১৯৮২ সালে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকদল পদার্থবিদ এলেন এসপেক্টের নেতৃত্বে এক পরীক্ষা চালান , যা বিংশ শতাব্দির গুরুত্বপূর্ণ গবেষনাগুলোর একটি বলে ধারনা করা যেতে পারে। বাস্তবে যারা সচরাচর বৈজ্ঞানিক জার্নাল পড়েন না , তাদের এলেন এসপেক্টের নাম জানার কথা নয়। কিছু লোকের ধারনা , এলেন এসপেক্টের আবিস্কার , মহাবিশ্ব সম্পর্কে এপর্যন্ত বিজ্ঞানীদের অর্জিত সকল জ্ঞানকে আমূল পাল্টে দেবে।

এসপেক্ট ও তার দলের আবিস্কারটা হলো – নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে সাব-এটমিক পার্টিকেল , যেমন ইলেক্ট্রন একে অন্যের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ করে/রাখে , তা একে অন্যের থেকে যত দুরে বা নিকটে থাকুক না কেন। দুরত্ব এখানে কোন সমস্যা নয় , তা একে অন্যের থেকে ১০ ফুট দুরেই থাকুক বা ১০ হাজার কোটি মাইল দুরেই থাকুক।

কোন না কোনভাবে প্রতিটি পার্টিকেল বা কণিকা জানে অন্যগুলো কি করছে। একটাই সমস্যা , এসপেক্ট ও তার দলের আবিস্কারটা , কোন যোগাযোগ আলোর গতির বেশি হতে পারেনা , আইনস্টাইনের এই মতবাদ/বিশ্বাস্বের পরিপন্থি। এই সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্য , প্রচলিত ধারনা বহির্ভূত কিছু মৌলিক ব্যাখ্যা এসেছে। এমনি এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ডেভিড বোহম। বোহমের মতে এস্পেক্টের আবিস্কার এটাই ইঙ্গিত করে যে , বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতার (objective reality) কোন অস্তিত্ব নেই। আমাদের এই মহাবিশ্ব এক ছায়া/মায়া মাত্র , এক অতিকায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সাজানো চমৎকার ত্রিমাতৃক (3-D) ছবি বা হলোগ্রাম।

বোহম কি বলতে চাচ্ছেন , তা বুঝতে হলে , আমাদের হলোগ্রাম সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারনা থাকা দরকার। হলোগ্রাম হলো লেজার রশ্মির সাহায্যে তোলা ত্রিমাতৃক ছবি। যে বস্তুর ছবি তোলা হবে , তার উপরে একটি লেজার রশ্মি ফেলে প্রতিফলিত করা হয়। ঐ প্রতিফলিত রশ্মির উপরে দ্বিতীয় একটি লেজার রশ্মি ফেলা হয়। এই দুই রশ্মির মিলিত প্যাটার্নকে (the area where the two laser beams commingle) একটি ফিল্মে ধারন করা হয়। তারপরে ঐ ফিল্মকে ডেভেলপ করা হয়। ডেভেলপ করা ঐ ফিল্মের ভিতর দিয়ে লেজার রশ্মি পাঠালেই কেবল ত্রিমাতৃক ছবি দেখা যায়। ত্রিমাতৃকতাই কেবল হলোগ্রামের বৈশিষ্ঠ নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ঠ হলো , হলোগ্রামের প্রতিটি বিন্দুই সম্পুর্ন বস্তুর ছবি ধারন করে। যদি গোলাপ ফুলের একটি হলোগ্রামকে কেটে দুভাগ করা হয় এবং যে কোন একাংশের ভিতর দিয়ে লেজার রশ্মি পাঠানো হয় , তাহলে অর্ধেক ফুল নয় , পুরো গোলাপ ফুলটার ত্রিমাতৃক ছবি দেখা যাবে , যা আয়তনে অর্ধেক। যত খুশি হলোগ্রামকে কেটে ছোট করুন না কেন , প্রতিটি অংশই আয়তনে ছোট কিন্তু পুরো ফুলটির ছবি দেখাবে।

