জেরোম ওয়াইডম্যান
অন্ধকারে বসে থাকেন আমার বাবা
অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন

আমার বাবার একটা আজব অভ্যাস আছে- তিনি একাকী অন্ধকারে বসে থাকতে পছন্দ করেন।

প্রায়ই আমি বেশ রাত করে বাড়ি ফিরি। সমস্ত বাড়ি অন্ধকারের চাদরে মোড়ানো থাকে। আমি যতটা সম্ভব নিরবে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করি যাতে আমার মার অর্ধঘুমন্ত অবস্থার কোন ব্যঘাত না ঘটে। পা টিপে টিপে আমি আমার রুমের ভেতর যাই এবং অন্ধকারে পোষাক পরিবর্তন করি। অতঃপর একইভাবে পানি পান করার জন্য রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াই। ভেতরে ঢোকা মাত্রই বাবার সাথে ধাক্কা লাগার উপক্রম হয়। তিনি পায়জামা পরিহিত অবস্থায় রান্না ঘরের একটি চেয়ারে বসে আছেন। হাতের চুরুটটা তখনো জ্বলছে।
‘কেমন আছো বাবা?’- আমি বললাম।
‘এই তো…!’- বাবা উত্তরে বললেন।
‘তুমি এখনো ঘুমুতে যাওনি কেন, বাবা?’
‘খুব শীঘ্রই যাবো।’- তিনি বললেন।
কিন্তু তিনি যান না। আমার যতক্ষণ না ঘুম আসে আমি টের পাই, বাবা ঠাঁই বসে আছেন, জ্বলছে হাতের চুরুটটাও।
মাঝে মধ্যে আমি বইয়ের মধ্যে ঢুবে থাকি। মা ততক্ষণে ঘুমানোর জন্য ঘরটা প্রস্ত্তত করছেন। আমার ছোটবোনটা তার রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। তার ঘুমানোর আগ পর্যন্ত চুল আচড়ানো থেকে শুরু করে এটা-ওটার শব্দ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পাই, মা বাবাকে ‘শুভরাত্রি’ বলে রাতের শেষ কথা সেরে নিচ্ছেন। আমি তখনও পড়তে থাকি। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পানি পিপাসা পায়। স্বাভাবিকের তুলনায় আমি একটু বেশিই পানি পান করি। রান্নাঘরে পা দেওয়া মাত্রই বাবার সাথে আমার হোচট লেগে যায় প্রায়। বেশিরভাগ সময় আমি বেশ চমকে উঠি, বাবার কথা প্রায়ই ভুলে যাই। তিনি তেমনি করে চুরুট হাতে বসে থাকেন আর কি যেন ভাবেন।
‘তুমি এখনো শুতে যাওনি কেন, বাবা?’
‘এই তো গেলাম বলে।’
কিন্তু তিনি যান না। চুরুট হাতে সেখানেই বসে থাকেন আর কি যেন ভাবতে থাকেন। আমি বুঝে উঠতে পারি না কিছুই, বিষয়টা আমাকে বেশ পিড়া দেয়। একদিন আমি জিজ্ঞেস করেই বসলাম-
‘বাবা, তুমি সবসময় এতো কি ভাবো?’
‘কই, কিছু নাতো!’

