ক.
বই পড়ার সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হল–‘‘যতই আমরা অধ্যয়ন করি ততই আমাদের অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করি’’। এক্ষেত্রে নিজের অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করতে পেরে আমার বেশ ভালোই লাগে। আর একটা সমস্যা হল, যতবেশি পড়ি ততবেশি ততবেশি বাকি থেকে যায় পড়তে।সুতরাং কম পড়ায় বোধহয় ভালো–এতে করে জীবনটাকে এত ছোট মনে হবে না; আর একেবারে না পড়ার অভ্যেস তো আরও ভালো–ভালো ভালো বই না পড়তে পারার আক্ষেপ থেকে বাঁচতে পারা কম আশীর্বাদের কথা নয়!

বই পড়ার ক্ষেত্রে বরাবরই আমি একটু হিসেবি–প্রয়োজন ও ভালোলাগার দিকটাকে মাথায় রেখে বইয়ের ভেতর প্রবেশ করি। এবং যে বইয়েই হাত দিই না কেন শেষ পর্যন্ত দেখা যায় কোনো না কোনো কারণে বইটি ভালো লেগে গেছে। তাই প্রিয় বই নিয়ে লিখতে বসে অনেকগুলো বই এসে মগজের মধ্যে ছটফট করছে। আলোচ্য বই নিয়ে মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে ওদের নিয়ে দু’একটি বাক্য না লিখলে মগজের এই যানজট ঘুচবে না। তাই ওদের নিয়ে দু’একটি কথা লিখেই আমি মূল আলোচনায় চলে যাবো।

খ. আমার প্রিয় বইগুলোর একঝলক
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়(১৯০৮-১৯৫৬)-এর উপন্যাসিকা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’(১৯৩৬) ও আইরিশ নাট্যকার জন মিলিংটন সিনজ(১৮৭১-১৯০৯)-এর নাটক ‘রাইডার্স টু দ্য সি’(১৯০৪) আমার প্রিয় বই গুলোর অন্যতম। দুটো বইয়েই এ্যন্টাগোনিস্ট হচ্ছে সুমদ্র। প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কতটা অসহায় তারই চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে আলোচ্য দুটি গ্রন্থে। একটিতে (‘পদ্মা নদীর মাঝি’) দেখি, মাঝবয়স্ক-পরিশ্রমী পুরুষ কুবেরের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। প্রকৃতির সাথে হাত মিলিয়ে বিরুদ্ধাচরণ করে তার ভেতরের পাশবিক চেতনা। ঈশ্বর-মানুষে আস্থা হারিয়ে কুবের একসময় মেনে নেয়–‘‘ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে, তাহাকে এইখানে খুঁজিয়া পাওয়া যায়বেনা।’’ অন্যটিতে (‘রাইডার্স টু দ্য সি’) বৃদ্ধা মওরার জীবন থেকে সুমদ্র একে একে ছিনিয়ে নেয় পরিবারের সাতটি পুরুষ। শশুর-স্বামী-সন্তান হারিয়ে মওরা শোকে পাথরে পরিণত হয়। প্রকৃতির বিজয় মেনে নিয়ে আপন মনে আওড়াতে থাকে বিশ্বপ্রকৃতির চিরন্তন সত্যকে– “They’re all gone now and there isn’t anything mire the sea can do to me… No man at all can be living forever and we must be satisfied.” কাজেই দেখা যাচ্ছে, অনুভবে ও আত্মপোলব্ধিতে একটি বই অন্যটির পরিপূরক এবং আমার প্রিয় বই তো বটেই।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৯৪-১৯৫০)-এর উপন্যাস ‘আরণ্যর’(১৯৩৯) ও ভন গ্যেটে(১৭৪৯-১৮৩২)’র ‘সাফারিং অব ইয়ং ইয়ের্দার’(১৭৭৪) আমার অত্যন্ত প্রিয় বই। লেখকদ্বয়ের বর্ণনাশক্তি বা ন্যারেটিভ পাওয়ার ও কাব্যিক আবহ আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়–অনুভূতি শক্তিগুলো আরো সজাগ ও স্বর্গীয় হয়ে ওঠে।

