লেখকঃ দ্বিজেন শর্মা

এক
১৮৭৬ সালের গ্রীষ্মের এক ভোরে লন্ডন থেকে উনিশ মাইল দূরে ওফিংটন রেলস্টেশনের লাগোয়া ডাউন গ্রামের নির্জন পথে যে বৃদ্ধ হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন তিনি সেখানকার সকলেরই প্রিয়। তাঁর দীর্ঘ দেহ সামনে ঝুঁকে পড়েছে, শরীর দুলছে চলার ছন্দে, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে লাঠির ঠক ঠক আওয়াজ। এমনি ভোরে বেড়ানো তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস। প্রায় মধ্যযৌবন থেকেই তিনি অসুস্থ। দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণকালে এক পোকার কামড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ থেকেই অসুখের শুরু। জ্বর, বমি, বদহজম, পেটে যন্ত্রণা, মাথাব্যাথা এমনি নানা বিকার চলছে প্রায় ত্রিশ বছর। ওষুধে উপকার হয় না। শেষে গেলেন জলচিকিৎসার জন্য মেলভার্ন। কিছুটা ফল হল। বেশ কিছুদিন ভাল ছিলেন। সে-থেকেই ভোরে বেড়ানোর অভ্যাস। পরনে কালো ঢিলে পোষাক, মাথায় লম্বা টুপি, মুখে উচ্ছ্বসিত সাদা দাড়ি, ছেঁটেফেলা গোঁফ, ঝুলে পড়া ভ্রুর নীচে তীক্ষ্ম বাদামী চোখ, কপালে অজস্র কুঞ্চন, মুখ রক্তাভ মসৃণ। প্রায় সারা জীবনই রোগজর্জর, তবু মুখে তার বিন্দুমাত্রও চিহ্ন নেই। প্রশান্তির প্রগাঢ়তায় দীপ্ত মুখশ্রী।

একদা, অনেককাল আগে ছেলেরাও সঙ্গে বেড়াতে আসত। এখন তারা বড়, প্রতিষ্ঠিত। মেয়েরাও বিবাহিত। তবু নিঃসঙ্গ নন। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে অবসর নেবার কথা ভাবেন না। ঘড়ি দেখলেন। সাতটা বাজে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। হাতে অনেক কাজ।

আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত একটানা গবেষণা, শুধু ন’টায় একবার আসেন ড্রয়িংরুমে, চিঠির খোঁজে। প্রতিদিন অজস্র চিঠি আসে। দেশ-বিদেশ, দূর-দূরান্তর থেকে কত জনের কত জিজ্ঞাসা! প্রকাশক, পণ্ডিত, সহকর্মী, সুহৃদ, ভক্তবৃন্দ, বিজ্ঞানী, ছাত্র, সাধারণ মানুষ নানা বিষয়ে নানা প্রসঙ্গে তাঁকে চিঠি লেখেন। সাধ্যমত সবার চিঠির উত্তর দেন। সময়াভাবে গ্রন্থপাঠে অসমর্থ ব্যক্তিকে তার আশু বক্তৃতার জন্য বিবর্তনবাদের মর্মসার লিখে দিতেও বিরক্ত হন না। শুধু ধর্ম-সম্পর্কে আলোচনায় তাঁর অপার অনীহা। নিজে নাস্তিক, ঈশ্বর ও পরলোকে অবিশ্বাসী। কিন্তু, কারও ধর্মবোধে বিন্দুমাত্র আঘাত দেন না। শিক্ষাগুরু হেন্স্লো, অগ্রজপ্রতিম লায়েল, সুহৃদ হুকার সবাই আস্তিক। ধর্ম নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কখনও মনান্তর ঘটেনি। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন ‘বিগল’ জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিট্স্রয়। বিবর্তনবাদের গবেষণা থেকে তাঁকে বিরত করার জন্য ডাউন গ্রামেও এসেছিলেন। নিসর্গী হিসাবে তাঁকে নিজ জাহাজে নির্বাচন করার জন্য ফিট্সরয় আক্ষেপ করেছেন আজীবন। কিন্তু নীতির প্রশ্নে ডারউইন কারও সঙ্গেই আপোস করেননি। এমনকি প্রিয়তমা স্ত্রীর করুণ অনুনয়েও না। তাঁর বিশ্বাস ছিল ‘নাস্তিক্যই স্বামীর রোগের উৎস’।

একটি চিঠিতে দেখলেন জনৈক জার্মান প্রকাশক তাঁকে আত্মজীবনী লেখার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছেন। মনে পড়ল পিতামহের কথা। একাধারে চিকিৎসক, দার্শনিক, কবি ও বিজ্ঞানী। লামার্কের সমসাময়িক এই পুরুষসিংহ বির্বতন-তত্ত্বেরও পিতামহ। আজকের সমগ্র জীবজগৎ যে একই পূর্বপুরুষ-উদ্ভূত এবং কোটি কোটি বৎসরের পরিবর্তনের ফল তাঁর বহু রচনায় এই তত্ত্ব বিবৃত ছিল। তিনিও আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তাঁরা সকলেই সেই গ্রন্থ পড়েছেন উত্তেজনা আর কৌতূহলে। ভাবলেন, তাঁর জীবনীও হয়ত সবাই পড়বে তেমনি। অন্তত আত্মীয়দের জন্য এমন কিছু লেখা বেমানান নয়।

আবার ফিরে গেলেন কাজে, তবু বারবার মনে এল সেই প্রসঙ্গ। আত্মজীবনী লিখলে কেমন হয়? কাজে মন বসল না। বেরিয়ে পড়লেন নিত্যদিনের দুপুর ভ্রমণে। সঙ্গে প্রিয় কুকুর পলি। যথানিয়মে প্রথমে গ্রিনহাউসে পরীক্ষাধীন গাছপালা দেখা এবং তারপর স্যান্ডওয়াকে। বৃত্তাকারে রোপিত লাইম, হেজেল আর বার্চ গাছে ঢাকা এই পথটি তাঁরই তৈরি। স্যান্ডওয়াক তাঁরই দেয়া নাম। গ্রিনহাউসের পর প্রশস্ত লন, দূরে অনুচ্চ পাহাড়, ঢালু উপত্যকায় পাইন বনে গভীর নির্জনতা।

এই পরিবেশই তাঁর ভাল লাগে। নির্জনতায় বিজ্ঞানে নিমগ্ন হবার জন্য এমনি পরিবেশই খুঁজছিলেন। আজ থেকে প্রায় ছত্রিশ বছর আগে এই গাঁয়ে এসেছেন। বিপুল পৈতৃক সম্পদ ও বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া পর্যাপ্ত যৌতুকের জন্য কোন অর্থাভাব ছিল না। চিররুগ্ন হলেও প্রিয়তমা স্ত্রী আদর্শ সেবিকা। স্বদেশ ও বিদেশের অভ্যাগতেরা আসতেন ক্রমাগত। তাছাড়া তাঁর সাতটি সন্তান, বিপুল সংখ্যক আত্মীয় সমাগম, কখনো-বা বিপন্ন বন্ধুর সন্তান-সন্ততির উপস্থিতিতে ডাউন-ভবন সর্বদাই কল্লোলিত ছিল। কিন্তু তাঁর গবেষণায় কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হত না। অভ্যাগত ও বন্ধুরা অনেকেই ছিলেন সহযোগী ও গবেষক। ‘বহুশোধিত সোনার মতো গুণান্বিতা’ বিচক্ষণ স্ত্রীর ব্যবস্থাপনায় বাড়িতে নিয়ম ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত ছিল।

