মহান মনিষীরা একই ভাবে চিন্তা করেন
কেমন করে ‍আলফ্রেড ওয়ালেস ডারউইনের মত একই রকম একটি বৈপ্লবিক অন্তদৃষ্টি অনুভব করেছিলেন।

(শন বি ক্যারল এর Great Minds Think Alike: How Alfred Wallace came to share Darwin’s revolutionary insights লেখা অবলম্বনে কাজী মাহবুব হাসান)

সমান্তরাল পথে:

গত দুইশত বছরে, সাধারন আর বিশেষায়িত,দুই ধরনের প্রানীর প্রজাতির উৎপত্তির কারন অনুসন্ধান অনুপ্রাণিত করেছে অনেকগুলো অসাধারন অভিযান। পুরো ২০০৯ সাল জুড়ে, চার্লস ডারউইনের দুইশততম জন্মবার্ষিকীতে, সারা পৃথিবী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছে আমাদের সবচেয়ে মহান প্রকৃতিবিজ্ঞানী আর সুদূরপ্রসারী এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের নেতার অবদান।

ডারউইনের বিখ্যাত সমুদ্রযাত্রা আর তার গবেষনা অতি সুপরিচিত, আর অত্যন্ত সঙ্গত কারনে। পরিচিত হওয়াটাই উচিৎ।কিন্তু বিবর্তন তত্ত্বের সূচনা, শুরুর দিকে এর ক্রমবিকাশ আর গ্রহনযোগ্যতার জন্য আমরা কিন্তু আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এর কাছেও অনেকাংশে ঋণী। আরো অনেকবেশী কঠিন ‍অবস্থার মধ্য দিয়ে যিনি দুটি সুদীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন এবং স্বতন্ত্রভাবে প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে ডারউইনের মত একই ধরনের ‍উপসংহারে পৌছে ছিলেন।

ছবিঃ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (বায়ে)বিবর্তন কেমন করে কাজ করছে সে বিষয়েই শুধুমাত্র ডারউইনের মত একই উপসংহারেই পৌছাননি,এমনকি তিনি একই বাক্য ব্যবহার করেছিলেন তার তত্ত্বাটকে ব্যাখা করতে।(ফটো ক্রেডিট (বায়ে) ই ও হপে/করবিস,(ডানে)স্টাপলটন কালেকশন/করবিস)

ওয়ালেসের নাটকীয় কাহিনী আর বৈজ্ঞানিক অবদানগুলোর পরিচিতি সাধারনত অনেক কম। লেখক সি ডব্লিউ সেরাম অভিযানকে ব্যাখা করেছিলেন ‘কর্ম আর প্রাণশক্তির একটা ‍মিশ্রন’ হিসাবে, আমি মনে করি আলফ্রেড ওয়ালেসের অভিযান ছাড়া আর কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানীরই অভিজ্ঞতাকে এটি সঠিক সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না। আমি তার কিছু উল্লেখযোগ্য অভিযান ‍আর আবিষ্কারের কথা বলব যেমন কিভাবে তিনি সম্পুর্ন স্বাধীনভাবে ডারউইনের মত একই সিদ্ধান্তে পৌছান আর এছাড়াও একটু বর্ণনা করতে চাই এই দুই মহান প্রকৃতিবিজ্ঞানীর মধ্যে উষ্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার ঘটনাটি।

তাদের দুজনের কিছু ব্যাপারে বেশ মিল ছিল। প্রথমত দুজনেই ইংল্যান্ড থেকে বের হতে চেয়েছিলেন আর ক্রান্তীয় অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে নানা প্রজাতির প্রানী ও উদ্ভিদ সংগ্রহ করে চেয়েছিলেন বিখ্যাত হতে। দুজনেই তাই করেছিলেন তাদের তরুন বয়সে, ডারউইন যখন এইচ এম এস বীগলে ওঠেন তখন তার বয়স ২২ বছর আর ওয়ালেস ২৫ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড ছেড়ে বের হন। সর্বোপরি দুজনের সবচেয়ে বড় মিল ছিল, তারা দুজনই ছিলেন বিপুল পরিমানে নমুনা সংগ্রহে অতি দক্ষ এবং এই নমুনা সংগ্রহ করার মাধ্যমে তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন প্রত্যেকটা প্রজাতিই কত বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্রময় আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পন্ন হতে পারে। আর কষ্টার্জিত এই জ্ঞানের মাধ্যমেই তারা নমুনা সংগ্রাহক থেকে হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানী, তারা শুধুমাত্র জানতে চাননি, কোন একটা নির্দিষ্ট স্থানে কত ধরনের প্রানীর বসবাস করে বরং ‍কিভাবে তাদের সৃষ্টি হলো সেই নির্দিষ্ট জায়গায়,আর এই প্রশ্নগুলোই তাদের দুজনকই পৃথকভাবে নিয়ে যায় ‍অনন্য এবং যৌথ এক বৈপ্লবিক আবিষ্কারের পথে।

গভীর আমাজনে:
১৮৪৭ সালে ওয়ালেস তার বন্ধু এবং নমুনা সংগ্রাহক হেনরী ওয়াল্টার বেটসকে প্রস্তাব দেন আমাজনে অভিযানের জন্য। তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতি বিজ্ঞানের তার একটি নিজস্ব সংগ্রহশালা গড়ে তোলা। কিন্তু সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক আলোচনার বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধেও ওয়ালেসের ভালো ধারনা ছিল। ডারউইন যেমন তার যাত্রা শুরু করেছিলেন কোন মহান ধারনার বা তত্ত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমান সংগ্রহ করার কোন প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছাড়াই ওয়ালেস কিন্তু তা করেননি, তিনি বন্ধু বেটসকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এই অভিযানের সময় তারা ‘ প্রজাতির উৎপত্তির সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন’। সমস্যাটি ১৮৪৭ সালের সমসাময়িক সময়ে একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছিল: প্রজাতিরা কি অপরিবর্তনশীল এবং বিশেষভাবে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট নাকি পরিবর্তনশীল এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট ?


