সেই মহান নকশা

এই বইয়ে আমরা বলেছি কীভাবে নভোমন্ডলের বস্তুসমূহ, যেমন- চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারাদের, ছন্দবদ্ধ গতি থেকে বোঝা যায় এগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পরিচালিত হচ্ছে, কোনো দেব-দেবী বা অসুরের খেয়াল খুশি মত নয়। এ ধরণের কিছু নিয়মের যে অস্তিত্ব আছে সেটা শুরুতে সামনে আসে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে (আসলে জ্যোতিসশাস্ত্র, কারণ সে যুগে এ দুটোর চর্চা একই ছিলো)। পৃথিবীর বুকে বস্তুসমূহের গতিবিধি এতটাই জটিল, এবং একটা বস্তুর উপর এত বেশি সংখ্যক অন্য বস্তুর প্রভাব কাজ করে যে প্রাচীন সভ্যতাগুলো এদের কোনো নিয়মবিধি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছিলো। ধীরে ধীরে অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও জ্ঞানের অন্যান্য শাখাতে বিভিন্ন সূত্র আবিষ্কার হতে লাগলো, ফলে জন্ম হলো বৈজ্ঞানিক নির্ধারণবাদের। এ মতবাদ অনুযায়ী, এমন এক সেট পূর্ণাঙ্গ নিয়ম থাকবে, যার সাহায্যে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থা পুরোপুরি জানা থাকলে, পরবর্তী যে কোনো সময়ে এটি কিভাবে বিবর্তিত হবে তা নির্ণয় করা সম্ভব হবে। আর এই নিয়মগুলো কাজ করবে সকল স্থানে এবং কালে; অবশ্য না হলে এগুলো তো নিয়মের মর্যাদাই পেত না। ফলে বিশ্ব পরিচালনায় দেবতা বা অসুরদের নাক গলানোর আর কোনো অবকাশ থাকলো না।

প্রথম যখন বৈজ্ঞানিক নির্ধারণবাদ প্রস্তাব করা হয়, তখন আমাদের জানা প্রকৃতির নিয়ম ছিলো শুধুমাত্র নিউটনের মহাকর্ষ ও গতির সূত্রগুলো। আমরা দেখেছি আইনস্টাইন কীভাবে এ সূত্রগুলোকে তার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধ করেছেন, এবং কীভাবে মহাবিশ্বের অন্যান্য ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করার জন্য অন্যান্য সূত্রসমূহও পরে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রকৃতির এ নিয়মগুলো বর্ণনা করে কীভাবে আমাদের মহাবিশ্ব আচরণ করে, কিন্তু এ বইয়ের শুরুতে করা কেন? প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর তারা দেয় না।

কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
কেন আমাদের অস্তিত্ব আছে?
কেন ভৌত সূত্র সমূহের ঠিক এই সেটটাই আমরা দেখছি, অন্যরকম নয় কেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর হিসাবে কেউ কেউ দাবি করবেন যে, নিশ্চই এমন এক ঈশ্বর আছেন যিনি এই মহাবিশ্বকে ঠিক এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। কে বা কী এই মহাবিশ্বকে বানিয়েছে, এ প্রশ্ন উদয় হওয়া যৌক্তিক; কিন্তু তার উত্তর যদি হয় ঈশ্বর, তাহলে প্রশ্নটা স্রেফ একটু সরে গিয়ে দাঁড়ায়- ঈশ্বরকে বানিয়েছে কে? এ প্রসঙ্গে এটা গ্রহণ করে নেওয়া হয় যে, কোনো একটা স্বত্তা থাকবে যার অস্তিত্বের জন্য কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই। এই স্বত্তাকেই বলা হবে ঈশ্বর। এটাকে বলা হয় ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রথম-কারণ-যুক্তি। অবশ্য আমরা দাবি করছি, এসব প্রশ্নের উত্তর, কোনো স্বর্গীয় সত্ত্বার আশ্রয় না নিয়ে, পুরোপুরি বিজ্ঞানের আয়তাধীন থেকেই দেওয়া সম্ভব।

তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণীত রূপায়ণনির্ভর বাস্তবতা অনুযায়ী আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ থেকে পাওয়া প্রেসনার সাপেক্ষেই বহির্জগতের কাঠামো সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। এভাবে আমরা আমাদের বাড়ি, গাছপালা, মানুষজন, বৈদ্যুতিক তারের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ, অণু, পরমাণু এবং অন্যান্য মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানসিক চিত্র গঠন করি। এসব মানসিক ধারণাই আসলে আমাদের জানা একমাত্র বাস্তবতা। বাস্তবতাকে কখনোই রূপায়ন অনির্ভর ভাবে যাচাই করা সম্ভব নয়। তাই দেখা যায়, একটা সুগঠিত রূপায়ণ তার নিজস্ব বাস্তবতা গঠন করতে পারে। বাস্তবতা এবং সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করতে যে উদাহরণ আমাদের সাহায্য করতে পারে তার নাম, গেম অফ লাইফ বা জীবনের খেলা। ১৯৭০ সালে কেম্ব্রিজের তরুণ গণিতবিদ জন কনওয়ে এটি উদ্ভাবন করেন।