ছেলেবেলায় পতঙ্গ ও গোবরে পোকার প্রতি আকর্ষণ ছিল। ছাত্রজীবনে প্রকৃতির প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হন। এক সময় ঠিক করেছিলেন গির্জায় যাজকের চাকুরি নিয়ে জীবন কাটাবেন গাঁয়ের নির্জনে। কেমব্রিজে অধ্যয়নকালে উদ্ভিদবিদ্যার প্রখ্যাত শিক্ষক হেন্স্লোর অনুপ্রেরণায় প্রকৃতি-নিরীক্ষা সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষালাভ করেন। পরে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণকালে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়। চন্দ্রালোকিত সমুদ্র, মরুপ্রান্তরের আশ্চর্য সন্ধ্যা, বিশাল পর্বতভূমির নৈঃশব্দ্য তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এ পর্যায়ের সর্বাধিক স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল ব্রাজিলের অরণ্যে। এই আদিম অনূঢ় অরণ্যের মহিমায় সম্মোহিত তাঁর সত্তার যেন রূপান্তর ঘটেছিল। তাই দেশে ফিরে এখানে, প্রকৃতির এই অবারিত ঐশ্বর্যের মাঝখানেই স্বস্তির আস্বাদ পেয়েছিলেন। অতঃপর আর কোথাও যাননি। জন্মস্থান শ্র“স্বারি থেকে অনেক দূরে শেষে এই পাড়াগাঁয়েই স্থায়ী বাসা বাঁধলেন।

এখন দুপুর। হেজেল আর লার্চ গাছের পাতায় হাওয়ার মৃদু গুঞ্জন। তিনি চলতে চলতে বারবার দাঁড়াচ্ছেন, গুনে গুনে দেখছেন ক’টি গাছ পেরিয়ে এলেন। এটি তাঁর অভ্যাস। এভাবেই তিনি তাঁর ভ্রমণপথের দূরত্ব মাপেন। বুড়ো হয়েছেন তবু দৃষ্টি অদ্ভুত তীক্ষ্ণ। গাছের উঁচু ডালে পাখির বাসা চোখে পড়ে, শুকনো পাতার ভিড়ে কাঠবিড়ালীর খেলা অনেকদূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পান, বলতে পারেন গাছের শিষডালে ঝুলে থাকা অর্কিডের নাম।

আজও অতি সাধারণ ব্যাপারেও তাঁর কৌতূহল এতটুকু ম্লান হয়নি। সন্তানের জন্য পাখির সহজাত মমত্ব, কাঠবিড়ালীর তীক্ষ্মবুদ্ধি, অর্কিডের পরাগ-সংযোগের আশ্চর্য অভিযোজনা এখনও তাঁকে বিস্মিত করে। আজকাল কেউ যখন প্রজাপতি কিংবা গোবরে পোকা ধরে আনে তিনি গভীর আগ্রহে পরীক্ষা করেন। মনে পড়ে কৈশোরে কখন কোথায় এই পোকা ধরেছিলেন। একবার হঠাৎ একটি দুষ্প্রাপ্য গোবরে পোকা দেখে সেটা ধরতে দুহাতে রাখা দুটি পোকার একটি মুখে পুরেন এবং মুহূর্তে মুখের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠেন। এখনো উত্তেজনা-উদ্বেল সেইসব মুহূর্তে অবিকল চোখে ভাসে। এসব পোকার বিবরণ তিনি কাগজে পাঠাতেন এবং মাঝে মাঝে তাঁর নাম ছাপা হত। দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ আর ছাপার হরফে নিজের নাম দেখার সে কী অতুল আনন্দ!

ক্রমে নেশাটি অন্বেষায় রূপান্তরিত হলে পিতা দারুণ অসন্তুষ্ট হলেন। একে স্কুলের পড়াশোনায় অমনোযোগিতার কারণ হিসাবে ধরে নিয়ে তাকে তিরস্কার করলেন। কোন ফল হল না। সেকালের যান্ত্রিক শিক্ষা, স্কুলের শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ এবং কল্পনাবিকাশের বিপ্রতীপ মুখস্থবিদ্যা তাঁর অসহ্য লাগত। শৈশবে মাতৃহীন এই নিঃসঙ্গ কিশোর তাই স্কুল পালিয়ে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। নানা জাতের পোকা-মাকড়, পাখি, মাঠের ইঁদুর তাঁকে প্রবলভাবে বাইরের জগতে আকর্ষণ করত। এরই পরিণতি যৌবনে অধ্যাপক হেন্স্লোর সঙ্গে প্রকৃতিনিরীক্ষা ও একাত্মতা এবং শেষাবধি কেমব্রিজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভের পর কালবিলম্ব না করে ‘বিগল’ জাহাজে নিসর্গীর অবৈতনিক চাকুরী নিয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে ভ্রমণ।

পাঁচ বছর পর যখন বাড়ি ফিরলেন, পিতা তাঁকে দেখে বিস্মিত হন, যেন রূপান্তরিত হয়েছেন তিনি। বললেন, ‘মাথায় খুলির গড়ন দেখি একেবারে বদলে গেছে।’ মনোবিদ-চিকিৎসকের এ উক্তির তাৎপর্য পরবর্তীকালে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। খেয়ালি এক তরুণ নিসর্গী দেশে ফিরেছিলেন স্থিতধী বিজ্ঞানী হয়ে। সত্যটি প্রথম তাঁর পিতাই আবিষ্কার করেছিলেন।

আজ তিনি বিশ্বখ্যাত। শ্রেষ্ঠতম মনীষার প্রথম সারিতে তাঁর নাম। নিউটনের সঙ্গে তুলনায় তিনি উচ্চারিত। এই দুই বিজ্ঞানী যথাক্রমে ‘প্রিন্সিপিয়া’ ও ‘স্পিসিজ’ দিয়ে ভৌত ও জীবজগৎ থেকে ক্রমান্বয়ে দৈবকে বিতাড়িত করে নিয়ম ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অথচ নিজের শ্রেষ্ঠতম রচনা ‘অরিজিন’ নিয়ে অনুকূল প্রতিক্রিয়ার আশায় দীর্ঘ দুই দশক অপেক্ষা করেছেন। শেষে গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে প্রথম দিনেই নিঃশেষিত হয় পুরো প্রথম সংস্করণ। বারো বছরে ছয়টি সংস্করণে সর্বমোট সংখ্যা ছাপা হল চল্লিশ হাজার। দেশ-বিদেশে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে এই তত্ত্ব। বিবর্তন সম্পর্কে ইতিপূর্বে কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু তাঁর মতো নিটোল যুক্তির ইমারতে আর কেউ তত্ত্বটিকে এমন দুর্ভেদ্য করতে পারেননি। জীবজগৎ সম্পর্কে অতঃপর যাবতীয় অজ্ঞতার সমাপ্তি ঘটল, পরাজিত কুসংস্কার নিরুদ্দিষ্ট হল ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

প্রজ্জ্বলিত দুপুর বাতাসে উষ্ণতা ছড়ায়। দমকা হাওয়ায় আন্দোলিত পাইনের বন। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা উড়ে আসে। কলকাকলীতে উচ্ছ্রিত প্রাণের স্পন্দন। আজ অনেক দূর হেঁটে বেড়ালেন, যেন যৌবনের উচ্ছলতা আবার ফিরে পেয়েছেন। আশ্চর্য মনে হল দিনটিকে। ফেরার পথে একবার দিনের অবশিষ্ট কাজের কথা মনে করলেন। গবেষণা ছাড়া এখনও সময় পেলে পাতার পাতলা টুকরো কাটেন, ছবি আঁকেন। এসব কাজে তেমন পারদর্শী নন বলে আজও দুঃখ হয়। জীববিজ্ঞানীর পক্ষে শিক্ষাটি তাঁর মতে অপরিহার্য।

