বেড়ার ফাক দিয়ে রোদ এসে চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় সরফুদ্দিনের। আমেনা এইমাত্র উঠে গেল মুখ হাত ধুতে। কলের হিম শীতল পানিতে হাত মুখ ধুয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে সরফুদ্দিন দেখল আমেনা ভাত বাড়ছে, সাথে কাল রাতের বাসি তরকারি। বয়সের সাথে সাথে রক্তের তেজ কমে যাবার কারণেই হয়ত শীতের দিনে হাত পা বেশি কাঁটা দেয় বৃদ্ধ সরফুদ্দিন আর আমেনার, তার মাঝে এই ঠান্ডা ভাত তরকারী খাওয়া। তবু দিনের এই সময়টাকেই বেশি ভালবাসে বুড়ো-বুড়ি। কারণ এরপরই আমেনা বেরিয়ে পড়ে সাহেবদের বাড়ির উদ্দেশ্যে আর সরফুদ্দিন রিকশা নিয়ে। এই সময়টাতে বুড়োবুড়ি আলাপ করে অনেক। বুড়ো জেনে নেয় আজ বাজার কি হবে, আমেনা কটা নাগাদ ফিরবে কাজ শেষে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সময়টা সরফুদ্দিনের ভাল লাগার আরেকটা কারণ হল রাত জেগে ছেলে-মেয়েদের কথা মনে করে কান্নাকাটি করার পর আমেনার কষ্টটা সেদিনের মত ধুয়ে যায় বলেই হয়তো এসময় আমেনা বেশ প্রসন্ন থাকে, সরফুদ্দিনের বড় ভাল লাগে। খেয়ে দেয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ে দুজনের ছোট্ট নীড়টি ছেড়ে।

গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সরফুদ্দিন। তার বয়সের আর কেউ রিকশা নেয়না এই গ্যারেজ থেকে, বয়সের কারণে এত পরিশ্রম সয়না অনেকেরই, তাছাড়া বয়স বেশি হলে আয়ও কমে যায় বলে মহাজন রিকশাও দিতে চায়না। মহাজন জালাল মিয়া সরফুদ্দিনকে সমীহ করে খুব। এজন্যই তার কাছ থেকে কিনে নেবার পরেও গ্যারেজের নাম বদলায়নি জালাল মিয়া। পাঁচ বছর আগে সরফুদ্দিন গ্যারেজ বিক্রি করেছিল ছেলে আজিমকে বিদেশে পাঠানো আর মেয়ে আরিফার বিয়ে দেবার জন্য। জালাল সরফুদ্দিনকে বলে, “পঙ্খিরাজখান আজীবন আপনেরই থাকব চাচামিয়া। পঙ্খিরাজ আপনের হাতে ছাড়া আর কারো হাতে দেখবার মন চায়না, জমা যা দেন তাতেই চলব, পোলা মনে কইরা খালি দোয়া করবেন আমারে।”