গেম অফ লাইফের, “গেম” বা “খেলা” শব্দটা একটু বিভ্রান্তিকর। কারণ এই খেলায় কোনো হার-জিত নেই, এমনকি নেই কোনো খেলোয়াড়ও। এটা বস্তুত কোনো খেলা নয়, বরং কিছু নিয়মের সমষ্টি, যে নিয়মগুলো একটি দ্বিমাত্রিক মহাবিশ্বকে পরিচালিত করে। তাই এটা একটা সুনির্ধারিত মহাবিশ্ব: আপনি যদি শুরুর একটা বিন্যাস বা শুরুর শর্তগুলো সাজিয়ে দেন, এরপর ভবিষ্যতে এখানে কী ঘটবে সেটা শুধুমাত্র কিছু নিয়ম দ্বারাই নির্ধারিত হবে।

কনওয়ে যে জগৎটি কল্পনা করেছিলেন সেটা অনেকটা বর্গাকার দাবার ছক এর মত কিন্তু এ ছকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সব দিকেই অসীম। আর এ জগতের প্রতিটি ঘর বা কোষ দুইটি অবস্থায় থাকতে পারে: জীবিত (সবুজ) বা মৃত (কালো)। প্রতিটি ঘরের প্রতিবেশী ঘর মোট আটটি (উপরে, নিচে, ডানে, বামের চারটি ঘর আর চার কোণার চারটি ঘর)। এই জগতে সময় অবিচ্ছিন্ন নয়। বরং বিচ্ছিন্ন ধাপে ধারাবাহিক ভাবে অতিবাহিত হতে থাকে। শুরুতে মৃত ও জীবিত ঘরের যে কোনো সজ্জা দেওয়া থাকলে, সে সজ্জার প্রতিটি ঘরের প্রতিবেশীদের মধ্যে কতজন জীবিত বা মৃত, সেটাই নির্ধারণ করে পরবর্তি ধাপে ঘরটির অবস্থা কী হবে। পুরো ব্যাপারটি নির্ধারিত হয় নিম্নে বর্ণীত নিময়মগুলো মেনে:

১. কোনো জীবিত ঘরের যদি দুই বা তিনটি জীবিত প্রতিবেশী থাকে তাহলে সেটি টিকে যায়। (জীবিত থাকা)
২. কোনো মৃত ঘরের যদি ঠিক তিনটি জীবিত প্রতিবেশী থাকে তাহলে কোষটি নিজেও বেঁচে ওঠে। (জন্ম)
৩. অন্য সকল ক্ষেত্রেই কোনো কোষ হয় মারা যায় অথবা মৃত অবস্থাতেই থাকে। অর্থাৎ, কোনো জীবিত ঘরের যদি শুধু শূন্য বা একটি মাত্র প্রতিবেশী থাকে তাহলে সেটি মারা যাবে একাকিত্বের কারণে; আর যদি তিনের অধিক প্রতিবেশী থাকে তাহলে মারা যাবে ভীড়ের চাপে।

পুরো ব্যাপারটার কারিগরি এটুকুই। ফলে শুরুর একটা অবস্থা নির্ধারণ করে দেওয়ার পরে এ নিয়মগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবিত কোষ সৃষ্টি বা বিনাশ করতে থাকে। কোনো একটা বিচ্ছিন্ন জীবিত কোষ, বা দুজনের একটা বিচ্ছিন্ন কোষজুটি পরের প্রজন্মেই মারা পড়ে, কারণ তাদের যথেষ্ট প্রতিবেশী নেই। কোনাকুনি বরাবর তিনটি জীবিত কোষ বাঁচে একটু বেশি। কারণ, তখন প্রথম ধাপে দুকোনার দুই কোষ মারা পড়ে, থাকে শুধু মাঝেরটা। এবং পরের ধাপে সেটাও মারা পড়ে। কোষদের এমন যেকোনো কোনাকুনি দাগই এভাবে সময়ের সাথে সাথে “উবে যায়”। আবার এই তিনটি জীবিত কোষকে যদি শুরুতে আনুভুমিক সারি বরাবর পাশাপাশি বসানো হয় তাহলে। প্রথম ধাপে দুপাশের দুটি কোষ মারা যায় ঠিকই, কিন্তু এ ক্ষেত্রে মাঝের কোষের ঠিক উপরের এবং নিচের কোষদুটি বেঁচে ওঠ। তাই আনুভুমিক সারিটি হয়েযায় একটি খাঁড়া স্তম্ভ। এভাবে, পরের প্রজন্মে এই খাঁড়া স্তম্ভ আবার আনুভুমিক সারিতে পরিণত হয়। এবং এভাবেই একটা থেকে আরেকটা বারে বারে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। এ ধরণের পুনরাবৃত্ত সজ্জাকে বলা হয় ব্লিঙ্কার।