দুপুরে খাবার পর ড্রয়িংরুমে খবরের কাগজ পড়েন। তারপর লেখেনে চিঠিপত্রের জবাব। জার্মানি থেকে আসা সেই চিঠিটি আরেকবার পড়লেন। আত্মজীবনী নিয়ে অনেক ভাবলেন। শেষে একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠে পড়লেন। এখন তিনটা। এবার শোবার ঘরে বিশ্রাম। এ-সময় স্ত্রী উপন্যাস পড়েন। তিনি শোনেন। উপন্যাসে আজও আকর্ষণ আছে। সরল মিলনাত্মক কাহিনী ভাল লাগে। পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে এই ক্ষণিক একাত্মতায় মুক্তি পান বিষয়মুখ বস্তুচর্চা থেকে, যেন স্বপ্নলোকে বিচরণ করে তাঁর চেতনা। মনে পড়ে ফেলে-আসা দিনের স্মৃতি। কেমব্রিজে ছাত্রজীবনে কত গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক পড়েছেন। মিল্টন আর শেক্সপিয়রের ভক্ত ছিলেন। এখন আর কবিতা পড়েন না। নাটকেও রুচি নেই। সব যেন অপাঠ্য জঞ্জাল। অদ্ভুত পরিবর্তন, তবু সত্য।

জীবনী, ভ্রমণকাহিনী আর উপন্যাস এখনও ভাল লাগে। আর পড়েন বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ক্ল্যাসিকে অতৃপ্ত আকর্ষণ। টমাস হাক্সলির ‘অমেরুদণ্ডীর দেহসংস্থান’ আর বেলফোরের ‘ভ্রুণবিদ্যা’ বহুপঠিত, তবু সময় পেলেই আবারও পড়েন। জার্মান ভাষায় তেমন দখল নেই। তবু এই ভাষায় প্রকাশিত বিজ্ঞান-প্রবন্ধগুলি পড়তেই হয়। অপারগ হলে ছেলেদের সাহায্যে নেন। কার্ল মার্কসের পাঠান নিজের স্বাক্ষরিত ‘দ্যাস ক্যাপিটাল’ বইটিরও দেড়শ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছেন মূল জার্মান থেকে(১)।. পড়েন ‘ন্যাচার’ পত্রিকার নিবন্ধগুলি। গণিত আর পদার্থবিদ্যার অনেক নিবন্ধই সঠিক বোঝেন না। তবু চেষ্টার ক্রটি নেই। দুরূহের মর্মোদ্ধারেই তাঁর আনন্দ।

দিনের আলো নিভে আসে। আসন্ন সন্ধ্যার আভাসে পাইনবন নির্জনতর। বাইরে এলেন। লনে বসলেন ঘাসের উপর। স্ত্রী পাশের বেঞ্চিতে। জোরে হাওয়া বয়। প্রজ্জ্বলিত অ্যাজালিয়ার রঙ বাতাসে দোল খায়। লাইম গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়। গাঢ় হয়ে আসে সন্ধ্যার নির্জনতা। পাইনের গভীর বন থেকে ভেসে আসে নাম-না-জানা পাখিদের ডাক।

অদূরে টেনিস খেলছে ছেলেরা। মাঝে মাঝে বল কাছে এসে পড়েছে। ফেরৎ দিচ্ছেন তিনি। বারবার তাকান ওদের দিকে। সেদিনের শিশুরা আজ যুবক। কী গভীর কৌতূহলেই না এদের শৈশব পর্যবেক্ষণ করেছেন। মানুষের শৈশবেই তার মানুষেতর জৈব-পরিচয়, তার আদিম আরণ্যক উওরাধিকার সবচেয়ে বেশি প্রকট থাকে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে লেখা তাঁর গ্রন্থটি নিরীক্ষামূলক মনোবিদ্যার ক্ষেত্রে আজ পথিকৃৎ অবদান। প্রজাতির উৎস, মানুষের উদ্ভব, প্রবালদ্বীপের ভূতত্ত্বসহ নানাবিধ মৌলিক নিরীক্ষা, সিরিপিডার ওপর কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত মনোগ্রাফ, রোহিনী উদ্ভিদ, গৃহপালনে উদ্ভিদ ও প্রাণীর পরিবর্তন, পতঙ্গভুক উদ্ভিদ এবং কেঁচো সম্পর্কে বহু নিবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর স্বাস্থ্যের সঙ্গে তুলনায় এই সাফল্য বড়ই অবিশ্বাস্য।

সন্ধ্যার অন্ধকারে সব ঢেকে যায়: লন, বাগান, পাইনবীথি। তিনি ঘরে ফেরেন। জীবন বড় স্তিমিত, মন্থর। কতদিন পার্টিতে যান না, সহ্য হয় না ভাল খাবার, রাত-জাগা, হৈচৈ। অথচ আনন্দ-উদ্দীপনায় তাঁর উৎসাহ চিরদিনের । আজ কতদিন এ গাঁয়ে আছেন, কিন্তু বাইরে গিয়েছেন খুবই কম। গোড়ার দিকে যেতেন জন্মভূমি শ্র“স্বারি আর মাতুলালয় মায়ের। এখন বছরে শুধু একবার করে সমুদ্রস্নান আর ভাইবোন কিংবা মেয়েদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। একেবারে নিমগ্ন ছিলেন বিজ্ঞানের সাধনায়। রোগ আর যন্ত্রণার কবল থেকে যেটুকু সময় কেড়ে নিতে পেরেছেন তার এতটুকুও অপব্যয় করেননি কোনদিন।

খাবার ঘরে উদ্দাম উচ্ছলতা। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। এ স্পন্দন তাঁর পরিচিত। ভাবলেন একবার ওখানে যাবেন, বসবেন সবার সঙ্গে। শেষে আর গেলেন না। মনে হল বড় বেশি বুড়ো হয়ে গেছেন, বেমানান ঠেকবেন তারুণ্যের ভিড়ে। তাঁর জন্য বরাদ্দ শুধু এককাপ চা, একটুকরা সিদ্ধ মাংস ও একটু পানীয়, আর কিছু না। মিষ্টি ভাল লাগে, কিন্তু খান না। ডাক্তারের বারণ।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সময়ের স্রোতকে এই মুহূর্তে বড় তীব্র মনে হয়, অসহায় মনে হয় নিজেকে। যেসব দিনেরা হারিয়ে গেছে তা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। কোনদিন আর উজ্জ্বলতা পাবে না এই স্তিমিত চেতনা। কেমব্রিজে যৌবনের সেই দিনগুলির স্মৃতি বারবার মনে আসে : কতো শিকার, পার্টি, হৈ-হল্লা, কী দূরন্ত বাঁধভাঙা যৌবনোচ্ছাস। হঠাৎ ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েন। অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হন। সুদূর অতীত হঠাৎ খুব কাছে আসে। হারান দিনের বেদনার স্মৃতি বারবার মনে পড়ে, প্রতিটি নিখুঁত নিটোল হুবহু। কী দুঃসহ! মুক্তি চান তিনি এই অসহ্য ভার থেকে। কিন্তু পারেন না। বড়ো তীক্ষ্ণ তাঁর স্মৃতি। এমনটি তো ঘটেছে পিতা, পিতামহের জীবনেও।

