‘পাপ ব্যক্তিগত; অপরাধ সামাজিক’।

১. একবিংশ শতাব্দী অতিক্রম করছি আমরা এখন, কিন্তু ব্যাপক অর্থে এখনও আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতার যুগে প্রবেশ করতে পারিনি। বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাটি এখনও এখানে অঙ্কুরিত অবস্থাতেই রয়ে গেছে, তাই প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত কাজকর্মও এখানে খুব বেশি সামাজিক হয়ে ওঠে! ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি অন্য কারো ক্ষতি বা সমস্যার সৃষ্টি না করে একজন মানুষের যা ইচ্ছে তা করতে পারার অধিকার। ব্যক্তিস্বাধীনতার সাথে আধুনিকতার ধারণাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেই অর্থে ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপক বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত কোন সমাজকে কিছুতেই আধুনিক বলা যায় না- এই হিশেবে আমরা এখনও এক অনাধুনিক মধ্যযুগীয় সমাজেই বাস করছি।

ব্যক্তিস্বাধীনতার একটা সীমারেখা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন, নতুবা সমাজের উপর এর ক্ষতিকর একটা প্রভাব পড়তে বাধ্য। ব্যক্তিস্বাধীনতার এই সীমারেখা টানতে গিয়ে পাপ ও অপরাধের ধারণাদুটি চলে আসে। নির্দিষ্ট কোন ধর্মের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে গেলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না আর, কারণ হাজারটা পাপকাজের শেকলে মানুষ বন্দী এখানে। ধর্মগুলো চিরকালই মানুষকে বন্দী করে রাখার দায়িত্ব বেশ সফলভাবে পালন করে এসেছে, আর মানুষকে বন্দী করার হাতিয়ার হিশেবেই এসেছে পাপের ধারণাটি। মানুষের তথাকথিত ‘নৈতিক অধঃপতন’ ঠেকাতে ধর্মগুলো নৈতিক কিছু বিধিমালা তৈরী করে, যা ভঙ্গ করাকে ‘পাপ’ বলে অভিহিত করা হয়। এখানে যে সমস্যাটি দেখা দেয় সেটা হচ্ছে, প্রতিটা মানুষের নৈতিকতাবোধ আলাদা; এজন্য এক ধর্মপ্রচারকের নৈতিকতার ধারণার সাথে অন্য ধর্মপ্রচারকের নৈতিকতার ধারণার অসামন্জস্যতা দেখা দেয়। ফলে প্রতিটা ধর্মের নৈতিকতার বিধিমালায় ভিন্নতা দেখা যায়। মজার ব্যাপার হল, প্রতিটা ধর্মই যথারীতি নিজেদের নৈতিকতার ধারণকেই পরম বলে দাবি করে, অন্যগুলোকে বাতিল করে অনৈতিক বলে!

২. ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্মে প্রদত্ত নির্দেশাবলি অমান্য করাটাই পাপ (sin)। অন্যদিকে সামাজিক বা আইনী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ‘পাপ’ বলে কিছুই নেই, আইনভঙ্গ করাকে এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অপরাধ (offense/crime) বলা হয়। ধর্মে প্রচারিত পাপের তালিকাসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে আধুনিক আইন অনুযায়ী বিবেচিত অপরাধের অনেকগুলোকেই এসব পাপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, আবার ধর্মগুলোতে এমন অসংখ্য পাপের ধারণা আছে যাদেরকে এখন আদৌ আর অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। নৈতিকতার ধারণাটি স্বততঃ পরিবর্তনশীল ; এক যুগের নৈতিক আচরণ আরেক যুগের নৈতিক স্খলন হিশেবে বিবেচিত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। ধর্মপ্রচারকরা একটি নির্দিষ্ট যুগে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম প্রবর্তন করেছেন যাতে রয়েছে কতগুলো নির্দিষ্ট বিধিমালা যেগুলো কেবলমাত্র ওই নির্দিষ্ট যুগের ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তির নৈতিকতার ধারণার সাথেই সামন্জস্যপূর্ণ; এ কারণে সব ধর্মেই এরকম অনেক নৈতিক বিধিমালা দেখতে পাওয়া যায় যা বর্তমান যুগের জন্য অসামন্জস্যপূর্ণ এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকরও বটে।

