বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ২৩ ডিসেম্বর তারিখে ২০১০ রয়টার্স এর বরাত দিয়ে খবর ছাপিয়েছে যে, জাকার্তায় বড়দিন উপলক্ষে শপিং মলগুলোতে অতিরিক্ত সাজসজ্জার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ ইসলামিক নেতারা।

তারা বলেছেন, বড়দিন উপলক্ষে অতিরিক্ত সাজসজ্জা অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে।

ইন্দোনেশিয়ার উলেমা কাউন্সিলের মারুফ আমিন ভাষ্য, বড়দিন খ্রিস্টান ধর্মীয় একটি উৎসব। ইন্দোনেশিয়ার খুব কম সংখ্যক মানুষ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও খ্রিস্টানরা বড়দিন নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তবে অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে হিংসা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে।

সাম্প্রদায়িকতার অঙ্গে কতরূপ! একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের ধর্ম সমারোহে উপভোগ করলে তা দেখে অন্য অনুসারীদের মধ্যে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে হিংসা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে!! কী অভিনব অযৌক্তিক যুক্তি আর অমানবিক মানসিকতা।

ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ ইসলামিক নেতারা বাণিজ্য আর ধর্মকে আলাদা রাখতে পারল না। হয়ত ধর্মকে বাণিজ্যে ব্যবহৃত হতে দিতে চায় না। আসলে বাণিজ্য, ধর্ম আর রাজনীতি যে একসূত্রে আবর্তিত, এ সুর বা বয়ান আমাকে নাড়া দিয়েছে। আতংকিত করেছে। দূর্গাপূজা উপলক্ষেও আমাদের দেশে ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ ইসলামিক নেতাদের অনুসরণ করে এমন রিমিকস সুর শুরু হওয়ার আশংকা করছি। কারণ ইন্দোনেশিয়ায় ২৪ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশ মুসলমান। কাজেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের ইসলামিক নেতাদের যদি বাংলাদেশের ওলেমারা অনুসরণ করে ফতোয়া দেয় তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। কিস্তু বিশ্লেষকদের মতে, দিন দিন চরমপন্থিরা সরব হয়ে উৎকন্ঠার পরিবেশ তৈরি করছে এবং অন্যান্য দেশেও যে ক্রমে ক্রমে এভাবেই চরমপন্থিরা নীরব থেকে সরব হচ্ছে এর প্রমাণ তো চারপাশে ছড়িয়েই আছে।
এতদিন জেনেছি, বাংলাদেশে আহমেদিয়াদের নিজ মসজিদে নামাজ পড়া নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির উসকানি চলে। এখন নতুন মাত্রা। সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উৎসবে বেশী আনন্দও নিষিদ্ধ।

সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, জুলুম, সন্ত্রাস,অত্যাচার, অবিচার, চাপ চলছে, চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এ সংখ্যালঘু কোন দেশে মুসলমান, কোন দেশে খ্রীষ্ট্রান, আর কোন দেশে ইহুদি। কোন দেশে হিন্দু। সাম্প্রদায়িক বাতাস এভাবেই ছড়ে ও ছড়ায়। ছড়ায় বাতাসে — ইথারে —–ওয়েবে।
তাহলে ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামিক নেতারা কেন বড়দিনের উৎসবমুখর বেচাকেনা সহ্য করতে পারছেন না?
জাকার্তার দোকানিরা জানিয়েছে, তাদের দোকানে সাজানো বিরাট ক্রিসমাস ট্রি, কাগজের তৈরী রেইন ডিয়ার ও বড়দিনের গানের কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য নেই, শুধু ছুটির এই দিনগুলোতে ক্রেতা আকর্ষণ করাই উদ্দেশ্য।
এ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই জাকার্তার বিপুলসংখ্যক দোকান বড়দিনের বিভিন্ন উপকরণ সান্তাক্লজ, ক্রিসমাস ট্রি, কৃত্রিম তুষার, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছিল। কিন্তু ব্যাখ্যা তো আর সরলভাবে ব্যাখিত হয় না!