মনে পড়ে শিক্ষাগুরু হেনস্লোকে, অগ্রজপ্রতিম লায়েলকে। তাঁরা আর বেঁচে নেই। লায়েল শেষে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ গাঁয়ে তাঁর কতবার এসেছেন। আর কোনদিন এ পথে তাঁদের ছায়া পড়বে না, শুনতে পাবেন না। তাঁদের প্রিয় কণ্ঠস্বর। সত্তরের গ্রীষ্মে গিয়েছিলেন ক্যামব্রিজ। ভূবিদ সেজউইক তখনো বেঁচে। ছিয়াশি বছর বয়সেও কর্মঠ। কিন্তু হেনস্লোহীন এই শহর তাঁরা শূন্য মনে হল। ইচ্ছা ছিল হেনস্লোর সেই প্রিয় বাড়িটি একাবর দেখেন। হুকার, হাক্সলি, ওয়ালেস এখন নিজ জীবনের গণ্ডিতে আবদ্ধ। তাঁরাও আসেননি অনেকদিন। বহুদিন এখানে কোন আলোচনা হয়নি, হয়ত আর হবেও না। তিনি নিজেই আজ আপন ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলে সংকোচিত, প্রত্যাহৃত। জীবনের অনিবার্য অবক্ষয় থেকে কারও মুক্তি নেই।

পিয়ানোয় একটি মধুর সুর বেজে ওঠে। স্ত্রী বাজাচ্ছেন, বিটোফন। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেন না। সংগীতে কান নেই। অথচ একদা ছাত্রজীবনে গান শিখেছিলেন। নিয়মিত সংগীতানুষ্ঠানে গিয়েছেন। তাছাড়া ছবিও ভালবাসতেন, যেতেন আর্ট-গ্যালারিতে। তারপর বিজ্ঞানে যতো বেশি নিমগ্ন হয়েছেন ততই ভুলেছেন গানের সুর, ছবির রং। আজ আর কিছুই মনে নেই। শিল্পানুরাগের এ-মৃত্যুর জন্য আক্ষেপ করেন। এর কোন প্রয়োজন ছিল না। বিজ্ঞানের সঙ্গে এদের কোন বিরোধ নেই। তাঁর বিশ্বাস এ নিজের দুর্বলতা, অর্পূণতা।

এবার পিয়ানোর যে-সুর বাজছে তা সঠিক বুঝতে পারেন। স্যুলিভানের রচনা : ‘তুমি এলে প্রিয়’ – তাঁর প্রিয়তম সংগীত।গান থামলে উঠলেন তিনি। এবার তাকে ঘুমোতে হবে। আগামী দিনের কাজের জন্য এ তাঁর জরুরি প্রস্তুতি। শেষ মুহূর্তে আবার মনে পড়ল সেই চিঠির কথা। আত্মজীবনী লিখবেন? আমি চার্লস ডারউইন, রবার্ট ওয়ারিং ডারইউনের পুত্র, এরেসমাস ডারউইন, রবার্ট ওয়ারিং ডারইউনের পুত্র, এরেসমাস ডারইনের পৌত্র…এবং অবশেষে আত্মজীবনী লিখেছিলেন : ‘রিকালেকসন অব দ্য ডেভেলাপমেন্ট অব মাইন্ড অ্যান্ড কারেক্টার, অর্থাৎ ডারউইনের বিবর্তন।

দুই
‘আমার জন্ম শ্র“সবারি, ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি। মা মারা যান ১৮১৭ সালের জুলাই মাসে। আমার বয়স তখন আট বছরের একটু বেশি। তাঁর শেষশয্যা, কালো ভেলবেট গাউন ও অদ্ভুত আকারের টেবিলটি ছাড়া মা সম্পর্কে আর কিছুই আমি মনে করতে পারি না। বসন্তেই আমি শ্র“সবারির কেসের ডে-স্কুলে ভর্তি হলাম। সবাই বলতেন আমার বোনের চেয়ে পড়াশোনায় আমি খারাপ। মনে হয়, আমি হয়ত দুষ্টু বখাটে ছিলাম। এই বয়সেই প্রকৃতিবিদ্যা এবং সংগ্রহে আমার নেশা ধরেছিল। গাছের নাম জানা ছাড়াও সবরকমের খোলস, মুদ্রা ও আকরিক সংগ্রহে আমার ক্লান্তি ছিল না। আমার কোন ভাইবোনের এমন নেশা ছিল না। …পাখির ডিম সংগ্রহে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল, কিন্তু কখনই বাসা থেকে একটির বেশি ডিম নিতাম না। আমার মাছ-ধারারও নেশা ছিল। আমি নদী অথবা পুকুরে ছিপ ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। ১৮১৮ সালের গ্রীষ্মে ড. বাটলারের স্কুলে ভর্তি হই। এখানেই সাত বছর পড়াশোনা করেছি। আমি হোস্টেলে থাকতাম। কিন্তু একটু সময় পেলেই ছুটে আসতাম বাড়িতে। পথচলার সময় আমি হঠাৎ অন্যতর ভাবনায় কখনও ডুবে যেতাম। …এ স্কুলের প্রভাব আমার জীবনে সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়েছিল। প্রাচীন ভূগোল ও ইতিহাসের খণ্ডাংশ ছাড়া আর কিছুই পড়ান হত না। আমি অলস ছিলাম না। কিন্তু হোরেসের কয়েকটি গাঁথা ছাড়া এখানে আর কোন পাঠ্যবস্তুই আমাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করেনি।

‘স্কুলের পাঠ শেষ হলে সকলেই নিশ্চিত হলেন যে আমার মেধা সাধারণের চেয়ে নিম্নমানের। বাবা আমার মনে গভীর আঘাত দিয়ে বলেন, ‘সারাদিন শিকার, কুকুর, ইঁদুর-ধরা ছাড়া আর কিছুতেই তোমার মন নেই, তুমি নিজের কাছে, পরিবারের কাছে শেষাবধি লজ্জার কারণ হবে।’ বাবা ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু এবং তাঁর স্মৃতি আমার মনে ভালবাসার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। তিনি আমার প্রতি তখন যে রূঢ় অভিযোগ করেছিলেন তার কারণ সম্ভবত তিনি হঠাৎ খুব বেশি রেগে গিয়েছিলেন।

‘শৈশবস্মৃতি থেকে আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যেটুকু ইংগিত আমি আজ সংগ্রহ করতে পারি, তা হল বিচিত্র বিষয়ে আমার প্রবল আকর্ষণ, পছন্দসই বিষয়ের প্রতি অটুট নিষ্ঠা এবং দুর্বোধ্যের মর্মোদ্ধারে গভীর আনন্দ। …স্কুল জীবনের শুরুতেই আমি ‘ওয়ান্ডার্স অব দি ওয়ার্ল্ড’ পড়ি এবং এ থেকেই আমার মনে বিশ্বভ্রমণের প্রবল আকাক্সক্ষার উন্মেষ ঘটে। ১৮১৯ সালে আমি প্রথমে ওয়েল্সের সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যাই। সেখানে সিঁদুর-লাল পোকা, নানা জাতের মথ দেখে গভীর কৌতূহল অনুভব করি। এসময়ে পাখির প্রতিও আমি গভীরভাবে আকৃষ্ট হই এবং কেন প্রত্যেকেই পক্ষিবিশারদ হয় না এ নিয়ে আমার ভাবনার শেষ ছিল না।