ওয়ালেস এবং বেটস দুজনেই ছিলেন স্বশিক্ষিত সৌখিন প্রকৃতিবিজ্ঞানী, যাদের ডারউইনের মত না ছিল কোন পারিবারিক অর্থসম্পদ, না ‍ছিল বিজ্ঞানীদের কোন সমিতি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন যোগাযোগ কিংবা ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীর জাহাজে সংরক্ষিত কোন জায়গা। আমাজনের দিকে সমুদ্রযাত্রার জন্য তাদের জায়গা নিতে হয় বানিজ্যিক পণ্যবাহী জাহাজে আর তাদের যাতায়াতের খরচ মেটান দুষ্প্রাপ্য বা চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন নমুনা ইংল্যান্ডে বিক্রির জন্য পাঠানোর মাধ্যমে।
১৮৪৮ এর মে মাসে ব্রাজিলের উত্তরপূর্ব ‍উপকুলে পারা’তে এসে পৌছান তারা । কিছুদিন একসাথে কাজ করার পর আলাদা পথে যাত্রা শুরু করেন দুইজন, ওয়ালেস এগিয়ে যান আমাজনের মুল শাখা ধরে, পরে রিও নেগ্রো এবং এর সবচেয়ে বড় শাখা রিও দোস উয়াউপেস ধরে। চার বছরের কষ্টকর আর বিপদসঙ্কুল যাত্রা আর সংগ্রহ শেষে ১৮৫২ সাল নাগাদ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ২০০০ মাইল ভিতরে নদীর পৌছে যান, এতটা দুরে কোন ‍ইউরোপীয় এর আগে আসেননি।
ইতিমধ্যে তখন তার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। শারীরিক পরিশ্রম, পুষ্টিকর খাবারের অভাব, ক্রাস্তীয় অঞ্চলের অসুখ তাকে এমনটাই কাবু করে ফেলে যে, তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন, ফিরে না গেলে হয়তো জঙ্গলেই তার মৃত্যু হতে পারে। নদীপথের বিভিন্ন স্থানে তার সংরক্ষিত নমুনা ছাড়াও ওয়ালেসের সাথে ছিল অনেক ধরনের বিচিত্র জীবন্ত প্রানীর একটি বড় ধরনের সংগ্রহ – বানর, ম্যাকাও, প্যারট এবং একটি টোকান, তার আশা ছিল এসব তিনি লন্ডন চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে পারবেন। এদের দেখাশোনা করতে গিয়ে তার অবশিষ্ট সামান্য শক্তিও প্রায় শেষ প্রান্তে পৌছে যায়।
ওয়ালেস পারার দিকে ফেরার জন্য নদীর মুখের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তিনি লন্ডন অভিমুখী একটি হেলেন নামের একটি জাহাজ খুজে পান । এই জাহাজে ৩৪ টা জীবন্ত প্রানী, আর অনেকগুলো বাক্স ভরা নমুনা আর মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষন আর গবেষনার কাগজপত্র নিয়ে তিনি দেশে ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করেন।

ছবিঃ আমাজনে তার চার বছর থাকাকালীন ওয়ালেস জোগাড় করেন টোকান সহ বিপুল পরিমান জীবন্ত প্রাণী। দুঃখজনকভাবে ইংল্যান্ডে ফেরার পথে তাকে হারাতে হয় সবকিছু । (ফটো ক্রেডিট: মিগুয়েল সেজার/স্টক ফটো)

সমুদ্রে বিপর্যয়:
যাত্রা শুরুর ৪ সপ্তাহ পর বারমুডার প্রায় ৭০০ মাইল পূর্বে, জাহাজের ক্যাপ্টেন ওয়ালেসের কেবিনে এসে তাকে জানান, ‘’‘ আমি দুঃখিত, আমার কিছু করার উপায় নেই, জাহাজে আগুন ধরে গেছে, দেখুন আপনি কি করতে পারেন’, ক্যাপ্টেনের সাথে ওয়ালেস মালপত্র রাখার জায়গায় এসে দেখতে পান আগুন ছড়িয়ে পড়েছে অনেকখানি, কুন্ডলী পাকিয়ে বের হচ্ছে ধোয়া। জাহাজের নাবিকরা ব্যর্থ হয় সেই প্রচন্ড আগুন নেভাতে, অবশেষে লাইফবোট পানিতে নামানোর নির্দেশ দেন ক্যাপ্টেন, ওয়ালেস তার গরম আর ধোয়া ভরা কেবিনে ঢুকে উদ্ধার করেন একটা ছোট টিনের বাক্স, যার ভেতরে ছিল কিছু কাগজপত্র, কিছু আঁকা ছবি আর একটি ডায়েরী । লাইফবোটে দড়ি ধরে নামার সময় পিছল খেয়ে দড়িতে কেটে যায় তার হাত, সমুদ্রের লোনা পানির ঝাপটা সেই ক্ষতর যন্ত্রণাকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। লাইফবোটে ওঠার পর টের পান, কোথাও কোন ছিদ্র দিয়ে পানি ঢুকছে লাইফবোটে। ওয়ালেস চোখের সামনে হেলেনকে পুড়তে আর সেই সাথে তার সংগ্রহ করা প্রানীদের আর নমুনাগুলো ধ্বংশ হয়ে যেতে দেখেন।
মধ্য আটলান্টিকের প্রায় ছিদ্র হওয়া লাইফবোটে শুয়ে খোলা আকাশের নীচে একটার পর একটা অনিশ্চিৎ দিন অতিক্রান্ত হয় ওয়ালেসের।। তৃষ্ণার্ত, সমুদ্রের পানিতে ভেজা, প্রায় সারাক্ষনই লাইফবোটে জমে উঠতে থাকা পানি ক্রমাগত সেঁচায় ভীষনভাবে ক্লান্ত আর তীব্র ক্ষুধার্ত ওয়ালেসের গায়ে সুর্যের প্রখর আলোয় ফোসকা পড়ে যায় । অবশেষে ১০ দিনের মাথায় তাদের উদ্ধার করে আরেকটি জাহাজ।
উদ্ধারকারী এ‌ই জাহাজে বসে ওয়ালেস, ব্রাজিলে তার এক বন্ধুকে এই দুর্ঘটনা আর ক্ষতির পরিমান ব্যাখা করে একাট চিঠি লেখা শুরু করেন:
‘“‘ ‘কতগুলো কষ্টের দিন আর সপ্তাহ আমি পার করেছি শুধু একটাই সখের আশা নিয়ে ‍এই সব জঙ্গল থেকে নতুন আর সুন্দর প্রানীদের দেশে নিয়ে যাবো; এদের প্রত্যেকটি খুব আপন হত আমার, স্মৃতি জাগানোর মাধ্যমে। এখন সব শেষ, আমার কাছে একটা নমুনাও বেচে নেই যা প্রমান করবে ‍ ঐসব অচেনা দেশে আমি একদিন ঘুরে বেড়িয়েছি….’’।