উপনিবেশবাদের আল্টিমেট পরিণতির দিকটি সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে জোসেফ কনরাড(১৮৫৭-১৯২৪)-এর ‘দ্য হার্ট অব ডার্কনেস’(১৯০২) উপন্যাসে। উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র মি. কুটজ আফ্রিকার অন্ধকারতম অঞ্চল কঙ্গোর বাসিন্দাদের আলোকিত করতে গিয়ে নিজেই হয়ে ওঠেন অন্ধকারের একজন। মানুষের অবচেতন মনের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা যে সহায়ক পরিবেশ পেলেই প্রকাশিত হয় তারই বহিঃপ্রকাশ এটা। উপনিবেশবাদের ভয়াবহ দিকটি উপলব্ধি করেই মৃত্যুর আগ-মুহূর্তে জীবন সম্পর্কে কুটজ-এর শেষ স্বীকারোক্তি দাঁড়ায়–‘horror! Horror! Horror!’। কুটজকে ‘evil genius’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এক্ষেত্রে কুটজ-এর চরিত্রের প্রকৃতি ফস্টাস (‘ফস্টাস’), স্যাটান (‘প্যারাডাইস লস্ট’), হেথক্লিপ (‘উইদারিং হাইটস’), আহাব (‘মবি ডিক’), ম্যাকবেথ (‘ম্যাকবেথ’) প্রভৃতি চরিত্রের সাথে বেশ মিলে যায়। এমনিভাবে, অনেক সময় গল্পের প্রটাগোনিস্ট বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে একটি উপন্যাস বা গল্প পাঠক মনে চিরকালীন আবেদন রেখে যায়। এক্ষেত্রে লেখকরা ভালো মন্দের মিশ্রণে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলেন যে বইটি ঐ চরিত্রের কারণে আমাদের খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। যেমন, পিপের কারণে ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন’, ক্রুসোর কারণে ‘রবিনসন ক্রুসো’, অয়ডিপাউসের কারণে ‘অয়ডিপাউস’, আনা কারেনিনার কারণে ‘আনা কারেনিনা’, এবং ম্যাকবেথের কারণে ‘ম্যাকবেথ’ আমার প্রিয় বই হয়ে উঠেছে।

যে দুটি উপন্যাসের ভালো লাগার কথা আলাদা করে বলতেই হয়, তা হলো জোনাথান সুইফট(১৬৬৭-১৭৪৫)-এর ‘গ্যালিভার’স ট্রাভেলস’(১৭২৬) ও জর্জ অরওয়েল(১৯০৩-১৯৫০)-এর ‘এ্যনিমাল ফার্ম’(১৯৪৫)-এর কথা। শৈলী ও বিষয়বস্ত্তর কারণে বেশ সাহসী ও শক্তিশালী উপন্যাস এ দুটো। মানব প্রকৃতির সামগ্রিক দিকটাকে স্যাটায়ার করা হয় ‘গ্যালিভার ট্রাভেলস’-এ আর সাধারণভাবে রাজনীতি বা রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিকাশ ও বিপর্যয়কে স্যাটায়ার করা হয় ‘এ্যনিমাল ফার্ম’ উপন্যাসে। এই দুটি উপন্যাসের গভীর পাঠ মানুষ সম্পর্কে আমাদের আশাহত করে তোলে বটে। কিন্তু সত্যি এটাই–মানুষ পাশবিক ও মানবিক চেতনার মিশ্রণেই মানুষ। এই কথাটি খুব সুন্দরভাবে রবার্ট লুই স্টিফেনসন(১৮৫০-১৮৯৪) তাঁর ‘ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড’(১৮৮৬) উপন্যাসে বলেছেন– ‘man is not truly one but truly two’। আমি তো মনে করি, বেসিক্যালি মানুষ হচ্ছে অস্থির প্রকৃতির, এবং স্বভাবগত ভাবেই ক্ষমতালোভী ও অলস প্রকৃতির। সুতরাং মানুষের কাছ থেকে absolute good বের করে আনা কখনই সম্ভব নয়। আর সেটা সম্ভব নয় বলেই ‘absolute good’-এর ধারণা থেকেই সৃষ্টিকর্তার ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী মনোবিজ্ঞান যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা হয়ত এটাকে ফ্রয়েডীও বা নয়াফ্রয়েডীও মতবাদ বলে উড়িয়ে দেবেন, কিন্তু সাহিত্যে আমরা মানুষ সম্পর্কে এই ধারণাটাই পাই বেশি।

