোন কল দিয়ে রাখলাম, তিনি তখন মেলায় অনুপস্থিত। মেলায় এসেই তিনি আমায় কল ব্যাক করবেন এ প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলাম । টি এস সি প্রাঙ্গনে এসেই আমার মাথায় আকাশ ভাঙার দশা!! হায় কপাল! এ কই আসলাম গো! এত বড় লাইন ফালায়ে মেলায় ঢুকতে হলে তো আর বই দেখতে হবে না! সিকিউরিটি গেইট পার হয়েই বসে পড়তে হবে! কি আর করা! চিরচরিত স্বভাব অনুযায়ী লম্বা একটা পল্টি দিলাম! টি এস সি থেকে লাইনের বাইরে দিয়ে হাটতে হাটতে সিকিউরিটি গেইটের থেকে ইকটু দূরে থাকতে লাইনে দুটো সোজা সরল মানুষ খুঁজে নিয়ে একটা ছোট্ট গ্যাপ বের করে আস্তে গা গলিয়ে দিলাম!! পিছন থেকে দু চারটা সুশ্রাব্য বাক্য আসা শুরু করছিল। মুখে তালা দিয়ে হজম করে নিলাম! ইকটু ছাড় তো দিতেই হবে! বইমেলা বলে কথা! অন্য কোথাও হলে এত বড় দূর্নীতি করেও দুচারটে শুনিয়ে দিতাম!

যা হোক, পল্টি মেরে সিকিউরিটি গেইট পার হবার পর প্রথমেই দেখি যে রাস্তার উপরেই সারি সারি স্টল। এ্যা বাবা! বই মেলা কি ইরাম রাস্তার উপ্রেই হয় নিকি!! তার উপর দেহি সব শেখ সাবের ছবি দ্যাহা যায়! আগানো শুরু করলাম। এর মাঝে রাস্তার উপরেই দুচারটে স্টলে উকি দিয়ে দেখলাম এবং বুঝতে পারলাম এরা সব নীলক্ষেত প্রডাকশন! এরপর একটু আগানোর পরই দেখি মেলার আসল চত্বরের গেইট উকি দিচ্ছে। ওটা সম্ভবত শেষের গেইট, দোয়েল চত্বরের দিকেরটা শুরুর গেইট। যা হোক, ঢুকে পড়লাম সাথের ক্লাসমেটকে নিয়ে। ঢুকেই বামদিকে উকি দিলাম (ডানে সম্ভবত মসজিদ)। বামে প্রথমেই একটা অপ্রয়োজনীয় স্টল। তাই তার মেমরী মাথা থেকে ডিলিটেড ( এ পর্যন্ত চারবার মেলায় গেলাম, তবুও ঐ স্টলের নাম মনে নাই!) এর পরেরটাই সময় প্রকাশনী । প্রথম দিন এইটুক পর্যন্ত সব ঠিক ছিল, এরপর থেকেই আবার হিস্টিরিয়া সিন্ড্রোম শুরু হয়ে গেল! মানুষের যন্ত্রণায় বই দেখতে অসুবিধা হলেও ধাক্কা ধাক্কি করে ফাঁক ম্যনেজ করে স্টলের সামনা সামনি ঢুকে পরছিলাম এবং উদ্ভ্রান্তের মত বই দেখতে লাগলাম। ধাক্কা ধাক্কি চরম পর্যায়ে পৌছানোর উপক্রম হলে ওই স্টল থেকে একটা করে ক্যাটালগ নিয়ে বের হয়ে পরছিলাম। আমার এক স্টল দেখতে দেখতে আমার বন্ধুর ১০টার মত স্টল দেখা শেষ! এরপর কিছুক্ষনের জন্য তাকে হারিয়ে ফেললাম! ঐ চিপা গলিটুকু পর্যন্ত তাও সব ঠিক ছিল, চিপা গলিটুকু ফেলে যেই নজরুল চত্বরে এসে পরলাম সেই মাথা খারাপ হবার যোগাড়! এত গলি! কোন দিকে ছিলাম, কোন দিকে গেলাম, কোন দিকে শুরু আর কোন দিকে শেষ স-অ-ব আউলে গেল!! লে বাবা! এ তো দেহি মাছের বাজার থিকা খ্রাপ অবস্থা! এহন কুন দিকে যাই!! পুরাই পাগল হবার দশা!! এবার মাথা পুরা আউলে গেল, অটোসাজেশন পুরা বৃথা গেল। উপরে স্টলের নামের দিকে তাকায়ে তাকায়ে হাটতে হাটতে নিচে কোন দিকে যাচ্ছি তার কোন খেয়াল নাই! ডান দিকে তাকিয়ে থেকে বাম দিকে যাই, বামে যেয়ে আবার মনে হয় – আরে! ডানে তো একটা ভালো স্টল ফেলে আসলাম! আবার ডানে দৌড়! তার উপর আকাশের দিকে তাকায়ে স্টলের নাম দেখতে দেখতে মুখ হা হয়ে আছে! সামনে তাকায়ে পিছনে হাটতেসি! স্টলে ঢুকে বই দেখে বড় বড় চোখ করে তাকায়ে আছি। এভাবে চলতে চলতেই অনেক স্টল পারি দেবার পর একটা বই কিনেই ফেললাম ( প্রথম দিন আমার কেনার কোন ইচ্ছা ছিল না, ভাবসিলাম না কিনে প্রথম দিন দেখেশুনে বের হয়ে যাব।)। আমার প্রথম একুশে বইমেলা থেকে কেনা প্রথম বই ‘দর্শনের ইতিহাস’ (লেখক- উইল ডুরান্ট, অনুবাদ- আবুল ফজল, দিব্যপ্রকাশ)।

