বইমেলার ভ্রমণবৃত্তান্ত ও আমার অনুভূতি:
ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার সময় শরীর যেমন অটোমেটিক নাচে। তেমনই ঘটে বইমেলায় গেলে। এ আমার একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি। আবেগে আপ্লুত হলেও নিজেকে কন্ট্রোলে রাখি। যেদিন যাই, সেদিন পুরোটা সময় কাটাই বইমেলায়। এমন কোনো স্টল নেই যেখানে ঢু মারি না। নতুন নুতন বইয়ের গন্ধ শুকি। কিনি বা না কিনি সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো বইয়ের গন্ধ শোকা। অন্যেরা আমার মত গন্ধ পেতে পছন্দ করে কি না, জানি না; কিন্তু আমাকে গন্ধ নিতেই হবে। কেন যে নতুন বইয়ের গন্ধ শুকতে ভালো লাগে তাও জানি না। কোনো লাইব্রেরী কিম্বা বইমেলায় গেলে গন্ধ শোকার নেশাটা মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে। বইমেলায় ঢোকার আগেই ১০/১২ টি খিলি পান সঙ্গে করে নেই। সেগুলো শেষ হলে বাইরে গিয়ে আবার নিয়ে আসি। কবি আসাদ যেমন পান খেয়ে ঠোটটা লালটুকটুকে করেন, আমিও তদ্রুপ করি। পানের নেশা বড় নেশা। একবার ধরলে ছাড়া খুবই মুশকিল। আমি আর কবি আফরোজা আপা একসাথে পান চিবুবো এমনই প্লান ছিল; কিন্তু সেই প্লান বাস্তবায়নের কোনো চেষ্টাই করি না। হঠাৎ করে মনের পরিবর্তন ঘটেছে। মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছি। অনেক মিসকল উঠে আছে। কারা কারা করলো, চেয়েও দেখি না। মেলায় ঘুরবো একা, সম্পূর্ণ স্বাধীন। কেউ বলবে না- চলো ঐদিকে যাই। কারো হুকুম, কারো পরামর্শ, কারো অনুরোধ থাকবে না আমার জীবনে এই মেলায়।

গতমেলায় এসেছিলাম। তখন মুক্তমনার সাথে পরিচয় ঘটেনি। ড. অভিজিৎ রায়ের ‘সমকামিতা’ বইটি দেখেছিলাম। কেনা হয় নি ঐ সময়। লেখককে চিনতামও না। এখন চিনেছি- কিনবো না বইটি। অনেক অনুরোধ করেছিলাম ‘ধর্মে সমকামিতা’ চ্যাপটারটি মুক্তমনায় দিতে। তিনি কথাও দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে আর সেই কথা রাখেন নি। তাছাড়া বইটি সম্পর্কে মেলার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলাম এভাবে: “বইমেলায় গেছি। বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে বই নাড়াচাড়া করে দেখছি। কিছু বইও কিনে ফেললাম। হঠাৎ করে একটি স্টলে এসে ‘সমকামিতা’ নামে বইটি দেখলাম। কেউ কেউ বইটির দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ কেউ হাতে তুলে আবার রেখে দিচ্ছে। কেউ কেউ ডানহাতে বইটি ধরে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বইয়ের পাতা অতি দ্রুত কির কির করে সরিয়ে দিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিচ্ছে। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কাউকেই ঐ বইটি কিনতে দেখলাম না। বইটি আমিও হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলাম। নামটাতেই কেমন এলার্জি ফিল করলাম। হঠাৎ করে একজনের মন্তব্য কানে এলো, ‘লেখক মনে হয় দেশে সমকামিতা চালু করতে চাচ্ছে।’ আর একজন বলছে- ‘নারী বইয়ের মত বইটা ব্যান্ড হতে পারে।’ যাহোক আমি বইটা না কিনেই চলে এসেছিলাম।”

পরে শুনেছি- বইটির কাটতি ভালোই। লুকিয়ে লুকিয়ে কিনেছেও কেউ কেউ। বইটি নিয়ে নানা ব্লগে মজার মজার হাস্যরসাত্মক ঘটনার অবতারণাও লক্ষ্য করা গেছে ঐ সময়।

আমার বলা ঘটনাটি নাকি গল্পের ঝাঁপি!! বিস্তারিত জানতে চাইলে আগ্রহী পাঠকগণ এখানকার (৩-৬ নং) মন্তব্যগুলো পড়ে দেখতে পারেন। দেখুন, কিভাবে আমাকে থামস ডাউন দেয়া হয়েছে। ঠিকই তো, সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া বাস্তববাদী যুক্তিবাদীরা তা মেনে নেবেন কেন? আর আমিই বা সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া ঘটনা বলি কোন আক্কেলে? প্রমাণস্বরূপ ছবি দরকার।