একসময় আমি তার কাছ থেকে সরে আসলাম। কয়েক ঘন্টা পরে আবারো আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি খুব তৃষ্ণার্ত ছিলাম ফলত পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে গেলাম। তিনি তখনো বসে ছিলেন। তাঁর হাতের চুরুট শেষ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তিনি বসে ছিলেন পূর্বের ন্যায় ঠায়, রান্নাঘরের দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। খুব তাড়াতাড়ি আমি অন্ধকারের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে পানি পান করলাম। তিনি বসে ছিলেন প্রশান্ত-পলকহীন। আমার মনে হল, আমার অবস্থান সম্পর্কে তিনি অবগত নন। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
‘তুমি এখনো শুতে যাওনি কেন, বাবা?’
‘এক্ষুনি যাবো। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো না।’
‘কিন্তু,’ বললাম আমি, ‘তুমি সেই কখন থেকে বসে আছো! কি হয়েছে তোমার? কি নিয়ে ভাবছ এতো?’
‘ও কিছু না’, তিনি বললেন, ‘এমনিই, এই একটু বিশ্রাম নিচ্ছি আর কি!’
তাঁর বলার ভঙ্গিটা সব সহজ করে দিল। তাঁকে মোটেই চিন্তিত মনে হল না। তাঁর কন্ঠস্বর ছিল শীতল, অন্যসব সময়ের মতই। কিন্তু আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না- অন্ধকারে একটি কাঠের চেয়ারে এভাবে একাকী বসে থাকার মধ্যে প্রশান্তির কি আছে? অন্য কি কারণ থাকতে পারে? আমি আর সব সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখলাম। আমি নিশ্চিৎ, এটা টাকা-পয়সা জনিত কোন ব্যাপার না। আমাদের খুব বেশি টাকা নেই বটে তবে অর্থনৈতিক কোন সমস্যার কথা তিনি গোপন রাখেন না। সমস্যটা তাঁর স্বাস্থ্য নিয়েও নয়। তিনি স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ উদাসীন। পরিবারের অন্যকারো স্বাস্থ্যও আলোচ্য সমস্যার কারণ হতে পারে না। আমাদের যথেষ্ট টাকা-পয়সা না থাকলেও স্বাস্থ্যের অবস্থা ঢ়ের ভালো। তাহলে কারণটা কি?- আমি শত হাতড়েও পাই না। তবে তাতে আমার চিন্তা দমে যায় না মোটেও, বরং দ্বিগুন শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে আসে।

হতে পারে তিনি তাঁর ভাইদের নিয়ে চিন্তা করেন। কিংবা তাঁর নিজের মা এবং তার দুই সৎ মা অথবা তাঁর বাবাকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। কিন্তু তাই বা হয় কি করে!- তাঁরা তো সবাই মৃত। তাছাড়া তিনি তাঁদের নিয়ে এভাবে ভাববেন না। তিনি যে আসলে দুশ্চিন্তা করেন তাও কিন্তু নয়, এমনকি তাঁকে দেখলে চিন্তিতও মনে হয় না। তাঁকে খুব প্রশান্ত মনে হয়। ঠিক তৃপ্ত না তবে খুব উৎকণ্ঠশূন্য। তাঁর ভাষায়- শান্তিময়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব, আমি বুঝে পাই না। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি খুব চিন্নিত হয়ে পড়ি।
তিনি কেন অন্ধকারে ঐভাবে বসে থাকেন? তিনি কি খুব অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছেন আজকাল? কিন্তু সবে তাঁর বয়স তেপান্ন, এবং তিনি আগের মতই সকল বিষয়ে উৎসাহি। আমার তো মনে হয় কোন দিক দিয়েই তাঁর কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তিনি এখনও সুফ খেতে খুব পছন্দ করেন। এখনও তিনি দিনের শেষভাগে পড়তে বসেন। এখনো লম্বা কলার বিশিষ্ট শার্ট পরেন। মোদ্দাকথা, তাঁর কোন পরিবর্তনই ঘটেনি। এমনকি পাঁচ বছর আগে যেমন দেখাতো এখনও তেমনই দেখায়। ‘স্বাস্থ্যটাকে বেশ ধরে রেখেছেন তো!’- অনেকে প্রায়ই বলেন। কিন্তু তিনি একাকী অন্ধকারে চুরুট হাতে ঠায় বসে থাকেন।