‘স্কুলে আমার অবস্থা অনুকূল না দেখে বাবা আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। ১৮২৫ সালে গেলাম এডিনবরা। অগ্রজের সঙ্গে আমারও পাঠ শুরু চিকিৎসাবিদ্যায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আমি নিশ্চিত হলাম যে আমার পৈতৃক সম্পত্তি যেহেতু সারাজীবন আরাম-আয়েসে কাটানোর জন্য যথেষ্ট, তাই কষ্ট করে ডাক্তারি শেখার প্রয়োজন কি! তাছাড়া এখানকার শিক্ষা ছিল বক্তৃতা-সর্বস্ব এবং একমাত্র হোপের রসায়ন ছাড়া আর সবই নিরস, বিকর্ষী। …হাসপাতালে দুটি অস্ত্রোপচার দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। একটি শিশুর অস্ত্রোপচার দেখে আমি ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। জীবনের দীর্ঘদিন ঘটনাটি ভুলতে পারি নি।

‘এসময় আমি ড. গ্রান্টের সঙ্গে পরিচিত হই। তাঁর ব্যবহার ছিল নিরাবেগ ও আনুষ্ঠানিক। কিন্তু সবই বাহ্য। ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন উচ্ছ্বাসপ্রবণ। একদিন আমরা যখন হাঁটছি, হঠাৎ তিনি ল্যামার্ক ও তাঁর বিবর্তন-তত্ত্বের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। আমি নীরবে তাঁর কথা শুনছিলাম, কিন্তু নিজে বিন্দুমাত্রও আলোড়িত হই নি। ইতিপূর্বে পিতামহ লিখিত ‘জুনমিয়া’ পড়েছিলাম এবং সেখানেও এই একই ব্যাখ্যা বিবৃত ছিল। জীবনের প্রথম পর্যায়ে এই ধরনের ব্যাখ্যা শোনার জন্যই হয়তো ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থে এর ভিন্নতর অভিব্যক্তি ঘটেছে।

‘এডিনবরা দু’বছর থাকার পর বোনদের কাছ থেকে সব খবর শুনে বাবা নিশ্চিত হলেন যে আমার পক্ষে ডাক্তার হওয়া অসম্ভব। তাই তিনি আমাকে যাজক হবার প্রস্তাব পাঠালেন। …গ্রামের কোন গির্জায় যাজকের চাকুরি আমার কাছে সেই মুহূর্তে আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। আজ যখন ধর্মান্ধরা প্রচণ্ডভাবে আমাকে আক্রমণ করে তখন সেদিনের যাজক হবার বাসনা বড়ই হাস্যকর মনে হয়। আমার বা পিতার এ ইচ্ছা আমি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করিনি। কেমব্রিজ ছাড়ার পর ‘বিগল’ জাহাজে নিসর্গীর চাকুরি নেবার পরই তার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল। কিছুদিন আগে এক মনস্তাত্ত্বিক দলের নিরীক্ষা আমি পড়েছি। তাঁরা আমার খুলির গড়ন বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আমি নাকি দশজন যাজকের চেয়েও বেশি ধার্মিক।

‘১৮২৮ সালের শুরুতে আমি কেমব্রিজ এলাম। যাজক হবার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি জরুরি ছিল। বিদ্যালয়িক দৃষ্টিকোণের বিচারে কেমব্রিজের তিন বছরও এডিনবার্গ বা স্কুলের মতই সম্পূর্ণ ব্যর্থ। গণিতে আমার উন্নতি ছিল অত্যন্ত মন্থর। গণিত সম্পর্কে অগভীর জ্ঞানের জন্য এখনও আক্ষেপ করি। বি.এ. পরীক্ষায় যারা অনার্স পায়নি তাদের মধ্যে আমার ফল ভালই হয়েছিল। সম্ভবত পঞ্চম, দশম, না দ্বাদশ স্থান পেয়েছিলাম আজ আর ঠিক মনে নেই।

‘কেমব্রিজে অনেক বক্তৃতা হত, আমি যেতাম না। এভাবেই আমি সেজউইকের ভূতাত্ত্বিক বক্তৃতা শোনার সুযোগ হারিয়েছিলাম, অন্যথা আমি বোধহয় ভূতত্ত্বেই প্রতিষ্ঠা লাভ করতাম। কিন্তু হেনস্লোর উদ্ভিদবিদ্যার বক্তৃতা আমার কোনদিন বাদ পড়েনি। উদ্ভিদবিদ্যা আমার পাঠ্য ছিল না। সে-সময় সংগ্রহে আমি বিশেষ সাফল্য লাভ করি। হেনস্লোর সঙ্গে পরিচয়ের পর আমরা দীর্ঘ ভ্রমণে যেতাম। প্রায় সন্ধ্যায়ই তিনি আমাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানাতেন। উদ্ভিদবিদ্যা, পতঙ্গতত্ত্ব, রসায়ন, আকরিক ও ভূবিদ্যায় তাঁর জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়। দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ-নির্ভর সিদ্ধান্তেই তাঁর অনুরাগ ছিল। হেনস্লো আমাকে ভূতত্ত্বে পাঠ নেবার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। তাঁর অনুরোধেই সেজউইক উত্তর-ওয়েলস পরিক্রমায় আমাকে তাঁর সঙ্গে নেন।

‘কেমব্রিজে শেষবর্ষে আমি প্রভূত যত্ন ও উৎসাহে হ্যামবোল্ডের ‘প্যারসন্যাল নেরেটিভ’ এবং স্যার জে. হারকেলের ‘ইনট্রডাক্সন টু দি স্টাডি অব ন্যাচারাল ফিলসফি’ পড়ি। বই দুটি আমাকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের প্রতি যতটুকু আকৃষ্ট করেছিল, এক ডজন অন্য কোন বইয়ের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না । হ্যামবোল্ড থেকে আমি দীর্ঘ অনুচ্ছেদ লিখে রেখে সবাইকে উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করে শোনাতাম।

‘সেজউইকের সঙ্গে ভূতাত্ত্বিক পরিক্রমা শেষে বাড়ি ফিরে দেখি হেনস্লো এক চিঠিতে আমাকে ‘বিগল’ জাহাজে ভ্রমণে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ প্রস্তাবে আমার আগ্রহের অবধি ছিল না। কিন্তু বাবার মত হল না। শেষে আমার মামার চেষ্টায় তিনি সম্মতি দিলেন। আমাদের জাহাজ ছাড়ল ১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বিগল ভ্রমণই আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখ্য ঘটনা এবং আমার জীবনদিশারী। এ থেকেই আমার মানসগঠন ও প্রশিক্ষণ পূর্ণতা লাভ করে। প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিবিধ শাখার সঙ্গে আমার নৈকট্য তখনই গভীরতর হয় এবং আমার দেখার ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আমার সঙ্গে লায়েলের ‘প্রিন্সিপল অব জিওলজি’ ছিল এবং আমি গভীর আগ্রহে পড়ি। বইটি নানাদিক থেকে আমার প্রভূত উপকারে এসেছিল। আমি যেসব জায়গায় গিয়েছি তার ভূতাত্ত্বিক নিরীক্ষার গুরুত্ব ছিল। তাছাড়া সব রকম প্রাণী সংগ্রহ, এদের বর্ণনা, সামুদ্রিক প্রজাতিসমূহের সাধারণ ব্যবচ্ছেদও আমার কর্মসূচি ছিল। ছবি আঁকার অক্ষমতা ও শারীরস্থান সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানের জন্য আমার স্তূপীকৃত পাণ্ডুলিপির প্রধান অংশ শেষাবধি অপ্রয়োজনীয় প্রমাণিত হয়েছিল।

