ডারউইনের অভিযান

প্রতি বিকেল বেলায় গল্পের আসর জমে আমবাগানে। উৎসব, নওরিন, উর্মী, সোহান, রৌরব, স্বাধীন আরো অনেকেই এসেছে। বড় বড় দুটো শীতল পাটি পেড়ে বসেছে গাছের তলায়। আজ তাদের নানা অন্য ধরনের গল্প বলবেন, অবশ্য সেটা তিনি আগেই জানিয়েছিলেন। নানা এত মজার করে গল্প বলেন যে কেবল শুনতেই ইচ্ছে করে। নানার আসা দেখে নওরিন বলে উঠল- এই তো নানা এসে গেছেন।

নানা আরাম করে পাটিতে বসতে বসতে বললেন- আজ কিন্তু বানানো কোনো ভুত-প্রেত কিম্বা রাজা-রাণীর গল্প শুনাবো না। সিন্দাবাদ কিম্বা ঠাকুমার ঝুলি থেকেও বলবো না। নবীদের কাহিনীও বলবো না। বলবো একদম পিওর সত্য ঘটনা। বলেই তিনি তার ঝুলা থেকে একটা বই বের করে সবাইকে দেখিয়ে বললেন- বলতো এই বইটার নাম কি? সকলেই বইটার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো- “আবিষ্কারের নেশায়”। নানা আবার শুধালেন- বইটার লেখক কে বলতো? জবাব দিল- আব্দুল্লাহ আল-মুতী।

নানা গল্প বলার ভঙ্গীতে শুরু করলেন- লেখক এই বইটাতে মজার মজার অনেক কাহিনী বলেছেন খুবই সহজ ও সরল ভাষায়। সবগুলোই সত্যি। বইটির সুচিপত্রে রয়েছে মোট ১৬ টা বিষয়। সবগুলোই বিজ্ঞান বিষয়ক। গ্যালিলিউ, আর্কিমিডিস, লেভনহুক, ডারউইন, লুই পাস্তুর, আইনস্টাইসহ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের বিষয়ে বলা হয়েছে। আজ তোমাদের এদের মধ্য থেকে একজনের বিষয়ে পড়ে শোনাব। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে, কোনো প্রকার হট্টগোল করবে না। সকলেই মাথা কাত করে বলল- ঠিক আছে।

নানা ‘আবিষ্কারের নেশায়’ বইটির পাতা উল্টে ৪১ পৃষ্ঠা বের করে যেভাবে গল্প বলেন ঠিক সেইভাবে গলার স্বর উচু-নিচু করে উচ্চারণ করলেন: — [[ডারউইনের অভিযান]]*

[[যে-ছেলের বাপ আর দাদা দু’জনেই নামজাদা ডাক্তার তার যে ডাক্তারির দিকে টান হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ডারউইনের বেলায়ও সবাই সেটাই ভেবেছিল। কিন্তু আদতে সবার এ-অনুমান ফলল না। ডারউইন ডাক্তার হলে হয়তো তাঁর আব্বার মতো টাকা করতেন অনেক। কিন্তু সারা দুনিয়ার মানুষের মনে তাঁর নাম যেমন চিরদিনের মতো খোদাই হয়ে গিয়েছে, ডাক্তারী পড়লে এমনটি হত কিনা সন্দেহ।

১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইংল্যাণ্ডের শ্রুসবেরি বলে একটা জায়গায় চার্লস ডারউইনের জন্ম হয়। ঠিক এই একই দিনে আমেরিকায় আর একজন বিখ্যাত লোক জন্মেছিলেন- তাঁর নাম আব্রাহাম লিংকন।

বারো বছরের ছেলে ডারউইন। তার কেবলই ইচ্ছে করতো বাইরে বাইরে ঘুরে প্রকৃতির সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার। হরেক রকম গাছগাছড়ার নমুনা যোগাড় করার। নানান ধরনের পোকামাকড়, জীবজন্তুর চালচলন লক্ষ্য করার। এমন কৌতুলী মন যার তার কি বোর্ডিং-স্কুলের বদ্ধ খাঁচায় ভাল লাগবে?