ওয়ালেস তার বন্ধুকে লিখেছিলেন, দেশে ফেরার পথে তিনি ‘৫০ বার’ শপথ কেটেছেন ‘ যদি একবার ইংল্যান্ডে পৌছাতে পারি, কখনোই আর সমুদ্রপথ পা বাড়াবো না’।তিনি যদি তার সেই প্রতিজ্ঞায় অটল থাকতেন, সেখানেই,তার কাহিনী শেষ হয়ে যেত আর খুব অল্পকিছু মানুষই আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসকে চিনতো। কিন্তু তার বন্ধুকে তিনি যেভাবে লিখেছিলেন ‘অনেক কঠিন প্রতিজ্ঞাও দ্রুত ম্লান হয়ে যায়’, ওয়ালেসও সিদ্ধান্ত নেন যে, তার অপূরনীয় ক্ষতি আর প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা সত্ত্বেও আবার সমুদ্রযাত্রায় বের হবেন।

 

মালয় দ্বীপপুন্জ্ঞে:
নতুন কোন জায়গায় অভিযান আর নমুনা সংগ্রহের তীব্র ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল ওয়ালেসের, এছাড়াও প্রজাতির উৎপত্তির কারন অনুসন্ধানের প্রতি উৎসাহ তো ছিলই। ১৮৫২ সাল, বৈজ্ঞানিক জগতের জানা মতে তখনও এই রহস্যের সমাধান হয়নি। যদিও ডারউইন কিন্তু তার উপসংহারে পৌছে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগেই, কিন্তু তার সেই তত্ত্ব’র কথা শুধুমাত্র খুব ঘনিষ্ট কয়েকজন ছাড়া আর কারোরই জানা ছিল না, আর ‌এই ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে ওয়ালেস অবশ্যই ছিলেন না।
ওয়ালেস তার পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে ভাবা শুরু করলেন দেশে ফেরার পর পরই। তাকে এমন সব প্রাণী বা নমুনা সংগ্রহ করতে হবে যা বিক্রি করলে মোটা অঙ্কের অর্থ লাভ হবে কিন্তু আমাজনে ফিরে যাবার চিন্তা বাদ দিলেন তিনি। মালয় দ্বীপপুন্জ্ঞ নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন তিনি, দক্ষিন-পশ্চিম এশিয়া আর অষ্ট্রেলিয়ার মাঝখানে একাট অসংখ্য দ্বীপের সমাবেশ হল এই মালয় দ্বীপপুন্জ্ঞ ( ম্যাপ দ্রষ্টব্য) । শুধু মাত্র জাভা ছাড়া, অন্য সব দ্বীপগুলোর উদ্ভিদ ও প্রাণী ছিল অজানা। সেখানকার ওলন্দাজদের বসতি থেকে আসা যথেষ্ট পরিমান তথ্য, ওয়ালেসকে মনস্থির করতে সাহায্য করে, যে সেখানে গেলে যেমন ভালো নমুনা সংগ্রহ করার সম্ভাবনা আছে, তেমনই পর্যাপ্ত সুবিধা আছে ভ্রমনকারীদের।
দ্বীপপুন্জ্ঞটির পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃতি ৪০০০ মাইল আর উত্তর দক্ষিনে প্রায় ১৩০০ মাইল, আকারে প্রায় পুরো দক্ষিন অ্যামেরিকা মহাদেশের মত বড় । ক্রান্তীয় বনভুমি দিয়ে ঢাকা দ্বীপগুলো দেখতে আপাতদৃষ্টিতে একই রকম লাগলেও, জীবজগতের বিচিত্রতায় তারা ভিন্ন একে অপর থেকে। এই পার্থক্যগুলো আবিষ্কার আর ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে ওয়ালেস আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ব মানচিত্রে তার ‍নাম লেখেন।

ছবিঃ ওয়ালেস লাইন (Wallace’s Line) হল ইন্দোনেশিয়ার মাঝ বরাবর একটি অদৃশ্য সীমারেখা, যা পৃথক করেছে সম্পুর্ণ আলাদা দুটি প্রানীজগতকে। (ফটো ক্রেডিট: শন ক্যারলের সৌজন্যে, লিয়ান ওল্ডস এর সৃষ্টি)

১৮৫৪ সালে এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুর এসে পৌছান ওয়ালেস, সেখান থেকে শুরু করেন তার অভিযান। এখানে তাকে মুখোমুখি হতে হয় আমাজন থেকে সর্ম্পুন ভিন্ন এক প্রকৃতির আর বিপদের। যেমন, সিঙ্গাপুরে তখন বাঘ ঘুরে বেড়াত; গড়ে প্রতিদিন একজন করে বাসিন্দার মৃত্যুর কারন ছিল বাঘের আক্রমন। মাঝে মাঝে ওয়ালেসও তাদের গর্জন শুনতে পেতেন, তবে বৃটিশদের স্বভাবসুলভ ভাবে সমস্যাকে হালকা করে তিনি মন্তব্য করেন .. ’পোকামাকড় খোজার কাজটা একটু চিন্তার বিষয় বলতে হবে..যখন এরকম একটা হিংস্র প্রানী আসে পাশেই কোথাও লুকিয়ে থাকে… “।”