রিকশা নিয়ে মোড়ে দাড়াল সরফুদ্দিন। মোটা করে এক লোক এক গাদি গাট্টি বোচকা নিয়ে ডাকল, “এই রিকশা!” সরফুদ্দিনসহ আরো একজন এগিয়ে গেল। লোকটি সরফুদ্দিনের পাশ কাটাতে গিয়ে “তুমি বুড়া মানুষ, পারবানা টানতে” বলে উঠে গেল দূরে থাকা রিকশায়। সরফুদ্দিন বসে থাকল। এক তরুণী বের হয়ে আর কোন রিকশা না দেখে উঠে বসল সরফুদ্দিনের পঙ্খিরাজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। মেয়েটা রিকশায় বসে সরফুদ্দিনকে বলল, “এত বয়সেও রিকশা চালান কেন? আপনার কষ্ট হয়না?”
সরফুদ্দিনঃ “কষ্ট হবে কেন? হাত পা থাকতে বইসা থাকাডাই বেশি কষ্টের।”
তরুণীঃ “আপনার ছেলে-মেয়ে নেই?”
সরফুদ্দিনঃ “না।” বলে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ভাবল, আজিমের এতদিনে নিশ্চয় ছেলে-মেয়ে হয়েছে, কে জানে? পাশের বাড়ির করিম আলীর ছেলে তাজুল বোধহয় জানবে। আজিম আর তাজুল একই সাথে কাজ করে ইতালিতে। করিম আলীকে লেখা তাজুলের চিঠিতেই তিন বছর আগে খবর পেয়েছিল, আজিম বিয়ে করেছে। আরিফা গত বছর মারা গেছে। কি করে তার কাপড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল তা তার শ্বশুর বাড়ির কেউ বলতে পারেনা। বেচারি তো মরে বাঁচল, কিন্তু তার স্বামীর মোটর সাইকেলের আশা অপূর্ণই থেকে গেল।
এই সময় হঠাৎ মেয়েটি দেখতে পেল সরফুদ্দিনের ডান হাতের কব্জিটা নেই। এতক্ষন চাদরে ঢাকা ছিল বলে দেখতে পায়নি।
মেয়েটি কেমন ভীতু গলায় বললঃ “হাত ছাড়া রিকশা চালাতে সমস্যা হয়না? যদি এক্সিডেন্ট করেন?”
সরফুদ্দিনঃ”না, এক হাতেই ত সামলানো যায় রিকশা। আপনি তাকায়া দেখেন অন্য রিকশার দিকে।”
তবুও কেন যেন মেয়েটি নিশ্চিন্ত হতে পারলনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েটিকে নামিয়ে দিয়ে আরেক ছেলেকে চট করে নামিয়ে দিয়ে এল নীলক্ষেত। সেখান থেকে আবার বিশ্ববদ্যালয়ে নিয়ে এল দুইজনকে। এরপর আবার অপেক্ষা।

এক দল ছেলে মেয়ে হৈচৈ করতে করতে এল রিকশাগুলোর কাছে। সরফুদ্দিন “কই যাইবেন” জিজ্ঞেস করতেই এক মেয়ে “নান্নায় চলেন” বলে সরফুদ্দিনের পঙ্খিরাজে উঠতে গেল। তখনই আরেক ছেলে বলল, “ওই নাম! রিকশায় উঠার আগে একটু দেইখ্যা লইবি তো? এই বুড়া মানুষটা টানতে পারব তগো? মাশাল্লাহ যে সাইজ তগো!” একথা শুনে হাসির রোল উঠল দলটার মাঝে।
পাশ থেকে আরেকটা মেয়ে বলল “আহারে লোকটা কত্ত বয়স্ক! তার উপর এক হাত নেই! কেমনে যে মানুষ এদের রিকশায় চড়ে! ইস, কি কষ্টই না হয় উনার রিকশা টানতে! কেন যে উনি রিকশা চালায়?” এরপর চলে গেল দলটা অন্য রিকশাগুলোয় চড়ে।

দুপুর হয়ে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে ভীষণ। কিন্তু সরফুদ্দিন দেখল জালাল মিয়ের জমার টাকাটা শুধু উঠেছে এতক্ষনে। তিনটার আগে রিকশা জমা দিতে হবে তাই গ্যারেজের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল অভুক্ত অবস্থাতেই। গ্যারেজে আসার পর রিকশা রাখতেই জালাল মিয়ে এগোল তার দিকে। “চাচামিয়া তাড়াতাড়ি বাড়িত যান। চাচীর কোমর ভাইঙ্গা গেছে সাহেবের বাড়ির বাথরুমে পইড়া গিয়া।”
তাড়াতাড়ি বাড়ি যেয়ে বুড়ো দেখল ব্যাথায় নীল হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে শীর্ণ আমেনা বিবি। তাড়াতাড়ি গিয়ে তার হাত ধরল সরফুদ্দিন। পাশের বাড়ির আজিজা ও রহিমা বলল তারা পড়া তেল মালিশ করে দিয়েছে আমেনার কোমরে, দু’দিনেই সেরে উঠবে সে।
সরফুদ্দিন আমেনার পাশে বসে কিছুক্ষন মাথায় হাত বুলিয়ে চলল জালাল মিয়াকে আজকের জমা বুঝিয়ে দিতে, কিছু বাড়তি টাকা নিয়ে গেল বাজার করবে বলে। সচরাচর বাজারটা আমেনবা বিবিই করে সকালের কাজটা থেকে ফেরার পথে। ফিরে রান্না করে, সরফুদ্দিন ফেরার পর একসাথে খেয়ে তারপর আবার যায় বিকেলের কাজটায় আর শরফুদ্দিন আবার বেরোয় রিকশা নিয়ে।