আর কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটির পরেই রায়হান ভাইয়ের ফোন, সে উপস্থিত এবং আমাকে শুদ্ধস্বরে যাবার আমন্ত্রণ দিল। এই শুদ্ধস্বর আমি আর খুইজা পাইনা! আবার রায়হান ভাইরে ফোন! তারপর তার থেকে রাস্তার ডিটেইল(!!) নিলাম। অন্যপ্রকাশের গলি (৪বার মেলায় যাবার পরও যেই একটা মাত্র স্টলে আমি এখনো একবারও যাই নাই) দিয়া ঢুইকা মাওলা ব্রাদার্স ফালায়ে আরো ৩টা স্টল পরে শুদ্ধস্বর! অনেক কষ্ট, আনেক ধাক্কাধাক্কি,অনেক হাতাহাতির পর সেই শুদ্ধস্বর! রায়হান ভাইয়ের হিরু মার্কা চেহারা খানা দেখতে পাইয়াই আমি একখানা লাজুক লাজুক টাইপ হাসি দিয়া দিলাম। রায়হান ভাইয়ের সাথে চোখাচোখি হবার আগ পর্যন্ত ভাবলাম যে প্রথম দর্শন হবে, একটু মুড নিয়া যাই, দাড়ি টারিও ভালো গজাইসে, মুডে থাকলে রায়হান ভাই না-ও চিনতে পারে। তারপর সারপ্রাইজ দিমু। তারপর সামনে যাবার পর আর ওসব মনে নাই। ভাব টাব কই গেল! ওখানে গিয়ে লেখক সাহেব কে পেয়ে অটোগ্রাফ সহকারে দ্বিতীয় বই খানাও কিনে ফেললুম। এরপর রায়হান ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থেকে কিছু অতিপরিচিত কিন্তু অপরিচিত মুখের জন্য অপেক্ষা। প্রথমেই তানভীর ভাই (স্পর্শ) তারপর মামুন ভাই (মাহবুব সাঈদ মামুন) তারপর রণদা (রণদীপম বসু)। প্রথম দিনের দর্শন এ তিন জনের সাথেই । সবার সাথেই হালকা পাতলা কথা বার্তা হল । রণদা গ্রুপ ছবি তুললেন (আমাকে চরম বাজে দেখাচ্ছে ঐ ছবিতে, বাস্তবে মনে হয় আমার চেহারা আরো খারাপ…… 🙁 )

এর পর আবার সবাই আলাদা হয়ে গেলাম । আরো কিছুক্ষণ নিজে নিজে হাটা হাটি, আরো কিছু বই কেনা । এরপর হাটতে হাটতে পৌছালাম এমনই এক স্টলের সামনে, যে স্টলের সামনে এসে আমার হাঁটার শক্তি যেন এক ধাক্কায় শেষ হয়ে গেল । (আমার ঢাকা শহরে আসার আগের জীবনে তিনজন মানুষের সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছা ছিল। এই তিন জন বাদে অন্য কোন বিখ্যাত অখ্যাত অথবা কুখ্যাত, কোন ব্যক্তির সাথেই দেখা করার আমার কোন আগ্রহ আমার কখনই ছিল না, এখনো নাই । সেই তিন জন হলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার, দলছুটের সঞ্জীব দা এবং মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া। এর মধ্যে সঞ্জীব দা তো হারিয়েই গেলেন ।) এই হল সেই স্টল, যে স্টলে আমার সেই তিন জন মানুষের একজন ‘মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া’ খুবই অসুস্থ শরীর নিয়ে বসে আছেন, এবং হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলে যাচ্ছেন। তার সামনে গিয়ে আমি হাটার শক্তি, কথা বলার শক্তি সব হারিয়ে বসে আছি! ঢাকায় আসার পর অনেক অনেক বিখ্যাত মানুষ পাশ দিয়ে হেটে চলে গেছে, মুহূর্তের জন্য পাত্তা দেইনি। অনেকের ক্ষেত্রে ফিরেও তাকাই নি। কিন্তু এই লোকের সামনে এসে আমি সব হারায়ে শুধু অবাক দৃষ্টি নিয়ে বোকার মত অনেক্ষণ চেয়ে ছিলাম। তারপর সামনে গিয়ে বোকার মত দুচারটে কথা বলার চেষ্টা করলাম, আর তারপর বুঝতে পারলাম তার সাথে কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই, আমি শুধু চেয়েই থাকতে পারি।
হাহ্‌…………………………!

(আমার ক্যমেরা নাই, আমি ছবিতোলা ব্যপারটা বিশেষ পছন্দও করি না তাই মোবাইল ক্যমেরা দিয়া ছবি তুলি নাই…… সে কারনেই এই পোস্টে কোন ছবি নাই)