অঙ্কুরিত ধারণাগুলো:
এ ধরনের সমস্যায় আদৌ বিচলিত না হয়ে ওয়ালেস প্রতিদিন রুটিন মাফিক তার কাজ করে যেতেন। ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে ঠান্ডা পানিতে গোছল আর কফি দিয়ে দিন শুরু হতো তার। প্রথমে আগের দিনে যা কিছু সংগ্রহ করেছিলেন তা ঠিকমত সাজাতেন, তারপর তার সংগ্রহ করার সব জিনিসপত্র নিয়ে আবার বের হয়ে যেতেন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। তার হাতে থাকতো পোকা মাকড় ধরার জাল, কাধে ঝোলানো বড় বাক্স, মৌমাছি, ভ্রমর ধরার জন্য সাড়াশি, ছোট আর বড় পোকামাকড়ের নমুনা রাখার জন্য ঘাড়ে প্যাচানো সুতোয় বাধা কর্কের ছিপি লাগানো দুই মাপের দুটো কাচের বোতল, আর কোন কোনদিন হাতে থাকত রাইফেল।
স্থানীয় অধিবাসীদের হিংস্রতার কুখ্যাতি থাকা সত্ত্বে দ্বীপপুন্জ্ঞে কিছু কিছু অংশে আদিবাসীরা জঙ্গল সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান ওয়ালেসের সাথে ভাগ করে নিয়েছিল এবং তাকে সাহায্য করেছিল তিনি যা চাইছেন তা খুজতে। দ্বীপের সবচেয়ে সুন্দর আর মুল্যবান প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন – ওরাংউটান, বানর, অসাধারন সুন্দর বার্ডস অব প্যারাডাইস, বিশাল আকারের উজ্জ্বল রঙ্গের প্রজাপতি। ওয়ালেসের এসব দেখে লিখেছিলেন: “প্রকৃতি মনে হয় খুবই সযত্নে সাবধানে ঠিক করেছে ,সহজলভ্যতার জন্য যেন তার সবচেয়ে সেরা ঐশ্বর্য্যরাশির মুল্য যেন কমে না যায়, প্রথমেই আমরা দেখি, উন্মুক্ত পোতাশ্রয়বিহীন, অবান্ধব সমুদ্র উপকুল,যা প্রশান্ত মহাসাগরের প্রচন্ড ঢেউ এর সম্মুখে উম্মোচিত; ‍তারপরেই জঙ্গলে ঢাকা পার্বত্য দেশ, জলাভুমি, খাড়া পর্বতমালার ধারালো কিনার, প্রায় অসম্ভব অনতিক্রান্ত এক প্রতিবন্ধকতা, এবং সবশেষে বন্য আর হিংস্র একটা জাতি.. ।“”
ওয়ালেসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল, তার সংগ্রহ করা বিভিন্ন প্রজাতির নমুনার অসাধারন বিচিত্রতা, প্রজাতির প্রত্যেকটি সদস্যর মধ্যকার ভিন্নতা এবং কোথায় তাদের তিনি খুজে পেয়েছিলেন তার প্রতি। এগুলো একজন পেশাদার সংগ্রাহকের ব্যবহারিক চিন্তার বিষয় হতে পারে, কিন্তু তার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছিল।

ছবিঃ বিভিন্ন দ্বীপে বার্ডউইং প্রজাতির প্রজাপতি বিভিন্নতা পর্যবেক্ষন ওয়ালেসকে বুঝতে সাহায্য করেছিল কেমন করে প্রজাতির পরিবর্তন হয়। ছবিটি কেয়ার্ন বার্ডউইং এর, অষ্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় স্থানীয় প্রজাপতি (ফটো ক্রেডিট: কিথ জে স্মিথ/ স্টক ফটো)

যেমন, সুন্দর বার্ডউইঙ্গ প্রজাপতি,যাদের বড় ডানা আর উজ্জ্বল রং এর জন্য সংগ্রাহকদের মধ্যে বিশেষ চাহিদা ছিল, খুজতে গিয়ে ওয়ালেস লক্ষ্য করেছিলেন যে, বিভিন্ন ধরনের বার্ডউইঙ্গ এর বসবাস দ্বীপপুন্জ্ঞের সুনির্দিষ্ট দ্বীপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গালাপাগোস দ্বীপপুন্জ্ঞর পাখিরা ডারউইনকে যে ইঙ্গিত দিয়েছিল,এই প্রজাপতিগুলো তাকে ঠিক সেই একই ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছিল – যে প্রজাতিও পরিবর্তিত হয়।
যখন ডারউইন নীরব ছিলেন বিবর্তন নিয়ে, ওয়ালেস তখন ভাবছিলেন সশব্দে, তার চিন্তা লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছিলেন তার নোটবুকে, তিনি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ম্যাগাজিনে পাঠানো একের পর এক তার লেখায়।এদের মধ্যে কোনটা সংক্ষিপ্ত মাঠপর্যায়ের নোট; অন্যগুলোতে স্পষ্ট প্রকাশ পায় তার সুবিশাল ধারনাগুলো। কিন্তু ডারউইন নীরব থাকার যে সকল কারন ছিল,ওয়ালেসের তা ছিল না । তার হারাবার কিছুই ছিল না বরং সুনাম অর্জন করতে হবে,বিজ্ঞানীদের মধ্যে তার জায়গা করে নিতে হবে, এটাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

