খুরশীদ এ. চৌধুরী

কিছু রক্ষণশীল সমাজে অতীতকাল থেকেই যৌনতা সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে প্রাণিযৌনতা শুধু বংশবৃদ্ধির জন্য । বাস্তবে বায়োলজিক্যাল শ্রমবিভাজনে প্রাণিপ্রত্তঙ্গ শুধুমাত্র একটি কাজের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয় না । যেমন হাত-পা শুধু চলাফেরার জন্য নয়, আত্মরক্ষাসহ বিভিন্ন কাজের হাতিয়ার হিসেবেও এর ব্যবহার, তেমনি খাদ্য শুধু শারীরিক জ্বালানীর প্রয়োজনে নয়, মস্তিষ্কের রিফ্রেশমেণ্ট (‘তৃপ্তি’) হিসেবেও প্রয়োজন । প্রাণিপ্রত্তঙ্গ এবং প্রাণীর নেচারাল ইন্স্টিংক্ট ন্যূনতম জ্বালানী (যেমন খাদ্য, শ্বসনক্রিয়া) এবং ন্যূনতম প্রত্তঙ্গের দ্বারা সর্বোচ্চ কর্ম সম্পাদনের জন্য বিবর্তিত হয় । প্রতিটি প্রাণীই একটি একক প্রত্তঙ্গ এবং একক ইন্স্টিংক্ট দ্বারা একাধিক কর্ম এবং একাধিক শারীরবৃত্তিয় প্রয়োজন সম্পাদন করে । প্রাণীর বংশবৃদ্ধির জন্য যৌনতা আবশ্যিক নয় । প্রাকৃতিকভাবে অযৌন প্রজনন যেমন একাধিক প্রাণীতে রয়েছে তেমনি যৌন প্রজননে অভস্ত্য প্রাণীর বংশবৃদ্ধি অযৌন প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব । ‘ঘুম’-এর মতো যৌনতা স্নায়ু ও মস্তিষ্কের কর্ম, হরমোন সেক্রেশনের স্বাভাবিতার এবং এসবের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। সমকামিতা এবং স্বমেহন সহ যেকোন যৌন অভ্যাসই যৌনকর্ম ।

বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজলোতে পুরুষদের অনেক বয়স পর্যন্ত স্বমেহনে অভ্যস্ত থাকার প্রবণতা রয়েছে । এখানকার সমাজে নারী-পুরুষ যৌনতার ব্যক্তিস্বাধিনতা নেই, বিবাহপ্রথা তরুণদের নাগালের বাইরে, স্বমেহনে অভ্যস্ত একজন পুরুষ প্রায়-মধ্য বয়সে উপনীত হবার পর একজন নারীর সারাজীবনের ব্যয়বহন করার সামাজিক প্রতিশ্র“তির মাধ্যমে পৈতৃকসম্পত্তি রক্ষার্থে কিংবা ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য বংশধর জন্মদেবার মানসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে এবং নারী এই প্রথার মাধ্যমে বিকৃত পুরুষদের অধীনস্ত থাকছে, এই উদ্ভট জীবনাচরণ আমাদের বংশধরদের জিনগত বৈশিষ্ট্যে খারাপ প্রভাব ফেলতে সক্ষম । উপমহাদেশের প্রচলিত বিবাহ প্রথা নারীকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুরুষনির্ভর করে দিচ্ছে । সন্তানরা জন্ম নিচ্ছে ব্যক্তিত্ববিহীন নারীর কোঁখে ।

মানুষ বায়োলজিক্যালি সিমেট্রিক প্রাণী, নারী এবং পুরুষ ‘বিপরীত’ লিঙ্গ নয়, বরং পরষ্পরের ‘আইডেণ্টিক্যাল’ (যেমন বেশিরভাগ আর্থ্রোপোডা প্রাণীগুলো অ্যাসিমেট্রিক) । সত্যিকার পুরুষতন্ত্র কিংবা নারীতন্ত্র কখনোই সম্ভব নয় কারণ সত্যিকার ‘নেচারাল পুরুষ’ ‘সুনারী’র প্রতি আকৃষ্ট এবং শ্রদ্ধাশীল হবে, এটাই স্বাভাবিক (এমনকি সমকামী হলেও) । তথাকথিত ‘পুরুষতান্ত্রিক’ কিংবা ‘নারীতান্ত্রিক’ সমাজব্যবস্থা বাস্তবে ‘বিকৃতপুরুষতান্ত্রিক’ এবং ‘বিকৃতনারীতান্ত্রিক’ । বিকৃতপুরুষতান্ত্রিক ও বিকৃতনারীতান্ত্রিক সমাজে অল্প বয়েস থেকেই ‘নেচারাল নারীত্ব’ এবং ‘নেচারাল পৌরুষ’ উভয়কেই অবদমনের ভেতর দিয়ে গড়ে তোলা হয় । বায়োলজিক্যালি সব পুরুষ সব নারীর চেয়ে বুদ্ধিমান বা শক্তিশালী হবে তা কখনোই নয় । অথচ বিকৃতপুরুষতান্ত্রিক ধর্মগুলো বিকৃত সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে কুনারী এবং কুপুরুষ সৃষ্টি করে যাচ্ছে । অলঙ্কার ও সাজগোজ বিহীন প্রতীকী ‘পুরুষ’ এবং অতি-অলঙ্কার ও অতিসাজগোজের প্রতীকী ‘নারী’ -দের ‘ডেমো’-রা সমাজ ও রাষ্ট্র চালাচ্ছে কিংবা সে’নিয়মে চলছে আর অন্যদেরকে বাধ্য করছে এই সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়মে চলতে । অবদমন সবচেয়ে বড় অপসংস্কৃতি । এখানে ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ হচ্ছে ‘প্রতীক’-ধারী ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ । বায়োলজিক্যাল বাস্তবতার বিকৃত ব্যখ্যা এবং অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস – এ দু’টোর সমন্বয় আমাদের উপমহাদেশের সমাজকাঠামোর মূল/অন্যতম মূল ভিত্তি, আর এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর উদ্ভব হয়েছে এই সমাজের সংরক্ষক শক্তি হিসেবে ।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে ধর্মীয়/সামাজিক-দৃষ্টিভঙ্গীমূলক শাসন কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মীয় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী সংরক্ষণ কোন ক্রমেই কাম্য নয় । যে বিষয়ের মূল উত্স্য হচ্ছে অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস কিংবা বিকৃত ধারণা তা আধুনিক কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন ও বিধানের উত্স্য হতে পারে না, কারণ গণতন্ত্র স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, প্রতিটি মানুষের স্বাধিনতার অধিকার । সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপের অধিকার রাখে না । মানুষ জন্ম নেবার সময়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়, কোন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নয়, রাষ্ট্র মানুষের জন্ম দেয় না । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হচ্ছে তাই যা মানুষের নিরাপত্তা, যোগাযোগ, অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি মানুষের ব্যক্তিস্বাধিনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল । ধর্মরাষ্ট্র, মার্ক্সবাদী রাষ্ট্র, নাত্সীবাদী (সামাজিক জাতীয়তাবাদী), ফাসীবাদী রাষ্ট্রগুলো ব্যক্তিস্বাধিনতার সবচেয়ে বড় শত্র“ ।

আমাদের বংশধরদের জন্য আমরা কেমন সমাজ ও রাষ্ট্র দিয়ে যাবো? – মুক্তমনা-পাঠকদের মন্তব্য চাইছি।