‘স্ত্রীর ভাগ্যে জন
আর স্বামীর ভাগ্যে ধন।’
অর্থাৎ সন্তান জন্মদানের বিষয়টি নারীর ভাগ্যের সাথে, সক্ষমতার সাথে, সম্পর্কিত এবং জড়িত। জনের জন্ম যে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই সক্ষমতার প্রয়োজন নিরক্ষর জনগোষ্ঠী তা জানে না। জানাতে গেলে মানে না। এ জানানো ও মানানোর দায়িত্ব কার? নাকি এ জানাজানি ও মানামানির চেয়ে নারীর মৃতুই সহজলভ্য!
আবার অনেক সময় অর্থের অভাবের দায় নারীর উপর দেওয়ার জন্য উপরোক্ত প্রবাদটিকে উল্টে বলা হয় —–
‘স্বামীর ভাগ্যে জন
আর স্ত্রীর ভাগ্যে ধন।’
অর্থাৎ সামাজিক মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে আসতেও কাটে যেতেও কাটে। নারীর শাঁখের করাতের মত অবস্থা। প্রবাদ প্রবচন যখন যেভাবে সম্ভব সেভাবে নারীকে আঘাত করে, আক্রমণ করে এবং তা নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।
সবাই জানি যে দাম্পত্য সম্পর্কে সন্তানের প্রত্যাশা মানব জীবনের এক স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। আর সামাজিক ইতিহাস বলে — ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠায় নিজের সন্তানকে উত্তারাধিকার বানানোর আকাঙ্ক্ষা থেকে বিয়ে প্রথা চালু করে নারীকে ঘরে বন্দী করার ষড়যন্ত্রের শুরু।
এ সন্তান কখনও কখনও নারীর জন্য বোঝা। সন্তান জন্ম দিয়ে বাবা হাওয়া। লাপাত্তা। মাকে সন্তানের দায়ভার বহন করতে হয়। আবার সন্তান না হলে নারীকে শুনতে হয় অপবাদ। বন্ধ্যা, বাঁজা। আটকুঁড়া। আটকুঁড়া নারীর মুখ দেখলে যাত্রা ভঙ্গ। এ আটকুঁড়া রাণীকে নিয়ে লোক গাঁথাও রয়েছে। আরও কত কি অপরাধে অপরাধী করা হয় বন্ধ্যা নারীকে। জীবনও দিতে হয় সন্তান না হওয়ার তথাকথিত অপরাধে।
যেমন ‘সন্তান না হওয়ায় স্ত্রী হত্যা’ শিরোনামে গত ২৬ অক্টোবর ২০১০ তারিখে দৈনিক মানব জমিন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সন্তান না হওয়ায় স্ত্রী তাহেরা বেগম তারাকে হত্যা করেছে পটুয়াখানী জেলার বাউফলের দক্ষিণ হোসনাবাদ গ্রামের আবদুর রহমান ওরফে রহমত। ১২ বছর তাদের বিবাহিত জীবন। কিন্তু কোন সন্তান না হওয়ায় সাত আট বছর যাবৎ মারধর চলছিল। এর মধ্যে মেয়েটি নিজে,তার মা বাবা অথবা অন্যান্য পরিবার পরিজন কেউই এর কোন সুরাহা করেনি। সর্বশেষে সন্তান না হওয়ার অপরাধে লাশ হয়েছে।
সন্তান না হওয়ায় ‘খুলনায় স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা’ শিরোনামে গত ২৫ আগষ্ট ২০১০ তারিখে দৈনিক ভোরের কাগজ এর খবর অনুযায়ী খুলনার পাইকগাছের কপিলমুনির রেজাকপুর গ্রামের সোহরাব গাজীর সঙ্গে প্রায় ১৭ বছর আগে বিয়ে হয় একই গ্রামের অরুণা বেগমের। সন্তান না হওয়ায় যৌতুকের দাবিসহ অমানুষিক নির্যাতন করত। বহুবার পারিবারিকভাবে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত স্বামী বাঁশ দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে মেরুদন্ড ভেঙে দিলে খুলনায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে অরুণা মারা যায়।
স্ত্রী দুইজন না হয় নির্যাতনের শিকার হয়েও ঘর করেছে নিজেদের অধঃস্তন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের কারণে। তালাকের মত এমন সহজ পথ থাকতে,ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বহু বিয়ের সুযোগ থাকতে কেন বাঁজা স্ত্রী নিয়ে এক স্বামী এক যুগ ও অন্যজন প্রায় দেড় যুগ ধরে ঘর করল? কেন দ্বিতীয় বিয়ে করেনি? আর এ সব না করতে পেরে অক্ষমের আক্রোশ ঢেলেছে স্ত্রীদের উপর।
তাছাড়া, সন্তান জন্মদানের যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তা আমাদের দেশের অগণিত মানুষ জানে না। তাই সন্তান না হলে ডাক্তারী পরীক্ষা ছাড়াই স্ত্রীকে অপবাদ দেওয়া ও স্বামীর একাধিক বিয়ের প্রচলন প্রচলিত। আর ডাক্তারী পরীক্ষায় যদি পুরুষটির কোন সমস্যা থাকে তবে নারীটিকে তা মেনে নেওয়ার মত সামাজিকীকরণ তো হয়েই আছে। সন্তান জন্মদানে অপারগ স্বামীকে তালাক দিয়ে সন্তানের জন্য স্রী অন্যত্র বিয়ে করার উদাহরণ আমি এখন পর্যন্ত আমার আশেপাশে পাইনি, তবে সন্তান জন্মদানে অপারগ স্রীকে তালাক দিয়ে বা রেখে একাধিক বিয়ে করার ঘটনা আমি নাম ঠিকানাসহ ডজন খানেক বলতে পারব। হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই এ নিয়ে উদাহরণ আছে।
আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধিক অর্থ খরচ করে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে সন্তান ধারণের ব্যবস্থাকে আমি বিবেচনায় নিচ্ছি না।

জৈবিক মা বাবা না হতে পারলে দত্তক নিয়েও তো মা বাবা হওয়া যায়। যদিও ধর্ম ও আইন এখানে বাঁধ সাধবে।
জৈবিক মা বাবাই যে শুধু মা বাবা নয়,তা সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বজন স্বীকৃত করতে হবে। তাই তো নারীবাদীরা maternal death কে মাতৃ-মৃত্যু না বলে বলে প্রসূতি মৃত্যু। কারণ প্রসব সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যু। আর সন্তানকে উদরে ধারণ না করেও মা হওয়া যায়। পালক বাবা হওয়া যায়। আর এ মা ও বাবা হওয়ার মত মনোভাব গড়তে হবে। তাহলে তাহেরা আর অরুণাদের মা না হতে পারার জের জীবন দিয়ে শোধ করতে হবে না।
তাছাড়া, মা হওয়া একজন নারীর যেমন আকাঙ্ক্ষা হতে পারে , তেমনি মা হতে না চাওয়াও একজন নারীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা- অনিচ্ছা এবং অধিকারও হতে পারে । তাহেরা বা অরুণার ক্ষেত্রে যদিও মা না হওয়ার কোন অনিচ্ছা ছিল না, তবে অন্য যে কোন নারী স্ব- ইচ্ছায় জৈবিক মা বা অন্যভাবেও মা হতে না চাইতেই পারে। সেক্ষেত্রেও অনেক নারী স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়। সেই নারীকে নির্যাতন করার অধিকার স্বামীকে কে দিল ?