যদি তাঁর কথা ঠিক বলে ধরে নিই, আমার আর কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু ধরো তিনি যা বলছেন সঠিক না। হতে পারে এটা এমন কিছু একটা যার আমি কোন কূল-কিনারা পাচ্ছি না। খুব সম্ভবত তাঁর কারও সহযোগিতার প্রয়োজন। কেনই বা তিনি কথা বলেন না, হাসেন না, কাদেন না? কেনই বা তিনি নিজেকে কোন কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখেন না? এইভাবে বসে থাকার কোন মানে হয়?
শেষের দিকে আমার ধৈর্যচ্যুত ঘটলো। হতে পারে কোন সঠিক কারণ না খুঁজে পেয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। আমার ভেতরে রাগ তৈরী হল।
‘কোন সমস্যা বাবা?’
‘কিছু না। এমনিতেই…।
কিন্তু এইবার এই উত্তরে দমে যাওয়ার পাত্র আমি না, আমার রাগ এখন মাথায় চড়ে গিয়েছে।
‘তাহলে তুমি এখানে এভাবে একাকী এতো রাত পর্যন্ত বসে আছো কেন?’
‘খুব শান্তিময়! আমার বেশ ভালো লাগে, বাবা।’
আমি বাড়িতেই আছি। কাল আবার তিনি এমনি করে বসে থাকবেন। আমি ঘাবড়ে যাব, চিন্নিত হব। না, আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে।
‘আচ্ছা, তুমি কি নিয়ে এত ভাবো বলো তো? শুধু এই একই স্থানে বসো কেন? তোমার কিসের এত চিন্তা, সত্যি করে বলবে কি?’
‘কোন কিছুই আমার চিন্তার কারণ না। আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। আমার বসে থাকতে ভালো লাগে, এটুকুই..। তুমি ঘুমুতে যাও।’
আমার রাগ দূর হয়ে যায়। তবে চিন্তার দাবানলে এখনো পুড়তে থাকি। একটা যৌক্তিক কারণ আমাকে খুঁজে পেতেই হবে। বিষয়টা খুব পাগলামো ঠেকছে। তিনি কেনইবা আমাকে কিছু বলছেন না? মনে হচ্ছে এর কোন কারণ না খুঁজে পেলে আমিই পাগল হয়ে যাবো। আমি আরও জোর দিয়ে বললাম-
‘কিন্তু তুমি কি নিয়ে ভাব, বাবা? বিষয়টি কি?’’
‘ও কিছু না। টুকটাক এটা-ওটা নিয়ে। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।’
আমি আমার উত্তর পাই না।