নারীদেরকে নিয়ে তথাকথিত যে ধ্যান-ধারণা সেই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে অনেক লেখক-সাহিত্যিক কলম ধরেছেন। নারীরা যে মানসিকভাবে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের থেকে পিছিয়ে নেই বরং কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষকেও ছাড়িয়ে গেছে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বেশ কিছু সাহিত্যকর্মে। এবং এর মধ্যে থেকে যে বইগুলো আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় উঠে এসেছে সে সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললেই নয়। প্রথমেই বলতে হয়
এ্যরিস্টফান(৪৪৪খ্রি.পূ.-৩৮৬খ্রি.পূ.)-এর ‘লিসিসটাটা(৪১১খ্রি.পূ.)’র কথা। এই নাটকে স্পার্টান পুরুষদের যুদ্ধবাজ মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য লিসিসটাটা যে উপায় বের করে (যতক্ষণ না স্বামীরা যুদ্ধ পরিত্যাগ করে ততক্ষণ স্ত্রীরা তাদের সাথে বিছানায় যাবে না) তা আপাত দৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও বাস্তবিকপক্ষে গভীর মনোযোগের দাবিদার। এ্যরিস্টফ্যান মজা করতে করতে বলে ফেলেছেন ইতিহাসের চরম সত্যটি–‘war is concerned with women’। ইউরিপাইডস(480 BC–406 BC)-এর গ্রিক ট্রাজেডি মিডিয়া(431 BC) তেও আমরা মিডিয়াকে একজন প্রতিবাদী নারী হিসাবে দেখতে পাই। স্বামী জেসনের প্রতি সে যে ব্যবহারটা করে তা অতি পাশবিক কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে কিন্তু তার প্রতিশোধের কারণ নিয়ে কোন দ্বিমত ঘটবে না। একইভাবে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী হয়ে ওঠে নোরা (ইবসেন-এর নাটক ‘ডলস হাউস’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র) ও টেস (উপন্যাস ‘টেস অব দ্য আরবাভিলে’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র)। নোরার নিজের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে স্বামী-সন্তান ছেড়ে চলে আসা ও টেসের স্বামী এলেককে খুন করে প্রেমিক এঞ্জেল ক্লারাকে গ্রহণ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তা অতি বিরল হলেও বেশ জরুরী। মা হিসাবে আবার নারীকে দেখা যায় ভিন্নরূপে, এখানে এসে নারী হয়ে ওঠেন ত্যাগী ও আরো বেশি ব্যঞ্জনাময়ী। মাক্সিম গোর্কি(১৮৬৮-১৯৩৬)’র ‘মা’(১৯০৭) উপন্যাসের মা, পার্ল এস বাক(১৮৯২-১৯৭৩)-এর ‘মা’(১৯৩৩) উপন্যাসের মা, বারটোল ব্রেট(১৮৯৮-১৯৫৬)-এর ‘মাদার কারেজ এন্ড হার চিলড্রেন’(১৯৩৮) নাটকের মা, শওকত ওসমান(১৯১৭-১৯৯৮)-এর ‘জননী’(১৯৫৮) উপন্যাসের মা, মহাশ্বেতা দেবী(১৯২৬-)’র ‘হাজার চুরাশির মা’(১৯৭৪) উপন্যাসের মা এবং আনিসুল হক(১৯৬৫-)-এর ‘মা’(২০০৩) উপন্যাসের মা তেমনি উদাহরণ। বইগুলো বার বার পড়তে ইচ্ছে হয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রিয় বইয়ের তালিকা নির্ণয় করা ক্ষেত্র বিশেষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা সময়ের পরিক্রমায় এই তালিকা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি পরিবর্তিতও হয়। যেমন, একসময় হুমায়ূন আহমেদ(১৯৪৮-)-এর হিমু সিরিজের বইগুলো আমার খুব প্রিয় ছিল। এখনো reading for pleasure ক্যাটাগরিতে ঐ সিরিজের বইগুলো আমার ভালোলাগে। মজা পেতে এখনো ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ পড়ি। মনের আনন্দের জন্য বার বার পড়তে ইচ্ছে হয় ‘এজ ইউ লাইক ইট’, ‘দ্য মান হু কেম টু দ্য ডিনার’, ‘দ্য এ্যলকেমিস্ট,’ ‘ইম্পরট্যান্ট অব বিং আর্নেস্ট’ বইগুলি। বিভিন্ন কারণে আরও যে বইগুলো আমার প্রিয়, তা হলো- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৯৮-১৯৭১)-এর ‘কবি’(১৯৪৪), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’(১৯৩৬), বিভূতিভূষণ-এর ‘পথের প্যাঁচালী’(১৯২৮), রবীন্দ্রনাথ(১৯৬১-১৯৪১)-এর ‘শেষের কবিতা’ ও ‘গোরা’(১৯১০), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’, বুদ্ধদেব গুহ-এর ‘চাপরাশ’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(১৮৭৬-১৯৩৮)-এর ‘শ্রীকান্ত’(১৯১৭,১৮), জয় গোস্বামীর ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’, হ্যারিয়েট বিচার স্টো(১৮১১-১৮৯৬)-এর ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’(১৮৫২), ভিক্টর হুগো(১৮০২-১৮৮৫)-’র ‘লা মিজারেবল’(১৮৬২), ভন গ্যেটে(১৭৩৯-১৮৩২)-র ‘ফাউস্ট’(১৮৩২), আলবেয়ার কামু(১৯১৩-১৯৬০)-র ‘দ্য আউটসাইডার’(১৯৪২), আর্থার মিলার(১৯১৫-২০০৫)-এর ‘ডেথ অব এ সেলস ম্যান’(১৯৪৯), সামুয়েল বেকেট(১৯০৬-১৯৮৯)-এর ‘ওয়েটিং ফর গোডুট’(১৯৪৯)।