তবে গুণমুগ্ধ পাঠকের ন্যায় — “অভিজিৎ-এর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর স্বর্ণময় কাজগুলি আজ হয়ত বাংলাদেশের তথাকথিত জ্ঞানী-গুণীজন থেকে শুরু করে শিক্ষিত পড়ুয়া শ্রেণী বাঁকা চোখে দেখে বা মনে মনে তেঁতো ডেকুর তোলে; এই তাদেরই পরবর্তী জেনারেশনরাই আবার ঐ জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাজ করা বিষয়গুলি নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করে বাঙালি সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।” — মামুন ভাইয়ের এমন মন্তব্য নতশিরে সহমত জ্ঞাপন করতেই হবে আমাকে।

গীতা দাসের ‘তখন ও এখন’ বইটি প্রকাশ হওয়ার পেছনে আমাকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ আসামী করা হয়েছে; এতে আমার অনুভূতিটা সুখেরই। সুখটা আরো বৃদ্ধি পাবে আফরোজা আলমের ‘ফানুস’টি বের হলে।

বড় আশা করেছিলাম- আকাশ মালিকের ‘যে সত্য বলা হয়নি’- বইটির জন্য। কিন্তু সেটি এবার প্রকাশ হয়নি। আরোও আশা ছিল- আবুল কাসেমের ‘ইসলামী কাম ও কামকেলী’ বইটি পাবার। এটাও প্রকাশ পায়নি। খাঁটি কথা হচ্ছে- মন যা চায় তা পায় না, আর যা চাই না তা-ই হাজির হয় সামনে। এ যেন অনেকটা – “আমি যে কি করি তা আমি নিজেই বুঝি না, কারণ আমি যা করতে চাই তা করি না, বরং যা ঘৃণা করি তা-ই করি।”- এর মতো। এ ধরনের বই প্রকাশ করা চাট্টি খানি কথা না। অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়।

বইমেলায় অবশ্য রক্তদান কর্মসূচিও চলে। রেড ক্রিসেন্ট, সন্ধানী সংস্থাগুলোর কর্মীবৃন্দ রক্ত সংগ্রহে সদা ব্যস্ত। সুন্দর ড্রেসে ওদেরকে দেখতে ভালোই লাগে। সেবামূলক কাজে নিয়োজিত। ভাবি মনে মনে- রক্ত দেবো কিনা? কিন্তু ঐ ভাবা পর্যন্তই, দেয়া আর হয় না। মাজুখানের ট্রেন দূর্ঘটনায় একবার রক্ত দিতে গিয়ে দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সারাদিনের না খাওয়া মানুষ, রক্ত দিলে তো একটু দূর্বল হবোই। কিন্তু ঐ সময়ে প্রচন্ড আবেগীয় টানে রক্ত দিয়েছিলাম। এরপর আর কোনোদিন দেয়া হয়নি। এ পজেটিভ রক্ত এমনিতেই এভেইলেবল। লোকে বলে- ‘এ’টা নাকি গরুর রক্ত!

মেলা সম্পর্কিত তথ্যকেন্দ্রটাতেও দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। প্রত্যেকটি স্টলের নম্বর দেয়া আছে; স্টলের খোঁজ পেতে নম্বরটি গুরুত্বপূর্ণ। নম্বর অনুসারে সহজেই পাওয়া যায় কাঙ্খিত স্টল।

এবারের বইমেলায় স্টলের সংখ্যা গোনা হয়নি। অবশ্য তথ্যকেন্দ্রে জিজ্ঞেস করলেই অনায়াসে তা জানা যাবে। কিন্তু নিজে গুণে গুণে দেখতে মজা পাই। নানা ধরনের প্রকাশকের সমাহার। ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশনীও মেলাতে স্থান পায়। যেমন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, বাহাইসহ সনাতন ধর্মের প্রকাশনাও রয়েছে। এছাড়া শিশু একডেমী, শিল্পকলা একাডেমী। কোনো কোনো স্টল বই বিক্রির সাথে সাথে সিডিও বিক্রি করে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামান্য চিত্র, কবিতা, গান, সিনেমার সিডি। ঐ তো, এশিয়াটিক সোসাইটির স্টল। এখান থেকেই বাংলাপিডিয়া বের হয়। বিশেষণের পর বিশেষণ যোগ করে জীবনীগুলো লেখা হয়েছে; বড়ই একপেশে- শুধুই প্রশংসা আর প্রশংসা।