যদি তিনটা জীবিত ঘরকে L আকৃতিতে সাজানো হয় তাহলে নতুন একটা ঘটনা ঘটে। পরের প্রজন্মে L দিয়ে ঘেরা কোনার কোষটি বেঁচে ওঠে এবং জীবিত কোষের একটা ২x২ বর্গ সৃষ্টি হয়। এ বর্গটি এক ধরণের কোষ বিন্যাসের সদস্য যাদেরকে বলে “স্থির জীবন”। কারণ এধরণের বিন্যাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে যেতে পারে। বিভিন্ন ধরণের আদি কোষ বিন্যাস আছে যারা শুরুর কিছু প্রজন্মে বিবর্তিত হয় কিন্তু শিঘ্রই হয় স্থির জীবন ধারণ করে অথবা মারা যায়, অনেকে আবার ঘুরে আদি বিন্যাসে ফিরে যায় এবং পুরো চক্রটাকেই ক্রমাগত পুণরাবৃত্তি ঘটাতে থাকে।

এছাড়াও এমন বিন্যাস আছে যাদেরকে বলে গ্লাইডার, বা উড়ুক্কু। এরা বিবর্তিত হয় অন্য আকৃতি ধারণ করে, এবং এভাবে কয়েকক প্রজন্ম পরে আবার ফিরে যায় নিজের আদি আকৃতিতে, কিন্তু ততক্ষণে পুরো আকৃতিটাই সরে গেছে কোনাকুনি এক বর্গ নিচের একটা অবস্থানে। আপনি যদি এদেরকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখতে থাকেন তাহলে মনে হবে এরা ছকের উওর কোনাকুনি হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। এ ধরণের উড়ুক্কুরা যখন একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন তারা সংঘর্ষকালীন কে কী সজ্জায় ছিলো তার উপর নির্ভর করে দারুণ সব ব্যাপার ঘটে।

এই ছকের মহাবিশ্বটা আগ্রোহদ্দীপক এই কারণে যে, যদিও এর মৌলিক ‘পদার্থবিজ্ঞান’ খুবই সরল, কিন্তু এ থেকে জটিল সব ‘রসায়ন’এর উদ্ভব হতে পারে। মানে, বিভিন্ন মাত্রার জটিল বস্তুসমূহ এ জগতে থাকতে পারে। একেবারে ক্ষুদ্রতম স্কেলে এখানকার মৌলিক পদার্থবিদ্যা আমাদের বলছে শুধু দুই রকম কোষ ঘর আছে, জীবিত বা মৃত। কিন্তু আরেকটু বৃহৎ স্কেলে ভাবলে সেখানে, গ্লাইডার, ব্লিঙ্কার, এবং স্থির জীবনের বিন্যাস দেখা যায়। আরো বড়ো স্কেলে, আরো জটিল সব বস্তু থাকতে পারে, যেমন গ্লাইডার বন্দুক: এটা একটা স্থির কোষ সজ্জা, যা নির্দিষ্ট সময় পর পর নতুন নতুন গ্লাইডারের জন্ম দেয় যেগুলো সেই নীড় ছেরে বেরিয়ে পরে বাইরে।

আপনি যদি এই গেম ওফ লাইফ জগৎ এর ঘটনাবলি যে কোনো আকারের স্কেলেই পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে সেই স্কেলের বস্তুসমূহের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সূত্র আপনি নির্ণয় করতে পারবেন। যেমন হয়তো অল্প কয়েক ঘর মিলে তৈরি বস্তুদের জন্য আপনি সূত্র পাবেন “চারকোনা ব্লক কখনো সরে না”, “গ্লাইডাররা কোনাকুনি সরে”। এছাড়াও দুইটি বস্তুর সংঘর্ষের ফলে কী ঘটতে পারে সেগুলোর বিবিধ সূত্র আপনি পাবেন। অর্থাৎ, আপনি যেকোনো পর্যায়ের মিশ্রবস্তুর জন্যই পূর্ণাঙ্গ একটা পদার্থবিজ্ঞান গঠন করতে পারবেন। এ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলোর মধ্যে এমন সব ধারণা এবং অনুসঙ্গ থাকবে একদম মূলসূত্রের মধ্যে যাদের কোনো স্থান নেই। যেমন, মূল সূত্রে, “সংঘর্ষ”, বা “সরণ” এর কোনো ব্যাপার নেই। তারা শুধুমাত্র স্থির একটা ঘর জীবিত নাকি মৃত থাকবে সেটা বর্ণনা করে। আমাদের এই মহাবিশ্বের মত এই গেম অফ লাইফেও আপনার বাস্তবতা নির্ভর করবে কী ধরনের রূপায়ণ আপনি ব্যবহার করছেন তার উপর।