গ ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ ও ‘মেটামরফোসিস’
আলোচ্য প্রবন্ধে আমার প্রিয় বই হিসাবে আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছি লেভ তলস্তয়(১৮২৮-১৯১০)-এর ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’(১৮৮৬) ও কাফকার(১৮৮৩-১৯২৪) ‘মেটামরফোসিস’(১৯১৫) বই দুটিকে। এর কারণ অনেক ও বহুবিদ। শুরুতেই যে প্রশ্নটি আসতে পারে–একবিংশ শতকে মানুষ যেখানে ‘প্রিয় গাড়ি’, ‘প্রিয় বাড়ি’, ‘প্রিয় ব্রান্ড’ ‘প্রিয় সেলিব্রেটি’ এগুলো নিয়ে পড়ে আছে সেখানে ‘প্রিয় বই’ নিয়ে চিন্তা কেন? আর যদি ‘প্রিয় বই’ নিয়ে চিন্তা করতেই হয় তাহলে বইটি কোন জাতের বা বর্ণের হওয়া উচিৎ? তথাকথিত ‘প্রিয়’ ও সময়ের মাতামাতিকে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় যে বইগুলো প্রিয় হতে পারে তা হল–কোন গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর লেখা বই কিংবা ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর পরিপাটি করে লেখা কোন বই কিম্বা কোন সেক্স গাইড। কিন্তু বিষয় যদি হয় সাহিত্য এবং সাহিত্যের কাজ যদি ধরে নিই–‘study of human disease’ আর যদি বিশ্বাস করি–‘art for life’s sake’, তাহলে এই সময়ে যে দুটো বই আমার কাছে অনেক বেশি প্রিয় ও দরকারী হয়ে ওঠে, তা হলো–‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ ও ‘মেটামরফোসিস’।

ভাষার বিচারে ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ রাশিয়ান ও ‘মেটামরফোসিস’ ফরাসী এবং উপন্যাসিকা দুটির রচনাকালের মধ্যবর্তী ব্যবধান প্রায় তিন দশক হওয়া সত্বেও এদের মধ্যকার বহুধরণের অন্তমিলিই আমাকে বইদুটি একসঙ্গে আলোচনার পথটি সুগম করে দিয়েছে। দুটির গল্প শুরু হয় এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ শুরু হয় এই উপন্যাসিকার কেন্দ্রীয় চরিত্র ইভান ইলিচের মৃত্যু আর ‘মেটামরফোসিস’ শুরু হয় এই উপন্যাসিকার কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রেগর সামছার দৈহিক পরিবর্তন অর্থাৎ মানুষ থেকে পোকা হওয়ার মধ্য দিয়ে। ইভান ইলিচের মৃত্যু ও গ্রেগরের পোকা হয়ে যাওয়ার কথা লেখকদ্বয় খুব সহজেই বলে ফেলেন। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামছার পোকা হয়ে যাওয়া এবং এই পরিবর্তনকে গ্রেগরের খুব সহজভাবে গ্রহণ করা–যেন এটা কোন ঘটনাই না! এই উপন্যাসিকার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক এটাই। দুটি গল্পেই একটি সরল আখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা ঢুকে পড়ি মানব জীবনের গাঢ় ও গূঢ় রহস্যের মধ্যে।

ঘটনার ক্রমানুসারে ইভান ইলিচের মৃত্যু এই উপন্যাসিকার অন্তের বিষয়। ইভান ইলিচের মৃত্যু দিয়ে গল্পটি শুরু করার ফলে শুরুতেই বোঝা যায় ইভান ইলিচের চারপাশের পরিমণ্ডলের সাথে তার সম্পর্ক এবং তলস্তয়-এর জীবন সম্পর্কে ক্রিটিক্যাল ভিউ। একই কথা মেটামরফোসিসের ক্ষেত্রেও খাটে। এখানে গ্রেগরের পোকা হয়ে যাওয়ার ফলে তার চারপাশের মানুষ (অথবা human in general) সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরো পরিষ্কার হয়।