সেকালে এমনকি বিলেতের স্কুলগুলোতেও বিজ্ঞান শেখাবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে শেখানো হত শুকনো ব্যাকরণ, কাব্যতত্ত্ব- এমনি নানারকম কেতাবি বিষয়। এসব একটুও ভাল লাগত না ডারউইনের- তার মন পড়ে থাকত বাইরে। তাই পরীক্ষার ফল হত খারাপ।

এসব কথা ডারউইনের আব্বার কানে পৌঁছত। একদিন তিনি রেগেমেগে ছেলেকে চিঠিতে লিখলেন: শিকার করা, কুকুর পোষা আর ইঁদুর ধরা- এ ছাড়া কোনদিকেই তোমার মন নেই। তুমি তোমার নিজের আর পরিবারের সবার মুখে কালি দেবে, আমি তা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।

আব্বা ঠিক করেছিলেন ডারউইনকে তাঁর নিজের মতোই ডাক্তার বানাতে হবে। তাই তাঁকে ষোলো বছর বয়সে একটা ডাক্তারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দেখা গেল ডাক্তারি পড়ায় তাঁর মোটেই উৎসাহ নেই। তার চেয়ে বরং তাঁর ঝোঁক ছিল প্রায়ই ছেলেদের সাথে সমুদ্রে নেমে পড়ায়। সেখান থেকে নানারকম সামুদ্রিক জীব সংগ্রহ করে তাদের তিনি পরীক্ষা করে দেখতেন। তাছাড়া কেমব্রিজে ছাত্র-অধ্যাপক মিলে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের এক সমিতি ছিল। তার বৈঠকে তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে নিয়মিত যোগ দিতেন।

বছর দু তিন দেখার পর একেবারে নিরুপায় হয়েই তাঁর আব্বা তাঁকে ভর্তি করে দিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার আর ডাক্তার নয়- পাদরি বানানোর জন্যে। ডারউইন যে কী করে এতে রাজি হলেন সেটা বোঝা শক্ত। হয়তো ভেবেছিলেন, কী আর এসে যায়? যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্ন। তবে তাঁর ঝোঁক থাকলো আগের মতোই। শিকার করা, বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে বই পড়া, বৈজ্ঞানিক সভায় যোগ দেওয়া, বনজঙ্গলে পোকামাকড় সংগ্রহ করে বেড়ানো- এইসব নিয়েই মেতে থাকলেন তিনি।

তা বলে পাদরি হবার জন্য ধর্মতত্ত্বের ক্লাসে কি তিনি যেতেন না? হ্যাঁ, তাও যেতেন বইকী! পরীক্ষা পাশও করলেন। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে মস্ত বড় একটা কাজের সুযোগও জুটে গেল। পাদরি হবার? না, তা নয়। বীগল নামে একটা জাহাজ সে-সময় পৃথিবীর নানা সমুদ্রে সফরে বেরুচ্ছিল। উদ্দেশ্য হল ইংরেজ সওদাগরদের জন্যে নানা দেশে যাবার রাস্তা বের করা আর বাণিজ্যের সুবিধে করে দেওয়া।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হেনসলো ডারউইনের অদ্ভূত খেয়ালের কথা ভালো করে জানতেন, আর তাঁকে ভালও বাসতেন খুব। তিনি ডারউইনকে লিখলেন: বীগল জাহাজে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী চায়। কোনো মাইনে-টাইনে নেই, তবে কাপ্তান তাঁর কামরায় খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেবেন। এতে গেলে নানান দেশবিদেশ থেকে তোমার অনেক কিছু দেখার জানার সুবিধে হবে।– ডারউইন অমনি রাজি হয়ে গেলেন।

কিন্তু শুধু ডারউইন রাজি হলেই তো হবে না। তাঁর আব্বা একবার বেঁকে বসলেন: এরকম বেয়াড়া রকম খামখেয়ালিতে জীবনটা নষ্ট করে দেবার কি কোনো অর্থ হয়? শেষমেষ তাঁর চাচা আব্বাকে অনেক বুঝয়ে কোনোমতে রাজি করালেন। কিন্তু তবুও ডারউইনের এই চাকরিটা একটুর জন্যে হারাবার মতো অবস্থা হয়েছিল। বীগল জাহাজের কাপ্তান তো ডারউইনের চেহারা দেখেই বেঁকে বসলেন। তার ধারণা ছিল লোকের নাক দেখেই তার চরিত্র বোঝা যায়। ডারউইনের নাকটা ছিল আবার একটু বোঁচা। কাপ্তান বললেন: উহুঁ, এরকম কাজের জন্যে যে-পরিমাণ উদ্যম আর সংকল্প থাকা দরকার তা এর থাকতে পারে না। একে দিয়ে কোনো কাজ হবে না।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ডারউইনের যাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক হলো। পরে অবশ্য জাহাজের কাপ্তান স্বীকার করেছেন নাকের ব্যাপারে তার গোঁড়ামিটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল।

