মানুষের মনসত্ত্ব বড় জটিল জিনিষ। আর মানুষের মনের সৃষ্টিকারী মস্তিষ্ক আরও বড় জটিল বস্তু। যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের রীতিমত হিমসিম খেতে হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে মস্তিষ্কের রহস্য যত উদঘাটন হবে, মানুষের আচার, আচরণ, স্বভাব চরিত্রের জটিলতা ততই বেরিয়ে আসবে।

আবার আমাদের সমাজে মানসিক রোগ নিয়ে যেমন তেমন সচেতনতা নেই। তেমনি এই নিয়ে বিভ্রান্তিও আছে। যেমন আমার মানসিকতার সঙ্গে অন্য কারও মানসিকতা পার্থক্য থাকায় আমি তাকে পাগল আখ্যা দিলাম তা কি ঠিক হবে? না কোন ভাবেই না এটাকে দুজন মানুষের মানসিকতার বৈচিত্র্য হিসাবে ধরতে হবে। কারও আচরণ বা মানসিকতা তখনই বিকারের আওতায় আসবে যখন সেই ব্যক্তির আচরণ বা মানসিকতা অন্যের বা তা নিজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।
মানসিক রোগ নিয়ে আরও কিছু বিভ্রান্তি আছে। অনেকে মনে করেন মানসিক রোগের প্রধান কারণ হল পরিবেশ। কথাটা ১০০% সঠিক নয়। পরিবেশ তো থাকেই সঙ্গে থাকে জিনেটিক কারণও। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, একই প্রতিকুল পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও দশটা মানুষের মধ্যে হয় তো একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়।
অনেকটা এইভাবে বলা যায় জিন দ্বারা বাহিত বিকার উপযুক্ত পরিবেশের কবলে পড়ে তার পূণাঙ্গ রূপ নেয়।

তবে অনেক রোগের কারণ এখনও অজানা এমন কি অনেকক্ষেত্রে ঔষধ কিভাবে কাজ করে তা জানা সম্ভব হয় নি।
কিন্তু যেভাবে জীববিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদরা কাজ করছেন তাতে নিশ্চিন্তে বলা যায় ভবিষ্যতে মনোরোগের চিকিৎসা এবং রোগের উৎস সঠিকভাবে জানা সম্ভব হবে।
এছাড়াও মানসিক রোগ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল মানসিক রোগ বলতে আমরা বুঝি প্রচণ্ড উগ্রতা, উন্মত্ততা অথবা পাগলামি। কিন্তু এই ধরণের আচরণ জটিল মানসিক রোগ যার ১ শতাংশ জনগণের মধ্যে দেখা যেতে পারে।
কিন্তু মানসিক রোগ বলতে শুধু উগ্র, ক্ষিপ্ত আচরণ নয় অনেক রোগ আছে যা সাধারণ মানুষের দ্বারা চেনা ও বুঝা শক্ত হয়ে যায়।

মানসিক রোগ নিয়ে আগে একটা লেখা আমি দিয়েছিলাম মনোরোগ ও কিছু কথা নামে। যেখানে কিছু সাধারণ মনোরোগ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজও আমি কিছু উদ্ভূত মানসিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব।
আমি উপরে বলেছিলাম এখনও অনেক রোগ এবং ঔষধ কিভাবে কাজ করে তা জানা সম্ভব হয় নি। তবে দীর্ঘদিন ঔষধ প্রয়োগ এবং থেরাপি চালিয়ে গেলে মানসিক অস্বাভাবিকতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

*এখন আমি যে রোগটা বলছি তার নাম পাইকা :- ম্যাগমাই নামে একধরণের পাখী নাম নিশ্চয় শুনেছেন। যার ল্যাটিন নাম হল পাইকা, এই পাখীরা বিভিন্ন অখাদ্য কুখাদ্য তৃপ্তি সহকারে খেয়ে থাকে।
আর তেমনি পাইকা রোগে আক্রান্ত রোগীরাও একই কাজ করে থাকেন। এইধরনের রোগী খেয়াল করলেই আশেপাশে পাওয়া যায়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীর পরিবারের তরফ থেকে রোগটি গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়।

তিন বছরের বেশী বয়সের কেউ যদি বিভিন্ন অখাদ্য যেমন চুন,রঙ, মাটি, চুল, কাপড়, ধুলো, বালি, প্লাস্টিক, সাবান ইত্যাদি খেতে থাকে তা হলে তাকে পাইকা রোগী বলে ধরতে হবে।

এই রোগের সবচেয়ে বিপদ হল যদি কেউ গর্ভকালীন সময়ে এই রোগের কবলে পড়ে। তা হলে গর্ভস্থ ভ্রূণেরও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
এই রোগে সাইকিয়ট্রিষ্টরা ঔষধ এবং সাইকো থেরাপির ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন।

*আরেকটা রোগ আছে একে ক্ল্যাপটোম্যানিয়া বলে। এই রোগে রোগী কোন অভাব ছাড়াই চোরি করে বসে।
কিন্তু সেক্ষেত্রে হয়ত চোরি করা বস্তু আদৌ তার কোন কাজের নয়। আবার চোরি করে এরা প্রচণ্ড আত্মগ্লানিতে ভোগে সেই থেকে দেখা দেয় ডিপ্রেশন।
এই রোগও পরিবারের সদস্যরা চেপে যেতে চান। কারণ কে সাধ করে মানুষকে জানাতে যাবে যে তার প্রিয়জন একজন স্বভাব চোর?

