Image and video hosting by TinyPic
জীবন আমার চলছে যেমন তেমনি ভাবে
সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে ছলে যাবে।….

সুচিত্রা মিত্র,একটি নামই শুধু নয়,একটি ইতিহাস। শিল্পীকে তার শিল্পের জন্যই সবাই স্মরণ করে,কিন্তু মানুষ হিসেবে সবাই শ্রদ্ধা পান না,যেমন পেয়েছেন সুচিত্রা মিত্র। রবীন্দ্রনাথের গান সবাই গান,কিন্তু এমনভাবে তা নিজের জীবনেও অনুসরন করতে পারেন কয়জন? তার জীবন সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দায়িত হয়ে বয়ে চলেছে এতটা কাল,আজ সেই স্রোতধারা সাগরে মিলল,শেষ হল এক কিংবদন্তীর পথ চলা।
তার বাবা সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন লেখক,পেশায় উকিল। তার জন্ম হয়েছিল চলন্ত ট্রেনে,তাই তিনি প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতেন,আমি তো জন্ম থেকে যাযাবর। দারুন সংস্কৃতিমনা পরিবার থেকে উঠে আসা বলে তার পরবর্তী জীবন ধারায় তার প্রভাব দেখা যায়। বাবা উকিল হলেও পেশায় যত না মন,তার চেয়ে সাহিত্যে মনোযোগ বেশি। ফলে,অভাব তার খুব অপরিচিত কিছু ছিল না।
ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা,একবার শুনলেই কোন গান শিখে ফেলেন আর তারপর গলা ফাটিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বেড়ানো,এই স্বভাবের সুচিত্রা যে পরের সময়টা গান শুনিয়েই কাটিয়ে দেবেন,তা কি খুব অমূলক মনে হয়?

তার বড়বোনের বান্ধবী উমা স্নেহানবীশ তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে কবিগুরুর স্মৃতিচারন অনুষ্ঠানে । কবি তখন সদ্য প্রয়াত। গান গাওয়ার কোনও যন্ত্রপাতি নেই। তার মাঝেও ছোট সুচিত্রা খালি গলায় গেয়ে উঠলেন,
যখন পড়বে না মোর পয়ের চিহ্ন এই বাটে……..গানটি সবার খুব মনে ধরেছিল। তারপর সুচিত্রা বৃত্তি নিয়ে সংগীতভবনে ভর্ত্তি হলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ২০ দিন পর।রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগেই সংগীতভবনে ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছিল। শৈলজারঞ্জন মজুমদার গুরুদেবকে বললেন,একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। তিনি সম্মত হলেন।শৈলজারঞ্জন তার পরিচিত মহলকে গুণীর সন্ধান করতে বললেন। তখন বিজয়া দাস তাকে জানান,তাদের স্কুলের ক্লাস টেনের একটি মেয়ে খুব ভাল গায়। সাথে সাথে বৃত্তি মঞ্জুর হয়ে গেল। বাবার আপত্তি সত্বেও দিদিদের উৎসাহে সুচিত্রা গেলেন গান শিখতে শা্ন্তিনিকেতনে।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বোলপুর তখন কিছুটা শুন্য মনে হলেও সংগীতভবন মোটেও তারকাশূন্য নয়। ছাত্রদের মধ্যে কণিকা বন্দোপাধ্যায়,অরুন্ধুতী গুহঠাকুরতা,কমলা সেন (বসু),চিত্রা মজুমদার,অশোকতরু–এরকম সব ছাত্র । আর শিক্ষকদের নামও কম ভারী নয়,

শৈলজারঞ্জন তো ছিলেনই মাথা হয়ে,আরও ছিলেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী,অশেষ বন্দোপাধ্যায়,ভিভি ওয়াঝেলওয়ার।
মোহরদি (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) পরে বলতেন,”কীরকম ঝরঝরে চেহারা,টরটরে কথাবার্তা,কী স্মার্ট চলাফেরা–আমরা অবাক হয়ে সুচিত্রাকে দেখতুম। তখন সুচিত্রার সাথে কিছুটা সমান তালে পাল্লা দিতে চেষ্টা করত অরুন্ধুতী। কিন্তু ঠোক্করও খেতেন। আর বাচ্চুদি বা নীলিমা সেন? একবার ক্লাসিকাল সংগীতের ক্লাস থেকে ওয়াঝেলওয়ার ওস্তাদজি দুজনকে বের করে দিলেন। বললেন,কো অপে গিয়ে কেরোসিন কিনে মাথায় ঢালো। বেরিয়ে এসে বাচ্চুদি তো কেঁদেই সারা,সুচিত্রার কোনও ভাবান্তর নেই। বরং বাচ্চুদিকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন,ভাবিস নে রে,এমন প্রাকটিশ লাগাব না আমরা,ওস্তাদজীর মুখ ভোঁতা হয়ে যাবে।”
গানের স্বরলিপি লিখন পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারেননি বলে ইন্দিরা দেবী বিরক্ত হয়েছেন। যদিও সহজেই গান কন্ঠে ধারন করতে পারতেন বলে সুচিত্রা ছিলেন তার প্রিয় ছাত্রীও।