বীগল জাহাজ ইংরেজ সওদাগরদের কতখানি কাজ দিয়েছিল, এই সফরে বাণিজ্যের কতখানি উপকার হয়েছিল তা আজ আর কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু এই জাহাজে পাঁচ বছরের সফরে ডারউইন যে-জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলেন তা মানুষের চিন্তার মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই জাহাজের অভিযানেই ডারউইন তাঁর যুগান্তকারী ক্রমবিকাশ-তত্ত্বের মালমসলা আর সূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন।

১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে বিলেতের প্রিমাউথ বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ল। ডারউইনের বয়স তখন মাত্র বাইশ বছর। ডারউইনকে এই জাহাজে লম্বা পাঁচটা বছর কাটাতে হয়েছিল। এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে জাহাজ যায়। আর যেখানেই যান সেখানেই ডারউইন সংগ্রহ করেন নানারকম গাছপালা, পাথর, জীবজন্তুর হাড়, পাথরে ছাপপড়া জীবজন্তুর মূর্তি- যাকে বলে ‘ফসিল’। নানা দেশের গাছপালা, জীবজন্তু দেখে তাদের সম্বন্ধে খাতায় লিখে রাখেন সব কথা। ভরে ওঠে পাতার পর পাতা।

ডারউইন যতই দুনিয়ার নানা দেশ থেকে বেশি করে তথ্য সংগ্রহ করেন ততই সবরকম গাছপালা জীবজন্তুর জন্মরহস্য সম্বন্ধে একটা সত্য তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। একটা দৃঢ় তাঁর মনের মধ্যে গেড়ে বসে: গাছপালা জীবজন্তুর নানা জাত সবাই একসঙ্গে আলাদাভাবে সৃষ্টি হয়েছে একথা সত্যি নয়, সত্যি হতে পারে না। বিভিন্ন রকম জাতের মধ্যে নানান আশ্চর্য মিল তাঁর চোখে পড়তে থাকে।

ঘুরতে ঘুরতে তিন বছর পরে বীগল জাহাজ এসে পৌছায় দক্ষিণ আমেরিকায়। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল গালাপাগোস নামে একটি দ্বীপপুঞ্জ আছে। বিষুব রেখার ওপরে ডজনখানেক দ্বীপ, মূল মহাদেশ থেকে প্রায় ৬৫০ মাইল দূরে। বীগল নোঙর করল এখানকার কয়েকটা দ্বীপে। আর ডারউইন খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তিনি দেখলেন, যদিও দ্বীপগুলোর ওপরকার গাছগাছড়া আর জীবজন্তু অনেকটা আসল মহাদেশের ওপরকার গাছগাছড়া, জীবজন্তুর মতোই, তবুও তাদের বেশির ভাগই পৃথক জাতের। আবার এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপেও এদের মধ্যে যথেষ্ঠ তফাত রয়েছে।

ডারউইন দেখলেন, গালাপাগোসের এক দ্বীপের পাখি আরেক দ্বীপের পাখির মতো প্রায় একরকমের হলেও একেবারে সম্পূর্ণ এক নয়। তাদের রঙে, তাদের গানে, তাদের বাসা বানাবার কায়দায়, তাদের ডিমে নানান ধরনের খুঁটিনাটি তফাত রয়েছে। তিনি এসব দ্বীপের ওপর থেকে ২৩ রকমের পাখি সংগ্রহ করলেন যার একটাও মহাদেশের ওপর দেখা যায় না।