প্রকৃতির একটি নিয়ম: ‍
১৮৫৫ সালে বোর্নিওর সারাওয়াকে বর্ষার মওসুমে অপেক্ষা করার সময়, ওয়ালেস ভূ-তত্ত্ব আর প্রাকৃতিক ইতিহাসের নানা সুত্র সংযোগ করে একটা নতুন সুত্র বা নিয়মের প্রস্তাব করেন: প্রত্যেকটি প্রজাতির উৎপত্তি হয় ইতিপূর্বেই বিদ্যমান নিকট বা প্রায় সমগোত্রীয় প্রজাতিদের সমসাময়িক সময়ে ও স্থানে ।
ওয়ালেস ধারনা করেন, প্রজাতিরা পরস্পারিক সম্পর্কযুক্ত ‘গাছের শাখাপ্রশাখার মত’; তিনি প্রস্তাব করেছিলেন নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয় পুরাতন প্রজাতি থেকে, যেমন করে নতুন শাখার জন্ম হয় পুরাতন শাখা থেকে। এই সাহসী ধারনা সেই সময়ের ‘‍বিশেষ সৃষ্টির’ প্রচলিত মতবাদকে প্রত্যাখান করে, যার মুল ধারনাই ছিল প্রত্যেকটি প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে বিশেষভাবে, একই সাথে, যে ভৌগলিক অবস্থানে তাদের বসবাস তার উপযোগী করে। ‍ ‍উপরন্তু, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওয়ালেস তার প্রাকৃতিক নিয়মের স্বপক্ষে সেই একই যুক্তি ব্যবহার করেছিলেন, যা ডারউইন দুই দশক ধরে তীব্র মানসিক যন্ত্রনাসহ একা একা নিজের মধ্যে রেখেছিলেন কিন্তু তখনও কোথাও প্রকাশ করেননি।
ওয়ালেস তার ‘সারাওয়াক সুত্র’ সমর্থনে ব্যাখ্যা করেন বিশেষ করে দ্বীপগুলোতে প্রজাতির বিস্তার সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের পর্যবেক্ষনগুলো। যেমন, ‘গালাপাগোসে’, তিনি লেখেন, ‘যেখানে স্বকীয় ক্ষুদ্র উদ্ভিদ আর প্রানী গোষ্ঠীসমুহ বিদ্যমান,কিন্তু বেশীর ভাগই দক্ষিন আমেরিকার মুল ভূখন্ডে উদ্ভিদ ও প্রাণীর সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত – বিষয়টি এযাবৎ কোন ধরনের,এমনকি কোন আনুমানিক ব্যাখ্যাও পায়নি।’ ওয়ালেস ডারউইনের পর্যবেক্ষনের প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন, যার এখনো কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
ওয়ালেস যুক্তি দেন যে, প্রজাপতির পরিবার, পাখি আর নানা ধরনের উদ্ভিদ একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকায় সীমাবদ্ধ। আমাজনে থাকাকালীন সময়ে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির বানর নদীর একপাশেই সীমাবদ্ধ। ‍’এরকম হওয়ার কথা না’ তিনি লিখেছিলেন ‘যদি না তাদের সৃষ্টি আর বিস্তারের উপর প্রকৃতির কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম যদি কাজ না করে থাকে।’ ‘ বিস্তার’ শব্দটি দিয়ে ওয়ালেস যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হল, একটি প্রজাতির কতটুকু বিস্তার লাভ করতে পারে কোন এলাকায়,যা ভৌগলিক বিশেষত্ব – যেমন নদী, পর্বতশ্রেণী ইত্যাদি দ্বারা সীমাবদ্ধ।

যখন এই রচনা প্রথম প্রকাশিত হয়, প্রায় কে‌উই তা পড়েনি বা লক্ষ্যই করেনি। ওয়ালেস তার প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক সুত্র সম্বন্ধে লন্ডন থেকে কোন প্রতিক্রিয়াই শুনতে পেলেন না শুধুমাত্র কিছু অসন্তোষ ছাড়া, যে তার উচিৎ নমুনা সংগ্রহে মনোযোগী হওয়া, তত্ত্ব তৈরী করা না।

 ছবিঃ মেগাপোড, ছবিটি ১৮৪৮ সালে ইংলিশ পাখিবিশেষজ্ঞ জন গুল্ড এর আকা, ইন্দোনেশিয়ায় এই পাখিটি শুধুমাত্র ওয়ালেস রেখার পুর্বে পাওয়া যায়। (ফটো ক্রেডিট: অ্যাকাডেমি অফ ন্যাচারাল সায়েন্সেস অব ফিলাডেলফিয়া/করবিস)