জালালকে টাকা দিতে যেতেই সে আহত কন্ঠে বলে “আরে চাচামিয়া, আপনি কি আমারে আপনের পোলা মনে করেননা? চাচীর অসুখে এহন ওষুধ পথ্য কত কিছু লাগব। আপনি লইয়া যান ট্যাকা। আমার মায়ের লাইগা দিলাম এইডা।”
সরফুদ্দিন “তাইলে বাবা তুমি নিজে হাতে তোমার মায়েরে দিও” বলে টাকাটা আলগোছে ধরিয়ে দেয় জালালের হাতে।
দুদিন কেন দু সপ্তাহ হয়ে গেল তবু আমেনার ব্যাথা সারার কোন লক্ষণ নেই। টাকা খরচ হবে বলে আমেনা রাজি না হবার পরও একরকম জোর করেই সরফুদ্দিন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল কোলে করে। ডাক্তার বলল আমেনার কোমর ভেঙ্গে গেছে। সে আর কখনো হয়ত সোজা হয়ে দাড়াতে পারবেনা।

সরফুদ্দিন তাকে কোলে করে টয়লেটে নিয়ে যায়, ঘরের কাজ, রান্না বান্না নিজেই করে। সেদিনের পর থেকে আমেনা কেমন যেন হয়ে গেছে, সারাক্ষন গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকে, সরফুদ্দিন কাজ সেরে ফিরে দেখে সে বিকৃত মুখে উঠে বসার চেষ্টা করছে। রাত জেগে শুধু কাঁদে।
একদিন বাড়ি ফিরে দেখে আমেনা নেই ঘরে। হতভম্ব হয়ে সরফুদ্দিন পাশের বাড়ির রহিমাকে ডাকতেই সে বলে আমেনা গেছে কাসেমদের সাথে। একথা শুনেই সরফুদ্দিন ক্ষোভে ভয়ে বিহবল হয়ে যায়। কাসেমদের দলের কাজ হল, শহরের বিভিন্ন স্থানে তাদের দলের মানুষদের বিশেষ করে শিশু আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভিক্ষা করতে বসানো, বিভিন্ন স্থানে মিথ্যে অসুখের খবর বলে মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। এটাই ওদের ব্যবসা।

আরিফা মারা যাওয়ার পর কাসেম এসেছিল তার কাছে। বলেছিল, “চাচাজান আর কত কষ্ট দিবেন শইলডারে আর চাচীরে? বয়স তো আর কম হইলনা কারোরই। আজিমের কোন খোঁজ নাই আইজ এত বচ্ছর। আমাগো বোইনডাও এমনে শ্যাষ হইয়া গেল পিচাশগো হাতে। তয় আপনের কোন চিন্তা নাই। আমরা তো আছি আপনাগো সন্তান হইয়া। পাশের বাসার আলিম চাচা রিকশা চালানো ছাড়নের পর তারে আর চাচীরে, বাসা বাড়ির কাজ ছাড়ার পর আলেয়া খালারে আমরা দ্যাখতাছিনা? আপনাগো দুই পেডের ভাত কি আমরা জোগাইয়া দিতে পারুমনা? আপনাগো এহন আরাম করনের বয়স। এত পরিশ্রম কি আপনাগো শইল্যে সয়?”
সরফুদ্দিন তাদেরকে ভদ্রভাবে বলল, “হাত পাও থাকতে বইসা খায়া ওগুলানেরে লজ্জা দিবার চাইনা। বাবারা তোমরা এখন যাও।”
বের হয়ে যাবার সময় উত্তর এসেছিল নিচু গলায়, “তাও যদি চাইর হাত পাও থাকত! হাহ লজ্জা! হাত পাওয়ের আবার লজ্জা! এল্লেইগাই মাইনষের ভাল করতে নাই।”

বুড়ো চলল আমেনার খোজে। দেখল মার্কেটের সামনে অধোমুখে বসে আমেনা। সরফুদ্দিনকে দেখেই তার মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। কেঁদে ফেলল আমেনা। মনে হল মানুষটাকে সে আজ যেন হারিয়ে দিয়েছে। সরফুদ্দিন কিছু না বলে আমেনাকে কোলে করে নিয়ে গেল ঘরে।