বিশেষ করে চোখে পড়ল তার বিভিন্ন দ্বীপে বিভিন্ন রকমের ফিঙে। কোনোটার ঠোঁট সরু, কোনোটার মোটা, কোনোটার বাকা। কেউ খায় ছোট বীজ, কেউ খায় বড় বীজ, আবার কেউ-বা বাঁচে পোকামাকড় খেয়ে। দ্বীপগুলোতে তিনি পেলেন ১৪ জাতের ফিঙে। এর একটারও মূল মহাদেশে দেখা পাওয়া যায় না। তাঁর কাছে মনে হল নিশ্চয়ই সুদূর অতীতে মূল মহাদেশ থেকেই দু’একটি ফিঙে এখানে এসেছিল। তারপর বিভিন্ন দ্বীপে বিভিন্ন রকম পরিবেশে পড়ে তাদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। কোনোটা খেতে শুরু করে এক ধরনের বীজ কোনোটা বা আরেক ধরনের বীজ। বিভিন্ন ধরনের জীবনযাত্রার ফলে ক্রমে ক্রমে তাদের গড়ন বদলে যেতে থাকে, তৈরি হয় নানারকম ঠোঁট – আলাদা আলাদা জাত।

ডারউইন আরও লক্ষ্য করলেন, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে বিরাট বিরাট রাক্ষুসে কাছিম আছে- তার এক-একটা এত বড় যে ঝুলিয়ে বয়ে নিতে হলে আটজন জোয়ান মরদের দরকার। আর সবচেয়ে বড় আশ্চর্য হচ্ছে, সেখানকার লোকেরা কাছিমের চেহারা দেখেই বলে দিতে পারে কোনটা কোন দ্বীপের। এইসব মিল-গরমিলের নিশ্চয়ই কিছু একটা মানে আছে। ডারউইন এ-সময়ে তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন: আমি ক্রমেই বিষ্ময়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি।

তিনি যতই অবাক হতে লাগলেন আর লক্ষ্য করতে লাগলেন ততই তাঁর কাছে মনে হতে লাগল, এই ধাঁধার একটাই মাত্র জবাব আছে। এইসব গাছ-গাছড়া আর জীবজন্তুর যদি একই ধরনের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে জন্ম হয়ে থাকে তাহলে খুব সহজেই এদের মিল-গরমিলের মানে খুঁজে পাওয়া যায়। মূল মহাদেশ থেকে সুদূর অতীতে যে-দু’-একটি পূর্বপুরুষ বিভিন্ন দ্বীপে গিয়ে পড়েছিল, যুগ যুগ ধরে তারা বদলাতে বদলাতে ক্রমে ক্রমে একে অন্য থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে পড়েছে।

বলা বাহুল্য, একদিনে এসব পরিবর্তন আসেনি, এসেছে হাজার হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে। গালাপাগোসের দ্বীপগুলি মহাদেশ থেকে দূরে বলেই প্রকৃতির এই পরীক্ষাশালায় মানুষের অগোচরে ঘটেছে নানারকম জাতের এই বিচিত্র সমাবেশ।

বীগল জাহাজ দূর্গম, রুক্ষ, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে কাটিয়েছিল মাত্র পাঁচ সপ্তাহ। ডারউইন লিখেছেন: এই পাঁচ হপ্তা আমার জীবনের সবচাইতে স্মরণীয় কাল।

বিলেতে ফিরে ডারউইন তাঁর ধারণাগুলি জড়ো করে নোট লিখে চললেন বিশ বছর ধরে। একটার পর একটা নোট বই ভর্তি করে যাচ্ছেন। প্রাণিজগৎ সম্বন্ধে যেখানে যত নতুন তথ্য পাচ্ছেন সব জড়ো করছেন। এইসব তথ্য থেকে তিনি প্রমাণ করলেন: সবরকমের জীবদেহ- সে গাছই হোক আর জীবজন্তুই হোক-সাধারণ পূর্ব-পুরুষ থেকে জন্মেছে। এক জাত থেকে বংশে বংশে বদলে কী করে একেবারে অন্য জাত সৃষ্টি হয় তাও ডারউইন প্রমাণ করলেন।

কী বললেন তিনি?