কিন্তু মারুফ আমিন দোকানিদের এমন বক্তব্যের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, দোকানিরা ধর্মীয় উপাদান ব্যবহার ছাড়াই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের উৎসবগুলো আরো কম আড়ম্বরের সাথে পালন করা হয়। সেখানে অল্প সংখ্যক ধনী খ্রীস্টানদের ক্ষেত্রে অন্যরকম হবে কেন? এখন প্রশ্ন, অন্য ধর্মাবলম্বীরা ধনী হওয়াও কি ইসলামে নিষেধ?
তাছাড়া, আগামী ঈদোৎসবে দশগুণ সমারোহে দোকান সাজালেই তো হতো।

তবে আমাদের দেশে বিষয়টি কিন্তু এখনও ইতিবাচকভাবেই আমাদের নাড়া দেয়। অন্য ধর্মের অনেক কিছুই আমাদের আনন্দে আপ্লুত করে। ছোটবেলায় মফস্বলে তো হিন্দু মুসলিম ভেদে দল বেঁধে পূজা দেখার চর্চা ছিলই। ঢাকায় প্রতিবারের মত এবারও আমার কিছু মুসলিম বন্ধুরা দূর্গাপূজা দেখেছে। শুধু একজন বলেছে আর উনি আর পূজা দেখতে যাবেন না। কারণ ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা দেখতে গিয়ে দেখেন পূজা মন্ডপে এক মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের রাজনৈতিক বক্তৃতা চলছে। উনার মতে যা পূজার আমেজকেই বদলে দিয়েছিল।
ধর্মীয় কিছু কিছু বিষয় অন্য ধর্মাবলম্বীকে চর্চায়ও উদ্ধ্বুদ্ধ্ব করে। যেমন, ইফতার খাওয়া ও খাওয়ানো। রোজার মাসে চারপাশ ইফতারময়। রাস্তাঘাটে ইফতারীর দোকান। টিভি খুললে ইফতার পার্টির খবর। পত্র-পত্রিকায় বাহারী ও সুস্বাদু ইফতারীর প্রতিবেদন। বন্ধুবান্ধব ইফতারের নিমন্ত্রণ করে। কাজেই এ বলয় থেকে বের হওয়া যায় না এবং হতেও চাই না। এটা ধর্মীয় অনুভূতি থেকে নয়। সামাজিক বেষ্টনীর জন্য। তাছাড়া, এমন ইফতারী থেকে কে বঞ্চিত হতে চায়! নিজে ঘরে বানাই। কিনি। খাই এবং খাওয়াই ও।

এ প্রসঙ্গে গত রোজার অভিজ্ঞতা বলেছিলাম ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে মুক্ত-মনায় স্বাধীন এর ‘এলোমেলো চিন্তাঃ গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আচরণ’ শিরোনামে লেখায় —- যা এখানেও উল্লেখ করছি।
রোজার মাসে একটা প্রশিক্ষণে আমাদের ৫-৬ জন সহকর্মী ময়মনসিংহে ছিলাম প্রায় এক সপ্তাহের জন্য। ওই দলে জন্মসূত্রে আমি হিন্দু এবং একজন খ্রীষ্ট্রান সহকর্মী। একদিন মুসলিম সহকর্মী ইফতারের দাওয়াত দিল যার বাসা ময়মনসিংহ শহরে। আমরা দলে ইফতারসহ রাতের খাবার তার বাসায় খেলাম। পরে একদিন একদিন আমাদের খ্রীষ্ট্রান সহকর্মী ও একজন মুসলিম সহকর্মী ইফতার খাওয়াল আমাদের ময়মনসিংহের অফিসে যেখানে শুধু আমরা ৫-৬-জনই ছিলাম। এরপর দিন আমি ও আমার আরেক মুসলিম সহকর্মী ইফতারের দাওয়াত দিলাম আরও কয়েকজনকে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৮-২০ জন। নামাজ না রোজা না, মুসলিম না অথচ ইফতার ভালই উপভোগ করলাম।

অন্যের আনন্দানুভূতির সাথে আমার একাত্মতা প্রকাশও আমার ধর্ম। আমার কাছে ধর্মানুভূতি মানে অন্য অনেক ব্যাখ্যার সাথে কারও নিষ্কলুষ আনন্দে অংশীদার হওয়া। কাজেই অন্যের অহিংস আনন্দে আনন্দ পাওয়াই তো এক ধরনের ধর্মানুভূতি! এ অনুভূতিও কি দিনে দিনে সহিংস রূপ নিবে?