গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম এসপেক্ট ও তার দলের আবিস্কার নিয়ে – “নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে সাব-এটমিক পার্টিকেল , যেমন ইলেক্ট্রন একে অন্যের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ করে/রাখে , তা একে অন্যের থেকে যত দুরে বা নিকটে থাকুক না কেন।” এবং শেষ করেছিলাম বোহমের এই বক্তব্য দিয়ে – “আমরা সাব-এটমিক কণিকাগুলোকে একে অন্যের থেকে পৃথক ভাবি , কারন আমরা তাদের বাস্তবতার একটি অংশই কেবল দেখতে পাই।”

বোহমের মতে এই কনিকাগুলোর স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই , এরা বৃহৎ কোন এককের এক একটি অংশ , হলোগ্রাফিক গোলাপের মতোই অবিভাজ্য। যেহেতু আমাদের এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই এই জাদুর কণিকা দিয়ে তৈরি , সেকারনে আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি , এই মহাবিশ্ব হলোগ্রাম/ছায়া/মায়া ছাড়া আর কিছু নয়।

মহাবিশ্বের এই ছায়াপ্রকৃতি আরো অনেক অভূতপূর্ব বৈশিষ্ঠের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কণিকাগুলোর এই আপাতদৃষ্টে ভিন্ন অবস্থান যদি মায়া হয় , এর অর্থ দাড়ায় বাস্তবতার আরো গভিরতর লেভেলে কণিকাগুলো একে অন্যের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত। মানুষের ব্রেনের একটি কার্বন অনুর ইলেক্ট্রন , সাতরে বেড়ানো সকল সালমান মাছের ব্রেনের বা সকল জীবিত প্রাণীর বা আকাশে যত তারা আছে , তাদের প্রত্যেকের সাব-এটমিক কণিকার সাথে যোগাযোগ রক্ষার মধ্য দিয়ে জড়িত। এই মহাবিশ্বের সকলকিছুই একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত , এরা একটি তারবিহীন জালের অংশ। এদের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ঠ খোজা অর্থহীন।

এই হলোগ্রাম বা ছায়া বিশ্বে সময় ও স্থান বা স্পেস বলে কিছু নেই। কারন মহাবিশ্বের কোনকিছুই যখন কোনকিছুর থেকে পৃথক নয় , তখন অবস্থানের ধারনাই বাতিল হয়ে যায়। একারনেই মনে হয় স্পেসকে মহাশুন্য বলে।

গভিরতর লেভেলে বাস্তবতা হলো একটি সুপার হলোগ্রাম , যেখানে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত একসাথে অবস্থান করে। ধারনা করতে দোষ নেই , ভবিষ্যতে সঠিক প্রযুক্তির উদ্ভব হলে , সুপার হলোগ্রাম লেভেলের বাস্তবতায় যেয়ে সুদুর অতীতের ভুলে যাওয়া কোন দৃশ্য তুলে এনে সকলের সামনে দৃশ্যমান করা সম্ভব হবে। তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারব এই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব কিভাবে হয়েছিল , মানুষ কিভাবে ধাপে ধাপে জীবের বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল , কোন বিতর্ক বা অবিশ্বাসের অবকাশ আর থাকবে না।

বোহম-ই একমাত্র গবেষক নন যিনি ‘আমাদের এই মহাবিশ্ব যে একটা হলোগ্রাম’ তার স্বপক্ষে যুক্তি প্রমান হাজির করার চেষ্টা করেছেন। ব্রেন নিয়ে গবেষনা করতে যেয়ে স্টানফোর্ড নেউরোফিজিওলোজিস্ট কার্ল পিরিব্রাম স্বাধীনভাবে এই হলোগ্রাম লেভেলের বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ব্রেনের ঠিক কোন অংশে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে , এটার গবেষনা করতে যেয়ে গবেষকগণ আশ্চর্য হয়ে দেখেন ব্রেনের কোন একটি বিশেষ অংশে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে না , বরং সম্পুর্ণ ব্রেনটাতেই স্মৃতি ছড়িয়ে থাকে। ১৯২০ সালে ব্রেন বিজ্ঞানী কার্ল ল্যাশলী দেখেন যে , ইদুরের ব্রেনের যে কোন অংশই অস্ত্রোপচার করে বাদ দেন না কেন , ইদুরটি অস্ত্রোপচারের পূর্বে শেখানো জটিল কিছু কাজের অভ্যাস ভুলছে না। সমস্যা দেখা দিল ব্রেনের ‘প্রতিটি অংশে সম্পুর্ন’ স্মৃতি সংরক্ষনের এই বিষয়টি ব্যাখ্যা সে সময়ে কারো জানা ছিল না।

১৯৬০ সালে কার্ল পিরিব্রাম হলোগ্রামের ধারনার সাথে পরিচিত হয়ে উপলব্ধি করলেন, ব্রেন বিজ্ঞানীরা এতদিন যে সমস্যার জবাব খুজে পাচ্ছিলেন না , তার জবাব লুকিয়ে আছে হলোগ্রামের ভিতরে , অর্থাৎ পুরো ব্রেনটাই একটা হলোগ্রাম। পুরো ব্রেন কিভাবে স্মৃতি সংরক্ষন করে তা লিখে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে এটুকু বলা যায় যে , আমাদের পঞ্চেন্দ্রীয় বাহ্যিক বাস্তবতার যে ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল পাঠায় , তা আমাদের ব্রেন যাচাই বাছাই করে একটি প্যাটার্ন হিসাবে সমগ্র ব্রেনে সংরক্ষিত রাখে , গোলাপফুলের যে হলোগ্রামের কথা লিখেছিলাম গত পর্বে , সেটার মতো। আমরা সহ আমাদের চারিপাশের এই মহাবিশ্বের বাস্তবতা আমাদের ব্রেনে ধারনকৃত ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল ছাড়া আর কিছু নয় এবং এরা সকলেই একে অন্যের সাথে সবসময় কোন না কোন ভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছে। এর ভিতরেই হয়তোবা প্যারানর্মাল কার্যকলাপ বা কোইন্সিডেন্সের (আকস্মিক যোগাযোগ বা ঘটনা) রহস্য লুকিয়ে আছে।

যারা আরো বিস্তারিত জানতে চান , তারা মাইকেল ট্যালবটের Spirituality and Science: The Holographic Universe পড়ে দেখতে পারেন।