ডারউইন বললেন, ধরা যাক একটা প্রাণীর কথা। একই প্রাণীর সন্তানসন্তুতির মধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক ব্যতিক্রম থাকেই। যেসব ব্যতিক্রম তাকে পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করতে সাহায্য করে সেগুলো বংশধরদের মধ্যে টিকে যায়। বাকিগুলো টেকে না; সেসব ব্যতিক্রমওয়ালা বংশধর লুপ্ত হয়ে যায়। আজকের মতো এমন লম্বা গলাওয়ালা জিরাফ চিরকাল ছিল না। জিরাফের মধ্যে কারও কারও হয়তো ছিল কিছুটা লম্বা গলা। তারা বন-জঙ্গলে গাছের ওপর থেকে বেশি পাতা খেয়ে শক্ত-সমর্থ হল বেশি, কাজেই বেশি বংশধরও রেখে গেল। তাদের বংশধররাও কিছুটা পেল বাপ-মায়ের লম্বা গলার আদল। এমনি করে ধীরে ধীরে লম্বা গলাওয়ালা জিরাফের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। খাটো গলা যাদের তারা পাতা খেতে পেল কম, তাই প্রতিযোগিতায় টিকল না; ক্রমে ক্রমে তাদের সংখ্যা কমতে লাগলো। ডারউইন একে বলেছেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’।

এ ধরনের ক্রমবিকাশ শুধু যে প্রকৃতিতে আপনা-আপনি হয় তা নয়। মানুষ আপন প্রয়োজনমতো এই পরিবর্তনের ধারাকে কাজে লাগাতে পারে। এই ক্রমবিকাশের ধরনকে কাজে লাগিয়েই মানুষ সৃষ্টি করেছে এমন জাতের পোষা গরু যার দুধ বেশি হয়, মাংশ বেশি হয়; এমন জাতের ঘোড়া যা আকারে বড় হয় আর জোরে ছুটতে পারে। এমনি আরও নানারকম প্রাণী আর গাছপালা।

প্রকৃতির এমন একটি সাধারণ নিয়ম এর আগে আর কেউ এত সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারেনি। ডারউইন কী করে এমন আশ্চর্য সাফল্য লাভ করলেন?

তাঁর সাফল্যের মোটামুটি দুটি কারণ আছে। প্রথমত, তিনি বিপুল পরিমাণ ঘটনা ও তথ্য যোগাড় করেছিলেন যা দিয়ে আগাগোড়া ব্যাপারটা সকলের চোখের সামনে ছবির মতো ঝকমকে করে তুলে ধরা যায়। দ্বিতীয়ত, শুধু ক্রমবিকাশ হয় একথা বলেই ডারউইন ক্ষান্ত থাকেননি, কী করে হয় এবং কেন হয় তাও তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

তাঁর ধারণাগুলো ডারউইন ১৮৪৪ সালে একটি বই-এর আকারে লিখতে শুরু করলেন। আঁটসাঁট যুক্তির বাঁধুনি দিতে দিতে পনেরো বছর কেটে গেল। অবশেষে বন্ধুদের নিতান্ত পীড়াপীড়িতে ১৮৫৯ সালে তিনি বইটি বের করলেন। এই বই ‘দি অরিজিন অব স্পিসিজ’ নামে পরিচিত। তাও তিনি যত কথা প্রথমে লিখেছিলেন তার মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছাপা হলো। ১২৫০ কপি বই একদিনেই বিক্রি শেষ হয়ে গেল। তারপর বার বার ছাপা হতে লাগল এই বই। আজও ছাপা হচ্ছে।

সবাই কি প্রথমেই মেনেছিল তাঁর কথা? মোটেই না। প্রবল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর বই নিয়ে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের অজস্র যুক্তি আর প্রমাণের কাছে শেষ পর্যন্ত কোনো বিরোধিতাই টেকেনি। ১৮৮২ সালে ডারউইনের মৃত্যু হলে তাঁকে রাজকীয় সম্মানে নিউটনের সঙ্গে ওয়েস্ট মিনস্টারে সমাধি দেওয়া হয়।]]

পড়া শেষ করে নানা বললেন- কেমন লাগলো? সকলেই সমস্বরে বলল- দারুন, নানা দারুন। রৌরব বলে উঠল- নানা আমার খুব ডারউইন হতে ইচ্ছে করছে। বীগলের মত একটা জাহাজে চড়ে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়াবো, কী মজাটাই না হবে তখন। উহ্ ভাবতেই কেমন যেন সুখ সুখ লাগছে। উর্মী বলল- তুমি না গতবার বলেছিলে, পিথাগোরাস হতে ইচ্ছে করছে। যখনই মজার কিছু শোনো তখনই তা হতে চাও, ব্যাপার কী ভাইয়া? কবে আবার বলে বসবে- আমার না ডাইনোসোরাস হতে ইচ্ছে করছে। উর্মীর কথা শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। নানা বইটি স্বাধীনের হাতে দিয়ে বললেন- তোমার কাছে রেখে দাও। বেশ কয়েকদিন গল্পের আসরে আসবো না। মেজ মেয়ের বাড়ীতে যাবো। কতদিন আমার নাতী ফরিদকে দেখি না। মনটা বড়ই আনচান আনচান করে। তোমরা সবাই স্বাধীনের পড়াটা মনোযোগ দিয়ে শুনবে আর পড়া শেষ হলে পঠিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। আশরাফ তো ঢাকাতেই থাকে, ওকে বলে দেবো যেন ১০ কপি কিনে পাঠিয়ে দেয়। তাহলে তোমাদের প্রত্যেককে একটা করে উপহার দিতে পারবো। যাগ্গে, আজ তাহলে বিদায়, সবাই ভালো থেকো।