৩. পাপ ও অপরাধের ধারণাদ্বয় সামন্জস্যপূর্ণ নয়, আবার পুরোপুরি সাঙ্ঘর্ষিকও নয়। আসলে পাপ ও অপরাধের ধারণা দুটি পুরোপুরিই ভিন্ন প্রেক্ষিতে বিবেটিত দুটি ধারণা- পাপ ব্যক্তিগত, অপরাধ সামাজিক। পাপের ধারণা বিকশেত হয়েছে স্রষ্টা ও ধর্মের ধারণাকে ভিত্তি করে; অপরদিকে অপরাধের ধারণা বিকশিত হয়েছে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার কথা বিবেচনা করে। কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্ম যদি সত্য হয়, তাহলে ওই ধর্মের নৈতিক সমস্ত বিধিমালাও সত্য হবে, ফলশ্রুতিতে ওই ধর্মে বর্ণিত সমস্ত পাপকাজও যুক্তিসিদ্ধ হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও ধর্মই ‘সত্য’ প্রমাণিত হয় নি, এ কারণে পাপের ধারণাটাই এখনও পর্যন্ত অযৌক্তিক রয়ে গেছে। অন্যদিকে অপরাধের প্রায়োগিক দিকটা সহজেই আমাদের চোখের সামনে ধরা পড়ে; কারণ, অপরাধের ধারণাটি নিছক কল্পনাপ্রসূত নয়, বরং এই ধারণা গড়ে উঠেছে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখতে যেসব ব্যাপার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদেরকেই অভিহিত করা হয়েছে অপরাধ হিশেবে- তাই অপরাধ সম্পূর্ণই বাস্তবসম্মত এবং একই সাথে প্রয়োজনীয় একটি ধারণা।

ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত অনেক পাপকেই বর্তমানে আর অপরাধ বলে গণ্য করা হয়না। এক্ষেত্রে একটি বহুল আলোচিত পাপের কথা উল্লেখ করা যায়- বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক। প্রায় সকল প্রধান ধর্মগুলোতেই বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে একটি মহাপাপ হিশেবে দেখানো হয়েছে; কিন্তু আধুনিক ধারণায়, এটা কোন অপরাধের মধ্যেই পড়ে না। বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক পুরোপুরিই একটা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সমাজের আর দশজনের উপর এই পাপের কোন প্রভাবই নেই। আর অপরাধ মানুষের সেইসব ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায় না যেসবের কোন সামাজিক প্রভাব নেই।

আমরা যদি আমাদের সমকালীন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমরা দেখব, বেশির ভাগ মানুষ এখনও পাপকাজের প্রতি মারাত্মক অসহনশীল, যেখানে অনেক গর্হিত অপরাধের প্রতি সেই একই মানুষেরা আশ্চর্য্যরকমভাবে উদাসীন থাকে। একটু আগে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের যে উদাহরণটা দেওয়া হয়েছে সেটার সাথে সম্পর্কিত পাপকাজের ভয়াবহরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় আমাদের মত দেশগুলোতে। অনেক দেশে তো এহেন পাপকাজের শাস্তি হিশেবে মৃত্যুদন্ডের বিধানও আছে। অন্যদিকে আমাদের সমাজেই দেখি অনেক খুনী, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারী, চোরাকারবারীদেরকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে, এমনকী এদের বেশির ভাগকে এখানে বরং শ্রদ্ধার পাত্র হিশেবেই গণ্য করা হয়! হয়ত এদেরই অনেকে একসময় ‘জনদরদী’ নেতায় পরিণত হয়ে ওঠে!

কোন একটা কাজ পাপ বলে অভিহিত হবে কী হবে না তা কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে না, বরং তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে কতগুলো নিম্নশ্রেণীর ‘পবিত্র বই’ এর দুবোর্ধ্য ব্যাখ্যার উপর। যেহেতু পাপ ব্যাপারটা কোন যুক্তির ধার ধারে না, সেহেতু ‘পাপ’ এর ধারণাটা প্রায়শই খুব মারাত্মক এবং ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। কয়েকদিন আগে আমরা দেখলাম আমাদের এই বাঙলাদেশেই হেনা নামের এক কিশোরীকে ‘ধর্ষিত’ হওয়ার ‘পাপ’ এ কিভাবে দোররা মেরে হত্যা করা হল! পাপের ধারণাটা এখনও সমাজে তীব্রভাবে উপস্থিত, এই কারণে নিরপরাধ পাপীরা শুধুই যে সামাজিক ভোগান্তির শিকার হয় তা নয, মাঝে মাঝে এই ভোগান্তিটা ‘মৃর্ত্যু’ পর্যন্ত হতে পারে!

শেষ কথা: যতদিন ধর্ম থাকবে, ততদিন পাপ থাকবে, ততদিন কূপমন্ডুকতা, গোঁড়ামি, পশ্চাদপদতা, অনগ্রসরতাও থাকবে। মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার অবশ্যই, তবে তা অবশ্যই হতে হবে একটা যৌক্তিক কাঠামোর মধ্যে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে ‘পরম সত্য’ বলে হয়ত কিছু নেই, কিন্তু ‘অধিকতর কল্যাণমূলক সত্য’কে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ‘পাপ’ নামক মধ্যযুগীয় ধারণাটিকে পুরোপুরি ছুড়েঁ ফেলার কোন বিকল্পই নেই।

(০৮/০২/১০)