‘এখন আমার নিজের পক্ষে যতটুকু পর্যালোচনা সম্ভব তাতে মনে হয় নিরীক্ষার আনন্দ ও প্রকৃতিবিজ্ঞানে নবতম তথ্যযোজনের জন্য আমি ভ্রমণকালে সম্ভাব্য কঠোরতম পরিশ্রম করেছিলাম। তাছাড়া সমাজে যোগ্য আসন লাভের বাসনাও আমার মনে যথেষ্ট দৃঢ়বদ্ধ ছিল। ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে ক্যাপ্টেন ফিট্স্রয় আমার জার্নালের অংশবিশেষ শুনে এটি ছাপার যোগ্য বলে অভিমত প্রকাশ করেন। বোনদের চিঠিতে জানতে পারলাম সেজউইক বাবার সঙ্গে দেখা করে বলেছেন যে বিজ্ঞানী হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠা আসন্ন। তাঁর পক্ষে আমার কার্যাবলী অবহিত হবার কোন সুযোগ থাকার কথা নয়। অবশ্য পরে জেনেছিলাম হেনস্লো আমার কোন কোন চিঠি তাঁকে পড়ে শুনিয়েছিলেন এবং অনেকগুলি ছাপিয়ে তাদের বন্ধুদের মধ্যে বিলি করেছিলেন। চিঠিটি পড়ে আমি পাহাড়ের চূড়ায় ওঠি এবং একটি আগ্নেয়শিলাকে হাতুড়ি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে প্রতিধ্বনির আলোড়ন তুলি। এ থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে আমি কতটা উচ্চাভিলাষী ছিলাম।

‘১৮৩৬ সালের ২ অক্টোবর আমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসি। হেনশ্লোর কাছে পাঠান আমার সংগ্রহগুলির যথাযথ ব্যবস্থা করতে কয়েক মাস কেটে গেল। অতঃপর আমার ভ্রমণকাহিনী রচনায় লিপ্ত হই। আমি তখন লন্ডনের মার্লবো স্ট্রিটে থাকতাম এবং বিয়ের আগে অবধি দু’বছর ওখানেই ছিলাম। দু’বছরে আমি ভ্রমণকাহিনী রচনা শেষ করি, ভূতাত্ত্বিক সমিতির অধিবেশনে কয়েকটি নিবন্ধ পড়ি এবং ভ্রমণকালীন ভূতাত্ত্বিক নিরীক্ষা ও প্রাণিজগৎ সম্পর্কিত গ্রন্থাবলী রচনা সম্পূর্ণ করি। ১৮৩৭ সালের জুলাই মাসে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ রচনার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী গ্রন্থনা শুরু করি এবং পরবর্তী বিশ বছর অবধি তা অব্যাহত থাকে।

‘১৮৩৯ সালের ২৯ জানুয়ারি আমার বিয়ের পর(২) কিছুদিন লন্ডনে থেকে শেষে ১৮৪৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সস্ত্রীক ডাউন গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি। এ সময় আমি কয়েকবার অসুস্থ হই। যখন একটু সুস্থ থাকতাম তখন ‘প্রবাল প্রাচীর’ গ্রন্থটি শেষ করার চেষ্টা করতাম।

‘১৮৪৪ সালের শুরুতে ‘আগ্নেয় দ্বীপ’ এবং ১৮৪৫ সালে ‘জার্নাল অব রিসার্চেস’, ১৮৪৬ সালে ‘দক্ষিণ আমেরিকার ভূতাত্ত্বিক নিরীক্ষা’ প্রকাশিত হয়। ১৮৪৬ সালের অক্টোবর থেকে আমি ‘সিরিপিডা’ সম্পর্কিত মনোগ্রাফ রচনা শুরু করি এবং দীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত কাজটি অব্যাহত থাকে। আমার প্রিয় পিতার মৃত্যু হয় ১৮৪৮ সলের ১৩ নভেম্বর। আমি তখন অসুস্থ। তাঁর অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।

‘১৮৫৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে প্রজাতির রূপান্তর বিষয়ে গ্রন্থ-রচনার জন্য আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করি। এ সম্পর্কে আমি ১৮৩৭ সালের জুলাই মাসে নোট নিতে শুরু করেছিলাম। ১৮৪২ সালের জুন মাসে আমার তত্ত্বের একটি রূপরেখা রচনা সম্পূর্ণ হয়, পরিসর ছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠা। ১৮৪৪ সালের গ্রীষ্মে রচনার আয়তন দুশো ত্রিশ পৃষ্ঠায় পৌঁছয়। ১৮৫৬ সালে লায়েল আমার তত্ত্ব সম্পর্কে দ্রুত একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনার তাগিদ দেন। আমার ইচ্ছা ছিল গ্রন্থটি হবে বর্তমান ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’-এর অন্তত চার-পাঁচগুণ। আমি যখন এ কাজে মগ্ন তখনই এল ওয়ালেসের নিবন্ধ (১৮৫৮)।. অগত্যা সংক্ষিপ্ত আকারে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ প্রকাশিত হল ১৮৫৯ সালের নভেম্বরে। সন্দেহ নেই, এটিই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। স্পেনিস, বুহোমিয়ান, পোলিশ, রুশসহ সমস্ত ইউরোপীয় ভাষায় এবং জাপানিতেও গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে।

‘অতঃপর ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয় : ফার্টিলাইজেশন অব অর্কিড্স (১৮৬২), ভেরিয়েশনস্ অব অ্যানিমেলস্ অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডমেস্টিকেশন (১৮৬৮), ডিসেন্ট অব ম্যান (১৮৭১), এক্সপ্রেশনস্ অব এমোশনস্ ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিমেলস্ (১৮৭২), ক্লাইম্বিং প্ল্যান্টস্ (১৮৭২) ইনসেক্টিভরাস্ প্ল্যান্টস্ (১৮৭৫), ইফেক্টস্ অব ক্রস অ্যান্ড সেল্ফ ফার্টিলাইজেশন ইন দ্যা ভেজিটেবল কিংডম (১৮৭৬), ডিফারেন্ট ফর্মস অব ফ্লাওয়ার্স অব দ্য সেইম প্ল্যান্ট (১৮৭৭), ফরমেশন অব ভেজিটেবল মোল্ড থ্রু অ্যাকশন অব আর্থওয়ার্ম (১৮৮১)।

আমার প্রকাশিত সমস্ত গ্রন্থের কথাই উল্লিখিত হল। এগুলিই আমার সাফল্যের স্তম্ভস্বরূপ। জ্ঞাতসারে আমার মনের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অবশ্য একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ্য। আমার পিতা তিরাশি বছর বেঁচেছিলেন এবং তাঁর মন সজীব ও কর্মক্ষমতা অটুট ছিল। আমার ইচ্ছা কোন মানসিক বৈকল্যে অথর্ব হবার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।’

তিন
ডারউইন ‘আত্মজীবনী’ প্রকাশ করেননি। মৃত্যুর অনেক বছর পরে পুত্র ফ্রান্সিস্ ডারউইনের সম্পাদনায় বইটি প্রকাশিত হয়। আত্মজীবনীর পর ডারউইন আর উল্লেখ্য কিছু রচনা করেননি। এ সময় তাঁর শারীরিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। কিন্তু তা ছিল গোধূলি আলোর শেষ উদ্ভাস। তিনি জানতেন জীবন সায়াহ্নের যবনিকাপাত আসন্ন, তবু নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করেননি। বিশাল ও জটিল একটি গ্রন্থ রচনায় হাত দিলেন। একদা গৃহপালনে জীবদেহের পরিবর্তন সংক্রান্ত যে-গ্রন্থ লিখেছিলেন তারই পরিপূরক : ‘ভ্যারিয়েশন অব প্ল্যান্টস্ অ্যান্ড অ্যানিমেলস্ ইন ন্যাচার’।. কিন্তু শেষাবধি তা পরিত্যাগ করলেন। বুঝলেন এজন্য প্রয়োজনীয় শ্রম বিনিয়োগে তিনি অসমর্থ। এই শেষ পশ্চাদপসরণ।