কনওয়ে এবং তার ছাত্ররা এই জগৎ তৈরি করেছিলেন কারণ তারা জানতে চাচ্ছিলেন- কোনো মহাবিশ্বে, যেখানে মৌলিক নিয়মগুলো এই গেম অফ লাইফের নিয়মের মত এতটাই সরল, সেখানেও কি জটিল কোনো বস্তুর উদ্ভব হতে পারে, যা বংশবিস্তার করতে সক্ষম? এই জগৎএ কি এমন কোনো মিশ্র বস্তু থাকতে পারে যেটা, কয়েক প্রজন্ম ধরে এ জগৎ এর নিয়মগুলো মেনে চলার পরে অন্য ধরণের বস্তুর জন্ম দিতে পারে? কনওয়ে এবং তার ছাত্ররা শুধু এমন কিছু বস্তু খুঁজে পেতেই সক্ষম হননি, তারা আরো দেখিয়েছেন যে এ ধরণের বস্তু চাই কি ‘বুদ্ধিমান’ ও হতে পারে! প্রশ্ন আসে, এখানে বুদ্ধিমান বলতে তারা কী বোঝাচ্ছেন? তারা আসলে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, যে এসব কোষের বিশাল একটা সমাবেশ, যেটা বংশ বিস্তার করতে সক্ষম, আসলে একটা “সার্বিক টুরিং মেশিন”। এর মানে হচ্ছে, আমরা আমাদের কম্পিউটার দিয়ে যে সব হিসাব করতে পারি, সেগুলোকে এই গেম অফ লাইফের জগৎ এর এসব কোষ সমাবেশও উপযুক্ত পরিবেশ পেলে করে ফেলতে পারে। অর্থাৎ কয়েক প্রজন্ম পরে এরা এমন একটা অবস্থায় যেতে পারে যেখান থেকে আমাদের কম্পিউটার হিসাব করে যে ফলাফল পেত, সে হিসাবগুলোই পাওয়া যাবে।

পুরো ব্যাপারটার একটা স্বাদ পেতে, চলুন দেখি কী ঘটবে যখন ২x২ মাপের একটা জীবিত বর্গের দিকে একটা গ্লাইডার ছুড়ে দেওয়া হয়। সংঘর্ষের সময় গ্লাইডারটা কী অবস্থায় স্থির বর্গটার কাছে পৌছাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে বর্গটা গ্লাইডারের উৎসের দিকে বা উৎস থেকে দূরে একঘর সরে যাবে। এভাবে এই স্থির বর্গ একটি কম্পিউটারের স্মৃতিকোষের মত আচরণ করতে পারে। আসলে, আধুনিক কম্পিউটারের সকল মৌলিক উপাদান যেমন AND ও OR-গেট এই গ্লাইডারের সাহায্যে তৈরি করা সম্ভব। ফলে কম্পিউটার যন্ত্রে ঠিক যেভাবে তড়িৎ সিগন্যাল পাঠিয়ে তথ্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় তেমনি একসারি গ্লাইডার ব্যবহার করেও তথ্য প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব।

এই গেম অফ লাইফের জগতে সৃষ্ট বংশবিস্তারকারী বস্তুগুলোর বিন্যাস ও ঘঠন আমাদের জগৎ এর বস্তুগুলোর মতই অনেক জটিল। জন ভন নিউম্যানের কিছু প্রাথমিক হিসাব মতে অনুমান করা হয়, গেম অফ লাইফের জগৎএ বংশ বিস্তার সক্ষম ক্ষুদ্রতম বিন্যাসে ঘরের সংখ্যা হবে প্রায় দশ ট্রিলিয়ন- প্রায় একটি মানবকোষের মোট অণু সংখ্যার সমান।

