সেই আশির দশক। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক শাখায় যশোর বোর্ডে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করলো নির্মল কুমার বিশ্বাস নামের প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে। রোজ কলেজে যাতায়াতের জন্য তাকে প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ মাইল সাইকেলের ওপর থাকতে হতো। মাধ্যমিকেও সে তৃতীয় হয়েছিল বোর্ড থেকে। পাশ করে সহপাঠীরা কে কোথায় কোন বিষয়ে পড়াশুনা করবে আলাপ হচ্ছিল। সবাই ব্রিলিয়ান্ট নির্মলের দিকে তাকিয়ে ছিল। স্বল্পভাষী বিনয়ী নির্মল কীসব ভেবে বেশ সময় নিয়ে বলেছিল আগামী বিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় থাকবে না বলেই আমার ধারণা। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবার। ওখানে গিয়ে নতুন করে ক্লাস নাইনে ভর্তি হবো। সহপাঠীরা হতবাক। বলে কী এ ছেলে! হিন্দু বলে কেউতো ওকে ফেল করিয়ে দেয়নি। ও ওর যোগ্যতা অনুযায়ী রেজাল্ট করেছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নির্মল কতদূর অব্দি ভেবেছে? এরকম কেনই বা ভেবেছে? পরে শোনা গিয়েছিল ওর দরিদ্র পিতা ওকে ভারতে গিয়ে আবার নতুন করে স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশুনার করার বাসনা ত্যাগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু নির্মল শোনেনি। ওর একসময়ের সহপাঠীরা কৌতুহলে মাঝে মাঝে গিয়ে ওর বাবার কাছে নির্মলের সংবাদ জেনে এসেছে। নির্মল ওখানে গিয়ে আহামরি কোন রেজাল্ট করতে পারেনি। পরবর্তীতে সে নাকি মহাকরণের একজন উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিল। শোনা কথা।

বন্ধুরা এখনও ভেবে পায় না নির্মলের পরিণামদর্শন আসলেই কতখানি বাস্তবসম্মত ছিল। তবে ভারতে চলে যাবার ধারা বড় বড় শহরগুলোতে আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। নির্মল সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল মাত্র। একটু ভালো করে খোঁজ নিলেই দেখা যায় এদেশের শিক্ষিত, ভালো উপার্জনক্ষম হিন্দু মা-বাবারা তাদের দু’তিনজন সন্তানের মধ্যে একজন দু’জনকে ভারতে লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এখন এ সংস্কৃতি প্রায় প্রতি সচ্ছল হিন্দু ঘরেই। সুদীপ্তা সরকার একটি সরকারি সংস্থার মধ্যমমাপের কর্মকর্তা। তার স্বামীও একটা এনজিওতে ভালো বেতনে কাজ করেন। তাদের দু’মেয়ে। দু’জনকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের একটা আবাসিক স্কুলে। সুদীপ্তা মেয়েদের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্থ নন। কিন্তু সারাক্ষণ মনভারি করে বেড়ান। অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখেন ঘর খালি, কথা বলার মানুষ নেই, কবে কোন পুজোর বন্ধে মেয়েরা আসবে তার আশায় ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর ভাবেন প্রতিদিন তার মেয়েরা তার চোখের বাইরে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। তাদের বেড়ে ওঠা তিনি দেখতে পারছেন না, তাদের মানসিক সঙ্গী হতে পারছেন না, বয়সের এই সন্ধিক্ষণে কত মানসিক পরিবর্তন হয়, কত কৌতুহল, কত প্রশ্ন জাগে মনে তার কিছুতেই তিনি তাদের সাহায্য করতে পারছেন না। কয়েকদিনের বন্ধে ওরা দেশে আসলে দু’জনকে দু’হাত দিয়ে যতক্ষণ পারেন বুকের সাথে লাগিয়ে রাখেন। মায়ের একাকীত্বে মেয়েদেরও কষ্ট হয়। কিন্তু তারা আস্তে আস্তে সেই পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। যদিও ওখানকার কোন কোন স্কুল-কলেজে ‘র‌্যাগিং’-এর শিকার হতে হয় বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের, হীনমন্যতায় ভোগারও যথেষ্ট কারণ থাকে, পরদেশে গলা বাড়িয়ে কথা বলারও অধিকার কম তার পরেও তাদের মা-বাবারা নিরুদ্বিগ্ন থাকেন। কেন? রাজেন্দ্র সাহা বলছিলেন