অগ্রজ এরেস্মাস মারা গেলেন ১৮৮১ সালের ২৬ আগষ্ট। এ মৃত্যু তাঁর উপর গভীর ছাপ ফেলল। এরেস্মাস ছিলেন তাঁর অতি প্রিয়, সুহৃদ। বন্ধুকে লিখলেন, এরেস্মাসশূন্য লন্ডন তাঁর কাছে অদ্ভুত অজানা জায়গা।

এ বছর লেক-ডিস্ট্রিক্টে বেড়াতে গেলেন। উলস্ওয়াটার তাঁর প্রিয় স্থান। কাঁচস্বচ্ছ প্রসারিত জলরাশি, অনুচ্চ পাহাড়ের ঢেউ, শ্যামল বনানী, উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গের মর্মর বারবার ক্লান্তি থেকে, অবসন্নতা থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছে, প্রাণশক্তি আহরণ করে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু এবার আর ভাল লাগল না। মনে হল প্রকৃতির উচ্ছ্রিত ঐশ্বর্য ভোগের পক্ষে তিনি বড়ই দুর্বল। প্রায়ই ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েন। গোধূলির আলো এখন ম্লানতর। অস্তগামী সূর্যের আভা কেবল তরুশীর্ষে, নীচে অন্ধকার এবং ক্রমশ বর্ধমান। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন : জীবনের বাকি দিনগুলি কাটাতে কী করব?

বাড়ি ফিরে উদ্ভিদদেহে ব্রণ তৈরির পরীক্ষা শুরু করলেন। নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে গাছপালায় ইন্জেকশন দেন। তাঁর ধারণা, এই ধরনের কৃত্রিম ব্রণের প্রভাব বীজমাধ্যমে বংশপরম্পরায় সংক্রমিত হতে পারে। শেষে শরতে কাজটি ছেড়ে দিলেন। শরীর তখন অত্যন্ত অসুস্থ। সম্ভবত এসময়ই কার্ল মার্কস ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণটি ডারউইনকে উৎসর্গ করার অনুমতি চান। মার্কস বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে বহু উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু ডারউইন রাজি হননি। জড়াতে চাননি নিজেকে নতুন কোন বিতর্কে।

শীতে মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এলেন লন্ডনে। একদিন গেলেন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বাড়ি ছিলেন না। তখনই মৃদু স্ট্রোক হল। পরিচারক তাঁকে বসতে বলল। তিনি শুনলেন না। পথে এলেন। এমনটি আরো কয়েকবারই হয়েছে। নিজেই গাড়ি খোঁজার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হঠাৎ যেন সব অন্ধকার হযে এল। পড়তে পড়তে পথপাশের রেলিং আঁকড়ে ধরলেন। ছুটে এল সেই পরিচারক। তাঁকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। কিন্তু একটু পরেই সুস্থ বোধ করলেন।

একমাস কেটে গেল কোনক্রমে। কিন্তু ফেব্রয়ারিতে একেবারে শয্যাশায়ী হলেন। হার্টের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে, অস্থিরতা বাড়ছে। দিনক’য় একটু ভাল ছিলেন। বেড়াতে গেলেন স্যান্ডওয়াকে। বসন্তের আভাসে তরুবীথি মুকুলিত। বিকেলের আলো জ্বলছে তরুশীর্ষে। হঠাৎ আবার স্ট্রোক। বাড়ি ফিরলেন অতিকষ্টে। এই তাঁর শেষ ভ্রমণ। মার্চের শেষে একটু উন্নতি হল। এপ্রিলের মধ্যভাগ অবধি ভাল থাকলেন। হাক্সলিকে তাঁর অবস্থা জনালেন। সেদিন পনেরো এপ্রিল, শনিবার। বিকেলে খাবার টেবিলে বসেছেন। হঠাৎ মাথা ঘুরতে শুরু করল। মূর্ছা গেলেন শেষে। পরে জ্ঞান হল। দুদিন একটু ভাল থাকলেন। আঠারো এপ্রিল মধ্যরাতে আবার আক্রমণ ও মূর্ছা। স্টাডিতে রাখা ওষুধের কৌটোটি স্ত্রী অজস্র শিশিবোতলের ভিড়ে খুঁজে পেলেন না। শেষে অনেক কষ্টে জ্ঞান ফিরল। ডাক্তারের ব্যবস্থামতো সামান্য ব্রান্ডি খেলেন। মনে হল মৃত্যুর নিঃশব্দ পদসঞ্চার শুনতে পাচ্ছেন। সকলের কছে থেকে বিদায় নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘মরণে আমার কোন ভয় নেই।

শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন ১৯ এপ্রিল। তখন বিকেল চারটা। ডাউন উজ্জ্বল রোদ, পাইনবনে বসন্তের সমারোহ, প্রকৃতি কল্লোলিত।

তাঁকে সমাহিত করা হল রাজকীয় সম্মানে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে, নিউটন ও লায়েলের পাশে। শবাধার বহন করলেন ডাল্টন হুকার, রাসেল ওয়ালেস, টমাস হাক্সলি এবং রয়েল সোসাইটির সভাপতি স্পটিগউড প্রমুখ বন্ধু ও সুধীবৃন্দ। তাঁর মৃত্যুতে বিজ্ঞানের এক যুগের সমাপ্তি সূচিত হল। সেই যুগ ছিল বিপ্লবের, আলোড়নের, নব নব আবিষ্কারের অভিঘাতে পুরনো জীর্ণ মূল্যবোধ অপসারণের। ডারউইন ছিলেন সেই যুগের শেষ অধিনায়ক।
—————————————————–

নোটঃ
১।. বিবাহিত জীবনের সাংসারিক ও সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিজ্ঞান সাধনায় বাধা সৃষ্টি করে সেজন্য বিবাহে মনস্থির করা সহজ হয়নি। তিনি বিয়ের সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেন। শেষে ‘নপুংসক মৌমাছি’র কর্মসর্বস্ব অর্থহীন জীবনের মোহ ত্যাগ করে বিয়ে করেন মাতুলকন্যা এমা উয়েজউডকে।-লেখক।