আমরা জীবন্ত সত্ত্বা বলতে বুঝি, নির্দিষ্ট আকারের এমন কোনো জটিল ব্যবস্থা যারা স্থিতিশীল এবং বংশবিস্তার করতে পারে। একটু আগে যে জটিল বস্তুটার কথা বলা হলো, সেটা উপরের এই বংশবিস্তারের শর্ত পূরণ করে ঠিকই কিন্তু সম্ভবত সেটা স্থিতিশীল নয়। অর্থাৎ বাইরে থেকে প্রযুক্ত মৃদু আলোড়নই এর সূক্ষ্ম কারুকাজকে নষ্ট করে দিতে পারে। অবশ্য প্রাথমিক নিয়মগুলো আরেকটু জটিল হলে সেটা এমন সব জটিল ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে পারবে যাদের জীবনের সকল গুণাবলীই আছে। এমন একটা সত্ত্বার কথা কল্পনা করুন, যেটা কনোওয়ের জগতের মত কোনো জগতের একটা বস্তু। এ ধরণের একটা বস্তু যদি পরিবেশগত প্রেসনার সাপেক্ষে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে, তখন দেখে মনে হবে এটা বুঝি সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এধরণের একটা জীবন কি নিজের ব্যাপারে সচেতন হবে? অর্থাৎ, এটাকে কি আত্মসচেতন বলা যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে প্রসংগে তীব্র মতবিভেদ দেখা যায়। কেউ কেউ দাবি করেন আত্মসচেতনতা মানুষের একটি অনন্য গুণ। এই আত্মসচেতনতাই হচ্ছে মুক্ত ইচ্ছার উৎস, যেটা তাদেরকে দিয়েছে বিভিন্ন কার্যপ্রবাহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।

একটা সত্ত্বার মুক্ত ইচ্ছা আছে কি না সেটা কীভাবে বলা সম্ভব? কেউ যদি একটা ভিনগ্রহবাসীর সম্মুখীন হয়, তাহলে কীভাবে নিশ্চিত হবে, যে এটা একটি রোবট নাকি, নিজস্ব মন ধারী সত্ত্বা? একটা রোবটের আচরণ থাকবে পুরোপুরী পূর্বনির্ধারিত, যেখানে একটা মননশীল সত্ত্বার মুক্ত ইচ্ছার ক্ষমতা থাকার কথা। ফলে কেউ হয়তো একটা রোবটকে চিহ্নিত করতে পারে এভাবে যে, এর সকল আচরণ পূর্বানুমান করা সম্ভব। যেমনটা আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছি, এ কাজটা অসম্ভবরকমের কঠিন হয়ে যেতে পারে, যদি সত্ত্বাটি বৃহৎ এবং জটিল হয়। আমরা তো এমনকি তিন বা তার অধিক কণিকার পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়াই পুরোপুরি গণনা করতে পারি না। সেখানে একটি মানবাকৃতির ভিনগ্রহবাসির গঠনকারী কণিকা হবে হাজার ট্রিলিয় ট্রিলিয়ন। তাই এটা যদি একটা রোবটও হয় তাহলেও সমীকরণ সমাধান করে এর আচরণ অনুমান করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে আমরা বলতে বাধ্য হবো, যে কোনো জটিল সত্ত্বাই মুক্ত ইচ্ছার অধিকারী। মুক্ত ইচ্ছা এসব সত্ত্বার একেবারে মৌলিক গুণ না হলেও, এদের আচরণ হিসাব করতে ব্যর্থতা আমাদেরকে মুক্ত ইচ্ছার অনুকল্পটিকে এদের আচরণের একটা কার্যকর তত্ত্ব হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য করছে।

কনওয়ের জীবনের খেলা থেকে দেখা যাচ্ছে যে একেবারে সরলতম এক সেট নিয়মও জটিল সব বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটাতে পারে, যেটা বুদ্ধিমান জীবনের সমতুল্য। নিশ্চই এ ধরণের বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ এমন অনেক সেট নিয়ম সম্ভব। প্রশ্ন আসে, আমাদের মহাবিশ্বকে চালনাকারী মৌলিক নিয়ম সমূহ (প্রকাশ্য নিয়ম সমূহ নয়) কীভাবে নির্ধারিত হলো? কনওয়ের মহাবিশ্বের মত আমাদের মহাবিশ্বের বিবর্তনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থা থেকে এসব নিয়ম মেনেই ঘটে। কনওয়ের জগৎএ আমরা হচ্ছি সৃষ্টিকর্তা, যারা ঐ মহাবিশ্বের আদি অবস্থায় বস্তু সমূহের অবস্থান ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিচ্ছি।