বিগত বইমেলাগুলোতে একটু বেশি সময় কাটাতাম ওসমান গনি’র আগামী প্রকাশনীতে। কারণ ওখান থেকেই হুমায়ুন আজাদের বই বের হতো। এখনও রিপ্রিন্ট হয়। এবার বেশি সময় কাটাবো শুদ্ধস্বরে। কারণ একটাই- মুক্তমনার লেখকদের বই বের হয়েছে এই প্রকাশনী থেকে। বলতে পারেন, এটা অনেকটা ‘সাম্প্রদায়িক প্রীতির টান’।

বাংলা একাডেমীর স্টলে যাই। তাদের স্টলটাই সবচেয়ে বড়। নিজস্ব বিল্ডিংয়ে তাদের বইয়ের সমাহার। ব্যাগ জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে। সেখানে থাকে অনেক পুরোনো বই। ৫০% পর্যন্ত কমিশন। আমার ইচ্ছা ড. ম আখতারুজ্জামান রচিত বিবর্তন-এর উপর বইটি কেনার।

চলতে চলতে হাটতে হাটতে নানান ভাবনা মাথায় আসে। কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ মেলায় আসতে চেয়েছেন। কবে আসবেন দিন-ক্ষণ জানি না। শুধু ভাবি- এই বুঝি আজকে দেখা হবে লম্বা চুলওয়ালা মানুষটির সাথে। অনেক কবিকেই দেখতে পাই। কিন্তু কই গেলেন আমাদের মুক্তমনার কবি যিনি ‘নাস্তিকতা’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। যিনি লিখেছেন- “ঈশ্বর মরে গেলে আমি খুশি হবো।”

কী ব্যাপার ঐ স্টলে এত ভীড় কেন? এগিয়ে যাই কৌতুলবশত। বাংলার কথা সাহিত্যিক/ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন। চরম জনপ্রিয়। অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য পাগল তরুণীরা। সদা হাস্য এই মানুষটি চমৎকার করে কথা বলেন। টিভি উপস্থাপকও বটে। একসময় তসলিমা নাসরিনের সাথে সখ্যতা ছিল। একটি নজর দিয়েই আগাতে থাকি অন্য আরেকটি স্টলের দিকে।

শুদ্ধস্বরের স্টলটি কোথায়?–মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করি। শুনেছি এখানে শুদ্ধস্বর নামে দুটি স্টল আছে। কোনটা আসল আর কোনটি নকল তা খুঁজে বের করতে হবে। আসলে, নকল বলে কিছু নেই। দুটিই আসল। একটি আহমেদ টুটুলের, অপরটি ….।

কবিতা উৎসবের প্যান্ডেলের দিকে যাই ঠিকই, কিন্তু বসি না। বসে শোনার কোনো প্রয়োজন অনুভব করি না। বইয়ের স্টলে থাকলেও মাইকের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। একই সময়ে দুটো কাজও হয়। কান দিয়ে মাইকের আওয়াজ শোনা অপরদিকে চোখ দিয়ে বইয়ের দিকে নজর দেয়া।

আচ্ছা, আমাদের সাংবাদিক বিপ্লব রহমান কি মেলায় আসেন? তাকে কি ফোন দেবো? ভাবতে ভাবতে মোবাইলের বাটনে আঙুল টিপি।
-“হ্যালো, কালের কণ্ঠের বিপ্লব রহমানকে চাচ্ছিলাম।”
-“হ্যা, আমি বিপ্লব; কে বলছেন”।
-“আমি মাহফুজ।”
-“কোন মাহফুজ।”
-“মোকছেদ আলীকে চেনেন?”
-“ও, হ্যা হ্যা মুক্তমনা, মুক্তমনা।”
-“বইমেলায় এসেছি, ভাবলাম যদি আপনার দেখা পাই।”
-“দেখা হলে তো ভালোই হতো; কিন্তু আজ আমার হাতে প্রচুর কাজ।”

হঠাৎ কার ধাক্কায় যেন মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল। তুলে নিলাম। বন্ধ হয়ে গেছে। পুরোনো মোবাইল, এমনিতেই বিগড়ে যায়। অনেকটা অনন্তের মোবাইলের মত। ধাক্কায় আমার কল্পনার জাল ছিন্ন হয়ে যায়।