২।. যদিও গোটা বিষয়টিই বিবর্তন তত্ত্বের সাথে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়, তবু প্রাসঙ্গিক হওয়ায় জানানো যাচ্ছে ডারউইন সম্পর্কে এরকম একটি প্রচারণা রয়েছে : ‘মার্কস ব্যক্তিগতভাবে ডারউইনকে তাঁর দ্যাস ক্যাপিটাল বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ পাঠিয়েছিলেন এবং বইটি তিনি ডারউইনকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডারউইন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মার্কসকে চিঠি লিখে না করেন।’ মূল বিষয়টি হচ্ছে, এডওয়ার্ড এ্যাভেলিং (Edward Aveling) নাস্তিকতার উপর ‘The Student’s Darwin’ নামের একটি বই লিখে ডারউইনকে উৎসর্গের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু ডারউইন রাজি হননি এবং তাঁকে চিঠি লিখে মত প্রকাশ করেছিলেন, ‘ধর্মীয় বিষয়ের সাথে বিজ্ঞানকে সরাসরি লিপ্ত করানো উচিৎ নয়।’ এডওয়ার্ড এ্যাভেলিং হলেন কার্ল মার্কসের মেয়ে ইলানোর মার্কস (Elanor Marx)-এর স্বামী। ইলানোর মার্কসের কাছে কার্ল মার্কসের লেখা যাবতীয় চিঠিপত্র, কাগজপত্র সংরক্ষিত ছিল। স্বামী এ্যাভেলিংকে লেখা ডারউইনের চিঠিও তাঁর কাছে ছিল। পরবর্তীতে লোকমুখে এ্যাভেলিংকে লেখা এই চিঠির কথাই ‘মার্কসকে লেখা ডারউইনের চিঠি’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। আর ডারউইনের কাছে এক কপি দ্যাস ক্যাপিটাল ছিল ঠিকই, তবে কানাডার বিখ্যাত বিবর্তন-তাত্ত্বিক মাইকেল রুজ (Machael Ruse) Darwinism Defended (Addition-Wesley Publ. Co, London, 1982) গ্রন্থে জানিয়েছেন : ‘ডারউইনের বাড়িতে গিয়ে তিনি দ্যাস ক্যাপিটাল বইটি সম্পূর্ণ অখোলা অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন।’ (আরো দেখুন : The Talk Origins Archive (Exploring the Creation/Evolution Controversy) (2005). “Index to Creationist Claims” edited by Mark Isaak, from http://www.talkorigins.org/indexcc/CA/CA002_2.html)।-সম্পাদক।

 দ্বিজেন শর্মা : বাংলাদেশের প্রখ্যাত নিসর্গবিদ এবং বিজ্ঞান-লেখক। দীর্ঘকাল বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ এবং ঢাকার নটরডেম কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে কাজের সুবাদে অনুবাদক হিসেবেও সুপরিচিত। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী : ‘শ্যামলী নিসর্গ’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘চার্লস ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘ডারউইন : বিগল-যাত্রীর ভ্রমণকথা’, ‘সতীর্থ বলয়ে ডারউইন’ ইত্যাদি। আলোচ্য প্রবন্ধটি লেখকের অনুমতিক্রমে সতীর্থ বলয়ে ডারউইন (মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৯৯) গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। -সম্পাদক

যুক্তি, সংখ্যা-৩ এ প্রকাশিত।

—————————————–

নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা

দ্বিজেন শর্মার শৈশব কেটেছে সিলেটের পাথারিয়া পাহাড়ের নিসর্গে। তিনি সিলেটের মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বাসিন্দা। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মে। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাঠ নেন। দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে পড়ার সময় উদ্ভিদের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। তখন দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবীব। তাঁর কাছে বৃক্ষবিষয়ক লেখা নিয়ে যাই। ফিচার পাতায় লেখা ছাপা হয়। ’৬২-৬৩ সালের দিকে গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত অবজারভার পত্রিকার ফিচারে কাজ করতেন। সেখানেও বৃক্ষ, পরিবেশ নিয়ে লেখা ছাপা হয়। অবজারভার-এর মালিক হামিদুল হক চৌধুরী গোলাপ ফুল খুব পছন্দ করতেন।’

দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘শুধু গোলাপ নিয়ে একটি সংখ্যা বের করেছিল অবজারভার। সেই ১৯৫৮ সালে ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা ১৫ লাখের মতো। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় চাকরি করতেন শামসুর রাহমান ও আহমেদ হুমায়ুন। লেখা দিতে গেলে তাঁদের সঙ্গে আড্ডা হতো। সাহিত্য পত্রিকা সমকাল-এর সম্পাদক ছিলেন কবি সিকান্দার আবু জাফর। সেখানে তরুণ লেখকদের আড্ডা হতো। ১৯৫৬-৫৮ সালের দিকে ঢাকা শহরে তিনটি রেস্তোরাঁয় আড্ডা হতো। পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো। গুলিস্তানের রেক্স রেস্তোরাঁয়ও শিল্পী-সাহিত্যিকেরা আড্ডা দিতেন। আড্ডায় আসতেন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী প্রমুখ। গুলিস্তান সিনেমায় ছিল গুলিসিতান রেস্তোরাঁ। এখানেও সংস্কৃতিমনা মানুষেরা আসতেন। গুলিস্তান সিনেমা হলের পাশে ছোট সিনেমা হল ছিল নাজ। পৃথিবীর বিখ্যাত সিনেমা দেখানো হতো সেখানে। আমি ম্যান ইন এ গ্রে ফ্ল্যানেল স্যুট, রোমান হলিডের মতো সিনেমা এই নাজে দেখেছি। ১৯৫৬ সালে কার্জন হলে সত্যজিত্ রায়ের পথের পাঁচালী দেখেছি। সেটা পর্দা টাঙিয়ে দেখানো হয়। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’

দ্বিজেন শর্মা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন ঢাকা শহর এত বড় হয়নি। মুগদাপাড়া, খিলগাঁওয়ে ছিল ধানখেত। ওই সময় তিনি স্বপ্ন দেখতেন রমনা গ্রিনের মতোই হবে ঢাকা শহর। জিনজিরা ছিল খালি মাঠ। দ্বিজেন শর্মা স্বপ্ন দেখতেন কলকাতা গড়ের মাঠের আদলে তৈরি হবে জিনজিরা। ১৯৭৪ সালে শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। দ্বিজেন শর্মা লেখা তৈরি করেন। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় বিচিত্রার উদ্যান সংখ্যা। আশির দশকে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার বৃক্ষ সংখ্যা, বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যা, পক্ষী সংখ্যাকে বড় কাজ বলে মনে করেন দ্বিজেন শর্মা।

১৯৫৮ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন দ্বিজেন শর্মা। সেখানে তিনি একটি বাগান করেন। ঢাকার নটর ডেম কলেজে অধ্যাপনা করেন ১৯৬২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। নটর ডেম কলেজেও বাগান করেন দ্বিজেন শর্মা। ১৯৭৪ সালে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনীতে চলে যান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বছর তিনেক সেখানেই ছিলেন। ঢাকায় থাকার একপর্যায়ে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

দ্বিজেন শর্মা অনূদিত বইয়ের সংখ্যা ৩০।. আর মৌলিক বই ১৫টি। দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘এখন আমি পরিবেশ নিয়ে পড়াশোনা করি। আর্থসামাজিক ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমার প্রিয় বিষয়। বছরে দু-তিনবার সিলেটের পাথারিয়ায় যাই, বরিশালে যাই। আমার বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা কবিরাজ ছিলেন। তিনি অনেক গাছ লাগাতেন। গাছের বাকল, পাতা দিয়ে ওষুধ তৈরি করতেন। ঔষধি গাছ সম্পর্কে বাবার কাছেই জেনেছি।’

দ্বিজেন শর্মার এক ছেলে চিকিৎসক, থাকেন মস্কোতে। এক মেয়ে অণুজীববিজ্ঞানী, লন্ডনে থাকেন। দ্বিজেন শর্মা থাকেন সিদ্ধেশ্বরীতে। তিনি প্রায়ই রমনা পার্কে যান, গাছ দেখেন। এখনো গাছ লাগান।
এই অংশ এখান থেকে নেয়া

আরো জানুন

দ্বিজেন শর্মার ভাষায় প্রাকৃতিক নির্বাচন