অনেক রাত হয়ে গেছে। রাস্তায় শূনশান নিরাবতা, অন্ধকারের কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে বাড়িটা। আমি সিঁড়ি বেয়ে শব্দহীন উঠে যাই। যেখানে পা পড়লে শব্দ হতে পারে আমি সেখানটা এড়িয়ে যায়। আমার চাবির সাহায্যে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করি এবং পা টিপেটিপে আমার রুমে প্রবেশ করি। পোষাক পাল্টে অনুভব করি, আমি তৃষ্ণার্ত। খালি পায়ে রান্নাঘরের দিকে যাই। আমি জানি, তিনি বসে আছেন। আমি অন্ধকারে তাঁর বাকানো শরীর স্পষ্ট দেখতে পাই। সেই একই চেয়ারে একইভাবে বসে আছেন- হাটুতে কনুই চেপে, নিভন্ত চুরুট ঠোঁটে নিয়ে এবং পলকহীন দৃষ্টি সামনে নিযুক্ত রেখে। তাঁকে দেখে মনে হল না তিনি আমার অবস্থান টের পেয়েছেন। তিনি আমার আসার কোন শব্দ শুনতে পান নি। আমি দরজার গোড়াই শব্দহীন দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে পরখ করি। সবকিছুই শব্দহীন-আত্মনিবিষ্ট; কেবলই রাতের ফিসফাস শব্দ শোনা যায়। আমি ওখানে জড়বস্ত্তর ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে সেই শব্দ শুনতে পাই : কাটাওয়ালা ঘড়ির টিকটিক শব্দ, অনেকদূর থেকে একটা মোটরগাড়ির শব্দ ভেসে আসে, পিচের রাস্তায় বাতাসের কাগজকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে জাওয়ার শব্দ চাপা নিঃশ্বাসের মত ওঠে আর নামে। খুব অদ্ভূত সুখকর একটা অনুভূতি। আমার ঠোঁটের শুষ্কতায় টের পেয়ে যাই রান্না ঘরে প্রবেশ করার কারণ।
‘কি করছ বাবা?’
‘কিছু না।’- তিনি বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা, স্বপ্নের ভেতর শোনার মত শোনালো।
তিনি বিন্দু মাত্র নড়লেন না, দৃষ্টি সেই আগের স্থানেই নিবিষ্ট রইল। আমি —। জানালা দিয়ে হালকা আলোক-ছায়া রুমে এসে রুমটিকে আরো অন্ধকার করে তুলেছিল। আমি রুমের মাঝখানে গিয়ে সুইসে চাপ দিলাম। তিনি একটা ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, যেন তাঁকে আঘাত করা হয়েছে।
‘কি হয়েছে বাবা?’- আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘কিছু না।’- তিনি বললেন। ‘আমি আলো সহ্য করতে পারি না।’
‘আলোতে তোমার সমস্যা কি?’- আমি বললাম।
‘কিছু না।’- তিনি বললেন। ‘আমি আলো পছন্দ করি না।’
আমি আলো বন্ধ করে দিলাম, সাবধানে পানি পান করালাম। আমাকে উত্তেজিত হলে চলবে না, নিজেকে নিজে বললাম। আমাকে বিষয়টির একেবারে তলানিতে প্রবেশ করতে হবে।
‘তুমি শুতে যাও না কেন? তুমি কেন এত রাত অব্দি অন্ধকারে এইখানে বসে থাকো?’
‘আমার ভালো লাগে।’- তিনি বললেন। আমি আলোতে স্বাভাবিক হতে পারি না। আমি যখন য়্যুরোপে ছোট ছিলাম তখন আমাদের এই আলো ছিল না।’
আমার ভেতরটা হালকা করে কেঁপে উঠল এবং আমি প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার মনে হল, আমি বুঝতে শুরু করেছি। আমি অস্ট্রিয়াই তাঁর বাল্যকালের গল্পগুলো স্মরণ করলাম। আমি দেখতে পেলাম, বড় বড় বর্গা বিশিষ্ট বারে আমার দাদাভাই বসে আছেন। অনেক রাত হয়ে এসেছে। খদ্দেররা সব চলে গেছে। এবং দাদুভাই ঝিমুচ্ছেন। পোড়া কয়লার একটা স্ত্তপ দেখতে পেলাম, এখনো হালকা উত্তাপ ছড়াচ্ছে।

ইতোমধ্যে অন্ধকার গ্রাস করে ফেলেছে চারপাশ, এবং আরো অন্ধকার চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসছে। আমি ছোট্ট একটা বালককে দেখলাম, আগুনের পাশে একটা কাঠের মাস্ত্তলের ওপর গুড়িমুড়ি করে বসে আছে। তার উজ্জ্বল চোখ মৃত প্রায় আগুনের দিকে নিবিষ্ট।
এই বালকটিই আমার বাবা। আমি দরজার গোড়ায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে ঐ সুখকর মুহূর্তটির অনুভূতি টের পেলাম।
‘তুমি বলতে চায়ছো, কোন সমস্যা নেই? তুমি অন্ধকারে বসে থাকো কারণ তোমার ভালো লাগে, তাই না বাবা? আনন্দে আমার চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলো।
‘হুম। তাই। আমি বাতি জ্বললে চিন্তা করতে পারি না।’
আমি গ্লাসটি রেখে রুমে চলে আসলাম।
‘শুভরাত্রি, বাবা!’- আমি বললাম।
‘শুভরাত্রি!’- বাবা বললেন।
তারপর আমার মনে পড়ে, আমি ঘুরে তাকালাম, এবং জিজ্ঞেস করলাম-
‘তুমি কি চিন্তা করো, বাবা?’
তাঁর কন্ঠস্বর মনে হল বহুদূর থেকে ভেসে আসছে।
‘কিছু না’, তিনি খুব সহজভাবে বললেন, ‘তেমন বিশেষ কিছু না।’