রেখা অংকন:
ওয়ালেস প্রায়ই এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়া আসা করতেন। প্রায় আট বছরের মধ্যে ওয়ালেস ৯৬ টি যাত্রার মাধ্যমে প্রায় ১৪০০০ মাইল অতিক্রম করেন, এর মধ্যে কিছু কিছু দ্বীপে তিনি বেশ কয়েকবার অভিযান করেন। কখনো তার পথ কোনদিকে হবে তা নির্ধারন করতো নৌকা পাওয়া বা না পাওয়ার উপর। ১৮৫৬ সালে মে মাসে একদিন একটি চীনা স্কুনার নিয়ে সিংগাপুর থেকে বালি যান, যেখানে যাওয়ার কোন উদ্দেশ্যই ‍ছিল না তার, কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন সেখান থেকে সুলাবেসী দ্বীপে লোম্বোক, পরে মাকাস্বার যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। এই আকস্মিক দুর্ঘটনার কারনে তার এই ভিন্ন পথে আসাটাই ওয়ালেসের অভিযানের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন আবিষ্কারের পথ করে দেয়।
বালি’তে ওয়ালেস এমন কিছু পাখির খুজে পেলেন যা তিনি পশ্চিমের দ্বীপগুলোতে অভিযানের সময় দেখেছিলেন, যেমস একটি উইভার, একটি কাঠঠোকরা, একটি থ্রাশ, একটি স্টারলিং – তেমন বিশেষ কোন উত্তেজনার বিষয় না। কিন্তু ‘তারপর লম্বোকে , বিশ মাইলেরও কম একটা প্রণালী যা একে বালি থেকে পৃথক করেছে, ‘আমি স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিলাম এই ধরনে পাখিদের সাথে আবার দেখা হবে, কিস্তু সেখানে আমার তিন মাস অবস্থান করার সময়, আমি তাদের কোনটিরই দেখা পেলামনা..’। বরং ওয়ালেস খুজে পেলেন ভিন্ন জাতের পাখিদের সমারহ: সাদা কাকাতুয়া, হানিসাকলের তিনটি প্রজাতি, একটা জোরে জোরে শব্দ করা পাখি, যাকে স্থানিয়রা ডাকে ‘কোয়াইচ-কোয়াইচ’ এবং একটা অদ্ভুত পাখি যার নাম মেগাপোড ( বিগ ফুট বা বড় পা), যে তার বড় পা ব্যবহার করে ডিমের বড় জায়গা তৈরীতে। এধরনের সমগোত্রীয় কোন পাখি সুমাত্রা, বোর্ণিও বা জাভার পশ্চিমের দ্বীপগুলোর কোথাও দেখা যায় না।
ওয়ালেসের কাছে প্রশ্ন তখন একটাই, কি সেই প্রতিবন্ধকতা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে এই প্রজাতিগুলোর বিস্তার ব্যাহত করেছে। নিশ্চয়ই পাখিদের কাছে মাত্র ২০ মাইলের একটা প্রণালী কোন বাধা হবার কথা না।
বেটস এর কাছে লেখা চিঠিতে ওয়ালেস এই রহস্য ব্যাখ্যা করেছিলেন। এর সমাধানে তিনি প্রস্তাব করেন, নিশ্চয়ই কোন অদৃশ্য ‘সীমারেখা’ আছে বালি আর লম্বোকের মধ্যে। ফ্লোরেস বা তিমোরের আরো পুর্বদিকে গেলে, যেমন আরু দ্বীপে আর নিউ গিনিতে, পাখি প্রজাতির এই পরিবর্তন আরো সুস্পষ্ট হয়। সুমাত্রা,জাভা বা বোর্নিওতে পাখিদের যে পরিবারগুলো দেখা যায়, তারা আরু, নিউ গিনি বা অষ্ট্রেলিয়ায় অনুপস্থিত, একইভাবে এর বীপরিতটাও তাই। একইভাবে পুর্ব আর পশ্চিমের দ্বীপগুলোর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে পার্থক্যও লক্ষনীয়। পশ্চিমের বড় দ্বীপগুলোতে আছে বানর, বাঘ, গন্ডার। কিন্তু আরুতে কোন প্রাইমেট বা মাংশাসী প্রাণী নেই। স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সবাই মারসুপিয়ালস -ক্যাঙ্গারু, কুসকুস ইত্যাদি।
বালি লম্বোকের মধ্যে সীমারেখার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ওয়ালেসের মনে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না বরং এর তার জন্য এর তাৎপর্য্য ছিল অনেক গভীর। ওয়ালেস যুক্তি দেন যে, প্রজাতির বিশেষভাবে সৃষ্টির মতবাদ অনুযায়ী, একই ধরনের জলবায়ুর দেশগুলোতে একই ধরনের প্রাণীর এবং ভিন্ন জলবায়ুর দেশগুলোতে ভিন্ন রকম প্রানীদেরই উপস্থিতি লক্ষ্য করার কথা। কিন্তু এরকম কিছু কিন্তু তিনি আদৌ পর্যবেক্ষন করেননি। পশ্চিমে বোর্ণিও আর পূর্বে নিউ গিনি’র মধ্যে তুলনা করে তিনি লেখেন: খুবই কঠিন হবে ব্যাখ্যা করা যে দুটি দেশ জলবায়ু আর ভুতাত্ত্বিক প্রকৃতিতে সদৃশ্য, কিন্তু তাদের পাখিরা এবং স্তন্যপায়ী প্রানীরা সম্পুর্ন আলাদা।
নিউ গিনি আর অষ্ট্রেলিয়াকে তুলনা করে তিনি লেখেন, এরকম পার্থক্য আমরা খুব কমই খুজে পাবো, এক দেশে বিরতিহীনভাবে বৃষ্টি আর আর্দ্রতা, আরেকটিকে তীব্র শুষ্কতার কমবেশী প্রকোপ, ওয়ালেস যুক্তি দেন, ‍যদি ক্যাঙ্গারুরা শুষ্ক সমতলে আর অষ্ট্রেলিয়ার বনে বিশেষভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তাহলে নিশ্চই কোন কারন আছে নিউ গিনির ঘন, আর্দ্র জঙ্গলে তাদের আবির্ভাবের। পশ্চিমের দ্বীপগুলোতে বানররা যে জায়গা দখল করেছে পূর্ব দিকের দ্বীপগুলোর ক্রান্তীয় বনভূমিতে সেই আবাসস্থল দখল করেছে গেছো ক্যাঙ্গারুরা।
ওয়ালিস আরো যুক্তি দেন যে, নিশ্চই প্রজাতির বিস্তার নিয়ন্ত্রনে অন্য কোন প্রাকৃতিক নিয়ম কাজ করছে। সেই নিয়মটাই, ওয়ালেসের প্রস্তাব অনুযায়ী ছিল, ‘সারাওয়াক সুত্র’, যা ‍তিনি এর দুবছর আগেই উত্থাপন করেছিলেন। আবারও ওয়ালেস তার পর্যবেক্ষনের স্বপক্ষে ভু-তত্ত্বর আর ভুগোলের উপর নির্ভর করেছিলেন। তিনি অনুমান করেছিলেন যে, নিউ গিনি, অষ্ট্রেলিয়া, এবং আরু অবশ্যই অতীতে কোন এক সময় সংযুক্ত ছিল আর সেকারনেই একই ধরনের পাখি আর স্তন্যপায়ী প্রাণী সেখানে পাওয়া যায়, একইভাবে ওয়ালেস ব্যাখ্যা করেন যে, পশ্চিমের দ্বীপগুলোও কোন একসময় এশিয়ার অংশ ছিল, সেকারনেই ক্রান্তীয় এশিয়ার প্রাণীদের সেখানে পাওয়া যায় -যেমন, বানর, বাঘ ইত্যাদি।
ওয়ালেসের ধারনা ছিল সঠিক। তিনি সফল হয়েছিলেন, প্রজাতির উৎপত্তি এবং কিভাবে প্রজাতির বিস্তার হয়, এই দুটি প্রশ্নকে সংযুক্ত করতে এবং তিনি এশিয়া আর অষ্ট্রেলিয়ার প্রানীজগতকে পৃথক করা সীমারেখার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার এই আবিষ্কার চিরকালের জন্য ‘ওয়ালেস লাইন’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে আর ওয়ালেসকে প্রতিষ্ঠিত করে জৈবভুগোল বিষয়ের প্রণেতা হিসাবে-যা উদ্ভিদ আর প্রানীর ভৌগলিক বিস্তার নিয়ে অধ্যয়ন করে।

ছবিঃ গেছো ক্যাঙ্গারু, যাদের শুধুমাত্র ওয়ালেস রেখার পূর্বে পাশে দেখা যায়, রেখার পশ্চিমে বানররা যে জায়গা দখল করে আছে, পুর্বদিকে সেই জায়গাটি দখল করে আছে এরা। (ফটো ক্রেডিট: ক্রেইগ ডিঙ্গল/স্টক ফটো)