‘প্রতিটি অংশে সম্পুর্ন’ (“whole in every part) হলোগ্রামের এই প্রকৃতি , আমাদের সামনে চিন্তার এক নুতন দুয়ার খুলে দিয়েছে। পশ্চিমা বিজ্ঞান আমাদের এতদিন এই শিক্ষা দিয়েছে যে , কোন জিনিষকে , তা একটি ব্যাঙ হোক বা অনুই হোক , ভালভাবে জানতে বা বুঝতে হলে , তাকে কেটে ছোট করে প্রতিটি অংশের গুনাবলি বিশ্লেষন করাই সর্বোত্তম পন্থা। হলোগ্রাম আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে , এই মহাবিশ্বে এমন ও কিছু আছে , যাকে কেটে ছোট করে বিশ্লেষন করা সম্ভব নয়। যদি কোনকিছু হলোগ্রামের মতো করে তৈরি হয়ে থাকে , তবে আমরা কখনৈ জানব না এটা কি দিয়ে তৈরি। কারন আমরা একে যতই ভাগ করি না কেন , আমরা পাব আয়তনে ছোট কিন্তু পুরাটাই (smaller wholes)।

হলোগ্রামের এই বৈশিষ্ঠই বোহমকে সাহায্য করেছে এস্পেক্টের আবিস্কারের নুতন ব্যাখ্যা দিতে। বোহমের মতে , সাব-এটমিক কণিকাগুলো একে অন্যের সাথে কোন রহস্যজনক তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখে না , বরং তাদের মধ্যেকার দুরত্বটা এক মায়া। এই
সাব-এটমিক কণিকাগুলোর আলাদা আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই , এরা সকলেই মৌলিক কোন একটি জিনিষের সম্প্রসারন বা সংযোজিত অংশ।

বোহম ঠিক কি বলতে চেয়েছেন , সেটা বোঝানোর জন্য নিম্নের উপমা বর্ননা করেছেন-

একটি মাছ ভর্তি এক্যুয়ারিয়াম কল্পনা করুন , যেটা আপনি সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন না। মাছ ও এক্যুয়ারিয়ামটির ছবি দুটি ভিডিও ক্যামেরা , যার একটি এক্যুয়ারিয়ামের সামনে থেকে ও আরেকটি একপাশ থেকে তুলে টেলিভিশনের পর্দায় পাঠাচ্ছে। আপনি একটি টেলিভিশনের পর্দায় সামনে থেকে তোলা ও আরেকটিতে একপাশ থেকে তোলা ছবি যুগপথ দেখছেন। যেহেতু ভিন্ন কোন(angle) থেকে ছবি তোলা হচ্ছে , সেকারনে আপনার কাছে মনে হবে দুই পর্দায় দেখতে পাওয়া মাছটি একি মাছ নয় , দুটি ভিন্ন মাছ। আপনি যতই মাছ দুটি দেখতে থাকবেন , ততই আপনার কাছে প্রতীয়মান হবে যে মাছ দুটির মাঝে নিশ্চিত একটি সম্পর্ক আছে। কারন যখন একটি মাছ ঘুরবে বা পাশ ফিরবে , তখন অন্যটি ও নিশ্চিতভাবেই কিছুটা ভিন্নভাবে হলেও ঘুরবে বা পাশ ফিরবে। একটিতে যদি মাছটি আপনার দিকে মুখ করে থাকে , অন্যটাতে আপনার দিকে পাশ ফিরে থাকবে। আপনার যদি এই পুরা সেটআপ সম্মন্ধে জানা না থাকে , তাহলে আপনার মনে হবে , মাছ দুটি একে অন্যের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখছে , যা আদৌ সত্য নয়। কারন এখানে দুটি নয় , একটিই মাছ আপনি দেখছেন।

বোহম বলছেন , ঠিক এভাবেই এস্পেক্টের গবেষনায় পাওয়া সাব-এটমিক পার্টিকেলগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে , দুরত্ব যেখানে কোন বাধায় নয়। বোহমের মতে আপাতদৃষ্টে আলোর চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন সাব-এটমিক কণিকাগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ এটাই ইঙ্গিত করে যে , বাস্তবতার আরো গভিরতর লেভেলে অনেক জটিল মাত্রা (dimension) আছে , যা আমাদের পঞ্চেন্দ্রীয় দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন , আমরা সাব-এটমিক কণিকাগুলোকে একে অন্যের থেকে পৃথক ভাবি , কারন আমরা তাদের বাস্তবতার একটি অংশই কেবল দেখতে পাই। চলবে….