গেম অফ লাইফে যেটা গ্লাইডার, ভৌত মহাবিশ্বে তার তুল্য হতে পারে ছুটে চলা বস্তুকণা। আমাদের জগতের মত অবিচ্ছিন্ন একটা জগৎকে বর্ণনাকারী কোনো নিয়মের সেটে অবশই সংরক্ষণশীল শক্তির ধারণা থাকবে। অর্থাৎ সময়ের সাথে ব্যবস্থাটির মোট শক্তির মান পরিবর্তিত হবে না। শূন্যস্থানে এই শক্তির মান স্থান এবং কাল নিরপেক্ষভাবে ধ্রূব থাকবে। স্থানের নির্দিষ্ট কোনো আয়তনে ধারণকৃত মোট শক্তি থেকে, সমআয়তনের শূন্যস্থানের মোট শক্তি বিয়োগ করে কেউ যে কোনো হিসাব থেকে এই শূন্য স্থানের শক্তিকে বাদ দিতে পারে। তাই আমরা চাইলে শূন্যস্থানের বা ফাঁকাস্থানের শক্তির মান শূন্য ধরে নিতে পারি। প্রকৃতির যেকোনো নিয়মকে অবশ্যই যে শর্তটা পূরণ করতে হয় সেটা হলো শূন্যস্থান দিয়ে ঘেরা কোনো বিচ্ছিন্ন বস্তুর মোট শক্তি অবশ্যই ধনাত্বক হতে হবে। যার অর্থ ঐ স্থানে বস্তুটিকে গঠন করতে শুরুতে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। বিচ্ছিন্ন বস্তুর শক্তি ঋণাত্বক হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এটা ঋণাত্বক হলে সেই বস্তুটিকে এমন একটা গতিশীল অবস্থায় তৈরি করা সম্ভব হতো, যেন বস্তুটির গতিশক্তি তার নিজস্ব ঋণাত্বক শক্তিকে কাটাকাটি করে ফেলে। এই ঘটনা সম্ভব হলে যে কোনো জায়গায় হুঠ করে কোনো বস্তুর আবির্ভাব না হওয়ার কোনো কারণ থাকতো না। ফলে শূন্যস্থান তখন অস্থিতিশীল হয়ে পড়তো। কিন্তু বিচ্ছিন্ন বস্তু সৃষ্টি করতে যদি ধনাত্বক শক্তি আবশ্যক হয় তাহলে আর এ ধরণের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে না, কারণ আমরা জানি মহাবিশ্বের মোট শক্তি ধ্রুব। কোনো মহাবিশ্বে স্থানিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এ শর্ত আবশ্যক, না হলে শুন্য থেকে এখানে-ওখানে বিভিন্ন বস্তুর আবির্ভাব ঘটতো।

যদি একটা মহাবিশ্বের মোট শক্তির মান সবসময়ই শূন্য হতে হয়, এবং যদি বস্তুসমূহ সৃষ্টি করতে ধনাত্বক শক্তির প্রয়োজন হয়, তাহলে শূন্য থেকে আস্ত একটা মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হলো? এ ব্যাপারটা থেকেই মহাকর্ষের মত নিয়মের প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু মহাকর্ষীয় বল আকর্ষী, তাই মহাকর্ষীয় শক্তি ঋণাত্বক। আর তাই মহাকর্ষীয়ভাবে আবদ্ধ দুটি বস্তুকে, যেমন পৃথিবী ও চন্দ্র, পৃথক করতে বাইরে থেকে কাজ করতে হয়। এই ঋণাত্বক শক্তির সাথে বস্তু তৈরিতে প্রয়োজনীয় ধনাত্বক শক্তির ভারসাম্য হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা অতটা সরল নয়। পৃথিবীর মোট ঋণাত্বক মহাকর্ষীয় শক্তি, পৃথিবীকে গঠনকারী কণিকাসমূহের ধনাত্বক শক্তির বিলিয়ন ভাগের এক ভাগেরও কম। এদিকে, একটা নক্ষত্রের মত বৃহৎ বস্তুর ঋনাত্বক মহাকর্ষীয় বল অনেক বেশি হবে, আবার নক্ষত্রটি যত ছোটো হতে থাকবে (অর্থাৎ এর গঠনকারী কণিকাসমূহের পারস্পরিক দূরত্ব যত কম হবে) এই ঋণাত্বক মহাকর্ষীয় বলও তত বাড়বে। কিন্তু এভাবে ঋণাত্বক শক্তি বাড়তে বাড়তে নক্ষত্রটির ধনাত্বক শক্তির সমান হওয়ার অনেক আগেই এটি একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। আর আমরা জানি কৃষ্ণগহ্বরের শক্তি ধনাত্বক। এসব কারণেই শূন্যস্থান স্থিতিশীল, ফলে নক্ষত্র বা কৃষ্ণগহ্বরের মত বস্তু হঠাৎ করে উদয় হতে পারে না। কিন্তু একটা আস্ত মহাবিশ্ব ঠিকই পারে।