দুই মহান মনের সম্মিলন :
প্রজাতি যে বিবর্তিত হয় ওয়ালেসের কাছে সেটা আর তখন কোন প্রশ্ন ছিল না, বরং কিভাবে হয়, সেটাই ছিল প্রশ্ন। ১৮৫৮ ’র শুরুর দিকে আগ্নেয়দ্বীপ টেরনাতে ম্যালেরিয়া জ্বরে ভোগার সময়, এর উত্তরটাও তিনি খুজে পেয়েছিলেন।
পর্যায়ক্রমে জ্বর বাড়া আর কমার মাঝে, ওয়ালেসের আর কিছু্ই করার ছিল না শুধুমাত্র, ‘ আমার পছন্দের বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া।’ ৮৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রার দিনে কম্বল মুড়ি দিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে পড়া ইংলিশ অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাস এর জনসংখ্যার উপর একটা রচনার কথা ভাবছিলেন ওয়ালেস। তার মনে হলো যে, ম্যালথাস যেমন যুক্তি দিয়েছিলেন মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ মানব জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রন করে তা আসলে প্রানীজগতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি ভেবে দেখলেন প্রানীদের প্রজনন হার মানুষের চেয়ে অনেক বেশী দ্রুত আর যদি তা নিয়ন্ত্রনে না থাকতো, সারা পৃথিবীতে প্রাণীর সংখ্যা মাত্রাহীন ভাবে বেড়ে যেত। কিন্তু তার সমস্ত অভিজ্ঞতা তাকে জানাচ্ছে প্রানীজগতের জনসংখ্যা সীমাবদ্ধ। ‘বন্য প্রানীর জীবন’ ওয়ালেসের পর্যবেক্ষনে ‘ হলো একটি অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম” , ( আন্ডারলাইন করা শব্দগুলো খেয়াল করুন, নীচে আরো আছে, আর কেন আমি তা আন্ডারলাইন করেছি তার ব্যাখ্যাও) ওয়ালেস আরো বললেন, ‘সকল ইন্দ্রিয়, শারীরিক এবং মানসিক শক্তি পুর্ন ব্যবহারের প্রয়োজন তাদের নিজেদের অস্তিত্ত্ব আর তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রতিপালন করতে’, খাদ্যের সন্ধান, বিপদ থেকে নিজেকে বাচিয়ে চলা প্রানী জীবনের প্রধানতম কাজ, আর দুর্বলেরা তাই টিকে থাকতে পারে না সেই সংগ্রামে।
দক্ষ নমুনা সংগ্রহকারী ওয়ালেস খুব ভালো করে জানতেন, একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বৈচিত্র, “ হয়তো এই সব বৈচিত্রগুলোর…অবশ্যই প্রজাতির সদস্যদের আচরন বা ক্ষমতার উপর সুনির্দিষ্ট কোন প্রভাব আছে, যতই তা ক্ষুদ্রতম হোক না কেন… এমন কোন বৈচিত্র বা প্রকারণ যা কিনা সামান্য শক্তিশালী করে, অবশ্যই সংখ্যায় তারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।”

ছবিঃ ইন্দোনেশিয়ার দুর্গম দ্বীপ টেরনাটে (দুরে), যেখানে ওয়ালেস ম্যালেরিয়ার সাথে যুদ্ধ করার সময় তার ’প্রাকৃতিক ‘নির্বাচন’ নিয়ে তার জীবনের সবচেয়ে বড় তত্ত্ব নিয়ে ভাবেন (ফটো ক্রেডিট: ফাদিল/করবিস)।

তার সমস্ত ধারনা ওয়ালেস মাত্র কয়েক রাতের মধ্যে সম্পুর্ন লিখে ফেলেন। তিনি তার রচনার নাম দেন “” ” On the Tendency of Varieties to Depart indefintly from the Original” বা ’মুলরুপ থেকে বৈচিত্রতার অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবর্তিত হবার প্রবণতা প্রসঙ্গে”। ওয়ালেসের রচনা ‍ছিল শুধু একটা খসড়া রুপরেখা মাত্র, ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানের কেন্দ্র থেকে ১০,০০০ মাইল দুরে, ভুমিকম্প-বিদ্ধস্ত দ্বীপের প্রায় ধ্বংশপ্রাপ্ত এক বাড়িতে বসে জ্বরের প্রকোপের মধ্যে পুরো চিন্তাটা অনুধাবন করে লেখা। ওয়ালেস সরাসরি লেখাটাকে জার্ণালে পাঠাতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন আগে তার রচনা কেউ আগে পড়ুক। সুতরাং তিনি লেখাটি পাঠালেন একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানীর কাছে, যার সাথে তিনি কেবল পত্র যোগাযোগ শুরু করেছিলেন, সেই প্রকৃতি বিজ্ঞানীর নাম -চার্লস ডারউইন। ১৮৫৮ সালেন জুন মাসের কোন সময় ডারউইন ওয়ালেসের রচনাসহ চিঠিটি হাতে পান। রচনাটি যখন পড়ে, তিনি হতভম্ব হয়ে যান। হতভম্ব হবার কারন স্পষ্ট হয়, যদি ডারউইনের পরিকল্পিত বড় আকারের একটা বই এর সম্প্রতি সমাপ্ত খসড়া দুটি অধ্যায়, আমরা ওয়ালেসের রচনার ভাষার সাথে তুলনা করি। ফেব্রুয়ারী, ১৮৫৭ সালে, ডারউইন তার বইএর ৫ম অধ্যায় লেখেন এবং নাম দেন “”‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে অস্তিত্ত্বের জন্য সংগ্রাম’ (আবার আন্ডরলাইন), এর পরের মাসেই তিনি ৬ ষ্ঠ অধ্যায় শেষ করেন যেখানে ব্যাখ্যা করেন যে: সমস্ত প্রকৃতি, যুদ্ধরত.. এই সংগ্রামে প্রায়শই বর্তায় ডিম বা বীজের উপর, অথবা চারাগাছে … যে কোন বৈচিত্র বা প্রকারণ, তা যে যতই ক্ষুদ্রতম হোক না কেন, যদি তা জীবনের যে কোন অংশে যদি সামান্যতমভাবে জীবের উপকার করে, সেই বৈচিত্রগুলো পরবর্তী প্রজন্মে সুরক্ষিত হয় বা নির্বাচিত হয়’।
দু্ই লেখকের কেউই একে অপরের চিন্তা বা রচনা সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন না। তাহলে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো ভাষার এই লক্ষনীয় সদৃশ্যতা -অস্তিত্ত্বের জন্য সংগ্রাম এবং ক্ষুদ্রতম বৈচিত্র?