ঘ. লড়াইটা মধ্যবিত্তের এবং অর্থ-বিত্তই যেখানে সব
ফ্ল্যাশব্যাকে তলস্তয় আমাদেরকে ইভান ইলিচের অতীত জীবনে নিয়ে যান। এখানে তিনি একটা কথা দিয়েই ইভান ইলিচ-এর জীবন সম্পর্কে তাঁর স্টাডি অনেকখানি পরিষ্কার করে তোলেন–“most simple and most ordinary and therefore most terrible.” ইভান ইলিচ তার সমস্ত জীবন ব্যপী প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ধ্যানে-জ্ঞানে সুখী হতে চেয়েছিল। সে তার বাবার তৃতীয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়জন–প্রথমজনের মত ওত ভদ্র-শান্ত নই আবার ছোটজনের মত অত অভদ্র-অশান্ত নই। তের বছর বয়সে সে আইনের স্কুলে ভর্তি হয়, একজন আদর্শ ছাত্র হিসাবে সেখানকার নিয়মকানুন মেনে চলে। সমাজের আরোপিত কোন নিয়মের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। সে পোশাক পরেছে, খাবার খেয়েছে, সবই প্রচলিত নিয়মে। বিয়ে করেছে প্রচলিত বিশ্বাসে। তার সন্তান হয়েছে, সংসার হয়েছে কারণ সমাজে একজন সুখী মানুষের এসব থাকে। আরো যা থাকে তা হলো সুন্দর একটা বাড়ী। ইভান টাকা জমিয়ে খুব সুন্দর একটা বাড়ি করার পেছনে যথেষ্ট শ্রম দিয়েছে। বিবাহের কিছু বছর পর ইভান ইলিচ বুঝতে পারে, বিবাহ সস্পর্কে তথাকথিত যে ধারণা–“conducive to the pleasures and amenities of life,” তা সবসময় ঘটে না। দাম্পত্য অশান্তির কারণে সে আরো বেশি কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে। সমাজ-স্বীকৃত জীবনযাপন করার জন্য স্ত্রীর সাথে একটা ঠাণ্ডা সম্পর্ক বজায় রাখে। এমনিভাবে তলস্তয় ইভান ইলিচকে খুব সাধারণভাবে একটি সমাজের মেজরিটির প্রতিনিধি হিসাবে গড়ে তুলেছেন। ইভান হয়ে উঠেছে একটি সমাজের ‘Everyman’। ইভান তৎকালীন রাশিয়ার পুঁজিবাদী সমাজের মস্ত হাতিয়ার। সমাজের উঁচুশ্রেণী থেকে নির্ধারিত জীবনকে সত্য বলে মেনে চলেছে সারাটা জীবন। তলস্তয় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাথে উঁচুশ্রেণীর সম্পর্ককে মেটাফোর হিসাবে দেখিয়েছেন–‘that of a fly being drawn to a bright light’। একটি মাছি যেমন আলোর মায়াতে তার কাছে ছুটে যায় এবং সেখানে পৌঁছানো মাত্র মারা পড়ে। তেমনি ইভান ইলিচ জীবন ভেবে যে জীবনের পেছনে ছুটে চলে সেই জীবনই তাকে জীবিত থেকেও মৃতের স্বাদ এনে দেয়।

ইভানের মতন গ্রেগরও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। সেলসম্যানের চাকুরী করে সে। যদিও চাকুরীটা তার মোটেও ভালোলাগে না, তথাপি পরিবারের কথা ভেবে ছাড়তেও পারে না। প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথে আপোষ করে বেঁচে থাকতে হয় গ্রেগরকে। আপোষ করতে হয় অফিসের বস, পরিবার এবং সমাজের সাথেও। আপোষ করতে করতে একসময় গ্রেগর হারিয়ে ফেলে তার মানব সত্তাকে। তার দৈহিক পরিবর্তনটা তারই চূড়ান্ত প্রতিফলন। গ্রেগরের অফিসে যেতে এক ঘণ্টা দেরী হওয়াই অফিসের বস গ্রেগরের খোঁজ নিতে বাড়ি আসে, অর্থকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গ্রেগরের প্রতি ঘণ্টা বিক্রি হয়ে যায় টাকার কাছে। অতিরিক্ত এক ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়া মানেই বাণিজ্য থেকে এক ঘণ্টা দূরে থাকা। গ্রেগরের দরজা খুলতে দেরী হলে গ্রেগরের মা বসকে বোঝায়–গ্রেগর সারাদিন কাজের মধ্যেই থাকে, এমনকি সন্ধ্যায়ও বাইরে যায় না। গ্রেগরের পোকা হয়ে যাওয়ার পর পরিবার কিংবা সমাজের আর কোন কাজে লাগে না সে ফলত সে পরিবার এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