কোন বাবা-মা-ই চান না সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই দূরে রাখতে। কারণ বিশ্বমানের স্কুল কলেজ বাংলাদেশেও প্রচুর আছে। বরং ভারতে ছেলেমেয়েদের পেছনে যে খরচ ও যাতায়াতের যে ব্যয়ভার তা দিয়ে দিব্যি দেশেই তাদের ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। আর মা-বাবা-পরিবারের মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠার তো কোন বিকল্প নেই তা কে না জানে? কিন্তু যখনই ভেবেছি দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা, যে পরিবর্তন সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ উৎপীড়নকে উৎসাহিত করে, রাজনৈতিক-সামাজিক অধিকারে বৈষম্য সৃষ্টি করে, নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে তখন মনে হয় আমরা নাহয় এসব সহ্য করেছি কিন্তু আমারই চোখের সামনে আমার সন্তান কেন তা ভোগ করবে? আমার বাবা-মায়ের সামর্থ ছিল না বা তারা সচেতন ছিলেন না বলে আমরা নির্যাতন সয়েও থেকে গেছি। কিন্তু আমার একটাই সন্তান। আমি বাবা হয়ে এ বৈষম্যের মধ্যে সন্তানকে বেড়ে উঠতে দিতে পারিনা। শুধু যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই ভারতে পড়তে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। অনেক মুসলমান ছেলেমেয়েও যাচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে মুসলমানরা ফিরে আসছে, হিন্দুরা ফিরছে না। এসব ছেলেমেয়েরা ওদেশে পাস করে চাকরি-বাকরি পেয়ে বিয়ে থা করছে। তাদের অনেকের বাবা মা রিটায়ার করে টাকাপয়সা বা ভিটেমাটি বিক্রিবাট্টা করে এদেশের পাট চুকিয়ে চলে যাচ্ছেন। স্বভাবতই ওখানে গিয়ে তারা ভালো থাকছেন না। ওদেশের জীবন আরও কঠিন। তাছাড়া উড়ে এসে জুড়ে বসা শখের উদ্বাস্তুদের স্থায়ী বাসিন্দারা কোন চোখে দেখবে তা আর না বলাই ভালো।

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা কি সবক্ষেত্রেই সুদীপ্তা রাজেন্দ্রর বর্ণনার মতো? মনে পড়ে সেই ৬৫ সালের যুদ্ধের কথা। তখন শৈশব। ডাঃ লক্ষীনারায়ন কুণ্ডুর তিন মেয়ে আর পাশের বাড়ির আমরা তিন বোন ছিলাম যেন হরিহর আত্মা। ঈদে আমাদের নতুন কাপড়ের সাথে ওদের জন্যও কেনা হতো নতুন কাপড়। দূর্গাপূজোয় মাকে গরদের শাড়ি পাঠাতেন ওদের মা। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে ওরা কোন কোন দিন আমাদের বাড়িতে খেয়ে তবে বাড়ি ফিরতো। লক্ষীপুজোয় সারা রাতদিন ওদের বাড়িতে আমাদের থাকতে হতো। কিন্তু ৬৫ সালের এক ভোরে উঠে ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি ওরা কেউ নেই। ওদের ঝকঝকে লাল শানের ঠাকুরঘর দরজাখোলা অরক্ষিত, বিশাল দরদালানের বারান্দার তারে ঝুলছে না কাকীমার ফিনফিনে শাড়ি, কলের পাড় শুকনো খটখটে, কাশীর পেয়ারা গাছের তলায় পড়ে আছে শুকনো পাতা। কেবল ওদের আদরের কুকুর লালু সিঁড়ির এককোণে পায়ে মুখ রেখে নিরবে বসে। সেদিন প্রিয়জন হারানোর ব্যথায় ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। ছোট্ট মনে কেবল প্রশ্ন ‘ওরা কেন না বলে চলে গেল?’ বাবা-মার কাছ থেকেও কোন সদুত্তর পাইনি সেদিন। এখন মনে হয় ওরাও কি নিরাপত্তাহীনতয় ভুগছিল? অবশ্য কোন কট্টর রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে হিন্দু জনগোষ্ঠি নিরাপত্তহীনতায় ভোগেন। তখন তারা যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেতে পারেন তারই একটা ক্ষেত্র রচনা করে রাখা আর কি। হিসেব করলে বরং দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানরা শিক্ষা, চাকরি, খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা ও অন্যান্য সকল সুযোগ-সুবিধায় হিন্দুদের সাথে কোটাপদ্ধতির নির্মম বলি। বাংলাদেশে তো হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য কোন কোটা পদ্ধতি নেই। বরং সংখ্যার