যেহেতু মহাকর্ষই স্থান ও কালকে আকৃতি দানকারী করে, সেহেতু এটা স্থান-কালকে স্থানিক স্থিতি দিলেও একটা সামগ্রিক অস্থিতি দান করে। ফলে পুরো মহাবিশ্বের স্কেলে, বস্তুসমূহের ধনাত্বক শক্তি মহাকর্ষীয় ঋণাত্বক শক্তি দ্বারা ভারসাম্য লাভ করতে পারে। তাই শূন্য থেকে পুরো একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ায় কোনো বাধা থাকে না। যেহেতু মহাকর্ষের মত একটা নিয়ম আছে, সেহেতু একেবারে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব শুরু হতে পারে এবং হয়। যে প্রক্রিয়া আমরা ষষ্ট অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এই স্বতস্ফুর্ত সৃষ্টিই হচ্ছে কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু থাকার কারণ।এ কারণেই অস্তিত্ব আছে আমাদের। আর তাই মহাবিশ্বকে শুরু করার সলতেয় আগুন দিতে কোনো ঈশ্বররের প্রয়োজন নেই।

এখনো প্রশ্ন থাকে, মৌলিক নিয়মসমূহ আমরা যেমন বললাম তেমন কেন? আমরা জানি, একটা পরম তত্ত্বকে অবশ্যই হতে হবে সুসংহত এবং পরিমাপযোগ্য চলকসমূহের সসীম মান অনুমান করতে সক্ষম। ফলে, অবশ্যই মহাকর্ষের মত একটা নিয়ম থাকতে হবে। আর পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা এও দেখেছি যে মহাকর্ষের মত একটা তত্ত্বকে সসীম মান অনুমান করতে হলে, এ তত্ত্বে অবশ্যই প্রকৃতির বলসমূহ এবং সেই বল যেসব পদার্থের উপর কাজ করে, তাদের মধ্যে এক ধরনের মহাপ্রতিসাম্য থাকতে হবে। এম-তত্ত্ব হচ্ছে মহাকর্ষের সবচেয়ে সাধারণীকৃত মহাপ্রতিসম তত্ত্ব। এসব কারণে এম-তত্বই হচ্ছে মহাবিশ্বের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বের একমাত্র প্রার্থী। এটা যদি সসীম হয় – এই সসীমতা এখনো প্রমাণ করা বাকি- তাহলে এটা হবে মহাবিশ্বের এমন একটা রূপায়ণ, যে মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করে। আর আমরা বাধ্য হয়েই এই মহাবিশ্বের অংশ কারণ এ ছাড়া আর কোনো সুসংহত রূপায়ণ নেই।

এম-তত্ত্ব হচ্ছে সেই সার্বিক তত্ত্ব যেটার খোঁজ আইনস্টাইন করেছেন। আমরা মানুষরা -যারা নিজেরাই প্রকৃতির মৌলিক কণিকাসমূহের একটি সন্নিবেশ ছাড়া কিছুই না- তারা যে আমাদের চালনাকারী নিয়মসমূহকে বুঝে ফেলার এত কাছে চলে এসেছি, সেটা নিশ্চয়ই একটা বড় বিজয়। কিন্তু হয়তো সত্যিকার অলৌকিক ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তির একটা বিমূর্ত রূপায়ণ থেকে এমন একটা অনন্য তত্ত্বে পৌছাতে পারা, যেটা বৈচিত্রময় জিনিসে পূর্ণ যে সুবিশাল মহাবিশ্বকে আমরা দেখি, সেটাকে বর্ণনা ও অনুমান করতে পারে। এই তত্ত্বকে পর্যবেক্ষণ দ্বারা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, এটাই হবে আমাদের প্রায় ৩০০০ বছরব্যাপি অনুসন্ধানের একটা সফল পরিসমাপ্তি। আর এভাবেই আমরা খোঁজ পেয়ে যাবো সেই মহান নকশার।

‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ < পর্ব ৭ । পর্ব ৮(শেষ)। পর্ব ১>

[অনুবাদকের নোট]
নভোমন্ডলের বস্তুসমূহ – Astronomical Bodies
দেব-দেবী এবং অসুর – gods and demons
জ্যোতিসশাস্ত্র – Astrology
জ্যোতির্বিজ্ঞান – Astronomy
বৈজ্ঞানিক নির্ধারণবাদ – Scientific Determinism
প্রবৃদ্ধ – Extend
প্রথম-কারণ যুক্তি – First-Cause Argument
সুনির্ধারিত- Deterministic
টিকে যাওয়া – Survival
উবে যায় – Evaporates
স্থির জীবন – Still Life
সার্বিক টুরিং মেশিন – Universal Turing Machine