আপাত দৃষ্টিতে ‘মেটামরফোসিস’ ও ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ হচ্ছে গ্রেগর সামছা ও ইভান ইলিচ নামের খুব সাধারণ দু’জন মানুষের গল্প। কিন্তু এঙ্গেলস এবং মার্ক্স-এর ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ অধ্যয়ন সাপেক্ষ নভেলা দুটির গভীর পাঠ থেকে জানা যায় এটি আধুনিক পূজিকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার মেটাফোরিক উপস্থাপন। গ্রেগর আর ইভান হচ্ছে এখানে শ্রমিক শ্রেণী বা proletariat আর অফিসের বসরা হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি। পূজিকেন্দ্রিক সমাজে একটা মানুষের পরিচয় ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয় তার উৎপাদন ক্ষমতার ভিত্তিতে। তাই কাজ করতে করতে তারা ভুলে যায় তাদের মানবিক অস্তিত্বের কথা। তৎকালীন পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও নীতিকে চরম সত্য জেনে পরম মমতায় লালন করেছে ইভান ইলিচ ও গ্রেগর সামছা। নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসে সমাজের চোখে সুখী হতে চেয়েছে তারা। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর তারা মানব সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আপন সত্তার কাছে। মানব সমাজ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আবিষ্কার করেছে ঐ সমাজকে, যে সমাজে কাজ না থাকলে কাছের মানুষগুলো অচেনা হয়ে যায়, বাতিল হয় সমাজের সদস্যপদ।

ঙ. মানুষের স্বার্থপরতা
ইভান ইলিচের মৃত্যু সংবাদ শুনে তার সহকারী বন্ধুদের মাথায় প্রথমেই যে চিন্তাটি আসে তা হল–ইভান ইলিচের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট খালি পদে কাকে নিযুক্ত করা যায়। বন্ধু হারানোর শোক নয় পদোন্নতি তাদের আলোচনার প্রাথমিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্য যে বিষয়টি তাদের মধ্যে স্বস্তি এনে দেয়, তা হল–“it is he who is dead and not I.” ইভান ইলিচের বন্ধুরা তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যায়, যেতে হয় এ জন্য। এটা তাদের কাছে শুধুই একটা ‘ritual’. ইভান ইলিচের স্ত্রী প্রাসকোভইয়া ফেদেরোভনা ইভান ইলিচের মৃতদেহ একঘরে রেখে অন্যঘরে ইভান ইলিচের সবচেয়ে কাছের বন্ধু পিটার ইভানোভিচের সাথে আলোচনা করে কী করে ইভান ইলিচের পেনসনের টাকার পরিমাণটা বাড়ানো যায় এবং কোন কবর স্থানের জমিনের দাম অপেক্ষাকৃত কম এই বিষয় নিয়ে।

ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায়, ইভান যখন অসুস্থ ছিল তখন স্ত্রী, কন্যা রুটিন করে তার রুমে প্রবেশ করতো। ইভান ইলিচের বেঁচে থাকা তাদের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইভান ইলিচের আত্মজিজ্ঞাসার জায়গাটা কেউই অনুভব করতে পারে না। এমনটি ডাক্তারও ইভান ইলিচকে যন্ত্রের মত দেখে চলে যায়। ইভান ইলিচ বুঝতে পারে, তাকে কেউই বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাচ্ছে না। সবার কাছে ইভান ইলিচের অসুস্থতা এবং সুস্থ থাকা সমান ভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। পরিবারের সবার ধারণা, এই রোগের জন্য ইভান নিজেই দায়ী এবং নিয়মিত ঔষধ সেবনে সেরে উঠবে সে। ফলতঃ ইভান ইলিচের শারীরিক সমস্যার থেকেও ভয়ংকর হয়ে ওঠে তার মানসিক সমস্যা। তার স্ত্রী কন্যা তাকে অসুস্থ রেখে সাজ-সজ্জা করে থিয়েটারে যায়। ইভান ইলিচের তখন মনে হয়, এই পৃথিবীটা হচ্ছে একটা থিয়েটার। এখানে চারপাশের সবাই অভিনয় করে চলেছে এবং তাদের জগতটা হচ্ছে–‘mesh of falsity’। এবং আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাই এই এই তথাকথিত প্রগ্রেসিব সভ্যতার মিথ্যা ও কৃত্রিমতা ইভান ইলিচের মৃত্যুর জন্য দায়ী। মানব জীবনের প্রকৃত সত্যটা অনুভব করতে থাকে ইভান ইলিচ। সে একমসয় উপলব্ধি করে, ‘illness is not a question of health or sickness, but of life or death.’