অনুপাতে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তরাই সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদে অধিক আসীন। যেখানে নিম্নপদে এ সংখ্যা কম। অপরদিকে উচ্চপদ উচ্চমর্যাদার চাকরি মুসলমানদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে নৈব নৈব চ। নিম্নপদে কিছু দেখা যায়। বর্ধমান মুর্শিদাবাদে মুসলমান মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু তাদের জন্য না আছে ভালো চাকরি, না ভালো বিয়ে। তাদের সাথে যাদের বিয়ে হবে তাদের অবস্থাও যে করুণ। একজন মাস্টার্স পাশ মেয়ে বিয়ে করছেন একজন পুলিশকে না হয় একজন তালিকাভূক্ত (যাদের কোন সরকারি চাকরি নেই কিন্তু ভবিষ্যতে পাবার সম্ভাবনা আছে) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে। উপরন্তু মোটা পণের বিনিময়ে। পুলিশ বা শিক্ষককে বিয়ে না করলে সে মেয়েকে আইবুড়ো থাকতে হবে। কেননা তদঞ্চলে এর বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন পাত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার মধ্যেও যারা স্বপ্ন দেখেন, সংগ্রাম করেন, অধিকার সচেতন তাদের মধ্যে হাতে গোনা কেউ কেউ বেরিয়ে আসছেন। সে সংখ্যা এতই নগন্য যে তা পরিসংখ্যানে আসে না। কিন্তু কই এতো বঞ্চনা সয়েও তো ওরা মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে সন্তানদের লেখাপড়া তথা জীবনযাপনের জন্য পাঠাচ্ছেন না? কেন? না, ওরা নিজের জাতীয় পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন প্রথমে আমি ভারতীয়, তারপর মুসলমান।

বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের যেসব ছেলেমেয়ে ওদেশে পড়তে যাচ্ছে তারা বেশিরভাগই আর ফিরে আসেন না। তাদের সবাইকে যে মেধাবী নির্মলের মতো করণিকের জীবন বেছে নিতে হচ্ছে তা-ও নয়। কেউ মোটামুটি ভালো বা মধ্যমমানের চাকরি পাচেছন কিন্তু সেটাই কি বড় কথা? যেসব শিশু-কিশোরদের মা-বাবারা ওদের ভালোর জন্য ওদেশে পাঠাচ্ছেন তাদের মনের কথা কেউ কি পড়ে দেখেছেন? ছুটিতে বেড়াতে আসা চার পাঁজজনকে দেখেছি তারা দেশে এসে পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়, পুরোনো বন্ধুদের সাথে সারাদিন কাটায়, অবিশ্রাম খেলা করে। তাদের সে মুখ হারানো প্রাপ্তির আনন্দে দিশেহারা, উন্মাতাল। যখন চলে যায় মুখ ছেয়ে যায় অব্যক্ত ভাঙনের অন্ধকারে। বাবা-মার অকাট্য যুক্তির কাছে তাদের আবেগ, ভালোলাগা, স্মৃতি, ছোটবেলা, খেলার সাথী, মাঠ, বাগান, সিঁড়ি, দুরন্ত দুপুর, খেলাভাঙা সন্ধ্যা আর অবাধ স্বাধীনতার পিছুটান নিতান্তই মূল্যহীন পথের ধারে পতিত ধূলোর মতো পড়ে থাকে।

আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠি যখন দেখি এর মধ্যেও কিছুসংখ্যক স্বশিক্ষিত, দেশপ্রেমিক, প্রকৃত উদার ধর্মীয় মনোভাবের সংখ্যালঘু সংস্কৃতিবান মানুষ আছেন যারা বাংলাদেশকে নিজের দেশ বলে গর্ব করেন, রক্ত দিয়ে অর্জিত ভাষার জন্য যাদের বুক অহংকারে স্ফীত হয়, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যারা এ দেশটির সমান দাবীদার, যুদ্ধে সবকিছু হারিয়েও যারা এমাটির বুক আঁকড়ে আছেন, যাদের সন্তানদের সাফল্য বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে চিনতে সাহায্য করে, বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম ভারতকে হারালে আনন্দে যাদের চোখে জল আসে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কমবেশি সবদেশেই বঞ্চনার শিকার। কিন্তু আমরা সম্প্রীতির উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাই। আমরা আমাদের বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠির সন্তানদের এক বাগানে রেখে নানাজাতের ফুল ফোটাতে চাই। মিশ্র সংস্কৃতির সন্তানেরাই বিশ্বে অনন্যসাধারণ মেধার অধিকারী। আমরা আমাদের ক্ষুদ্রতাকে প্রশ্রয় দিয়ে এতোবড় সম্ভাবনাকে কেন অগ্রাহ্য করবো?