সুস্থির আশ্রমকন্যা তিনি ছিলেন না,কলাভবনের ছাত্রদের সাথে ভলিবল খেলেছেন। আবার কেন্দুলিতে জয়দেবের মেলায় যাওয়ার সময় সারাটা পথ সুচিত্রা ছেলেদের সাথে পায়ে হেঁটে গেছেন,অন্য মেয়েদের সাথে গরুর গাড়িতে যান নি। কোনও কিছুতে সুবিধা প্রত্যাশা করে থাকা তার চরিত্রে ছিল না। এই মানসিকতাই পরবর্তী জীবনে তাকে অনেক সাহায্য করেছে।
সঙ্গীতভবন থেকে বের হওয়ার বছরেই তার প্রথম রেকর্ড বেরোয়। তার একদিকে ছিল,মরণরে,তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান,অন্য পিঠে ছিল হৃদয়ের একূল ওকূল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেইকালেও প্রথম রেকর্ডে অপরিমেয় সাফল্যলাভ!! সেইকারনে সম্মেলক কন্ঠে ছাড়াও দেখা যাচ্ছে,তার ‘৪৭ এ দুটো,’৪৮ এ তিনটি,’৪৯ এ তিনটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে এমন গানও আছে,যার সাথে সুচিত্রার নাম চিরদিন জড়িয়ে থাকবে;সার্থক জনম আমার,নৃত্যের তালে তালে,যদি তোর ডাক শুনে,নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে ইত্যাদি।

সুচিত্রা সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি। ধ্রুব মিত্র সুভদ্র হলেও দায়িত্ববোধের অভাব ছিল। ফলে,সংসারের খরচ অনেকটাই সুচিত্রাকে যোগাড় করতে হত। ধ্রুব আবার তার স্বাধীনচেতা স্বভাবও মেনে নিতে পারেন না। ফলে একসময় আলাদা হয়ে বাস করতে শুরু করলেন তিনি।

সেকালে একজন মহিলার একা থাকা সমাজে যথেষ্ট কৌতুহলের জন্ম দিত। তার নামেও নানারকম গুজব ছড়িয়েছে। কিন্তু তিনি টলেননি,একমাত্র পুত্র কুনালকে মানুষ করেছেন। এর মাঝে তার প্রাক্তন স্বামীর মৃত্যু ঘটেছে। ধ্রুব মিত্রের নাবালক পুত্র সহ স্ত্রীটি সংসারযাত্রায় অসুবিধায় পড়েছেন। সুচিত্রা সেই পরিবারেরও ভার নিলেন,তার প্রাক্তন স্বামীর নাবালক পূত্রটির যাতে পড়াশোনায় সমস্যা না হয় তার জন্য প্রানপণে পরিশ্রম করতে লাগলেন। নিজের জীবনকে,চারপাশকে সুবিন্যস্ত রাখতে চাইতেন,নিজের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচও কমাতে পারেন না,গাড়ি নেই তবুও ড্রাইভারকে ছাড়ান না,ছাড়ালে ও বেচারার বৌ ছেলেমেয়ে খাবে কি? যেকোনো অন্যায় অবিচারে তার অংশগ্রহন ছিল অবশ্যম্ভাবী।

কিছু লেখক যখন রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করেন,তিনি তখন বিদেশে। বিদেশ থেকে এসে সব খবর শুনলেন,মুখে কিছু বললেন না।মাসখানেক পরেই রবিতীর্থর বার্ষিক অনুষ্ঠানে একটা দিন নির্দিষ্ঠ ছিল সুচিত্রার গানের জন্য। সুচিত্রা তার যাবতীয় আবেগ নিয়ে গাইলেন,
সবার মাঝারে তোমারে স্বীকার করিব হে/ সবার মাঝারে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে।
সেদিনের শেষ গানটি ছিল,

অপমানের পথের মাঝে,তোমার বীণা নিত্য বাজে
আপন সুরে আপনি নিমগন।
ইচ্ছা ছিল বরনমালা পরাই তোমার গলে,
নাইবা তোমার থাকল প্রয়োজন।

অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে নীলিমা সেন বললেন,”তবুও তো একজন প্রতিবাদ করল।আমরা পারলাম না,ও একা সুচিত্রাদিই পারে।”

গণনাট্যর হয়ে অনেক গান করেছেন। ১৯৫১ সালে পূর্ব বার্লিনে গিয়েছেন গান গাইতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও দেবব্রত বিশ্বাসের সাথে তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন।

রবীন্দভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের একটা বিভাগও খুলেছিলেন,যার প্রধান ছিলেন ১৯৮৪ পর্যন্ত।তার অসামান্য কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি ১৯৭৪ এ পদ্মশ্রী,পরবর্তীতে দেশিকোত্তম ও এইচএমভি’র গোল্ডেন ডিস্ক এওয়ার্ড পান। তিনি ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘দহন’ এ অসাধারন অভিনয় করেন।
Image and video hosting by TinyPic

‘আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালবাসি’ ,তার কন্ঠে এই গান ‘৭১ এ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। কৃষ্ণকলি আমি তাকেই বলি,তবু মনে রেখ,ভালবাসি ভালবাসি এবং অবশ্যই একলা চলো রে,তার অবিস্বরণীয় সব গান। এর মাঝে একলা চলো রে বোধহয় তার জন্যই কবিগুরু সৃষ্টি করেছিলেন,কারন সারাটা জীবনই তিনি একলাই চলেছেন। ছেলের কাছ থেকেও টাকা নিতে চাইতেন না,বলতেন ,”সে কি রে!ওদের সংসার আছে না? আমি কি ওকে মানুষ করেছি শেষবয়সে আমাকে দেখবে বলে? ইমপসিবল!”

আজ কবিগুরুর সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর বছরে তিনি চলে গেলেন সারা জীবন অমৃতের সন্ধান করে,আর অপরকে অমৃত বিতরন করে। তার সংগ্রামী জীবন আমাদের সামনে রেখে গেলেন,আর বলে গেলেন,

“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে দিন কাটবে,
কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে, আহা,
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সে দিন উঠবে ভরি–
চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি– আহা,
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে॥