উপহারের কথা শুনে সকলের মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে উঠলো।

========================================

*[[..]] মধ্যে অবস্থিত টেক্সটগুলো আব্দুল্লাহ আল-মুতী রচিত ‘আবিষ্কারের নেশা’ বই-এর ‘ডারউইনের অভিযান’ থেকে নেয়া হয়েছে।

=========================================

আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন-এর পরিচিতি:
আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন (১৯৩০-১৯৯৮) জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক, শিক্ষাবিদ ও প্রশাসক। আব্দুল্লাহ আল-মুতী ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারী সিরাজগঞ্জ জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এম. এসসি এবং মার্কিন যুক্ররাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা বিষয়ে ১৯৬০ সালে এম এ ও ১৯৬২ সালে পিএইচ. ডি ডিগ্রী লাভ করেন।
বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব আল-মুতী শরফুদ্দিনের কর্মজীবন শুরু হয় সরকারী কলেজের একজন শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি শিক্ষক-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই), বিদেশে বাংলাদেশে দূতাবাসের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক কাউন্সিলর, শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি এডিবি ইউএনডিপি অর্থায়নকৃত মাধ্যমিক বিজ্ঞান শিক্ষা প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে আল-মুতী শরফুদ্দিনের অবদান অসামান্য। তিনি এদেশে বিজ্ঞানকে ছোটদের মধ্যে জনপ্রিয় করার পথিকৃৎ। তাঁর প্রকাশিত বিজ্ঞান, পরিবেশ ও শিক্ষা বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা ২৮।
উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে রয়েছে: বিজ্ঞান ও মানুষ, এ যুগের বিজ্ঞান, বিপন্ন পরিবেশ, বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসা, সাগরের রহস্যপুরী, মেঘ বৃষ্টি রোদ এবং পরিবেশের সংকট ঘনিয়ে আসছে।
বিজ্ঞান শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, একুশে পদক, শিশু একাডেমী পুরস্কার, ইউনেস্কোর কলিঙ্গ পুরস্কার এবং ড. কুদরাত-ই-খুদা স্বর্ণপদকসহ এক ডজনের অধিক পুরস্কার লাভ করন।
আল-মুতী শরফুদ্দিন বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বিজ্ঞান বিশ্বকোষ-এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন এবং ‘মুকুল’ নামে ছোটদের ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মময় জীবনের মাঝখানেও তিনি সাহিত্য সংসদ, প্রগতি লেখক সংঘ, কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিষদ এবং হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামিক একাডেমী অব সাইন্স-এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো; বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো এবং সভাপতি (১০৮৮-৯১)। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতি (১৯৮৬-৯০), ফাউন্ডেশন ফার রিসার্চ অন প্লানিং এন্ড ডেভলপমেন্ট-এর সহ-সভাপতি (১৯৯৩), বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর সাইন্স এডুকেশন- এর সভাপতি (১৯৮৮-৯৫), ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব এসোসিয়েশন ফর সাইন্স এডুকেশন -এর নির্বাহী সদস্য (১৯৮৯-৯৩) এবং ইউনেস্কোর মহাপরিচালক মনোনীত ইন্টারন্যাশনাল সাইন্টিফিক কাউন্সিল-এর সদস্য ছিলেন। আল-মুতী শরফুদ্দিন ১৯৯৮ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ প্রজেক্ট-এর প্রজেক্ট ইমপ্লিমেনটেশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। (বাংলা পিডিয়া থেকে সংগৃহীত)