কৃতজ্ঞতা: এ পর্বের বেশকিছু বানান প্রমাদ সংশোধন করে দিয়েছেন সেজবা

কিছু কথা:
TED এ একটা লেকচার আছে স্টিভেন হকিং এর। লেকচার শেষে উপস্থাপক তাকে একটা প্রশ্ন করেন। তিনি তার চোখের নিচের মাসলটা নেড়ে নেড়ে সেই প্রশ্নটার উত্তর তৈরি করতে সময় নেন প্রায় ৭ মিনিট। দেখে মনটা কেমন যে দুঃখে ভরে গেছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। একই সঙ্গে ভালোও লেগেছিলো। জীবনকে জিতে যেতে দেখে। এই শারীরিক ভাবে অসহায় মানুষটা, কী অপার বিশ্বয় আর কী অসীম ভালোবাসা বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন! আমরা সুস্থ সবলরাই কী তার খোঁজ জানি? এই হার না মানা মানুষটার লেখা অসাধারণ বইগুলোর কথা ভাবি আর শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে। তার জীবনীশক্তির কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর এই বইয়ে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে দিনের পর দিন চিন্তা করে, এবং এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অসীম ধৈর্য্য আর যত্নের সাথে বইটি লিখে তিনি শুধু আমাদের বৈজ্ঞানিকভাবেই আলোকিত করেন নি। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এক মহিমানিত্ব জীবন দর্শনের।

তার সহলেখক লিওনার্দ ম্লদিনাওকেও এ সুযোগে কৃতজ্ঞতা জানাই।

শেষের কথা:
যাক, অবশেষে এটা শেষ করতে পারলাম। মূল লেখকদ্বয়ের ‘কৃতজ্ঞতা’ এবং টীকা সেকশনটা এখানে আর পোস্ট করছি না। ই-বুক আকারে সঙ্কলিত হলে সেখানে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
মুক্তমনার সদস্য এবং পাঠকদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা আমার। সামগ্রিক ভাবে মুক্তমনার কাছেই কৃতজ্ঞ। এমন একাগ্র পাঠক অন্য কোথাও পেতাম না বলেই মনে হয়। পরিভাষা, বানান, বাক্য এসব ব্যাপারে পাঠকরা প্রচুর সাহায্য করেছেন। তাদের চিন্তাশীল মন্তব্য আমাকে অনুবাদের অনেক অংশ নিয়েই নতুন করে ভাবিয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা আমার অনুবাদ প্রচেষ্টাকে মানসিক সমর্থন দিয়ে যাওয়ায়।

আমি খুব দ্রুতই কোনো কিছু থেকে আটেনশন হারাই। যথারীতি মাঝপথে এটা করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলাম। সে সময় অভিজিৎ দা, রায়হান আবীর, সোহাগ, নীল রোদ্দুর, নিপুন, স্বাধীন ভাই, স্বাক্ষর শতাব্দ, এবং ধ্রুব(রূপম) ভাই এঁরা ক্রমাগত আমাকে প্রেরণা, তাগাদা এবং ঝাড়ির একটা মিশ্রন জুগিয়েছেন কাজটা শেষ করার জন্য। ভবিষ্যতেও এঁদের সাথে পাবো বলেই আমার বিশ্বাস। নিয়মিত এবং মনোযোগী পাঠক হিসাবে রৌরব, রনবীর সরকার, আকাশ মালিক, সংশপ্তক, সেজবা, অপার্থিব, ফরিদ আহমেদ এঁদেরকে পেয়ে আমি ভাগ্যবান। আর সেজবা, আকাশমালিক এবং তৃষিয়া নাশতারান অনেকগুলো পর্বের প্রুফ রিডিং করে দিয়েছেন যত্ন করে। এছাড়াও মন্তব্যে, ফেসবুকে এবং মেইলে আরো অনেকেই ক্রমাগত পরামর্শ ও উৎসাহ যুগিয়েছেন। আপনাদের সবাইকে সঙ্গে না পেলে এটা শেষ করা সম্ভব হতো না হয়তো।

বড় আকারে কিছু একটা লিখতে কেমন লাগবে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে গিয়েই এই অনুবাদ প্রকল্পের শুরু। স্পেশালি বই লিখতে কেমন লাগে সেটা দেখার শখ হয়েছিলো। শুরু করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে। মানে বই ধরে দেখে দেখে টাইপ করে বোঝার চেষ্টা করা। কম্পিউটারে কতটুকু লিখলে বইএর কতটুকু হয়। পরে সুনীলের প্রথম আলোরও কয়েক পৃষ্টা টাইপ করে দেখলাম। ব্লগে আমার নিজের কোনো লেখা আগে কখনো পাঁচ পৃষ্ঠা ক্রস করে নি। সে হিসাবে এই অনুবাদ ছিলো রীতিমত ম্যারাথন দৌড়। দৌড় শেষ করে ভালো লাগছে। দমও বেড়েছে আশা করি। দেখা যাক ফলাফল কী দাঁড়ায়। সবশেষে, সবার জন্য সবার জন্য রইলো প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

আমাদের সবার জীবন দীপান্বিত হোক।