মহান মনিষীরা একই ভাবে চিন্তা করেন:
দুজনেই প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং বুঝেছেন এটা আসলে একটা যুদ্ধক্ষেত্র। দুজনেই একই প্রজাতিরই অনেক নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন যে, বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাতির মধ্যে বৈচিত্রতা । দুজনেই দেখেছিলেন সামান্য ভিন্ন প্রজাতিরা নির্দিষ্ট দ্বীপে সীমাবদ্ধ এবং অনুধাবন করেছিলেন প্রজাতি পরিবর্তিত হয়। দুজনেই ম্যালথাসের রচনাটি পড়েছিলেন,বুঝতে পেরেছিলেন জনসংখ্যার উপর এর গুরুত্ব। একই ধরনের স্বাক্ষ্যপ্রমান তাদের প্রায় একই ধরনের উপসংহারে নিয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও ডারউইন,প্রজাতির উদ্ভব সম্বন্ধে তার প্রথম অনুধাবনের ২০ বছর পরও শঙ্কিত হয়েছিলেন যে,‘আমার সব মৌলিকতা, যতটুকুই থাকুক না কেন, সব তুচ্ছ হয়ে যাবে।’
‘সামান্য একটু গর্বিত’:
এর পরে আসলে কি ঘটেছিল তা এখনও বিতর্কের বিষয় কিছু কিছু পন্ডিতদের মধ্যে। মুল সত্যটা হলো যে, ওয়ালেস ডারউইনকে তার রচনার পান্ডুলিপিটা ভু-তত্ত্ববিদ চার্লস লায়েল বরাবর পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন, যা ডারউইন করেছিলেন। লায়েল এবং প্রখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী জে ডি হুকার, যারা দুজনেই ঘনিষ্ট ছিলেন ডারউইনের, যাদের কাছে আগেই ডারউইন তার প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব এবং এর স্বপক্ষে মৌলিক সব যুক্তিগুলো ব্যাক্তিগতভাবে প্রকাশ করেছিলেন। লায়েল এবং হুকার উদ্যোগ নেন ওয়ালেসের প্রবন্ধটি এবং সাথে ডারউইনের রচনার একটি সংক্ষিপ্ত রুপ আসন্ন লিনীয়ান সোসাইটির সভায় যৌথভাবে পাঠ এবং প্রকাশ করার জন্য।
আবিষ্কার করার একক গৌরব কি ওয়ালেসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল? যৌথ প্রকাশনার ব্যপারটা কি সঠিক ছিল? ( (যৌথপ্রকাশের আগে বিষয়টা কিন্তু ওয়ালেসকে জানানোই হয়নি )। ডারউইনই প্রথম ‘প্রাকৃতিক নির্বচন’ বা ন্যাচারাল সিলেকশন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এবং তিনি তার ১৮৪২ সালের ধারনাগুলোর প্রাথমিক রুপরেখা, অন্ততপক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক ভাবে, অন্য বিজ্ঞানীদের সামনে প্রকাশও করেছিলেন।
সত্যি কথা, আজ ডারউইনের নাম আর তার কর্ম ওয়ালেসের তুলনায় অনেক বেশীই পরিচিত। কিন্তু একবার ভেবে দেখুনতো এ বিষয়ে ওয়ালেসের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হতে পারে। মালয় দ্বীপপুন্জ্ঞে থাকাকালীন সময়ে, ডারউইনের কাছ থেকে ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ বইটার একটি কপি তিনি হাতে পান। বার বার বইটা তিনি পড়েন। তারপর তার প্রতিক্রিয়া দীর্ঘদিনের বন্ধু বেটসকে ব্যক্তিগত একটা চিঠিতে প্রকাশ করেন:

‘আমি জানিনা কিভাবে এবং কার কাছে আমি ডারউইনের এই বইটার প্রতি আমার প্রশংসাটা সম্পুর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারব … আমি সততার সাথে বিশ্বাস করি, যতই ধৈর্য্য নিয়ে আমি বিষয়টা নিয়ে কাজ এবং গবেষনা করি না কেন, আমি কখনোই এই বইএর মতো বিষয়টির সম্পুর্ণতার কাছে পৌছাতেই পারবো না, -এর সুদৃঢ় যুক্তি, অপুর্ব ভাষা আর প্রানশক্তি … ডারউইন একটা নতুন বিজ্ঞান এবং একটা নতুন দর্শনের সৃষ্টি করেছে, আর আমি ‍বিশ্বাস করি, মানুষের জ্ঞানের কোন শাখাতেই এমন পুর্ণতার নজির নেই, যা কেবল একজন ব্যাক্তির পরিশ্রম আর গবেষনার ফসল।’

এই চিঠিতে যেমন না, তার বাকী দীর্ঘ জীবনে কোনদিনও (৯০ বছর পর্যন্ত্য বেচে ছিলেন তিনি) ওয়ালেস একটিও অনুশোচনা, বিদ্বেষ বা ক্ষোভের শব্দ উচ্চারন করেননি। হয়তো ওয়ালেসের কাছে মুল ব্যাপারটাই ছিল বিজ্ঞানী সমাজে তার স্বীকৃতি আর গ্রহনযোগ্যতা পাওয়া নিয়ে। ১৮৫৮ সালের আগ পর্যন্ত্য তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের -যারা চিন্তার জগতে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন – আসরে ছিলেনস একজন বহিরাগত। যখন তিনি জানতে পারেন যে লায়েল এবং হুকার তার প্রবন্ধ সম্বন্ধে প্রশংসাসুচক মন্তব্য করেছেন, তিনি তার পুরাতন বন্ধু আর স্কুলের সহপাঠীকে লেখেন যে, ‘‘‘আমি সামান্য গর্ববোধ করছি..’, ওয়ালেস ঐ চক্রের কেন্দ্রে থাকতে চাননি. শুধুমাত্র তিনি বিজ্ঞানীদের চক্রের ভেতরে ঢোকার সুযোগ চেয়েছিলেন। আর সেটা, এবং আরো অনেককিছু -তিনি নিঃসন্দেহে অর্জন করেছিলেন।

ছবিঃ ওয়ালেস, (ছবিতে তার জীবনের শেষে). ১৮৫৮ সালে ডারউইনকে তার রচনাটা পাঠানোর জন্য কোনদিনও মনস্তাপে ভুগেছিলেন কিনা, তা কখনো প্রকাশ করেননি। (ফটো ক্রেডিট:করবিস)।