অন্যদিকে, গ্রেগর সামছার পোকা হয়ে গেলে তার চারপাশের স্বার্থপর মানুষগুলোর চেহারা পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়। মা-বাবা-বোন এই নিয়ে গ্রেগরের পরিবার। পোকা হওয়ার আগ পর্যন্ত আর পাঁচটা সুখী পরিবারের মতই ছিল সব। আর গ্রেগরের দৈহিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটলো পরিবারের অন্যদের আচরণের। বাবা আপেল ছুড়ে গ্রেগরকে ঘরের ভেতর থাকার ইঙ্গিত দেয়, মা গ্রেগরকে দেখলে ভয়ে মূর্ছা যায়, বোন প্রথম দিকে গ্রেগরের খাবার দাবারের দিকে খেয়াল রাখলেও পরে আর রাখে না। গ্রেগরের ব্যবহার্য কোনকিছু কেউ স্পর্শ করে না। আপাতদৃষ্টিতে গ্রেগর পোকা হয়ে যায় বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মানুষ্যগুনাবলী হারায় না বরং আশেপাশের মানুষরাই আপাতদৃষ্টিতে ঠিক থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারাই মানুষ্যগুনাবলী হারিয়ে পোকা হয়ে যায় তারাই। গ্রেগর যখন পশুর মত খাটুনি খেটে সংসার চালাতো, বাবার ঋণের টাকা পরিশোধ করতো তখন পরিবারের আর সবাই আয়েশ করে দিনযাপন করতো। আর গ্রেগর যেই মাত্র কাজ হারালো তখন তাকে ছুঁড়ে ফেলা হল আবদ্ধ কক্ষে। পরিবারের সকলের কাছে গ্রেগরের মৃত্যু হয়ে উঠলো একমাত্র কাম্য। আস্তে আস্তে গ্রেগরের রুম থেকে আসবাবপত্র বের করে নেওয়া হল। বানানো হল স্টোর রুম।

চ. মৃত্যু ও পুনর্জন্ম
আফিমের ঘোরে যখন ইভানের শারীরিক যন্ত্রণা কিছু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়ায় তখন ইভান স্বপ্ন দেখে, তাকে একটি গভীর কালো বস্তার ভেতর ঠেলে ঢুকানো হচ্ছে। সে ঐ অন্ধকারে পতিত হবার কামনা ও ভয় করে। যেন সে সাহায্য ও সহযোগিতা দুটোই করে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে কাঁদতে কাঁদতে ঈশ্বরকে বলেন, “Why hast Thou done all this? Why has Thou brought me here? Why, why dost Thou torment me so terribly?” তারপর সে নীরব হয়ে যায়, তার ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, “What is it you want?” ইভান উত্তর দেয়, সে ভালোভাবে এবং শান্তিতে বাস করতে চায়, যেমনটি সে সারা জীবন করে আসছে। অতঃপর সে তার অতীত জীবনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অনুভব করে, যতবেশি সে তার বাল্যকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে ততবেশি হতাশ হয়ে পড়েছে আর মূল্যহীন হয়ে উঠেছে তার জীবন।

ইভানের স্বপ্নের কালো বস্তাকে যদি কবর বা মৃত্যুর সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সে মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করছে আবার তীব্রভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আবার গভীর বস্তাটিকে যদি মাতৃগর্ভের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, চিন্তা চেতনার জগতে ইভানের পুনর্জন্ম হচ্ছে। বস্তায় প্রবেশ মুহূর্তে যে যন্ত্রণা সে অনুভব করছে তা হল জন্মমুহূর্তের যন্ত্রণা। যেটাকে ইভান ইলিচের মৃত্যু বলে মনে হচ্ছে, সেটা আসলে তার দৈহিক মৃত্যু ও আত্মার বা আধ্যাত্মবোধের পুনর্জন্ম। এই আধ্যাত্মবোধ বা আত্মার মৃত্যুর কারণ ছিল তার তথাকথিত ধারায় যাপিত জীবন। সমাজের চোখে ইভান ইলিচের মৃত্যু ঘটছে বটে কিন্তু ইভান ইলিচের কাছে তার পুনরায় জন্ম হচ্ছে। ইভান যখন শারীরিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তার আধ্যাত্মবোধের জন্মের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সে নিজেকে তার এতদিনের বিশ্বাস ও যাপিত জীবনের প্রতি প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হয়েছে।