এইধরনের রোগী যে শুধু তার পরিবার বা সমাজের জন্য সমস্যা তাই নয় সে নিজের মধ্যেও সমস্যা হয়ে দাড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
এই রোগেও ঔষধের পাশাপাশি বিহেভিয়ারাল থেরাপি এবং সাইকো-কাউন্সেলিং মধ্য দিয়ে রোগ সারিয়ে তোলা হয়।
আরও একটা জিনিষ বিশেষ প্রয়োজন রোগীর প্রতি সমাজ এবং পরিবারের সহানুভূতি।

*বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার :- এই ধরণের রোগী নিজের চেহারার মধ্যে খুঁত খুঁজে বেড়ায়। তার আদৌ হয়ত কোন চেহারার খুত নেই। কিন্তু সে বদ্ধ ভাবে বিশ্বাস করে তার খুত আছে।

এইসব রোগী সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় থাকে তার চেহারা নিয়ে। তার কল্পিত খুতের পরিবর্তনের জন্য প্লাস্টিক সার্জনের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু কোন কিছুতেই এরা স্বস্তি খুঁজে পায় না। ধীরে ধীরে সমাজ এবং বন্ধু-বান্ধব থেকে দূরে সরে একা হয়ে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত আত্মগ্লানি থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

এইসব রোগীর চিকিৎসা করা সমস্যার ব্যাপার। কারণ রোগী নিজে বোঝতে পারে না তার সমস্যাটিতে যে মনো-বৈজ্ঞানিক কারণ লুকায়িত। এরা একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের চেয়ে কসমেটিক সার্জনকেই বেশী পছন্দ করে।

*অ্যাটেশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভ ডিসওর্ডার :- এইরোগ স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। এরা অতিরিক্ত চঞ্চল হয়। এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। অসম্ভব মন:সংযোগের অভাব থাকে। বিপজ্জনক কাজ করে এবং জিনিস পত্র নষ্ট করে। কোন প্রশ্নে করলে উত্তর বোকার মতো দেয়।
এই ক্ষেত্রেও বিহেভিয়ারাল থেরাপি এবং ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।

*অটিজম :-প্রথমে বলি অটিজম দুধরণের মুখ্য ও গৌণ। মুখ্য অটিজম বংশগত রোগ।
এই রোগের রোগীরা অন্যদের যন্ত্র বা প্রাণহীন মনে করে। অন্যদের সঙ্গে মিশে না বা নিজেদের নিয়েই মগ্ন থাকে। এদের চোখের চাউনি অদ্ভূদ রকমের।
এদের কথা এবং ভাষাতে শৃঙ্খলার অভাব পাওয়া যায়। জীবনের পরিচিত ছকের বাইরে গেলে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে।

যেমন যে পথ দিয়ে যায় সেই পথ দিয়েই যেতে হবে। যেখানে বসে খায় সেখানে বসেই খেতে হবে। ঘরের জিনিসপত্র যেভাবে রাখা সেইভাবে রাখতে হবে।
এই রোগ তিন বৎসর বয়স থেকে ধরা পড়ে। উপসর্গ কৈশোরে পূর্ণতা পায়। এই রোগটি ক্রনিক, পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায় না। তবে সঠিক চিকিৎসায় এর তীব্রতা হ্রাস করা যায়।

আজকাল মানসিক রোগ নিয়ে জন সচেতন জাগানোর জন্য সিনেমা জগত ও উঠে আসছে। আপনারা অনেকে হয়ত বলিউডের দুটা ফিল্ম দেখেছেন ১) গজনী যেখানে আমীর খানের Sort term memory lose এর সমস্যা দেখেছেন। ২) তারে জমিন পর যেখানে ডিকলেকশিয়া নামক মানসিক ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত বাচ্ছাটার করুন অবস্থা দেখেছেন।

শুধু সিনেমা জগতে বা বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই সীমা বদ্ধ না রেখে মানসিক ব্যাধি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে সমাজ তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে। আর ঘৃণা নয় আমরা তাদের মানুষ ভেবে তাদের সুস্থ করার প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে যাই।
আজ এই পর্যন্ত । যদি আপনাদের ভাল লাগে ভবিষ্যতে মানসিক ব্যাধি নিয়ে আরও আলোচনা করব। না হলে এতটুকুতেই ইতি দেব।