ইভান তার নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করে, “Life, a series of increasing sufferings, flies further and further towards its end—the most terrible suffering.” সে এখন খতিয়ে দেখতে চায়–“what it is all for.” জীবনের সমস্ত অধ্যায় ঘেঁটে ঘেঁটে মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ইভান বুঝতে পারে, তার সমস্ত জীবন ধরে সে যা সঠিক বলে মান্য ও গণ্য করেছে তা সবই ছিল ভুল। সে ছিল সুখী–সমাজের চোখে এবং সে সেটাই হতে চেয়েছিল। ইভানের আধ্যাত্মবোধ যখন ফিজিক্যাল জগতকে অতিক্রম করে যায়, তখন সে মৃত্যুকে জয় করে নতুন জীবন অর্জন করে, এবং এই মুহূর্তে যখন সে নিজেকে প্রশ্ন করে–“What is the right thing?” ঠিক তখনই তার একটি হাত তার ছেলে ভাসার মাথা স্পর্শ করে। ভাসার মধ্যে ইভান তার বাল্য কালের অবয়ব দেখতে পাই, সে তার জন্য দুঃখ অনুভব করে। এবং তার কাছে ক্ষমা চায়। মানুষের ফিজিক্যাল সংস্পর্শে এসে ইভান অনুভব করে, সমস্ত জীবন ব্যাপী সে শুধু নিজের চারপাশে একটি দেয়াল স্থাপন করে এসেছে, সরে গেছে অর্থপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক থেকে। যখন সে মানব জীবনের প্রকৃতি উদঘাটন করতে সক্ষম হয় তখনই তার পুনর্জন্ম হয়–সে মারা যায় শান্তিপূর্ণ ভাবে।

‘মেটামরফোসিস’-এর প্রথম বাক্যেই গ্রেগর সামছার মৃত্যু ঘোষিত হয় এবং সমস্ত গল্প জুড়ে সে ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। ইভান ইলিচের মত গ্রেগর সামছাও মৃত্যু-চিন্তার সাথে লড়াই করে চলে প্রতিনিয়ত। সমালোচক মার্টিন গ্রিনবার্গ এর মতে– ‘‘…Tolstoy’s work is about death literally and existentially; Kafka’s is about death in life’’। যতক্ষণ না ইভান ইলিস তার যাপিত জীবনকে মিথ্যা বলে মেনে নেয় এবং স্বীকার করে এটা যেমনটি হওয়ার কথা ছিল তেনটি হয়নি, ততক্ষণ সে তার আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে সজাগ হতে পারে না। শেষ মুহূর্তে সে আবিষ্কার করে–‘the truth of life and death’। এবং তার মৃত্যু ঘটে। গ্রেগর সামছার ক্ষেত্রে, জীবিত থেকেও সে মৃত সুতরাং মুক্তি মেলে না সহজে। সকালে উঠে গ্রেগর তার যে অস্বিত্ত সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে সেটাই হচ্ছে তার ক্ষেত্রে–‘the truth of life and death’। ‘the dream reveals the reality’–কথাটি উভয়ের ক্ষেত্রে সত্য বলে খাটে। গ্রেগর সামছারও মৃত্যু ঘটে শান্তিপূর্ণ ভাবে।

ছ. একবিংশ শতকের মানসে
চলতি শতকে আমরা দেখছি মানুষ বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। শিল্প বিপ্লব ও বিজ্ঞানের উন্নতির চূড়ান্তে পর্বে আমরা উপস্থিত–মানব প্রকৃতির সাথে সাথে বিশ্ব-প্রকৃতির এক চরম বিপর্যয় টের পাচ্ছি। এখন অর্থ নির্ধারণ করছে সবকিছু। টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ভোতা হয়ে যাচ্ছে আমাদের অনুভূতিগুলো। ব্যস্ততা এতই বেড়ে যাচ্ছে যে আমরা পরিশ্রম করে যা অর্জন করছি তার দশ ভাগের একভাগও নিজের জন্য ব্যয় করার সময় পাচ্ছি না। মানুষের পরিবর্তে যন্ত্রের সাথে হয়ে উঠছে আমাদের আত্মার আত্মীয়তা। আমরা প্রতিনিয়ত গ্রেগর সামছার মত পোকা হয়ে যাচ্ছি আমাদের অজান্তেই। ইভান ইলিচের মত সমাজের প্রচলিত স্রোতে গা ভাসিয়ে ছিটকে পড়ছি আপন সত্তা থেকে। এই সংকটময় অবস্থায় ‘ইভান ইলিচ’ ও গ্রেগর সামছা’র জীবন পাঠ আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কারণ, “we are all frozen inside and literature should be the axe that smashes the ice.”

ব্রেশ-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা দিয়ে ‘আমার প্রিয় বই’ বিষয়ক লেখাটির ইতি টানছি–
‘‘ভুখা মানুষ বই ধরো, ওটা হাতিয়ার।’’

উল্লেখ্য : লেখাটি ধমনি সাহিত্য কাগজের প্রকাশিতব্য ‘প্রিয় বই সংখ্যা’র জন্য লেখা।